১২
চোখের পলকে ছয় মাস কেটে গেল। ছিমছাম ধুলাউড়ি গ্রামটা আমার বেশ পছন্দ। মানুষগুলো জলের মতো। কেউ স্বচ্ছ, কেউ ঘোলাটে। তবে জলের মতোইএ যার সঙ্গে কথা বলবে, তার সঙ্গে মিশে যায়।
আমি আর রেনু সত্যিকার অর্থে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলাম বিন্তিদের বাড়িতে। বিন্তিদের বাড়িতে বিন্তি আর তার মা। বিন্তি পড়ে ক্লাস এইটে। অভাবের সংসার। রেনু এসেই বিন্তির মাকে একটা সোনার গয়না দিয়ে বলল, মা এটা বিক্রি করে যা টাকা হয় সব আপনার। বিনিময়ে আমরা যে কয়দিন পারি থাকব। আপনি সবাইকে বলবেন, আমি আপনার বড় বোনের মেয়ে। বিদেশ থেকে এসেছি।
বিন্তির মা কথা বলেন কম। তার চোখ আর মুখে হাসি উপচে পড়ে বেশি। আমি অবশ্য সোনার গয়নার ভরসায় থাকলাম না। ফ্রিল্যান্সিং কাজ আর ছবি এঁকে ভালোই আয় হচ্ছিল আমার। নিয়মিত বাজার করা, এটা ওটা কেনা এসবের কারণে খাতিরযতেœর কোনো অভাব হচ্ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা বিন্তিকে আমি এক মাসের মাথায় ছবি আঁকা শিখিয়ে দিয়েছি। কোন রঙের সঙ্গে কোন রঙ মেশাতে হবে, কী করে সহজে ঘন জঙ্গল এঁকে তাতে সূর্যের আলোর ছটা বসিয়ে দিতে হবে, কী করে জাবর কাটতে থাকা গরু আঁকতে হবে সব। সে এখন চাইলে ছবি আঁকার স্কুলও চালু করতে পারে। আমি তাকে পড়াশোনাও করালাম। তারপরও রেনুপা বলতে অজ্ঞান সে।
সময় কম যায়নি। এর মধ্যে ঘটনার মতো অঘটনও আছে। আবার সেই অঘটনের কারণে তৈরি হয়েছে আরেক প্রেমোপাখ্যান। রেনুর সঙ্গে মোটেও সাধাসিধে সংসার চলছিল না আমার। প্রায় প্রতি দিনই, বিশেষ করে রাতের সময়টা আমাদের নিত্য নতুন অ্যাডভেঞ্চার চলমান ছিল। রেনুর প্রতিটি পাগলামিতে আমার সায় ছিল। বলতে গেলে শেষের দিকে পাগলামিটা আমার ওপরই ভর করেছিল যেন। আমি যা-ই বলেছি রেনু তাতে না করেনি।
প্রথম দিকে রেনু হঠাৎ রাতে বলত, চলো আজ নদীর তীরে যাই। এক উড়ালে যাব আর আসব। মাঝে কী হবে সেটা আর আমাকে বলে দিতে হলো না। আমরা রাত দুইটা তিনটার দিকে নদীর তীরে গেলাম। ঠিক কোন জায়গায় যাব সেটাও আগে ঠিক করা থাকতো।
তারপর কোনো এক গভীর নিশুতিতে আমরা চলে যেতাম কোনো এক বাড়ির উঠোনে। আগে থেকে জানতাম ওই বাড়িতে ওই রাতে লোকজন থাকবে না। কিংবা চুরি করে মধ্যরাতে কারো বাসর ঘরে উঁকি দেওয়া। তারপর চোর সন্দেহে যখন চেঁচামেচি শুরু হতো তখন দিতাম উড়াল। একবার তো আমাকে নিচে রেখেই উড়াল দিল রেনু। ইচ্ছে করে। মেজাজ গেল চড়ে। মন চাইল ধরা পড়ি। পরে আবার বুঝলাম এটা হলো তার একটা খেলা, আমাকে বিপদে ফেলে দেখতে চায় আমার বুদ্ধি কতখানি। এর আগে এমন কোনো এক খেলায় সম্ভবত আমি কাউকে খুন করেছিলাম। আমার ঠিক মনে পড়ে না। আমি হোগলার জঙ্গল আর সবজির বাগান মাড়িয়ে দুদ্দাড় ছুটে চলে আসি বিন্তিদের বাড়ি।
একটা এক শ বছরের পুরনো বটের ওপর গোল একটা কাÐ আবিষ্কার করেছিলাম আমরা। ওই কাÐটার ভেতর চাইলে আরামসে একজন মানুষ শুয়ে থাকতে পারে। বুঝতেই পারছেন, সেখানে একজন নয়, কোনো এক আধো জোছনার রাতে সেখানে দুটি দেহ শুয়েছিল, পাখিদের নিস্তব্ধতা ভেঙে।
সপ্তাহখানেক আগের কথা। এক সন্ধ্যায় বিন্তিদের বাড়ির উঠোনে আসে এক লোক। পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি। গলায় একগাদা মালা জড়ানো। সাধু সন্ন্যাসীদের বেশ ধরার চেষ্টা করছে। তবে বেশটা ঠিকঠাক হচ্ছে না তার। আমাকে দেখে একগাল হাসল, ‘ভাইসাব লেখক আর শিল্পী মানুষ। মহা গুণী ব্যক্তি। ভালো ভালো। আপনার সর্বশেষ ছবিখানা জার্মানিতে বিক্রি হয়েছে। খুউব ভালো।’
‘কী চাই আপনার? খবরটা পেলেন কী করে? মুখ দেখে সব বলে দিতে পারেন?’
‘আমি কী চাই? আপনি কী চান বলেন তো? কে কী চায়? কে কারে চায়? এইটাই তো দুনিয়ার একটা বড় প্রশ্ন।’
‘এসব আধ্যাত্মিক কথা শোনার মুড নাই। আপনি আসুন।’
‘তা বেগম সাহেবারে একটু বলবেন একটু পানি দিতে। পানি খেয়ে চলে যাব।’
‘পানি খেতে হবে না। আপনি ভাগেন।’
কথাবার্তা শুনে রেনু এলো। আসতেই কেমন যেন একটা বিশ্রীরকম হাসি খেলে গেল লোকটার মুখে।
‘অধমের নাম প্রামাণিক। অধম এসেছিলাম একটু পানি খেতে। আর যদি বাসায় একটা চিরুনি থাকে তো দেন। বহুত দিন চুল আঁচড়াই না।’
আমি আর কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না। ভদ্রতার সংজ্ঞাও আমার জানা নেই। সোজা এগিয়ে এসে লোকটার পাঞ্জাবি খামচে ধরে ছুড়ে মারতে চাইলাম। পড়লো না। তবে রাগের চোটে গটগট করে চলে গেল।
ভয় পেয়ে গেল বিন্তির মা।
‘কী দরকার ছিল! সাধু সন্ন্যাসী মানুষ।’
‘আমি তারচেয়েও বড় সাধু খালাম্মা। নিশ্চিন্তে থাকেন। ওই ব্যাটা আর জ্বালাবে না আপনাদের। বেশি জ্বালালে সোজা কল্লা ফেলে দেব।’
এর তিন দিন পরের ঘটনা। নদীর তীরের কোনো এক বালিয়াড়িতে একরাত আমাদের উদ্দাম মিলন চলছিল। সারা গা কাদা বালিতে মাখামাখি। রেনু তার স্বভাবসুলভ আনন্দঘন শব্দগুলো আওড়াচ্ছিল। কৃদের ভাষা শেখাটা জরুরি হয়ে গেছে মনে হলো।
হঠাৎ টর্চের আলো। চটজলদি সামলে নিলাম। উঠে দাঁড়ালাম। ঝটপট নিজেকে ঢেকে নিল রেনু। বেকায়দায় শুয়ে আছে। আমি কঠিন দৃষ্টি হানার চেষ্টা করলাম টর্চধারীর দিকে। কিন্তু টর্চের শক্তিশালী আলোর কাছে পারলাম না। একটা মোটাসোটা মানুষ। চেহারা আবছা দেখা যাচ্ছে। তাতেই মনে হলো পরিচিত। এ লোকটাই এসেছিল বিন্তিদের বাড়ি। কিছুতেই নাম মনে পড়ছে না।
‘তুমরা তাইলে এখানে প্রেমলীলা চালাইতেসো? হা হা হা। পাইসি আইজ তোরে ডাকিনি। আমার হাত থেইকে আজ তোক বাঁচাবিনে কেউ।’
রেনুকে কেউ বাঁচাতে পারবে না এমনটা ভাবার কারণ লোকটার হাতে লম্বা একটা আঁকাবাঁকা ছুরি। এটাকেই সম্ভবত খঞ্জর বলে। খপ করে আমার কলার ধরে ফেলল। এরপর বিড়বিড় করে কী যে আওড়ে গেল। আমি হয়ে গেলাম পাখির পালকের মতো ওজনহীন। এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল আমায়। মাথায় গাছের গুড়ির সঙ্গে বাড়ি খেলাম। জ্ঞান না হারালেও শরীর নাড়াতে পারছি না একটুও।
রেনু শাড়ি পরে ততক্ষণে উঠেই রক্তচোখে তাকাল লোকটার দিকে।
‘তোকে সাবধান করে দিচ্ছি প্রামাণিক! মানুষদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই আমাদের। আমি ওকে ভালোবাসি! আর আমরা মানুষ হত্যা করি না।’
‘হে হে, এটাই তো আমার সুযোগ। তুই না করলে কী হবি, আমি তোরে খুন করমু। বলতে বলতে লোকটা বিড়বিড় করেই চলেছে। আমি বিড়বিড় করা শব্দগুলো বোঝার চেষ্টা করছি। অন্য কোনো ভাষা নয়, কিছু শব্দ। কিছু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে শব্দ। নিশ্চয়ই অনেক সাধনা করে এভাবে মন্ত্র আওড়ানো শিখেছে লোকটা। কিন্তু রেনুর সঙ্গে কীসের লেনদেন তার? সে কি বিন্তিদের বাড়িতে এসেছিল রেনুকে দেখতে? কী চায়? ভাবতে ভাবতে আমার চোখ প্রায় বুঁজে এলো।
আধবোজা চোখেই দেখলাম রেনুর সঙ্গে প্রামাণিক নামের লোকটার আধিভৌতিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। রেনু বার বার উড়তে গিয়ে আবার পড়ে যাচ্ছে। কয়েকবার চেষ্টার পর মনে হলো ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে ও। উপুড় হয়ে গেল। এমন সময় রেনুর ওপর ঝাঁপ দিল প্রামাণিক নামের লোকটা। মাংসের ভেতর ছুরির ফলা ঢোকার শব্দটা কানে আসতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। রেনুর পিঠে বিঁধেছে ছোরাটা। লোকটা আর দাঁড়াল না। দৌড়ে পালাচ্ছে। লোকটা সরে যেতেই আচমকা আমার শক্তি ফিরে এলো। ছুটে গেলাম রেনুর কাছে।
সাদা বালিতে রক্তের চিকন ¯্রােতটা দেখে মাথা খারাপ হওয়ার দশা। রেনুকে পাশ ফেরাতেই দেখি ছুরির চার-পাঁচ ইঞ্চি পিঠ চিরে ঢুকে গেছে। ভাগ্য ভালো মেরুদÐে লাগেনি।
স্থির হতে বললাম রেনুকে। যন্ত্রণায় গোঁঙ্গাচ্ছে। তবে নড়ছে না। সাবধানে ছাড়ালাম ছোরাটা। গেঞ্জি ছিঁড়ে বাঁধার চেষ্টা করলাম। দুর্বল বাঁধন। রক্ত চুইয়ে পড়ছে। ওর শাড়িটার খানিকটা ছিঁড়েও পেঁচিয়ে দিলাম। বললাম, ‘উড়তে পারবে? হাসপাতাল ঘুরে গেলে চার-পাঁচ কিলো হবে। নদীটা পার হতে পারলেই মেইন রোড। তারপর…।’
‘নাহ! উহ.. পারবো না।’
আমার শরীরে যাকে বলে শীতল ঢেউ খেলে গেল। বিপদের সময় এমনিতে হাত-পা অবশ অবশ লাগে। শরীরে শক্তিও থাকে না। ওই অবস্থায় রেনুকে কোলে নিয়ে নদীর বালিয়াড়ি থেকে রাস্তায় উঠলাম। মাথায় খেলতে লাগল বুদ্ধি। আগে দরকার একটা ভ্যান। মনে পড়ল রইসু মিয়ার কথা। জলদি করে ওর বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলাম।
‘এই দিকে কই যাও! এদিকে তো বাজার না।’
‘তুমি চুপ করে কাটা জায়গায় প্রেশার দিয়ে রাখো। রক্ত যেন বেশি বের না হয়। তুমি লোকটাকে চিনতে?’
‘দুই বাড়ি পরেই তো থাকত। ভাবতাম পাগল টাগল। সে কোনোভাবে আমার কথা জেনে গেছে।’
রইসুর উঠোনে ভ্যানদুটো দেখেই মনে হলো এবার আমরা উড়তে পারবো। বেশি ডাকাডাকি করতে হলো না। রেনুকে ভ্যানে শোয়ালাম। আমার খালি গা আর পরনের জিন্সের প্যান্ট। রেনুর শরীরে কোনোরকম শাড়ি পেঁচানো। রইসু চোখ ডলতে ডলতে হিসাব মেলাতে পারছিল না নিশ্চয়ই। তবে ভ্যান ছাড়তে দেরি করেনি। একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে গেল। ভাড়া পরে নেবে বলে জলদি আমাকে তাগাদা দিল রইসু। এক বালতি পানি জোগাড় করে সে ভ্যানের রক্ত পরিষ্কার করছিল। রেনুর রক্ত। বুক ভাঙা হাহাকার নিয়ে দৃশ্যটা দেখছিলাম।
হাসপাতালে রাতেই সেলাই করে বলল, ঢাকায় নিয়ে যেতে। কী একটা নাকি জটিলতা দেখা দিয়েছে। বড় ক্ষতি হতে পারে। নিজেকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। কে বলেছিল এসব ছেলেমানুষী অ্যাডভেঞ্চার করতে।
ঢাকায় যাওয়ার পথে আবার সেই পরিচিত অ্যাম্বুলেন্সের শব্দটা শুনতে পেলাম। মানে গাড়ির ভেতর থেকে শোনা। এর আগে মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথে শুনেছিলাম। রেনু ঘুমুচ্ছে নাকি জ্ঞান হারিয়েছে বোঝার উপায় নেই। ওর রক্তের গ্রুপ কী! জানি না আমি। উফফ আমার রক্তগুলোকে মনে হলো মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। আমি বারবার রেনুর মাথায় হাত বুলোচ্ছি আর একটু পর পর পানি খাবে কিনা জিজ্ঞেস করছি। রেনুর ঘুমের মধ্যে বকবক করলো বেশ খানিকক্ষণ। যতক্ষণ বকেছে, ততক্ষণ যেন আমি বেঁচেছিলাম। ‘ওহ তুষার.. তুমি জানো না.. কিচ্ছু জানো না.. তোমাকে ভালোবাসি…।’
রেনুর ওপর রাগ করতে গিয়েও পারলাম না তখন। আগে তুষার নামে তার সঙ্গে কারো সম্পর্ক ছিল এটা বললেই পারতো। কিছুটা রাগও হলো, অন্তত একবার সে ‘ওহ.. ফয়সাল..বলতে পারতো।’ আমার নামটা একবারও মুখে আনলো না। কিন্তু তাই বলে বিশ্বাস করুন, ওর জন্য আমার মন খারাপ এক ফোঁটা কমেনি।
ঢাকায় আসার পাঁচ ঘণ্টা মনে হলো দ্রুতই কেটেছে। অনন্ত মহাকাল টাইপ কিছু মনে হয়নি। মনে হলো স্বপ্নের মতো সব ঘটেছে। গ্রিন লাইফ হাসপাতাল। এখানেই নিয়ে এসেছিলাম মাকে। এবার রেনুকে। চোখের পলকে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। কেবিনও পেলাম।
বেডে শোয়ানোর পরপরই নিয়ে যাওয়া হলো এক্সরেসহ কী কী সব পরীক্ষায়। ফোন করে আনা হলো ডাক্তার। এরপর সার্জারি। এরপর পোস্ট অপারেটিভ রুমের বাইরে একা একটি রাত।
কেবিনে নেওয়ার পর দিন রেনুকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো। মঞ্জু এলো এর মাঝে দেখতে। আগে সে গ্রামে গিয়ে ঝামেলা বাঁধাতো। ওর ধারণা আমি শিল্পী মানুষ, মাথাভর্তি পাগলামি আর ঘোর। ঘোর খুব দ্রæত কেটে যাবে এরপর আমি মহাবিপদে পড়ব। রেনু আমার নামে নারী নির্যাতনের কেস করবে। হেনতেন।
যখন দেখল এ ঘোর ছয় মাসেও কাটলো না। হাল ছেড়ে দিল মঞ্জু। এখন তার মতো বন্ধু আর হয় না। আবার রেনুও তার মতে শ্রেষ্ঠ ভাবী। হাসপাতালে এসেই খুব হম্বি তম্বি করে বলল, রক্ত লাগবে কিনা বল, সব গ্রæপের একজন করে স্ট্যান্ডবাই রেখে দিয়েছি। বললেই চলে আসবে।
‘ডাক্তাররা এখন পর্যন্ত আমাকে রক্তের গ্রুপটাও জানায়নি। সম্ভবত লাগবে না।’
‘বলিস কি, রেয়ার গ্রুপ নাকি। তা হলে তো বিপদের সোয়া সের। আর ভালো কথা, কে ছোরা মেরেছে আমি খুঁজে বার করবো। স্পট থেকে শুধু একবার ছুরিটা খুঁজে পাই। তারপর হারামজাদার গুষ্টি উদ্ধার করা হবে।’
মঞ্জুকে কিছু বলিনি। পুরো ঘটনা তো বলার মতো না।
মঞ্জু একসময় চলে গেল। হাসপাতালে আমি আর রেনু একা।
আমার কোনো আত্মীয় নেই। রেনুরও নেই। তার বাবা-বোনকে এ বিপদের মধ্যে টেনে আনার কোনো মানে হয় না। ও তো আর মরে যাচ্ছে না। বড়জোর দিন দশেক থাকতে হবে হাসপাতালে।
নিচে গেলাম খাবার কিনতে। চারপাশের ঝলমলে আলোটা বেশ পরিচিত মনে হলো। কেবলি মনে হচ্ছিল বামের রাস্তা ধরে এগোতে থাকলে একটা রেস্তরাঁও পাব। নামটা মনে আসি আসি করেও আসছিল না। মদিরা রেস্তরাঁটা দেখেই দেজা ভ্যু হলো। ব্যাপারটা এত ঘন ঘন হচ্ছে যে আমি আর এটাকে বিশেষ পাত্তা দিলাম না। সাধাসিধে রেস্তরাঁ। পরোটা আর ডিম ভাজা হচ্ছে। আমি ভেতরে বসে পরোটার অর্ডার করলাম। ম্যানেজার লোকটা বিশালদেহী। কিন্তু চোখজোড়া মনে হয় কোটরে একটু বেশিই বসানো। আমার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। তারও কি দেজা ভ্যু হচ্ছে? আমাকে দেখে চেনা চেনা মনে হচ্ছে?
‘আপনে ফয়সাল না?’
আমি আঁতকে উঠে আবার স্বাভাবিক হলাম। মৃদু মাথা ঝাঁকালাম।
‘আমি আপনার লেখা পড়ি। আপনার গল্প খুব ভালো লাগে। ব্যাপক রোমান্টিক।’
‘ওহ.. আচ্ছা।’
‘তা রোগী কে?’
‘জ্বি, আপনার ভাবি।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। তা পোলা না মাইয়া।’
‘না, একসিডেন্ট করেছে।’
‘ওমা! বলেনকি! অবশ্যি চিন্তার কারণ নাই। ভালো হাসপাতাল। আমার চাচাত ভাইয়ের শ্বশুররে আনসিলাম ওইদিন। তার আবার…।’
আমি গভীর মনযোগ দিয়ে ম্যানেজারের গল্প শোনার ভান করলাম। এরপর বিল দেওয়ার সময় জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা, আপনার রেস্তরাঁর নিচে কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড আছে? মদটদ পাওয়া যায়?’
লোকটা যতটা সমীহ করছিল, ততটা বিরক্ত হল। আমিও বুঝে গেলাম সব দেজা ভ্যু সত্য নয়। রেনুর জন্য স্যুপ খুঁজতে দেরি হয়ে গেল। এসে দেখি ও আবার ঘুম। ডেকে তুললাম। মহাবিরক্ত হলো। খাইয়ে দিতে গেলাম, তাতেও বিরক্ত।
‘আমার হাত-পা সব ঠিকাছে। খাইয়ে দিতে হবে না। স্যুপও ঠাণ্ডা। ফ্রিজে রাখা ছিল নাকি! চামচ কেটে খাওয়ার মানে হয় না। এদিকে দাও।’
হাত থেকে বাটিটা নিয়ে একটানে সুরুৎ করে খেয়ে ফেলল। আমি খানিকটা মন খারাপ ভাব করে বসে রইলাম। যদিও আমার মন আগের মতোই।
‘তুমি বাসায় যাও। গ্রিনরোডে না তোমার বাসা? কাছেই তো। আমি একা থাকতে পারব। যাও ভাগো।’
বিরক্তির রহস্য ফাঁস হয়ে গেল। রেনু চায় যেন আমি বাসায় গিয়ে আরাম করে ঘুমাই।
‘ঠিকাছে যাচ্ছি। অ্যান্টিবায়োটিক..।’
‘ওটা দিয়ে গেছে। রাতে আর ওষুধ স্যালাইন নেই। তুমি যাও তো।’
‘ওকে, যাচ্ছি।’
আমি কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এলাম। রেনুর অনেক ক্ষমতা থাকলেও সুপারম্যানের মতো দেয়াল ভেদ করে দেখার ক্ষমতা নেই।
কেবিনের বাইরে একটা লোহার শক্ত চেয়ার রাখা। পরপর তিনটি চেয়ার একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া। মাঝে হাতল দেওয়া। তা না হলে শুয়ে পড়া যেত। গ্রাউন্ড ফ্লোরে অনেকে শুয়ে তাকে। চাইলে তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া যায়। মন চাইল না। রেনুর কাছাকাছি থাকা দরকার। কেন দরকার সেটা জানি না। সঙ্গে পাস কার্ড আছে। যখন খুশি ঢুকতে বের হতে পারব। স্টিলের চেয়ারে বসতেই মেজাজ বিগড়ে গেল। মোটেও আরামদায়ক নয়। কিছুক্ষণ বসে থাকা যায় বড়জোর। বের হয়ে একটু ঘুরঘুর করা যেতে পারে। রাত দুটোর দিকে আবার আসবো। তার আগে মিনিট গা এলিয়ে নেওয়া যাক।
হাসপাতালের গেট পার হয়ে আবার সেই মদিরা রেস্তরাঁ। ম্যানেজার আমাকে দেখে এবার ভয় পেয়েছে। ভাবছে আমি আবার গোয়েন্দা পুলিশ কিনা। খারাপ কিছু না করলে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। তারপরও ম্যানেজার ভয়ে অস্থির।
একজনের বিল হয়েছে দুই শ টাকা। সে পাঁচ শ টাকা দিয়ে তিন শ টাকার জন্য বসে আছে। ম্যানেজার বুঝতে পারছে না কত ফেরত দিতে হবে। দুই শ না তিন শ। বারবার আড়চোখে আমাকে দেখছে। আমিও পাথরের মতো চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। মানুষকে ভয় দেখানোর মধ্যে একটা রস আছে। ছয়টা রসের মধ্যে কোনো এক রসে নিশ্চয়ই সেটা পড়ে। আমি কোন রসে আছি সেটা জানি না। তবে বিষয়টা ভালো লাগলো না। ভালো লাগানোর মতো আরো কাজ আছে আমার হাতে।
ছয়টা পরোটার অর্ডার দিলাম। মিনিটের মধ্যে গরম গরম হাজির। রেস্তরাঁয়ার ছাউনির পাশে দাঁড়িয়ে খালি গায়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ছিল ছ-সাত বছরের এক কিশোরী। সঙ্গে তার বড় ভাইও আছে। ছেলেটাও ছোট। বোনকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। ইশারায় ডাক দিলাম। এলো না। সাহসী ছেলে। ওয়েটারকে ডাক দিয়ে চারটা পরোটা আর ডিম ভাজি দিয়ে বললাম, ওদের দিয়ে আসো। ম্যানেজার তড়াক করে উঠে শিশু দুটিকে ধরে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিল।
‘স্যার বলসে, বসতে। বস! বইসা খাবি। দাঁড়াইয়া খাবি ক্যান।’
কিশোরটা ফোঁস ফোঁস করতে বলল, ‘খামু না! খিদা নাই’।
কিন্তু একেবারে ছোটরা আবার রাগটাগের ধার ধারে না। পিচ্চি বোনটা চিৎকার করে বলল, ‘আমি খামু! আমার খিদা লাগসে!’
চেঁচামেচির মধ্যে উঠে ওয়েটারকে বিল বুঝিয়ে চলে আসলাম। ম্যানেজারের ভিতু চেহারা দেখতে ভালো লাগছিল না।
মনের মধ্যে মিশ্র অনুভ‚তি। খারাপ ও ভালো লাগা দুটো মিশে নতুন কিছু তৈরি হয়নি। দুটোই আলাদা আলাদা চেম্বারে বসে আছে। এর মধ্যে রেনুর কাছে যাওয়ার তাগাদাটা বড় করে দেখা দিল।
হাসপাতালে ঢুকলাম। নার্স স্টাফরা আমাকে কেন যেন চিনে ফেলেছে। আমাকে দেখলেই তরুণী নার্সরা ফিকফিক করে হাসছে। হাসি অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। আমিও জবাবে হাসলাম। তারপর ওরা একজনের গায়ে রীতিমতো আরেকজন ঢলে পড়ে হাসছে। স্লো মোশনে দুলছে। বাহ আজকাল এমনও ঘটছে তা হলে!
লিফটে চড়ে উঠে গেলাম বারো তলায়। কেবিন নম্বরটা মনে নেই। হাসপাতালটাও মনে হচ্ছে নড়েচড়ে গেছে। এমনটা হওয়ার কথা নয়। আমি টের পেলাম একটা প্রচণ্ড এবং চেনা আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করছে। আমার মন চট করে ধরে ফেলল এখানে কোনো কেবিনে রেনু নেই। বের হওয়ার সময় আলো-আঁধারি দেখলাম, এখন সবখানে আলো ঝলমল করছে। নার্স-ডাক্তারও অনেক। কিন্তু অপরিচিত মুখই বেশি। ভুল হাসপাতালে ঢোকার প্রশ্নই আসে না। এই এলাকায় আর হাসপাতালই নেই!
‘আপনি ফয়সাল না? আপনাকে রেনু আপা ডাকে। আপনি ডাক্তারদের লিফট দিয়ে উঠেছেন তো এ জন্য চিনতে পারছেন না। ওপাশে যান।’
আটকে রাখা আতঙ্কটা পানির মতো গলে গেল। অন্ধের মতো এগিয়ে গেলাম ডিউটি নার্সের দেখানো পথে। ছাদের মতো খোলা গ্রিল দেওয়া বারান্দামতো একটা জায়গা আছে।
বারো তলায় বাতাসের অভাব নেই। একটু পর ঝড়ও আসবে মনে হচ্ছে। রেনু কোন ফাঁকে শাড়িও বদলেছে। অশরীরি মানবীর মতো তার চুল আর সাদা শাড়ির আঁচল উড়ছে। আমি সাহস করে এগিয়ে গেলাম। আশপাশে কেউ নেই। রেনুর পাশে দাঁড়ানোর সাহস হলো না। দুই হাত গ্যাপ রেখে দাঁড়ালাম।
‘কাছে আসবে না খবরদার!’
‘জ্বি আসব না। সাইড থেকে দেখব। উঁকি ঝুঁকিও দেব না।’
‘তাও তো দিচ্ছো! তোমার চোখ কোথায় ভেবেছো দেখিনি!’
আমি ইচ্ছে করে আরো বেশি করে দেখার ভান করলাম। শাড়িটা আরো উড়ে গেল। শাড়িটা বুঝলো কী করে! অবাক কাণ্ড! ওটাও উড়ছে স্লো মোশনে। সময় আবার দুষ্টুমি শুরু করেনি তো? মাঝে মাঝেই তো আটকে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে। রেনুর মুখে এই হাসি, এই কষ্ট। কখনো ব্যথার ছাপ। কখনো দারুণ প্রেম।
কোন ফাঁকে যে তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি টের পাইনি। আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে ও। এই অবস্থায় আবার আকাশে ঝাঁপ দেবে না তো! ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। ভয়ের মাঝেই মাথায় খেলে গেল একটা লাইন, ‘সব পাওয়ার আনন্দ যোগ দিয়ে দেখোই না, তোমার পাশে বসার এক মুহূর্তের নামতা যেন।’
রেনু তার পিঠে হাত রেখে হঠাৎ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে ধরলো। আমি সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করছি, ছাড়ো আমাকে, ওড়াওড়ি জাহান্নামে যাক। উড়তে মন চাইলে হাজার হাজার ফ্লাইট আছে। জেট বিমান আছে। তুমি আপাতত রেস্ট নাও।
মুখ দিয়ে কিছু বের হলো না। সব ঘোলাটে হয়ে আসছে। চোখ খোলা, তারপরও মনে হলো সব অন্ধকার। এত আলো এত নার্স-ডাক্তার কেউ নেই। ঝপ করে গোটা ফ্লোরে যেন অন্ধকার চেপে আছে। এর মধ্যে আমি ভেসে যাচ্ছি। ভেসে ভেসে হাসপাতালের ভেতরের দিকে যাচ্ছি।
ভাগ্যিস উড়াল দেয়নি রেনু। একবার হালকা একটা আলো দেখলাম শুধু। কড়া হলেও ভীষণ ঘোলাটে সেই আলো।
কানে একবার বকাবকির মতো কথা ভেসে এলো। ঠিক বুঝলাম না। এরপর দরজা লক করার শব্দ। তারপর একটা পরিচিত গন্ধ। শিউলি না বকুল না কাঁঠালচাঁপা বোঝা গেল না। এর সঙ্গে আবার হাসপাতালের হালকা ফিনাইলের গন্ধও মিশে আছে। বেশ একটা ওম টের পেলাম। প্রবল একটা মায়ার চাদর আমাকে ক্রমে ঢেকে দিতে লাগল। আমি হারিয়ে যেতে লাগলাম অন্য এক রাজ্যে।
নাহ, অন্য কোনো রাজ্য টাজ্য না। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ওই বেঞ্চেই। হোটেলের পরোটা, ম্যানেজার, কিশোর-কিশোরী, নার্সদের হাসাহাসি সবই ছিল স্বপ্ন। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙল। পাশে রেনু বসে বসে নাস্তা করছে। হাসপাতালের দেওয়া পাউরুটি, সেদ্ধ ডিম, সঙ্গে আরো কী যেন।
‘কাল রাতে বেঞ্চ থেকে কোলে করে কেবিন পর্যন্ত এনেছি। শাস্তি হিসেবে আজ তোমার খাওয়া দাওয়া বন্ধ।’
আমি তাকিয়ে আছি রেনুর শাড়িটার দিকে। সাদা শাড়ি। স্বপ্নে ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম তেমন।