আধুনিক মালয়েশিয়া গড়ার পেছনে বাংলাদেশিদের অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে। এটা আর কোনো দেশ দাবি করতে পারবে না। বাংলাদেশিদের এই অবদান দেশটির সরকার ও সাধারণ মানুষও স্বীকার করেন। বাংলাদেশের নাগরিকরা কঠোর পরিশ্রম, সততা আর দক্ষতায় মালয়েশীয়দের ভালোবাসা ও আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এসব কারণে বিয়ে করার জন্য মালয়েশীয় নারীদের পছন্দের তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশি যুবকরাও।
বাংলাদেশি নাগরিকদের মালয়েশীয় স্ত্রীরা মিলে সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তাঁদের কার্যক্রমও আছে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের পাশাপাশি একে অন্যের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ান তাঁরা। একই সঙ্গে তাঁরা মালয়েশিয়ার সমাজে বাংলাদেশিদের সততা, কর্মদক্ষতার কথাও তুলে ধরেন।
এমন একটি সংগঠন ‘কেলাব স্ত্রী’ বা কেআইবি। সংক্ষেপে বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘মিষ্টি বউ’। সংগঠনটি ২০১৪ সালে গঠন করা হয়। গত ৬ নভেম্বর এই সংগঠনের উদ্যোগে কুয়ালালামপুরে আয়োজন করা হয়েছিল এক প্রীতি সম্মিলনীর। সেখানেই আয়োজকরা তাঁদের সংগঠনের উদ্দেশ্য ও বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁদের অভিব্যক্তি তুলে ধরেন।
বাংলাদেশি নাগরিকের মালয়েশীয় স্ত্রী সাশা সৌন সংগঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের মালয়েশীয়দের মধ্যেও কেউ কেউ বাংলাদেশিদের ছোট করে দেখেন। তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশ একটা গরিব দেশ। তারা শুধু মালয়েশিয়ায় কাজ করতে আসে, তারা শ্রমিক। আর বাংলাদেশিদের মধ্যেও মালয়েশীয় নারীদের নিয়ে একটা খারাপ ধারণা আছে। আমরা বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গিয়ে দেখেছি, সেখানকার মানুষের ধারণা, মালয়েশিয়া খারাপ দেশ। মালয়েশীয় মেয়েরা শুধু বাংলাদেশি ছেলেদের আটকে রাখে।’
‘এই ভ্রান্ত ধারণা পাল্টে দিতেই আমরা বেশ কয়েকজন মালয়েশীয় নারী, যাঁরা বাংলাদেশি নাগরিকদের বিয়ে করেছি, তাঁরা সংগঠন গঠন করি। আমাদের সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য হলো, মালয়েশিয়াবাসীর কাছে আমাদের স্বামীদের ভালোভাবে উপস্থাপন করা’, যোগ করেন সাশা শৌন। তাঁর মতে, বাংলাদেশিরা অনেক ভালো। তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করতে ভালোবাসেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছে সততা ও ভালোবাসা। মালয়েশিয়া মুসলিমপ্রধান দেশ। বাংলাদেশের মানুষও মুসলিম। বাংলাদেশিদের মধ্যে ধর্মের প্রতি রয়েছে অগাধ বিশ্বাস আর তাঁরা অতিথিপরায়ণ।
বাংলাদেশি নাগরিকদের বিয়ে করেছেন মালয়েশিয়ার সুসি ও লিজা। তাঁরাও শুরু থেকে যুক্ত ছিলেন ‘মিষ্টি বউ’ সংগঠনের সঙ্গে। তাঁরা নিজেদের দাম্পত্য জীবনে সুখী মনে করেন। তাঁদের মতে, বাংলাদেশিরা স্ত্রীদের অনেক মর্যাদা দেন। কর্মস্থলে থাকলেও তাঁরা স্ত্রীদের যথেষ্ট খোঁজখবর রাখেন।’
সুসি, লিজা, শাশা মনে করেন, বাংলাদেশিরা এখানে শুধু কাজ করেন না, তাঁরা কাজ করানও। তাঁদের প্রতিষ্ঠানে অনেক মালয়েশীয় নারী-পুরুষ স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করেন।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় ব্যাপক বন্যা হয়। দুর্গতদের পাশে অন্য কোনো দেশ না দাঁড়ালেও বাংলাদেশ দাঁড়িয়েছে। এটাও বাংলাদেশি নাগরিকদের মালয়েশীয় স্ত্রীদের গর্বের আরেকটি কারণ। বিষয়টি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব তুন রাজ্জাকেরও নজরে আসে। যদিও এটা আবার বাংলাদেশিদের প্রতি মালয়েশিয়ায় বসবাসরত অন্য জাতির মানুষের জন্য ঈর্ষার একটি কারণ বলে মনে করেন ‘মিষ্টি বউ’ সংগঠনের উদ্যোক্তারা।
মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহিদ হামিদির কাছে বাংলাদেশিরা প্রাধান্য পান। এর একটি প্রমাণ হলো, গত ৪ নভেম্বর মালয়েশিয়ার সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদি বলেন, ‘এটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়, বাংলাদেশি শ্রমিকরা অন্যদের তুলনায় বেশি সৎ। আমরা দেখেছি, তারা যদি ব্যবসার ক্যাশে বসেন অথবা পেট্রল স্টেশনের কাউন্টারে বসেন, তাঁরা অনেক বেশি বিশ্বস্ততার পরিচয় দেন।
জাহিদ হামিদির এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সুশি, শাশা ও লিজা।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশি এক শ্রমিককে গাড়ি ময়লা করার অভিযোগে নির্যাতন করেন এক গাড়ির মালিক। গত ১৭ অক্টোবর দুপুর ২টার দিকে কুয়ালালামপুরের সুংগাই বুলুহ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশি শ্রমিককে নির্যাতনের ঘটনার আংশিক দৃশ্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান মালয়েশিয়ার মানুষও। তাঁরা এর প্রতিবাদ করেন। দোকানের গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা বাংলাদেশি নির্যাতনের এ ভিডিওটি শনিবার রাত পর্যন্ত প্রায় ৪৯ হাজারবার শেয়ার হয়েছে এবং এক মিলিয়নেরও বেশিবার দেখা হয়েছে। মন্তব্য করা হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার। বাংলাদেশি শ্রমিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার বাংলাদেশি নাগরিকদের মালয়েশীয় স্ত্রীরা। তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও একটি গ্রুপ পেজ চালান। সেখানে বাংলাদেশের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বাংলাদেশের পোশাক, খাবার, বাংলাদেশি খবরা-খবর এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পোস্ট করা হয়।
কেআইবি সংগঠনে এখন প্রায় ২০০ বাংলাদেশি নাগরিকের মালয়েশীয় স্ত্রী যুক্ত রয়েছেন। তাঁদের উদ্যোগে আগামী ৫ ডিসেম্বর কুয়ালালামপুর আম্পাং হলরুমে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলামকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।