ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার সঙ্গে কোনো রকম যোগসূত্র নেই কিন্তু বিশ্বকাপ এলেই এ দুটি দেশের প্রতি অন্ধ সমর্থনে এই দেশের মানুষের জান কোরবান! অবাক হচ্ছেন? ব্যাপারটা কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই জান-কোরবান করার মতো কুৎসিত রূপ নিয়েছে এবং তা নজর কেড়েছে বিশ্ব মিডিয়ারও।
গত বিশ্বকাপ চলাকালীন লালমনিরহাটে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে এক হোটেলশ্রমিক মারা যান। এবার অবশ্য বিশ্বকাপ শুরু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা সহ্য হয়নি। গত সপ্তাহেই নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় চাকু-চাপাতি নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা। সংবাদ সংস্থা এএফপি অবশ্য বলেছে, লিওনেল মেসি ও নেইমারের দুই দল সমর্থক। সে যাই হোক, এই সংঘর্ষে মারাত্মক আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন এক বাবা ও ছেলে।
এখানেই শেষ নয়। বিশ্বকাপের মৌসুম এলেই পত্র-পত্রিকায় খবর বেরোয়, অমুক দলের পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অমুকের মৃত্যু। কিশোর, যুবক কিংবা বুড়ো—সমর্থক যে-ই হোক না কেন, এভাবে মৃত্যু কি কাম্য? অবশ্যই নয়। কিন্তু তাই ঘটছে। এবার যেমন রাস্তার পাশের খুঁটিতে ব্রাজিলের পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ১২ বছর বয়সী এক প্রাণ অকালে ঝরে পড়েছে।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘লাতিন আমেরিকান জায়ান্টদের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র নেই, বিশ্বকাপে তাঁদের জাতীয় দলও অনুপস্থিত—দলটা র্যাঙ্কিংয়ে ২১১টি দলের মধ্যে ১৯৪তম—কিন্তু ঠিকই বিশ্বকাপজ্বরে কাঁপছে গোটা বাংলাদেশ।’ পছন্দের দলের পতাকা টাঙানোর প্রতি এই দেশের মানুষের অলঙ্ঘনীয় মোহ নিয়েও সংবাদ সংস্থাটি লিখেছে, ‘১৬ কোটি মানুষের এই দেশের শহরগুলো ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকায় সয়লাব।’
আসলে তো শুধু শহর নয়, গ্রামেও চলছে পতাকা টানানোর উৎসব। গঠন করা হচ্ছে অমুক কিংবা তমুক দল সমর্থক গোষ্ঠী। আর চলছে মিটিংয়ের পর মিটিং—প্রিয় দলের সমর্থনে আর কী কী করা যায়, কিংবা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দল আজ ওটা করছে তো কাল আমাদের তা ছাপিয়ে যেতে হবে! এই সবই মিটিংয়ের বিষয়বস্তু। আর শহরের ব্যস্ততম রাস্তা দখল করে মোটর শোভাযাত্রা কিংবা ভোজের আয়োজনও বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। তবে বিশ্ব মিডিয়ার কাছে তা বোধ হয় নতুন বিষয়—এএফপি যেমন জানিয়েছে, মাদারগঞ্জে হাজারো মানুষ প্রিয় দলের পতাকা নিয়ে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা করেছে।
বিশ্বকাপে ভিনদেশি দেশের পতাকা ওড়ানোর বিরুদ্ধে একজন আইনজীবী তো আদালতে রিট পর্যন্ত করেছেন। আর বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশি সমর্থকদের উন্মাদনা প্রসঙ্গে এএফপি লিখেছে, ‘বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কখনো খেলার সুযোগ না পেলেও প্রতি চার বছর পরপর বিশ্বকাপ ঘিরে এ দেশের মানুষ উন্মত্ত হয়ে পড়ে।
এই উন্মত্ততার শুরু কোথায়?
আশি-নব্বইয়ের দশকে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ছিলেন পেলে। ব্রাজিলের ‘কালো মানিক’ তখন থেকেই এ দেশে পরিচিত নাম। এতে ব্রাজিলের প্রতি সমর্থনও বেড়ে যায়। আর আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় কেড়েছে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে। সেটা ডিয়েগো ম্যারাডোনার জাদুতে ভুলে। ঠিক তখন থেকেই এ দেশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু—এএফপিকে এমন তথ্যই দিয়েছেন এ দেশের একজন অভিজ্ঞ ক্রীড়া সংবাদকর্মী।
শুধু পেলে-ম্যারাডোনা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, এরপর রোনালদো-বাতিস্তুতা কিংবা রোনালদো-ওর্তেগা আর এখন চলছে মেসি-নেইমারকে নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু এদের অনেকেই জানেন না ‘ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা ঠিক কোথায় অবস্থিত’—বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নেহাল করিম। যদিও এ দেশের লেখকের প্রশ্ন, ‘একজন আর্জেন্টিনা সমর্থক যদি বাসার ছাদে পতাকা ওড়ানোর মধ্যে সুখ খুঁজে পায়, তাহলে এই সুখে বাধা দেওয়ার আপনি কে?’
না, এই সুখের আস্বাদনে হয়তো কারও তেমন আপত্তি নেই। কিন্তু সমর্থনের নামে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ কারওরই কাম্য নয়। কিন্তু বিশ্বকাপ এলে এ দেশে তা নিয়মিত ঘটে থাকে বলেই এএফপির প্রতিবেদনটা ফলাও করে ছেপেছে বিশ্বের প্রথিতযশা কিছু সংবাদমাধ্যম। তাতে বাংলাদেশের সম্মান কমল না বাড়ল?
সূত্র : প্রথম আলো