Cover Story Op-ed মেয়েদের নিয়ে ভারতের সেনাপ্রধানের কথার জবাবে তসলিমা যা বললেন By abc on Dec 23, 2018 তসলিমা নাসরিনপ্রতিদিন ঘরে বাইরে যুদ্ধ করতে হয় মেয়েদের । যুদ্ধ না করে মেয়েরা বেঁচেই থাকতে পারে না। পরিবেশ যখন নারীবিরোধী, নিয়ন্ত্রক যখন প্রুুষতন্ত্র, তখন জন্ম থেকেই মেয়েরা যুদ্ধক্ষেত্রে। পুরুষ যতটা যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে, তার চেয়ে দ্বিগুণ যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয় নারীদের। অথচ সবাইকে বিস্মিত করে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত বলে দিলেন, ‘এ দেশে যুদ্ধক্ষেত্রটা এখনো মেয়েদের জন্য নয়। যুদ্ধে নামার ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকে শুরু করে নানা অসুবিধা রয়েছে মহিলাদের। শুধু তাই নয়, রণক্ষেত্রে মহিলাদের কম্যান্ডিং অফিসার হিসেবে মেনে নেওয়ার ব্যাপারে জওয়ানরাও ততটা প্রস্তুত নয়।’জেনারেল বলতে চাইছেন, যুদ্ধক্ষেত্রটা শুধু পুরুষের জন্য, মেয়েদের জন্য নয়, মাতৃত্বকালীন ছুটি দরকার হয় মেয়েদের, সে কারণে রণক্ষেত্রে তাদের কম্যান্ডিং অফিসার না হওয়াটাই ঠিক। অসুখে বিসুখে মানুষের ছুটির দরকার হয়, এতে কোনও অসুবিধে নেই কারোর। কিন্তু মাতৃত্বকালীন ছুটির দরকার হয় এই ছুতোয় মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ চাকরিতে না নেওয়ার চল নতুন নয়। মাতৃত্বকালীন ছুটি লম্বা ছুটি, এসময় যার ইউনিট সে ছুটিতে গেলে, অন্য একজনকে তার জায়গায় ইউনিট সামলানোর জন্য দেওয়া হবে। এই ব্যবস্থা সেনাবাহিনীতে করে নেওয়া এমন কোনও কঠিন নয়। যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, সেই সমস্যার সমাধান করা অসম্ভব নয়। তা ছাড়া মেয়েরা আজকাল প্রতি বছর সন্তান জন্ম দেয় না। একটি, বড়জোর দুটি সন্তান জন্ম দেয়। পৃথিবীর সব দেশেই মেয়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়ার নিয়ম। অনেক দেশে শুধু মাকে নয়, মা-বাবা উভয়কেই ছুটি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। সভ্য দেশে, বিশেষ করে উত্তর ইউরোপের দেশগুলোয় পুরুষেরা পিতৃত্বকালীন ছুটি পায়, নারীরা ছ’মাস পেলে পুরুষেরাও ছ’মাস পায়। দেখা গেছে কম-শিক্ষিত মা-বাবা সেই ছুটি কাটায় একই সময়ে। কিন্তু শিক্ষিতরা সেই ছুটি কাটায় একজনের পর আরেকজন। সন্তানের মা মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর বাবা পিতৃত্বকালীন ছুটি কাটাতে যায়। কম-শিক্ষিতরা বিশ্বাস করে সন্তানের মূল দায়িত্বটা মায়ের, তাই বাবারা একই সময় ছুটি নেয় যেন মায়েদের সন্তান-পালনে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু শিক্ষিতরা সন্তানের প্রতি মা এবং বাবার দায়িত্বকে সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্বাস করে। সন্তানের মূল দায়িত্ব শুধু মায়ের নয়, বিশ্বাস করে, সন্তানের মূল দায়িত্ব বাবারও। সে কারণে বাবার দায়িত্ব ‘সন্তান-পালনে মাকে সাহায্য করা’ নয়, বাবার দায়িত্ব ‘সন্তান পালন করা’। গবেষণায় দেখা গেছে, সেই সন্তান সুষ্ঠুভাবে এবং সুস্থভাবে গড়ে ওঠে যে সন্তান বাবা এবং মা উভয়ের একইরকম ‘মনোযোগ’ পায়, একইরকম ‘যতœ’ পায়, এবং লালন পালনের ‘সময়’ও একই পরিমাণ পায়। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যে দেশে মা-বাবা উভয়ে সন্তান লালন পালন করে, সে দেশে শিশু-মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম। সভ্য দেশগুলো বিশ্বাস করে সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পিতা-মাতা উভয়ের সমান। তাই মাতৃত্বকালীন ছুটি যেমন জরুরি, পিতৃত্বকালীন ছুটিও একইরকম জরুরি। প্রশ্ন হলো, পিতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করে বলে কি পুরুষেরা রণক্ষেত্রে কম্যান্ডিং অফিসার হওয়ার যোগ্যতা হারায়? হারায় না। একই রকম মেয়েরাও মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করে বলে রণক্ষেত্রে কম্যান্ডিং অফিসার হওয়ার যোগ্যতা হারায় না। কেউ একজন ছুটিতে গেলে অন্য একজন তার জায়গায় কাজ করে। সেনাবাহিনীর সব মেয়েই তো একই সময়ে গর্ভবতী হয় না। এখানে আসলে সমস্যা ছুটি নিয়ে নয়, সমস্যা স্ত্রীলিঙ্গে। স্ত্রীলিঙ্গধারী মানুষকে মানুষ মানুষ বলে মনে করে না, যেন ওদের কাজই হলো ঘরে বসে সন্তান উৎপাদন করা, আর সন্তান পালন করা।জেনারেল রাওয়াত আরও বলেছেন, ‘যুদ্ধে গিয়ে যদি কোনও মহিলা-অফিসার মারা যান আর তাঁর যদি সন্তান থাকে, তা হলে ভাবুন তো সেই সংসারটার কী দশা হবে! সেটা তো ভেসে যাবে। তা ছাড়াও, যুদ্ধক্ষেত্রে মহিলা-অফিসারদের জামাকাপড় বদলানোর সময় যদি কোনও জওয়ান উঁকিঝুঁঁকি মারে, তা হলে তো আরও বিপদ! তখন কর্তৃপক্ষের কাছে মহিলা-অফিসারদের বারবার নালিশ ঠুকতে হবে। দায়িত্বের প্রয়োজনে কোনও কম্যান্ডিং অফিসারকে মাতৃত্বের ছুটি না দেওয়া হলে হইচই হবে।’যুদ্ধে গিয়ে মহিলা-অফিসার মারা গেলে সংসার ভেসে যাবে! যুদ্ধে গিয়ে পুরুষ-অফিসার মারা গেলেও তো একই রকম সংসার ভেসে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে, সে কারণে কি পুরুষ-অফিসারদের যুদ্ধে পাঠানো হয় না? যুদ্ধক্ষেত্রে মহিলা-অফিসার জামাকাপড় বদলানোর সময় জওয়ানরা উঁকিঝুঁকি মারতে পারে, সে কারণে মহিলা-অফিসারদের যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া বন্ধ করার আমি কোনও যুক্তি দেখি না। কর্তৃপক্ষের কাছে নারী-পুরুষ উভয় অফিসাররাই নানা কারণে নালিশ ঠোকে। নালিশ ঠোকার একশ’ একটা কারণ নিয়ে অসুবিধে নেই, জওয়ান কেন উঁকিঝুঁঁকি মারে, এই নালিশ নিয়েই যত অসুবিধে! এই নালিশ ঠুকে অসভ্য জওয়ানদের যদি সভ্য বানানো যায়, তবে এ নিশ্চয়ই খুব উপকারী নালিশ। পুরুষ-অফিসাররা জামাকাপড় বদলানোর সময়ও জওয়ানরা উঁকিঝুঁকি মারতে পারে। উঁকিঝুঁকি মারলে শুধু নারী-অফিসার কেন, পুরুষ-অফিসারও অস্বস্তি বোধ করতে পারেন। আবার এরকমও হতে পারে, জওয়ানরা উঁকিঝুঁকি মারলে নারী-অফিসাররা কোনও রকম অস্বস্তি বোধ করছেন না। আসলে অস্বস্তি বোধ করাটা ঢালাওভাবে লিঙ্গভিত্তিক নয়। বরং ব্যক্তিভিত্তিক। আর উঁকিঝুঁকি মারার চরিত্রও সব জওয়ানের নয়, এ চরিত্র কারও কারোর। যারা অপরাধ করে, তাদের বিরুদ্ধে তো কোর্ট মার্শালের ব্যবস্থা থাকার কথা। ব্যবস্থায় কোনও গণ্ডগোল হচ্ছে না তো? সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘‘সেনাবাহিনীর জওয়ানদের বেশির ভাগই আসেন গ্রাম থেকে। দূরদূরান্তের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। রণক্ষেত্রে কোনও মহিলা-অফিসার সামনে থাকলে, জওয়ানরা কি তাঁর কম্যান্ড মেনে নিতে চাইবেন? মহিলা-অফিসারদের কম্যান্ড মেনে যুদ্ধে লড়বেন? চেয়েছিলাম, মহিলাদের যুদ্ধে পাঠাতে। কিন্তু এই সব সাতসতেরো ভাবতেই হয়েছে আমাদের।’’জেনারেল বিপিন রাওয়াতের কথা শুনে মনে হয় যুদ্ধক্ষেত্রে মেয়েদের পাঠানোর ব্যাপারে সেনাবাহিনী এখনও প্রস্তুত নয় পুরোপুরি। মেয়েরা সেনাবাহিনীতে ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার হিসেবে থাকলে আপত্তি নেই, কিন্তু অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে নামার এখনও, তিনি বলছেন, সময় আসেনি। সময়কে তো আনতে হয়। সময় তো আকাশ থেকে পড়ে না। মেয়েরা কি বলেছে তারা কম্যান্ডিং অফিসার হতে চায় না? মেয়েরা বলেনি। জেনারেল বলছেন, গ্রাম থেকে আসা জওয়ানরা মেয়েদের কম্যান্ডকে গুরুত্ব দেয় না। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের কম্যান্ডিং অফিসার হওয়া থেকে বিরত না করে বরং জওয়ানদের শিক্ষিত করাটা জরুরি। জওয়ানদের এই শিক্ষা দিতে হবে যে কম্যান্ডিং অফিসার, সে পুরুষ হোক কি নারী হোক, তাঁর কম্যান্ড মানতে হবে। সেনাবাহিনীতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কম্যান্ড মানতে না চাইলে কোর্ট মার্শাল করা হয়। মহিলা কর্মকর্তার কম্যান্ড না মানলেও তো তাই হওয়া উচিত। যদি তা না হয়, তাহলে নিশ্চিতই সেনাবাহিনীতে আইন প্রয়োগে কোনও সমস্যা হচ্ছে, প্রশাসনিক দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছে। অপরাধী জওয়ানদের যদি শাস্তি না হয়, তাহলে তা জওয়ানদের দোষ নয়, দোষ সেই নারীবিরোধী প্রভাবশালী কর্তৃপক্ষের, যারা জওয়ানদের ওপর দোষ চাপিয়ে আসলে নিজেদের বদ-উদ্দেশ্যই হাসিল করতে চায়। নারীকে তারা গৃহবধূ হিসেবে দেখতে চায়, যোদ্ধা হিসেবে নয়। দেখতে চায় নারীর কোলে সন্তানসন্ততি আর হাতে কড়াই খন্তি। নারীকে তারা সমস্ত কাজে পুরুষের সমান পারদর্শী হিসেবে দেখতে চায় না। নারীকে দেখতে চায় কোমল, দুর্বল, পরনির্ভর, ভীতু প্রাণী হিসেবে। কিন্তু পুরুষের মতোই তার বল, মনোবল, তার দৃঢ়তা প্রখরতা এই সত্য পুরুষের সহ্য হয় না। জওয়ানরা গ্রাম থেকে এসেছে বলে ভালো শিক্ষা পেলেও বদলাবে না, এ তো কোনও যুক্তির কথা নয়। গ্রামের ছেলে বলে ওদের এমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয়। ক’টা শহুরে ছেলেই বা মেয়েদের কম্যান্ড মানতে চায়? মানতে চায় না বলে কি আমরা সর্বক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করবো? মোটেও না। বঞ্চিত করলে নারীবিদ্বেষীদের জয় হবে, এবং মেয়েদের বিভিন্ন জায়গা থেকে হটিয়ে দেওয়ার কাজটা যে সহজ কাজ সেটাই প্রমাণিত হবে। এসব না করে বরং নারীবিদ্বেষী লোকদের মনে নারীর প্রতি যে প্রচণ্ড ঘৃণা আর বিদ্বেষ আছে সেটা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। এতেই বৈষম্যের সমাজকে সমতার সমাজ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।কোনও এক সময় মেয়েদের লেখাপড়া করতে দিতেও আমাদের সমাজ চায়নি, ঘরের বাইরে চাকরি বাকরি করবে, তাতেও আপত্তি ছিল। যখন ধীরে ধীরে বিরোধীদের অমান্য করে মেয়েরা এগিয়ে গেল, তখনও মেয়েদের এই চাকরি করা চলবে, ওই চাকরি করা চলবে না বলে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। নারীবিরোধীদের মতকে মূল্য দিলে মেয়েরা এখনও ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতো না, শিক্ষিকা আর সেবিকা হিসেবেই রয়ে যেত হতো। সেইজন্যই বলি, নারীবিরোধীদের আদেশ উপদেশ মেনে চললে সমাজ ধ্বংস হবে। এদের যত পরাজিত করা যায়, ততই মঙ্গল। Post Views: 1,553 Related posts: ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের কলাম : নির্বাচনের আগে-পরে ক্রাইম পেট্রোল -এর প্রভাবে হত্যাকাণ্ডের ধরন বদলে গেছে কাকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে মাঠে নেমেছেন, ড. কামাল ? রিয়াজুল হকের কলাম : পিতাদের নিঃসঙ্গতা এবং আর্থিক সংকট পয়লা বৈশাখের উৎসব দুই বাংলায় একই দিনে হোক : তসলিমা নাসরিন মানুষ কি আবার বানর হওয়ার পথে? মানুষ জাতটা জাত হিসেবে ভালো বলে আমার মনে হয় না : তসলিমা নাসরিন ৫৫টি জামা, ২২ জোড়া জুতা নিয়ে বিশ্বকাপ যাত্রা : পিয়া ফেসবুক থেকে : রিকশা উচ্ছেদ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ফেসবুক থেকে : লাস্ট কবে গরুর মাংস খাইছেন? তসলিমা নাসরিনের কলাম : জানাজার নামাজে মেয়েরা কেন যায় না? নবনীতা চৌধুরীর কলাম : ‘আমরা নাটক করতেসি, আমাদের আরও পেটানো যাবে’ Which Business will not be affected by Covid-19 ? করোনা দিনের কড়চা-২ covid-19 business practice : which businesses should you do after lockdown People Will Follow This Lifestyle after Covid-19 Trump’s biggest ‘rival’ is now the economy Lee hsien Loong কে নিয়ে সিঙ্গাপুর প্রবাসী শেখ রাব্বানীর স্ট্যাটাস করোনা দুর্যোগে টাকা বাঁচাবেন কিভাবে Indians are now looking at Bangladesh differently