ছাত্রলীগের বিচার না পেয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২ শিক্ষকের একযোগে পদত্যাগ

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২ জন শিক্ষক গতকাল সোমবার দুপুরের দিকে তাঁদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে একযোগে পদত্যাগ করেন। ছাত্রলীগ নেতাদের অসৌজন্যমূলক আচরণের বিচার চেয়ে না পেয়ে শিক্ষকরা এমন সিদ্ধান্ত নেন।

সেমিস্টার পরীক্ষায় অকৃতকার্য এক ছাত্রীকে ছাত্রলীগের নেতারা জোর করে পরবর্তী পরীক্ষায় বসানোর চেষ্টা করেন। গত রবিবার ওই ছাত্রীকে কেন্দ্রে বসানোর চেষ্টার সময় দায়িত্বরত শিক্ষকরা বাধা দেন। এ নিয়ে ছাত্রলীগের নেতারা শিক্ষকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এর প্রতিবাদ জানিয়ে শিক্ষকরা ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অনুরোধ করেন। কিন্তু উপাচার্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিশ্বদ্যািলয়ের শিক্ষক সমিতির ৫২ জন শিক্ষক গতকাল সোমবার দুপুরের দিকে তাঁদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে পদত্যাগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. তৌহিদুল ইসলামের কাছে তাঁরা পদত্যাগপত্র জমা দেন। তবে রেজিস্ট্রার ৪৯ জনের পদত্যাগপত্র পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষার ফল গত শনিবার ঘোষণা করা হয়। এ পরীক্ষায় ওই বিভাগের ছাত্রী ঈশিতা বিশ্বাস অকৃতকার্য হন। ফলে রবিবার সকালের দিকে ওই বিভাগের কোয়ান্টাম মেকানিকস-১ পরীক্ষায় তাঁকে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এ খবর পেয়ে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সজীব তালুকদারের নেতৃত্বে দলের নেতারা ঈশিতাকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য জোর করে পরীক্ষা কেন্দ্রে বসান। কেন্দ্রে দায়িত্বরত শিক্ষকরা এতে বাধা দিলে সজীব তালুকদারসহ তাঁর সহযোগীরা শিক্ষকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও গালাগাল করেন। পরীক্ষা শেষে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্স পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ করে। প্রশাসনিক ভবনের সামনে তারা বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করে।

গতকাল রাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার করেছে বলে জানা গেছে।

শিক্ষকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করায় রবিবার বিকেলের দিকে জরুরি সভা করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। ছাত্রলীগের সভাপতি সজীব তালুকদার, সহসভাপতি ইমরান মিয়া ও আদ্রিতা পান্না এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাবির ইকবালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমিতির ১৫ জন শিক্ষক স্বাক্ষরিত একটি আবেদন উপাচার্যের কাছে দেওয়া হয়। সন্ধ্যার দিকে উপাচার্যের কক্ষে ছাত্রলীগ ও শিক্ষকদের নিয়ে একটি সভা হয়। সভার একপর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতারা বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের বের করে বিক্ষোভ শুরু করেন। গভীর রাত পর্যন্ত এ বিক্ষোভ চলে।

অন্যদিকে বিক্ষোভ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জননী জাহানারা ইমাম হলের ছাত্রলীগের নেত্রীরা হলে ফিরে গেলে সেখানে সাধারণ ছাত্রীদের সঙ্গে তাঁদের হাতাহাতি হয়। ছাত্রলীগের নেত্রীরা বিষয়টি ছাত্রলীগ সভাপতি সজীব তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমানকে জানান। তাঁরা ছাত্রী হলের ভেতরে ঢুকে সাধারণ ছাত্রীদের গালাগাল করেন। এতে ছাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে সজীব ও সাইদুরকে ধাওয়া দিলে তাঁরা হল থেকে বেরিয়ে যান। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সজীব তালুকদার জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে ফেল করলে তাকে এক বছর বসে থাকতে হয়। সেই অর্ডিন্যান্সের শিকার হয়ে এক ছাত্রী ফেল করে। এই অর্ডিন্যান্স পরিবর্তনের আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। এ বিষয় নিয়ে ওই ছাত্রীর বন্ধুদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। তারা স্যারদের কাছে ওই ছাত্রীর পরীক্ষা নেওয়ার অনুরোধ করে। সজীব তালুকদার বলেন, ‘এ খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের শান্ত করে চলে আসি। আর ঈশিতার পরীক্ষা দেওয়ার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না। পরে সেখানে গিয়ে স্যারদের সঙ্গে কথা বলি। স্যাররা সংগঠনকে নিয়ে বাজে কথা বলেন। একপর্যায়ে তাঁদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। পরে আমরা চলে আসি।’

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মুহাম্মদ শাহীন উদ্দিন জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী কোনো শিক্ষার্থী সেমিস্টার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তাকে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়। অকৃতকার্য এক ছাত্রীর পরীক্ষা দেওয়াকে কেন্দ্র করে সংগঠনের নেতারা শিক্ষকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক, অসদাচরণ করেন। তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপাচার্যকে অনুরোধ করা হয়। সব প্রক্রিয়া মেনেই এ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়। উপাচার্য সে ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড সদস্য, ডিন, প্রভোস্ট, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, হাউস টিউটরসহ বিভিন্ন পদ থেকে ৫২ জন শিক্ষক পদত্যাগ করেন। সমিতির সভা করে এমন সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষকরা। গতকাল সোমবার দুপুরের দিকে পদত্যাগপত্রগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দেওয়া হয়। ড. মুহাম্মদ শাহীন উদ্দিন বলেন, ছেলেরা এর আগেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছে। তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে পরবর্তী সময়ে সমিতির পক্ষ থেকে আরো কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ড. মুহাম্মদ শাহীন উদ্দিন জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ছুটিতে থাকাসহ ১৯৯ জন শিক্ষক রয়েছেন। বর্তমানে ক্যাম্পাসে আছেন প্রায় ১৪৫ জন। তাঁদের মধ্যে ৫২ জন পদত্যাগপত্র জমা দেন।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মোহা. তৌহিদুল ইসলাম জানান, ৪৫ জন শিক্ষক পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। দুপুরের পর আরো চারজন পদত্যাগপত্র জমা দেন।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলাউদ্দিনের সঙ্গে সন্ধ্যা ৬টার দিকে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘রিজেন্ট বোর্ডের সভা চলছে। সভা শেষে কথা বলা যাবে।’