মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প -ফেরা: তন্ময় আলমগীর

মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প -ফেরা: তন্ময় আলমগীর

চারদিকে হই-চই পড়ে গেছে- বিজয় অতি সন্নিকটে

চারদিকে হই-চই পড়ে গেছে- বিজয় অতি সন্নিকটে। জসিমরা বিভিন্ন এলাকা থেকে এমন গুঞ্জনই শুনছে কিছুদিন যাবত। রেডিওতেও  একই খবর- পাক-বাহিনী পিছু হাটতে শুরু করেছে। শহর-বন্দর ছাড়া বাকি সব ক্যাম্প সরিয়ে নিয়েছে পাক-বাহিনী। ক্রমাগত ফায়ার, বোমার শব্দ না শোনা যাওয়ায় স্বস্থি ফিরেছে সাধারন মানুষের মনে। জসিম যুদ্ধ করছে দু’নম্বর সেক্টর থেকে।

অগণিত সফল অভিযানের নায়ক জসিম। কমান্ডার বলেছে- এ সপ্তাহে আর কোন অভিযান চালানোর আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যেতে পারে। কথাটা শুনে মনের অস্থিরতা খানিকটা প্রশমিত হল জসিমের। বন্ধু সোহেল তো আনন্দে লাফালাফি করতে লাগল। কতদিন পর বাড়ি ফিরবে স্বাধীন দেশের স্বাধীন পতাকা হাতে নিয়ে, এরচে মধুর দৃশ্য পৃথিবীতে আছে কী? সত্যিই দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। দলে দলে বিজয়োল্লাস করে বাড়ি ফিরছে মুক্তিযোদ্ধারা। এ তো এমনি এমনি পেয়ে যাওয়া নয়, লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশ। নিজের দেশ, স্বাধীন দেশ, মুক্ত বাতাস, মুক্ত আকাশ। আহা!- প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে সবাই। কী যে শান্তি, কী যে সুখ তা কেবল নয় মাস যুদ্ধ করা মানুষেরাই অনুভব করতে পারে।

 

অল্প যা জিনিসপত্র ছিল তাই-ই এক সাথে করে বন্ধু সোহেল জসিমকে তাড়া দিল- কীরে, জলদি কর। জসিম নির্বিকার। সোহেল ধাক্কা দিল- শুনছিস? কোন উত্তর নেই। মাটির বিছানায় উপরের দিকে তাকিয়ে যেভাবে শুয়েছিল, সোহেলের পীড়াপীড়িতেও কোন পরিবর্তন হল না। সোহেল কিছুটা ভরকে ওঠে মুখের কাছে গিয়ে দেখল- জসিম কাঁদছে। দু’চোখ বেয়ে ঝরঝর  করে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।

 

শেষ রাতের অন্ধকারের মধ্যেই দুজন বেড়িয়ে পড়ল বাড়ির উদ্দেশে। রাস্তায় অনেককেই দেখছে বাড়ি ফিরছে আনন্দ-মিছিল করতে করতে। সোহেলও জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছে কয়েকবার। কিন্তু জসিমের চুপসে থাকা ভঙ্গির কারণে  থেমে গেছে। সোহেল ভাবছে- তুখোর আক্রমণাত্বক যোদ্ধা জসিম যুদ্ধজয়ের পর এমন মিইয়ে গেল কেন?

 

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিল জসিম। ততক্ষণে কুয়াশা ভেদ করে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এলোমেলো সবুজ আলখেত পেরিয়ে যেতে যেতে জসিম বলল- যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পরই যদিও আমি এলাকাতে রাজাকার হিসেবে পরিচিতি পেলাম। আমিসহ আরো তিনজনের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল পাক-বাহিনীর ক্যাম্পে। তাদের সাথে খুব খাতির ছিল আমাদের। আমরা মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্স হিসেবে কাজ করতাম। পাক-বাহিনীর বিভিন্ন অপারেশনের তথ্য সরবরাহ করতাম মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। আর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে দিতাম ভুল তথ্য।

 

একদিন তা ফাঁস হয়ে যায়। পাক-বাহিনী আমাদের উপর ফুঁসে ওঠে। সহকারি তিনজনকে আটক করে তারা। আমার খোঁজে আমার বাড়িতে এসে দেখে আমি উঠোনে বসে ভাত খাচ্ছি। সদ্য বিবাহিত বউ আমার পাতে তরকারি বেড়ে দিচ্ছে। সেখান থেকে আমাকে জিপে উঠিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলল তারা। বউ আর্তনাদ করে ওঠল।

 

আমার খুব সুন্দরী আদরের বউটার উপর লোভ পড়ল ঐ পশুদের। তিনজন পশু এসেছিল। ঘরে নিয়ে গিয়ে পালাক্রমে অমানবিক নির্যাতন চালাল আমার বউয়ের শরীরে। আমি চিৎকার করতে থাকলাম। কাজ শেষে ওরা এসে গাড়িটা স্টার্ট দিতে যাবে- অমনি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেহটা নিয়ে বউ আমার সামনে এসে দাঁড়াল। সবার মত বউও ভাবত আমি পাক-বাহিনীর দূসর। অথচ তারাই সর্বনাশ করে দিল আমার! বউ রাগে-ক্ষোভে একদলা থুথু ছিটিয়ে দিল আমার মুখের উপর। আমি অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকলাম। পরক্ষণই বউ দৌড়ে ঘরের ভিতরে গেল। হাতে করে নিয়ে আসল বটি দাউ। ভয়ে আঁতকে ওঠলাম আমি। দেখতে দেখতে এক কুপে আলগা করে দিল নিজের গলা।

কথা শেষে টলতে থাকা জসিমকে জড়িয়ে ধরল সোহেল। জসিমও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোহেলের উপর ঢলে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলল- কই যাব, এখন কার কাছে যাব আমি বল?

 

 

গল্প