বাংলা গল্প : কবি ও মুক্তা

বাংলা গল্প : কবি ও মুক্তা

লিখেছেন – নাবিলা সিদ্দিকা

 

বেদনার নীল রং..।
আব্বে রাহো তোমার কবিতা। কী কইলা? বেদনার কালারডা জানি কী? নীল? নীলতো অইবোই! ঠ্যাঙ্গের নলিতে পটাশ পটাশ দুইখান বাড়ি দিলে নীল রঙা ছোপতো পড়বোই। নতুন কিছু কও।
কবি রানা মজুমদার তাৎক্ষণিকভাবে নতুন কিছু বলতে পারে না। সে উঠতি কবি। এখনো আঙ্গুল টিপে মাত্রা গোনে। অক্ষরবৃত্তে যুগ্মধ্বণিতে সে প্রায়ই তালগোল পাকায়। মাত্রাবৃত্তকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চললেও চর্চায় তার ত্রুটি নেই।

কবিতার জন্য চাই আইডিয়া। আইডিয়ার জন্য ভেরিয়েশন। সেই জন্যই দিন দশেক হলো পুরান ঢাকার একদল উঠতি বখাটের সঙ্গে রানার ওঠাবসা শুরু। আড়াই টাকার সিগারেটে টান দিতে কবির বেজায় কষ্ট। বখাটেরা এজন্য তাকে চার টাকার সিগারেট খাওয়ায়। কবিতার জন্য না, নিতান্ত ভদ্র ছেলে বলেই তারা পছন্দ করে। চা-সিগারেটের বিলটা তাই তারাই দেয়। বিল দেয়ার সময় রানা তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। পেঁজা তুলোর সঙ্গে পাড়ার হট-আইটেম মুক্তার মিল খুঁজে বেড়ায়।

সান্ধ্যকালীন আড্ডাটা হয় চায়ের দোকানে। মাঝে মাঝে রঞ্জুর মেসে টুয়ান্টি নাইন। অবশ্য চারজন মিলেও রানাকে খেলাটা শেখাতে পারেনি। মিয়া-বিবি থাকলেই ম্যারেজ! ম্যারেজ! বলে লাফায়। রংয়ের তোয়াক্কা করে না। তবে এক আধ চুমুক বিয়ার গেলা ঠিকই শিখেছে (হয়তো ঠেকেই শিখেছে)।
বখাটে চার যুবকের সঙ্গে মিশে রানা যা বুঝেছে তা হলো, এরা মোটেই বখাটে নয়। নিজেদের মধ্যে অশ্লীল গালির তুবড়ি, সিটি বাজানো এবং নারী বিষয়ক সেমিনার করলে কেউ বখাটে হয় না। আবার এও হতে পারে, নিজের অজান্তে রানাই বখাটে হয়ে গেছে। তা না হলে মুক্তাকে সে বিশেষভাবে ভাবতো না। নিজেকে বোঝায়, ভাবনাটা শৈল্পিক। দোষের না। তাকালেও কেউ টের পায় না। এছাড়া নিজের কাছে তো লুকানোর কিছু নেই।
আজকের সন্ধায় রানার কেবলি মুক্তার কথা মনে পড়ছে। কিছুটা স্থ‚লকায়। তবে তাতে গোলগাল মুখখানা আরো কোমল দেখায়। এমন মেয়ের সঙ্গে স্লিম ফিগার শব্দযুগল মোটেও খাপ খায় না। প্রায় ধসে পড়া এক বাড়ির নিচতলায় বৃদ্ধা চাচীকে নিয়ে থাকে। তাও আপন চাচী নয়। মুক্তা দুতিনটা বাড়িতে ঝি’র কাজ করে। এখানেই রানার যতো আপত্তি। এমন ফর্সা চেহারার সঙ্গে ‘ঝি’ ক্যারেকটার পুরোপুরি বেমানান। কাস্টিংয়ে বড় ধরনের গোলমাল। তবে শরীরের সঙ্গে যা মানিয়েছে তা হচ্ছে সাহস। আড্ডা শেষে ফিরতে রানার প্রায়ই নটা বাজে। ফিরে আসার সময় সে বেশকদিন মুক্তাকে চাল-ডাল কিনতে দেখেছে। উবু হয়ে চালের প্যাকেট তোলার সময় মুক্তার কিঞ্চিৎ মেদবহুল ফর্সা পেটও দেখেছে। তবে একেবারে মার্জিনাল লেভেলের আড়চোখ যাকে বলে। রানা যে দেখেছে তা বোঝার সাধ্য নাই কারো।

আটটা বুঝি বেজেই গেল। মুক্তার দেখা নেই। অন্যদিন হলে এর মাঝে মুক্তা একবার চায়ের দোকানটায় আসতোই। পান কিনতে নয়তে খুচরো তেল। মুক্তা আসছে না। সে আসলে রানা কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বসার ভান করতো। মুক্তা মনে করতো, ‘নাহ্ ছেলেটা অন্য সবার মতো না। এ ছেলে লজ্জাও পায়।’ ভাবনা থেকে ভালোলাগা। না না ঝি বলে কথা। রানা ওসব ভাবে না। অতিশয় ক‚টিল পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে হয়তো এমনটা মনে হবে। রানা টের পায় তার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক। গলার কাছটায় চিনচিনে ব্যাথাটাও নেই। অথচ মুক্তা আসলে…। নাহ্ রানা নিজেকে এ নিয়ে অসংখ্যবার বুঝিয়েছে। সেলফ মোটিভেশন যাকে বলে। তার কবি হওয়া চাই। জটিল ঘরানার কবি। এসব তুচ্ছ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ফিজিক্সের চ্যাপ্টারে পড়ে থাকাই বাঞ্চনীয়। স্থান-কালের বাইরের জগতে এসব আকর্ষণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। তবে আজ মুক্তার চিন্তা কিছুটা অন্যভাবে, কিছুটা অন্য সূরে কবির একান্ত জগতে প্রবেশের জন্য পাখা ঝাপটাচ্ছে।

৯টা বাজতেই কবি রানা মজুমদারের মনের ভেতরকার সবকটা কুঠুরির দরজা সটাসট বন্ধ হয়ে যায়। আজ মুক্তার দেখা পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। সিগারেটে বড় একটা টান দিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকে কবি। অফিসের ফাইলের মতো দেবুর হাতে সিগারেট ট্রান্সফার করে। রঞ্জু আর বাবলার দিকে ঘোর মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকায়। টানটা একটু জোরেই দিয়েছে। বাবলা পেটে হাত বুলোয়। তার ক্ষিদে পেয়েছে। এ সময়টায় রানা কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে। আরো কিছুক্ষণ থাকলে সবার সঙ্গে হোটেলে খেতে হবে। বিল ওরাই দেবে। রানাকে কখনোই দিতে দেয় না। তবে কখনোই পুরোটা দেয় না। রানা খেলে রঞ্জু আর বাবলার কল্যানে রানার বিলটাও হাফ হয়ে যায়। রানা এখনো ওতে ধাতস্থ হতে পারেনি। বিল কম দিতে হয় জন্যে উপাদেয় কালা ভুনাকেও মনে হয় কলার তরকারি। তারচেয়ে হলের ক্যান্টিনই শ্রেয়।

রানা উঠে দাঁড়ায়। বিদায় নেয়ার কোনো ফর্মালিটি তাদের মধ্যে নেই। যে যার মতো আসে যায়। এটা রানার পছন্দ। কাউকে কিছু না বলে সেও ঘুরে উল্টো দিকে হাঁটা দেয়। মুক্তাদের বাসার সামনে দিয়েই ফেরার রাস্তা। তবে তার জন্য আবার বাড়তি কিছু গলি পেরুতে হয়। কিন্তু বিকল্প নেই। তাই মাথা উঁচু করে ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে হেঁটে আসতে পারে রানা। বখাটেদের কল্যানে এখন রাত হলেও আর ভয়ডর করে না। তবে ভালোমতো খেয়াল করলে যা ধরা পড়বে তা হচ্ছে, মুক্তাদের বাসা পার হওয়ার আগ পর্যন্ত রানার হাঁটার গতি স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম থাকে। অবশ্য পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে কম মনে হতে পারে। রানার সাপেক্ষে সে যথেষ্ট গতিশীল। এখানেও থিউরি অফ রিলেটিভিটি। এ ফাঁকে বলে রাখা ভালো যে, অবসরে রানা মজুমদার বিজ্ঞান চর্চাও করে। তবে তাত্তি¡ক বিজ্ঞানই তার প্রিয়। গণিতে দুর্বল থাকায় সূত্রের মারপ্যাঁচ অতোটা বোঝে না।

রানার মনে হয়, তার আর মুক্তার মাঝে মাধ্যাকর্ষণ ছাড়াও বিশেষ কোনো আকর্ষণ বল কাজ করছে। ব্যাখ্যা করতে পারলে যা হবে পঞ্চম শক্তি। কিছুটা মাধ্যাকর্ষণ, কিছুটা বিদ্যুৎচুম্বকীয় আর কিছুটা দুর্বল শক্তি। সব মিলিয়েই তাদের মধ্যকার এ বিশেষ শক্তির জš§। রানা পুলকিত হয়। শক্তির উপস্থিতি টের পেয়ে শিহরিত হয়। ভাবে, মুক্তার ভেতর এ আকর্ষণ কীভাবে কাজ করছে! হয়তো এখনো সুপ্তই রয়ে গেছে। নাহ্, বিজ্ঞানের সঙ্গে কীসব ছাই পাশ গুলিয়ে ফেলছে। রানা আবার নিজেকে বোঝায়। তবে কিছু কিছু সময় নিজেকে বোঝানোর এ আকুতি তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। ভাবে, কী এমন ঠেকা পড়েছে যে এসব ভাবা চলবে না। আরে! কবিতা মানেতো ধান্ধা। যার যতো পাবলিসিটি, সে ততো দুর্বোধ্য ঠেকবে। কবিরা কি এমন করে ভাবে না? ভাবে ভাবে! রানা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওপর-নিচ মাথা ঝোঁকায়। কিন্তু মনের কোণে আবার কী যেন উঁকি দেয়। সে কি ভিন্ন মাত্রার কবি হতে পারে না?
রানার হাঁটার গতি যথেষ্ট স্বাভাবিক। সোয়া নটার মধ্যেই চানখারপুল এলাকায় চলে এসেছে। ক্ষিদে চড়ে যাওয়ায় হল পর্যন্ত যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিল। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে খেয়ে নিলেই হলো।

খাওয়া শেষ হতে পৌনে দশ। চা-সিগারেটে দশটা। দোকানপাট ছাড়া আশপাশে আরো কোনো জীবন্ত ঘরবাড়ি নেই। বাতাসটা কেমন যেন ভেজা ভেজা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আনাগোনাও নেই। রানা ভাবে, এমন আবহাওয়ায় মানুষের কতো কিছুই না করতে ইচ্ছে করে। রানাও তার হিজিবিজি ইচ্ছেগুলো টের পায়। হুট করে তার মনে হয়, এখন চলে যাওয়া উচিৎ হবে না। তার গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিশেষ কিছুর জন্য। ঘোর লাগা ইচ্ছে। কবি নিজেই এখন নিজের কাছে অস্পষ্ট। তার ধারণা, কবিতার চর্চা করে বলে মনের ইচ্ছেকে একটু বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। তাই ইচ্ছের যৌক্তিকতা খোঁজার বালাই তার নেই। কিন্তু কাজ ছাড়া ঘুরঘুর করার একটা শক্ত কারণ তাকে দ্রুত খুঁজতে হবে। তা না হলে পাবলিকের ভ্রƒকুটি তার পিছু ছাড়বে না। পুলিশ দেখলেতো কথাই নাই।

রানা কিছুক্ষণ ভাবে। সিগারেট অর্ধেক এবং চা পুরোটা শেষ। পরপর দুকাপ চা খেতে কবির মুখে বাধে। সিগারেটই ভরসা। তবে একটা শেষ করলেই নিজেকে প্রশ্ন করে, চরম ফালতু একটা বস্তু কেন টাকা দিয়ে কিনে খেলাম! তাই তাৎক্ষণিকভাবে দ্বিতীয়টা কেনার প্রশ্নই আসে না। কী করবে তাহলে? শূন্য হাতে বসে থাকবে? চায়ের দোকান ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় কবি রানা মজুমদার। ইচ্ছেগুলো বড় বিচিত্র! বড় স্বাধীনতা ভোগ করে! আবার ভয়টাও যাচ্ছে না। লম্বা দম নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, কবিদের অতো ভাবতে নেই। কবি হতে চাইলে, বড় মাপের উদাসীনতা থাকা চাই। তাছাড়া, কে তাকে কী বলবে! পাড়ার রঞ্জুতো তার ইয়ার দোস্ত। পুলিশ? বড়জোর থানায় নিয়ে যাবে, তাকে কী! জেলে থাকার অভিজ্ঞতা এখনো হয়নি যেহেতু…। গলির ভেতর সাহস করে ঢুকে পড়ে রানা। ঠাণ্ডায় মাঝে মাঝে শিউরে উঠছে। এর জন্য হয়তো লো প্রেসারও দায়ী। গলির দুটো বাঁক কাটলেই মুক্তাদের বাসা। অসংখ্যবার এ রাস্তা দিয়ে হাঁটলেও কবির মনে হচ্ছে এবারই প্রথম। যতোই কাছাকাছি আসছে রানার চেহারা ততোই কঠিনতর হচ্ছে। এ মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হতে পারে, ছেলেটা খালার বাসায় যাচ্ছিল, কিন্তু পথ ভুলে গেছে। অথবা সে বেরিয়েছে রাতের পুরান ঢাকা নিয়ে সরেজমিন রিপোর্ট করতে। যাতে থাকবে মাদকের অবাধ ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু এক্সক্লুসিভ।

চেহারার সঙ্গে রানার মনটাও কিঞ্চিৎ আকু পাকু শুরু করেছে। বিচিত্র ও দুঃসাহসিক ইচ্ছেগুলোর নব্বই শতাংশই হাওয়া। বাকি দশ ভাগও নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু করেছে। কবি এখন বেশি কিছু চাচ্ছে না। মুক্তাদের বারান্দায় ঝুলতে থাকা শাড়ি পেটিকোট দেখলেই খায়েশ মিটে যাবে।
কবির মনের একাংশ এখন জটিল হিসেবে ব্যস্ত। দূরত্বের সঙ্গে ব্যাস্তানুপাতে বাড়ছে আকর্ষণ। ঠিক কতোটুকু কাছে আসলে একে অপরকে…। মনের ভেতর বিরোধী দলেরও অভাব নেই। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ, ইটস অল অ্যাবাউট ফ্ল্যাশ, জাস্ট ফ্ল্যাশ, নট মোর। মনের একাংশ আবার নিজেকে দুঃসাহসী টম সয়্যার বানিয়ে ফেলেছে। কবি ও মুক্তার মাঝে দূরত্ব বড়জোর ১৫ ফুট। কিন্তু রানার মনে হয়, এ অসীম। কেননা, সে থেমে গেছে। পা দুটো আর এগুতে চাচ্ছে না। মন সায় দিচ্ছে না। এখানেও সেই মনের ইচ্ছে। তবে এবার মনের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেবে কিনা তা নিয়েই দ্বিধায় পড়েছে কবি। নিজেকে এ মুহূর্তে মাইনকা চিপায় পড়া সফটওয়্যারের মতো মনে হচ্ছে। চোখের সামনে কেবল কন্ট্রোল অল্ট ডিলিট।
ওই! আমারে লেবেনচুস দে!

আচমকা পিঠে গুঁতো খেয়ে কঁক জাতীয় শব্দ করে লাফিয়ে উঠে কবি রানা মজুমদার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার গুঁতো, ‘ওই! তোরে না কইলাম! দে! লেবেনচুস দে!’। রানার সিস্টেম রিস্টার্ট নিচ্ছে। অপারেটিং সিস্টেম এখনো র‌্যামে পৌঁছায়নি। ধাতস্থ হওয়ার আগেই পাগলীটা তার দিকে তাকিয়ে অপার্থিব হাসি দিল। রানা সচরাচর প্রার্থনা করে না। ইদানীং সে সৃষ্টিকর্তা বিষয়ক চিন্তাও ছেড়ে দিয়েছে। কবিতাই তার ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু এখন তার বড্ড বেশি প্রার্থনার বেগ পাচ্ছে। ‘হে ঈশ্বর! হে সৃষ্টিকর্তা, এইখানে ঝটপট দুই খান কুত্তা পাঠাইয়া দাও।’ পাগল ঠেকাতে কুকুরের বিকল্প নাই। এটা এখন কবির কাছে জগতের সেরা পংক্তি। ‘লেবেনচুস দে, নইলে তোরে কামড়ামু’। রানা পিছু হঠবে নাকি ঝেড়ে দৌড় লাগাবে বুঝতে পারছে না। কবি হয়েতো ভালোই যন্ত্রণা হলো। দৌড়ালে ইগোতে লাগবে। ভাবে, একদিন যখন সে বিখ্যাত হবে তখনো পাগলীর তাড়া খেয়ে পালানোর গ্লানি তাকে বয়ে বেড়াতে হবে। একি! অর্ধনগ্ন পাগলীটা এগিয়ে আসছে কেন! রানার মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত। রিলেটিভিটি টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে। সময়টা স্লো হয়ে গেছে।

এমন সময় দেবদূতের মতো হাজির হলো স্বাস্থ্যবান এক হুলো। পাগলীর দিকে রূঢ় দৃষ্টি হেনে উদারা সপ্তকে বলল, ‘মেঁয়াও’। আহা! কী সুন্দর ডাক! কবি মন উচ্ছ¡াসিত হয়। ‘এই! যাহ! সর! সর!’। পাগলীকে মানুষ মনে হচ্ছে না রানার। আধিভৌতিক অস্তিত্ব মনে হচ্ছে। বেড়াল দেখে পাগলী থেমে গেছে। তবে ভয়ে নয়। বেড়ালটা তার সঙ্গেই থাকে। ওটাই তার নিকটাত্মীয়। পাগলীর দিকে হুলোটা তাই গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায়। রানার কাছে আপাতত আর লেবেনচুসের আবদার আসছে না। পাগলীকে ধীরে ধীরে পাশ কাটায় কবি রানা। তবে খুব সাবধান। ভয় পেয়ে পা টিপে টিপে পলায়ন চলবে না। তাতে কবিত্বের অপমান। যে করেই হোক আজ রাতেই এ ঘটনা নিয়ে একটা কবিতা লেখা চাই। তা না হলে অভিজ্ঞতাটা শিল্পের মর্যাদা পাবে না। ভয়াবহ একটা স্মৃতি হয়ে গেঁথে যাবে। একবার ভাবলো, দোকান থেকে কয়েকটা চকোলেট কিনে পাগলীকে দিয়ে আসে। কিন্তু, ইয়ে.. মানে.. কবি রানা মজুমদারের পকেটে কেবল পাঁচ টাকার একটা কয়েন অবশিষ্ঠ। এমন ঘটনার পর যদি একটা চার টাকার সিগারেটই না ধরালো তবে এক পশলা এ জীবনের আর কী রইল! ওসব মুক্তা-টুক্তার আকর্ষণ কদিনের! রানা মজুমদার নিজের ভাবনায় নিজেই পুলকিত। মনে মনে নেক্সট কবিতার নামও ঠিক করে ফেলল। ‘এইসব দিনরাত্রি’। কেমন যেন নকল ফ্লেভার আছে। কিন্তু কে নকল করে না! নিজেকে প্রবোধ দেয় কবি। শব্দের ওপর কারো একক আধিপত্য নেই। ভাবতে ভাবতে দ্রুত পা চালায়।

একসময় নিজের ডেরায় ফিরে আসে কবি। সিগারেটের পরও তার কাছে এক টাকার একটা কয়েন ছিল। ভাবে, আহারে! পাগলীটাকে একটা লেবেনচুস কিনে দেয়া যেতো। মনের অপেক্ষাকৃত দুর্বল অংশটি বোঝায়, চকলেট আর সময়, দুটোই এক, চুষতে চুষতে শেষ। কবির মন চনমন করে গেয়ে ওঠে, ‘আইডিয়া! আইডিয়া!’।

storiesstoryগল্পপ্রেমের গল্প