রোমান্টিক উপন্যাস – ফ্যান্টাসি থ্রিলার কৃ (পর্ব-১৩)
রোমান্টিক উপন্যাস – ফ্যান্টাসি থ্রিলার কৃ (পর্ব-১২)
১৪
সপ্তাহখানেক পরের কথা। ওই প্রামাণিক মরে গেছে দিন তিনেক আগে। গ্রামের লোকজন কোনোমতে সৎকার করে বাঁচল। আমি আর রেনুও ছিলাম। সবার কাছে সে ছিল মাথা খারাপ হওয়া লোক। আমার আর রেনুর কাছে মনে হলো হারামজাদা পেটের ভেতর একগাদা রহস্য নিয়ে চলে গেল।
আমি যখন কিনা রহস্যের একটা কিছু আঁচ করতে শুরু করেছি, এর মাঝে একদিন হুট করে রাত বারোটায় চোখের সামনে এক অন্য রেনু এসে হাজির। অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে। তাকে এমন পোশাকে দেখেছি বলে মনে হলো না। আবার মনে হলো দেখেছিও।
‘এমন শহুরে মেম সাজলে হঠাৎ।’
‘তুমি জানো না। গ্রামে আজকাল এ সব পাওয়া যায়।’
‘কিন্তু এই স্টাইল করা ফতুয়া আর জিন্স পরা অবস্থায় তোমাকে নিয়ে যাব কোথায়? গোটা গ্রামের ঘুম ছুটে যাবে।’
‘গেলে যাক। গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরবো। বাইরে যাবো।’
‘আজ জোৎস্না? কদিন আগে না চাঁদ ছিল। চাঁদের টাইম কি চেঞ্জ হয়ে গেল নাকি। কিন্তু ঘটনা হলো তোমাকে এমন খুশি খুশি দেখাচ্ছে কেন?’
‘এমনি। নোটবইটা আজ ফেলে দেব ঠিক করেছি। ওটার আর দরকার নাই। আমরা তো এই বেশ আছি।’
এবার ভালো করে তাকালাম রেনুর দিকে। চাপা কষ্টটা আর লুকানো গেল না। রেনু যদি সত্যিই কৃ নামের জিনিসটা হয়ে থাকে তবে তারা অভিনয়ে মানুষের চেয়ে অনেক কাঁচা বলা যায়।
আমাদের রুমে সাধারণত বিন্তি বা কেউ আসে না। তারপরও দরজা লাগিয়ে দিলাম। রেনুর হাত ধরে বসালাম। আমার মুখে চিন্তার ছাপ নেই। কারণ আমি কৃ না। খাঁটি মানুষ। এরপর মুখে একটা সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে যে রহস্যের সামান্য কিনারা করতে পেরেছি সেটা রেনুকে বলতে শুরু করলাম।
‘আমাদের জগতে কিছুটা না, বড় ধরনের গোলমাল আছে। প্রামাণিক ঠিক বলেছে। তুমি খেয়াল করে দেখো, বিন্তিদের বাড়িতে কোনো মেহমান আসে না। কারো কোনো রোগ শোক নেই। সবকিছু একেবারে স্বপ্নের মতো চলছে। মঞ্জু নিয়ম করে গ্রামে আসে যায়। আমাদের টাকা নিয়েও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তোমার কি মনে হচ্ছে না আমরা একটা পারফেক্ট রুটিনে চলে এসেছি। মানে আমাদের ঘিরে গোটা জগৎটা…?’
রেনু মাথা নিচু করল। তারমানে বিষয়টা সে জানে। এ জন্যই প্রামাণিকের অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিল।
‘এর জন্য প্রামাণিক ব্যাটা তোমাকে দায়ী করে গেছে। তাই বলে নিজেকে অপরাধী ভাবার কিছু নেই। আমার তো মনে হয় ওই নোটবইতে একটা কিছু আছে যেটার পাঠোদ্ধার করা অসম্ভব না।’
‘আমি হাজারবার চেষ্টা করেছি। সব কিছু পড়ে দেখেছি। ছাইপাশ সব মন্ত্র, কিছুতে কিছু হয় না।’
‘হুমম।’
এবার আমার সত্যিকার অর্থে চিন্তা করার পালা। নোটবইটা হলো একটা ধাঁধা। যেটার সমাধান সহজে মিলবে না। কঠিনে মিলবে। অর্থাৎ চোখে যা দেখবো তাতে কিছু হবে না। অন্য কিছু লাগবে। সেই অন্য কিছুটা খুঁজে বের করতে হবে।
চোখ বুঁজে সেই রাতের কথা ভাবতে বসলাম। যে রাতে প্রামাণিক রেনুকে ছুরির ঘাই দিয়েছিল। রেনু আলগোছে আমার কোলে তার মাথা ছেড়ে দিল। এতে অবশ্য ভাবনার ব্যাঘাত ঘটল না। রেনু কাছে থাকলে কেন যেন মাথাটা হালকা হয়ে যায়। গুন গুন করে গাইতে ইচ্ছে করে একটা কিছু। গুন গুন! একটা সুর! না না! সুর না ঠিক! একটা বিশেষ ধরন, প্রামাণিক যখন মন্ত্রগুলো পড়ছিল তখন সে একটা স্টাইলে পড়ছিল। কেমন যেন একই শোনাচ্ছিল তার কথাগুলো। গান নিয়ে আমার কিঞ্চিৎ জানাশোনা আছে। প্রামাণিকের গলার কম্পনটা আবার কল্পনায় শোনার চেষ্টা করলাম। একটাই কম্পন, একটাই মাত্রা, একইটাই স্কেল! পেয়েছি!
‘পেয়েছি!’
মাথা তুলল রেনু।
‘নোটবইটা দাও। আর উড়ে গিয়ে কোথাও থেকে একটা হারমোনিয়াম নিয়ে আসো। পারবে?’
‘রাতদুপুরে ওড়াওড়ি করলে সমস্যা নেই, কিন্তু খবরদার গান গাইতে শুরু করবে না!’
‘আরে গান গেয়ে সবার ঘুম হারাম করে দেব। খবর হয়ে যাক। সবাই ভয়ে হার্টফেল করুক। এ জগৎ আমাদের না। এখানে যা খুশি হোক। আমি রাস্তা পেয়ে গেছি।’
নোটবইটা ওলটাতে লাগলাম পাগলের মতো। জগৎ পরিবর্তন জনিত কোনো মন্ত্র পেলাম না। তবে কৃকে আহŸান করার মন্ত্রটা পেলাম। প্র্যাকটিস করে নিলাম বিচিত্র শব্দগুলো। মিনিটখানেক পর নতুন একটা হারমোনিয়াম হাতে হাজির কৃ। কোনো দোকান থেকে তুলে এনেছে সম্ভবত। একদম নতুন।
স্কুলে থাকতে কিছুদিন গান শিখেছিলাম। রাগ খাম্বাজ আর আশাবরী এখনো মনে আছে টুকটাক। মুদারা সপ্তকে সারেগামার স্কেল ঠিকাছে কিনা পরীক্ষা করে নিলাম। প্রামাণিকের গলার পিচ ছিল উদারা সপ্তকে। মানে আরো গম্ভীর গলা। আমি মুদারায় সা বাজালাম। তারপর প্র্যাকটিস করে নেওয়া মন্ত্রটা ঠিক ওই সা’তেই বসালাম। মানে বলতে শুরু করলাম শব্দগুলো। একই তরঙ্গদৈর্ঘ্য।ে রেনু চোখ কুঁচকে আমার কারবার দেখছে। কিছু বলছে না। কিছু ঘটলোও না।
‘তুমি কি একটু বাইরে যাবে?’ রেনুর সামনে এমনিতে অস্বস্তি না লাগলেও এখন লাগছিল। কারণ ওর সামনে আমি কখনও গুন গুন করেও গাইনি। ও চলে গেল দ্রæত।
আবার শুরু হলো আমার মধ্যরাতের সারগাম মন্ত্র। সা থেকে শুরু। কোমল গান্ধারে আসতেই মনে হলো একটা কিছু ঘটছে। মগজে আবার সেই ঝলকানি টের পেলাম। বাইরে বাতাসের তোলপাড়ও। রেনু ছুটে এলো আমার কাছে। আমি থামার পাত্র নই। মন্ত্রটা বিড়বিড় করে আওড়ে গেলেও স্কেল থেকে টলছি না। হারমোনিয়াম থাকাতেই রক্ষে। খালি গলায় এমন স্কেল ধরে রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব। বাতাসের শব্দ বাড়তে বাড়তে হুট করে থেমে গেল। যেন দরজার কাছে এসে দাঁড়াল কেউ।
‘আসতে পারি?’
‘জ্বি আসুন।’
আমি যতটা সম্ভব খোশমেজাজ দেখালাম। রেনু বিস্ময়ে কথাই বলছে না। নিজেকে ওর সামনে নায়ক নায়ক লাগছিল।
ঘরে ঢুকলো ন¤্র ভদ্র চেহারার একজন লোক। প্রথমে মনে হলো আমার বাবার মতো চেহারা, মুহূর্তেই আবার সেটা হয়ে গেল রেনু আর বিথির বাবার মতো। একটু পর আবার মঞ্জুর মতো মনে হলো। বুঝলাম এই লোকটা আমার মগজ থেকে চেহারা চুরি করে সেটা রি-ক্রিয়েট করার চেষ্টা করছে।
‘এককাজ করেন। আপনি রেনুর বাবার চেহারায় আসেন।’
তাই করলো লোকটা। রেনুকে আগের চেয়ে স্বাভাবিক মনে হলো যেন।
‘কেমন আছো…।’
কথাটা রেনুকে বলল। রেনু উত্তর দিল না। সে লোকটাকে চেনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। লোকটা আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। অথচ কষ্ট করে মন্ত্রটন্ত্র পড়লাম আমি।
‘তোমরা যে একটা..।’
‘জ্বি সেটা জানি। বুঝতে পেরেছি বলেই আপনাকে ডেকেছি। আমরা আমাদের আসল জগতে যেতে চাই। যেখান থেকে এসেছি। যেখানে আমার নাম তুষার, আর ওর নাম কৃ।’
‘ওর নাম..।’ লোকটা বলতে গিয়ে থমকে গেল। তারপর ধীর লয়ে বলল ‘কৃ.. হুম। কিন্তু আমি তো সেটা পারবো না।’
আমার সঙ্গে আর বিশেষ আলাপ হলো না। রেনু ইশারা করতেই আমি বাইরে উঠানে এলাম। মাথার ওপর গোলগাপ্পা চাঁদ। সত্যিই বিচিত্র এ জগৎ। প্রতিরাতেই দেখি পূর্ণিমা।
লোকটার মুখ থেকে বের হওয়া বিশেষ কিছু শব্দ শুনতে পেলাম। রেডিওর নব ঘোরানোর সময় যেমন শব্দ হয়, অনেকটা ওই রকম। এটাও মনে হয় অন্য জগতের কোনো স্বরলিপি। যে গানটা বুঝতে হলে আগে ওই সারগাম শিখতে হবে। আপাতত সে চেষ্টা নিরর্থক। জানালার ফাঁক দিয়ে রেনুর চেহারা দেখলাম এক ঝলক। দেখে মনে হলো সে ওই কৃর সব কথাই বুঝতে পারছে। কথাবার্তা শেষে লোকটা যেভাবে এসেছিল সেভাবে চলে গেল। আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। তার কাছে মানুষ যেন একটা নিচুস্তরের প্রাণী। ‘হুহ’ জাতীয় শব্দ করে আমিও নিজেকে বড় কিছু প্রমাণ করে ঢুকে পড়লাম ঘরে।
খাটের ওপর চুপচাপ বসে আছে রেনু। ভাবছে আমাকে কীভাবে কী ব্যাখ্যা করবে।
‘শোনো এখন ঘুমাও। অনেক রাত হয়েছে। আর কিছু খেলে বলো। উড়ে গিয়ে নিয়ে আসি।’ হড়বড় করে বলল রেনু।
‘এত রাতে আর উড়ে কাজ নেই। তুমি শুয়ে পড়ো। আজ আমরা জোৎস্না দেখবো আর ওটা করবো। হে হে।’
‘বাজেভাবে হাসবে না। বাজে হাসি দিয়ে বলল কিছুই হবে না। রোমান্টিকভাবে বলতে হবে।’
বুঝতে পারছি পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করছে রেনু। কারণ লোকটা তাকে ভালো কিছু বলে যায়নি মনে হয়।
‘খাবারের কথা বলতেই তোমার চেহারা ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। দাঁড়াও, বিস্কিট আর কলা নিয়ে আসি। বাসাতেই আছে। উড়তে হবে না।’
রেনু খাবার নিয়ে এলো না। এলো বিন্তি আর তার মাকে নিয়ে। বাকি দুজন রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে। কৃকে আসতে দেখেছিল নিশ্চয়ই। বিন্তির মা বলল, ‘বাবারা, তোমরা কী আমি জানি না। তবে বিন্তি আমার আদরের মেয়ে। ওর কোনো ক্ষতি যেন না হয়। তোমরা চইলা যাও। পারলে আইজকা রাইতেই যাও। আমার বাসায় উল্টাসিধা কাজ কারবার হইতেসে। তোমরা..।’
‘আচ্ছা, আমাদের ঘণ্টাখানেক সময় দিন। গুছিয়ে নিই। আর ঘরে কলা বিস্কিট থাকলে দিন। খিদে পেয়েছে। খেয়ে বিদেয় হই। রেনু তুমি বসো। বিন্তি যাও, কলা বিস্কিটা নিয়া আসো।’
১৫
রাতেই ঢাকায় চলে এলাম। আমার ফ্ল্যাটে। মঞ্জু নেই। ফ্ল্যাটের অবস্থা দেখে মনেও হয় না কেউ থাকে এখানে। তালাচাবির বালাই নেই যদিও, তবু আমার কাছে এক্সট্রা চাবি ছিল একটা।
ঢাকায় আসতে বেশিক্ষণ লাগেনি। রেনুর শরীর এখন সুস্থ। তবে বেশিক্ষণ উড়লে একটা কাণ্ড ঘটে। কাণ্ডটা আমি চুপ করে উপভোগ করি। উড়তে হয় রেনুকে জাপটে ধরে। এতে তার শরীর একটা ঘ্রাণ আমার শরীরে চলে আসে। সহজে যায় না। আমি বসে বসে সেই ঘ্রাণটা নিতে থাকি।
‘এবার বলো তোমাকে ওই কৃ মশাই কী বলেছে?’ আয়েশ করে খাটে পা তুলে বসলাম।
‘তুমি বুঝবে না।’
‘আরে বোঝাও না। তবে ঘটনা যদি কোয়ান্টাম তত্তে¡র মতো জটিল কিছু হয় তবে বাদ দাও।’
‘তারচেয়েও জটিল।’
‘তা হলে বলো। চট করে বুঝে ফেলব।’
রেনু ঠোঁট বাঁকা করে বিছানায় পা দোলালো। আমার মনে হলো আগেও এ দৃশ্য দেখেছি। তবে বিছানা এটা ছিল না। দেজা ভ্যুগুলো সত্যিকারের স্মৃতি হতে পারে। বাস্তবতা বদলে গেলেও ব্রেইনের কিছু কিছু নিউরন কিছু স্মৃতিকে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে আটকে রেখেছে।
‘সত্যিটা বললে তুমি আমার গলা টিপে ধরবে।’
বাসায় এসেই সবার আগে কাপড় বদলেছিল। আমার আলমিরায় একটা লাল শাড়ি ছিল। সম্ভবত বিথির ওটা। রেনুকে দেখাচ্ছে ডানাবিহীন লাল পরীর মতো। এই পরীর গলা টিপে ধরা কোনো সাইকোপ্যাথের পক্ষেও সম্ভব কিনা…।
‘আমারই দোষ।’
‘কোনটা?’
‘সব।’
‘এখন কী করবে তা হলে? আমার বাস্তবতা বদলে দেবে?’
‘সেটাই করতে হবে। তুমি হচ্ছো আমার সেই নীল ফুল, যাকে ধরতে গিয়েও…।’
‘দাঁড়াও দাঁড়াও, এসব উপমা কবিতা শের সায়েরি লেখা আমার কাজ, তুমি লিখতে যেও না। তা হলে আর আমার বই এক কপিও চলবে না।’
‘তোমাদের বোঝা মুশকিল।’
‘আমাকে দেখছো তো, এজন্য এটা বললে। মঞ্জুকে বোঝা দুই মিনিটের কাজ। আর আমার মা তো আরো সহজ সরল ছিলেন।’
‘উঁহু। তারপরও।’
‘আর তোমাদের বোঝা খুব সহজ? আচ্ছা ভালো কথা, তোমাকে এখন কী নামে ডাকবো? রেনু নাকি মিকরি?’
‘কৃ। শুধু কৃ বলে ডাকতে পারবে না?’
‘আগে কেমন শোনাতো জানি না। তবে এখন এর চেয়ে প্রেমময় ডাক আর কী আছে, বলো কৃ।’
‘ফাজলামো করবে না। অসহ্য!’
‘কী করবো তা হলে? সারাক্ষণ পুতুপুতু করে প্রেমের কথা বলবো? নাকি ওটা..। মানে যেটা আমাদের বিন্তিদের বাড়িতে..।’
উড়ে এসে আমার কোলে জুড়ে বসল রেনু। আমার কাছে এবারও বেখাপ্পা লাগল। ছেলেরা অনেক কিছু অতিকল্পনা করতে ভালোবাসে। বিশেষ করে প্রেমিকাকে নিয়ে। আমার বেলায় অতিকল্পনাগুলোই অতি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। আবারো বুকে ছ্যাঁৎ করে উঠল, স্বপ্ন টপ্ন দেখছি না তো? ঘুম ভেঙে দেখবো রেনু টেনু কেউ নেই। দশটা বেজে গেছে। উঠে তাড়াতাড়ি খেয়ে না খেয়ে অফিস। উফফ। নাহ.. স্বপ্নটাই থাকুক।
‘দেখো, আমাদের যে ক্লাইম্যাক্সওয়ালা জীবন এটার জন্য মানুষ হা-পিত্যেশ করে। মানে সারাক্ষণ হায় হায় করে। এ জন্য একটু টাকাপয়সা হলে মানুষ আর কিছু না হোক প্যারাসুট বেঁধে আকাশ থেকেও লাফ দেয়।’
‘আমরাও লাফ দেব। তোমার ক্লাইম্যাক্স দরকার? এক মাইল উপর থেকে ছেড়ে দেই?’
‘তোমাকে ভয় পাই না।’
‘যদি আর না ধরি? পড়ে তো ভর্তা হয়ে যাবে।’
‘ও….।’
‘কী? কী বুঝতে পেরে গেলে এর মধ্যে আবার।’
রেনুর চোখে প্রশ্নের পাশাপাশি দুশ্চিন্তাও। আমি যা ধরেছি, সেটাই সে ভাবছে কিনা।
‘তুমি আমাকে এ জগতে মেরে ফেলার প্ল্যান করছো না তো? মানে এখানে মরে গেলাম, পরে অন্যজগতে ঘুম থেকে উঠলাম। এরকম একটা সিনেমা দেখেছিলাম একবার। ক্রিস্টোফার নোলানের। সিনেমার নাম ইনসেপশন। স্বপ্নের ভেতর মারা যাওয়া মানে আরেক জগতে ঘুম ভাঙা।’
‘আমাকে রিরিসা সব বলেছে। মানে ওই যে এসেছিল। সমস্যা হলো আমার কিছুই মনে পড়ছে না। কিন্তু…।’
‘আগে বলো আমাকে মেরে ফেলবে কিনা। তা হলে মানসিক প্রস্তুতি নিই।’
‘আমার হাতে মরতে তোমার মানসিক প্রস্তুতি লাগবে?’
‘কী করি বলো প্রিয়, মরি তো প্রতিদিনই, কিন্তু মরলে যে আবার তোমায় দেখবো না।’
‘এত ঘনঘন সায়েরি কপচাবে না। সস্তা হয়ে যাচ্ছো দিন দিন।’
‘ঠিকাছে। এই আমি উঠলাম। আর পাবে না। পালিয়ে যাচ্ছি। দেখি খুঁজে পাও কিনা। ওহ.. ভালো কথা। নীল ফুলের বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করো। কথাটা শেষ করোনি।’
‘থাক, শুনতে হবে না।’
‘মেলোড্রামা ভালো লাগে না। জলদি বলো।’
‘আমার লাগে। তখন শোনোনি কেন!’
গুটি গুটি পায়ে আবার বিছানার দিকে এগোলাম। রেনু ভান করছে সে খুব ভয় পেয়েছে। পিছু হটছে ধীরে ধীরে। তার শাড়ির এক কোনার দখল নিয়ে নিলাম চটজলদি। এক টানে প্যাঁচ ছাড়াতেই পুরোপুরি নগ্ন কৃ। যথারীতি নিয়মমাফিক চুম্বনের ধার ধারলাম না। ঘাড়ের কাছে কামড়ে দিলাম, হালকা রাগ দেখিয়ে। ‘উহ’ শব্দ করে গলা জড়িয়ে ধরল কৃ।
এরপর বিড় বিড় করে বলল, ‘ওরে আমার নীল ফুল।’
আমার মুখে শব্দ নেই। মুখ অন্য কিছু খুঁজছে। কৃ সেটা সহজে পেতে দিতে নারাজ।
‘তুমি ছিলে অনেক উঁচু থেকে দেখা একটা ছোট্ট নীল ফুল।’
‘কত উঁচু থেকে?’
‘তা ধরো বিশ ত্রিশ তলা বিল্ডিং তো হবেই। আমি নিচে তাকালাম, আর দেখলাম তোমাকে। নীল ফুলের মতো। তারপর আমার কী হলো, সব নিয়ম ভুলে গেলাম। সব তুচ্ছ মনে হলো। তোমার স্বাভাবিক জীবনটাও থামাতে পারেনি আমাকে।’
আমার কান দিয়ে কথাগুলো ঢুকে ঢুকে মাথার ওপর দিয়ে নীল রঙের বাষ্পের মতো উবে যাচ্ছে। কারণ আমি তখন আমার দুধে আলতা রঙা ফুলের পাপড়ি নিয়ে ব্যস্ত। দুহাতে বারবার মেপে যাচ্ছি রেনুর দেহের সোনালী অনুপাত।
‘তারপর একদিন ঠিক করলাম, ঝাঁপ দেব। নীল ফুল আমার চাই।’
‘এত উঁচু থেকে ঝাঁপ দিলে তো..।’
‘ঠিক ধরেছো, মরে যাব। কিন্তু মরার ক্ষণিক আগে তো আমি ফুলের খুব কাছে আসতে পারবো, তাই না?’
রেনুর শেষ কথাটায় অন্য কিছু ছিল। আমি থেমে গেলাম। দুজন পাশাপাশি নগ্ন। আমার হাত আলতো করে রাখা রেনুর কোমরে। চোখ রাখলাম রেনুর চোখে। মানুষকে সে যতটা আন্ডার এস্টিমেট করে আসছে, মানুষ আসলে তারচেয়ে বেশি চালাক।
‘আচ্ছা। তা হলে এখন তোমার সেই ঝাঁপ দেওয়ার মুহূর্তটা চলছে?’
‘হুম। এবার তো জেনে গেলে সব। ভালোবাসবে আমাকে?’
‘আমার তো মনে হচ্ছে তুমিও বাস্তবতা বদলাতে পারো।’
রেনু চুপ। স্বীকারোক্তির ইঙ্গিত?
‘মনে হয় পারি। আমি নিশ্চিত নই।’
‘তো আমরা যেমন ছিলাম তেমনটা আবার..।’
‘ওই যে বললাম, নীল ফুলটাকে খুব কাছ থেকে একটুখানি এক মুহূর্ত ছুঁয়ে মরতে চাই। বাস্তবতা বলে আবার কিছু আছে নাকি! আমার বাস্তবতা তো তুমি!’
আমি উঠে ঢকঢক করে গøাস ভরে পানি খেলাম। মাথার ভেতর ফিজিক্স কিলবিল করতে শুরু করলো। রেনুও ঢুকে পড়েছে এর মধ্যে, আমার মাথায়।
‘শোনো, প্লিজ। ঘাবড়ে যেও না। এখনো অনেক সময় বাকি। আর যে এসেছিল সে মিথ্যে বলেনি। আমি তো জানোই মাথার ভেতর ঢুকে পড়তে পারি। আমি রিরিসার সব কথা যাচাই করে দেখেছি।’
‘মানে কী!’ চেঁচিয়েই বললাম কথাটা। আমার নিউরনে নিউরনে যুক্তির ঝড়। রেনুর উপমাটাকে যদি অংকের মতো সাজাই, তবে আমি হলাম রাস্তায় পড়ে থাকা একটা নীল ফুল। সেটা নেওয়ার জন্য ঝাঁপ দিয়েছে রেনু। সে এখন ফুলের খুব কাছে। ফুলটা ছুঁলেই তার কাজ শেষ। এরপর সে মরে যাবে।
‘তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাব। এটাই আমার মৃত্যু। আমাদের সম্পর্কের মৃত্যু।’
‘হেঁয়ালি যথেষ্ট হয়েছে রেনু। এবার সত্যিটা বলো।’
‘নদীর তীরে যাবে?’
‘নদীর তীর সবসময়ই আমার প্রিয় ছিল। এ কারণে সেখানে নিয়ে যেতে। এখন বুঝতে পারছি। আমার মন যা চায় সব তুমি দেবে, তাই না?’
‘তুমি তা চাও না।’
‘সম্ভবত না!’
হাসার চেষ্টা করলো কৃ। আমার রাগের কাছে সহজে হার মানার পাত্রী নয়।
‘আর নদীর তীর না। সদরঘাটে নিয়ে চলো। বুড়িগঙ্গার ময়লা পানির পাশে বসে আমি তোমার কথা শুনতে চাই।’
নগ্ন অবস্থাতেই রেনু আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মন চাইল একবার কাপড় টাপড় পরে নেওয়া দরকার। পরে আবার ভাবলাম, এ জগৎই তো আমার না, আমাদের না। চুলোয় যাক পোশাক।
দুজনে উড়ে গিয়ে পৌঁছলাম একটা জলাভ‚মির মতো জায়গায়। ভোর হতে এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। দুজন গা ঘেঁষে বসে আছি চুপচাপ।
‘তুমি আমার সেই ফুল, যাকে আমি কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারিনি।’
‘তুমি দেখছি আমাকে কপি করতে শুরু করেছো। কবিতা লেখা জীবনানন্দ আর আমার কাজ। তুমি লিখলে সেটা ভয়াবহ একটা বস্তু হবে। কারণ তুমি মন পড়তে জানো। সব পাঠককে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেবে। পরে আমার বই চলবে না।’
‘কেন গালিব কী দোষ করলো?’
‘ওই ব্যাটা ধার করে মদ খাওয়ার জন্য যা খুশি বলতো আর লোকে তাতেই বাহ বাহ করতো।’ ‘কোলে মাথা রেখে শোবে? আজ আর বাধা দেব না।’
‘জাদু টাদু করে আগে জামা-কাপড় পরাও। তা না হলে পরে আবার আরেক ঝামেলা।’
‘এদিকে কেউ আসে না। আমি আগে আসতাম। যখন তুমি ছিলে না।’
‘বলো কী! তোমার বয়স কত! আমি ছিলাম না মানে! এখানে বসে বসে ডায়নোসর দেখতে?’
হাসল রেনু। পরিচ্ছন্ন নির্মল হলেও মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মতো হাসি। ভয়টা হলো তাকে হারানোর। আমার প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি সময় শেষ। এখুনি সিনেমা শেষ হবে, লোকজন বের হয়ে যাবে। রেনু চলে যাবে তার না ফেরার দেশে। আমি আমার বাস্তবতায়। কী ভয়ানক! মনের ভেতর উঁকি মেরে আবার শুনে ফেলল কথাটা।
‘মোটেও ভয়ানক নয়। তুমি তোমার বাস্তবতায় কী করতে শুনি? বিয়ে করতে, সংসার করতে, একসময় স্ত্রী হয়ে যাবে শুধু সঙ্গী। এরপর দুই বুড়ো-বুড়ি, এরপর তো মরেই যাবে। তো আমি কী দোষ করেছি? আমার সঙ্গেও একই জীবন চলুক না?’
‘তুমি সুইসাইড করেছো। নিজেকে জেনেশুনে মেরে ফেললে তুমি।’
‘সব কিছুই তো শেষের দিকে এগিয়ে যায়। আমিও যাচ্ছি না হয়। আর তোমরা মানুষরা যখন কেউ কাউকে খুব করে ভালোবাসো, তখন তো এটা ভাবো না যে একদিন তোমাদের কেউ একজন মরে যাবে।’
‘এটা মানুষের একটা মনুষ্য বৈশিষ্ট্য বুঝলে! এটাই আমাদের জীবন।’
‘কিন্তু সত্য তো এটাই। আমার সত্যের সঙ্গে এ সত্যের কোনো পার্থক্য আছে?’
‘অবশ্যই আছে। আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না। তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে হবে, এটা আমি ভাবতাম না, এখন মাথায় সারাক্ষণ এটাই ঘুরছে।’
‘চিন্তা করো না, বেশি সময় ঘুরবে না। যাবার আগে তোমায় একটা উপহার দিয়ে যাব।’
‘আমি তোমার আর একটা কথাও শুনবো না। দয়া করে পারলে সব ভুলিয়ে দাও। অন্য এক বাস্তবতায় নিয়ে চলো। যেখানে আমি জেমস বন্ড আর তুমি বন্ড গার্ল।’
‘ওটা আবার কী বস্তু! অন্য কোনো দেশে যাবে? আরেকটু বেশি সময় যদি জড়িয়ে ধরতে পারো সোজা অস্ট্রেলিয়া না হয় নিউজিল্যান্ডে…।’
‘আমি নীলগিরি যাব। তারপর সেখান থেকে ঝাঁপ দিব। ঝাঁপ দিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসবো। আমার ইচ্ছা!’
এরপর রেনুর চুম্বনটা প্রত্যাশিত ছিল না। ছিল ঘাবড়ে যাওয়ার মতো। আমার ঠোঁট কেটে একাকার। রেনুর পরনে কিছু নেই যে সেটা দিয়ে চেপে ধরবে। হাত দিয়েই নিজের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করছে। ঠোঁট কাটলে রক্ত একটু বেশিই বের হয়। খুব ভালো হয়েছে। এতক্ষণ আমাকে মানসিক অত্যাচার দেওয়ার কঠিন প্রতিশোধ।
‘হয়েছে। ব্যথা লাগছে না বেশি। এবার কান্নাকাটি থামাও।’
কান্নাকাটি থামাতে বলা ঠিক হয়নি। ফিক ফিক কান্নাটা ভেউ ভেউতে পরিণত হলো। এক সময় সেই কান্না হয়ে গেল অন্যরকম। মানে জাগতিক কোনো প্রাণীর কান্নার মতো মনে হলো না। রেনুর এ দৃশ্য দেখে আমার হাহাকারটা চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল। রেনু কি সেটা বুঝতে পারছে? আমি বুঝতে পারছি, রেনুর হাতে বেশি সময় নেই। আবার হয়তো আছে। সময় জিনিসটাই গোলমেলে। রেনুর হাতে একশ বছর থাকলেও এখন মনে হচ্ছে সেটা না থাকার সমান। কারণ আমাদের এক শ বছর একসঙ্গে কেটে গেলেও একসময় আমি আমার আরেক বাস্তবতায় চলে যাব। বিষয়টা এত দ্রæত কী করে বুঝে যাচ্ছি সেটাও এক রহস্য বটে। হয়তো রেনুই আমাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে।
১৬
সে রাতে আর বিশেষ কিছু হলো না। ঘটনা বলতে, রেনু আমাকে উড়িয়ে নিয়ে কাকডাকা ভোরে বাসায় নিয়ে এলো। এরপর নিজে কোনোমতে শাড়ি পেঁচিয়ে ছুট লাগাল ব্যান্ডেজ নিয়ে আসতে। সঙ্গে আবার পেইনকিলারও। আমি লক্ষী ছেলের মতো ব্যান্ডেজ লাগনোর চেষ্টা করলাম। ঠোঁটে ওসব ব্যান্ডেজ লাগানোর জো নেই। তুলো চেপে বসে রইলাম।
এরপর কদিন পেরিয়েছে জানি না। ঘড়ি পরাই বাদ দিয়েছি। ক্যালেন্ডার দেখার তো প্রশ্নই আসে না। মজার বিষয় হলো খাওয়া দাওয়া বা টাকা নিয়েও চিন্তা করতে হচ্ছে না। ব্যাংক ভর্তি টাকা। কার্ড ঢোকালেই সরসর করে বেরিয়ে আসে নোট।
রেনু আবার কোথায় যেন গেল। ড্রয়িং রুমের টেবিলে পড়ে থাকা নোটবইটায় চোখ পড়ল। নোটবইটা নিতে গিয়েই ধপ করে মনে পড়ল টেবিলটা থাকার কথা আমার বেডরুমে। আর সেই টেবিলে আমার এক গøাস পানি কিংবা একটা জগ থাকার কথা। যদিও বেডরুমের অবস্থান বদলে গেছে এবং আমার আর কিছুই মনে পড়ল না। কাজ না পেয়ে নোটবইটাই উল্টেপাল্টে দেখলাম।
হরেক মন্ত্র লেখা। বেশিরভাগই বশীকরণ টাইপ। মনের মানুষকে নিয়ে নানা কিসিমের মন্ত্র। বাণ মেরে মানুষসহ অশরীরি প্রেতাত্মা মেরে ফেলার মন্ত্রও আছে। শেষের দিকে হাতের লেখা বোঝা মুশকিল। এটা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট পরে হবে। এখন হারমোনিয়াম দিয়ে মন্ত্রসঙ্গীত গাওয়ার ইচ্ছে আমার এখন মোটেও নেই।
ভেবেছিলাম এসবের ব্যাখ্যায় ট্যাখ্যায় যাব না। নিজেকে বোঝানোর জন্য ভাবলাম, একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যাক। মন্ত্র পড়তে হবে একই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বজায় রেখে। এতে শব্দের যে ওঠানামা হয় সেটার কারণে হয়তো স্পেস-টাইম কিংবা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা ধরা যাক প্রাণীর মস্তিষ্ক থেকে নির্গত দুর্বল তরঙ্গটাও প্রভাবিত হয়। এতে কেউ মারা গেলেও যেতে পারে আবার উল্টোপাল্টা দৃশ্যও দেখতে পারে।
নাহ, যুৎসই হচ্ছে না। ভাবনা বাদ দিলাম। লোকে আমার এসব তত্ত¡কথা শুনলে ইগনোবেল নামের একটা বিদঘুটে পুরস্কার পেয়ে যেতে পারি। পিঠের যদি বাম পাশে চুলকায়, আর আপনি যদি একটা আয়নায় তাকিয়ে ডান পাশে চুলকাতে থাকেন, তবে চুলকানিটা চলে যেতে পারে। এ বুদ্ধি আবিষ্কারের জন্যে কাকে যেন একবার ইগনোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। আমার মনে হলো এই মন্ত্রফন্ত্রের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে আমিও ইগনোবেল পেয়ে যেতে পারি।
ইউরোপ আমেরিকায় অবশ্য মন্ত্র অচল। সেখানে চলে ভুডু চর্চা। পুতুল টুতুলের গায়ে খোঁচাখুঁচি করতে হয়। রীতিমতো অসুস্থ মানুষের কাজ কারবার।
নোটবই উল্টেপাল্টে আরেকটা মন্ত্রে চোখ আটকে গেল। নিউজের মতো মন্ত্রেরও হেডলাইন দেওয়া আছে- হরেক দুনিয়া, হরেক সময়। বিড়বিড় করে পড়তে লাগলাম ওটা। কেমন যেন একটা ছন্দ আর তারল্য আছে কথাগুলোয়। একটা শব্দ পড়লে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরেকটা শব্দ চলে আসছে মুখে। যেমন কদম শব্দটার সঙ্গে বর্ষা কিংবা ফুল, আবার কিংবা ধরুন কোনো এক পানশালার এক কোণে বিষণ্ন বসে থাকা মির্জা গালিব। কীসের সঙ্গে কী।
এমন সময় নোটবইয়ের পাতায় একটা অবয়ব। চমকে উঠলাম। ছায়াটা অচেনা! ঘুরে তাকাতেই এক রাশ অন্ধকার। চারদিকে ঘুটঘুটে নিকশ কালো অন্ধকার। আমি যেন অন্ধ হয়ে গেছি। নিজের হাত চোখের সামনে এনেও দেখতে পেলাম না। তবে অনুভব করতে পারছি সব।
কতক্ষণ কাটল টের পেলাম না। সময় জিনিসটা প্রথম থেকেই আমার সঙ্গে ফাজলামো শুরু করেছে। আলো ফুটলো কিনা বুঝলাম না। চারদিকে সাদা। একবার মনে হলো আমি সাদা একটা মহাকাশে ভাসছি। আবার মনে হলো আমি দিক শূন্য একটা স্থানে। যে দিকেই ফিরি না কেন, সেটাই আমার আগের দিক।
পদার্থবিজ্ঞানে ভয়াবহ কোনো প্যাঁচ লেগে গেছে। ভয় যে পাচ্ছি না তা নয়। চারদিকে সব সাদা আর সব অন্ধকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যতক্ষণ না সেখানে দ্বিতীয় কিছু থাকছে। তবে আলো থাকার সুবিধা হলো আমি আমার হাতটা অন্তত দেখতে পাচ্ছি। মরে টরে যাইনি তো?
‘তুমি সুস্থ আছো তুষার।’
‘আমার নাম..।’
‘আমার কাছে তোমার যে ডাইমেনশনাল তথ্য আছে… আচ্ছা, বাদ দাও। আমি কৃ। বলতে পারো.. কৃদের দলনেতাদের একজন।’
‘আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?’
‘কারণ আমি তোমার প্রসঙ্গ কাঠামোর বাইরে। তোমার স্পেস টাইমের সঙ্গে আমাদের মেলে না। এখন তোমার ভাষায় তোমাকে যতটা সম্ভব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি।’
‘জ্বি আমি বুঝতে পারছি। বলুন।’
নিজেকে মনে হচ্ছে এক টুকরো কাগজে আঁকা একটা কার্টুনের মতো, যার সঙ্গে কথা বলছে স্বয়ং শিল্পী। উপমাটা ঠিকঠাক হলো কিনা জানি না। তবে স্বস্তি পেলাম।
‘যাকে তুমি কৃ বলে জেনেছো তার নাম..।’
যে শব্দটা কানে এলো সেটাকে ঠিক অক্ষর দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। আপাতত ওটা একটা ফ্রিকোয়েন্সির মতো মনে করি।
‘তুমি বেশ বুদ্ধিমান। আশা করি তুমি বুঝতে পারবে।’
‘আমার এত বোঝাবুঝির কাজ নেই। আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন। একটু পর রেনু এসে চিল্লাফাল্লা করবে।’
‘ও এখন আসবে না। ও কখন আসবে না আসবে সেটা নির্ভর করছে তোমার সময় কাঠামোর ওপর। তোমার হাতঘড়িতে তাকাও।’
আমি খুব একটা অবাক হলাম না। হাতঘড়ি থাকার কথা নয়। কিন্তু যেটা আছে সেটাও চলছে না। হয়তো ব্যাটারি নষ্ট। এতে কী যায় আসে! সময় তো যাচ্ছে। সময় মানে তো সেকেন্ডের টিক টিক না।
‘রেনু তোমাকে পছন্দ করেছে। এটা নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও অনেক কৃ এ অন্যায় করেছে। আমাদের জাতি..।’
‘অন্যায়?’
ভরাট কণ্ঠস্বরটা অন্যায় শব্দটার প্রতি একটু বেশিই জোর দিয়েছে। মেজাজ গেল বিগড়ে।
‘দেখো, রেনু তোমাকে পছন্দ করে। তাই কিছু করা হচ্ছে না তোমাকে। রেনু আমার ক্রিমানিব্রাসিয়া। এর মানে বুঝবে না।’
আমাকে বোঝাতে হলো না। আমি বুঝতে পারলাম, এটা এক ধরনের সম্পর্ক। একজন মানুষ একটা ছাগলকে ঘাস চেনাতে পারবে, কিন্তু মামাত ভাই বা চাচা শ্বশুর জিনিসটা কী সেটা চেনাতে পারবে না। বিষয়টা ওই রকমই। নিজেকে ছাগলের সঙ্গে তুলনা করায় নিজের প্রতিই রাগ হলো।
‘আমি আগেই বলেছি তুমি বুদ্ধিমান। তবে খুব ছেলেমানুষ। তুমি রেনুর মায়া ত্যাগ করো। তাকে আঘাত করো। তাকে ছেড়ে..।’
‘তার আগে হারামজাদা সামনে আয় একবার। মানুষ দেখেছিস, মানুষের ফাঁদ দেখিসনি।’
কোনো শব্দ শোনা গেল না। আমি পকেট হাতড়াতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম জিনিসটা। নোটবইয়ের একটা পাতা আগেই মার্ক করে রেখেছিলাম। আওড়ে যেতে লাগলাম মন্ত্রটা। সুস্থির একটা ফ্রিকোয়েন্সি বজায় রেখে। দুলে উঠতে শুরু করলো সব। আমি ঘুরতে লাগলাম বন বন করে। তারপর আবার হারিয়ে গেলাম অন্ধকারে। তারপর চোখ মেলে তাকালাম।
‘এক শ পাঁচ ছিল, এখন তিন। সাপোজিটরি দিতে হয়েছিল।’
আমার ইচ্ছে হলো রেনুকে মাঝারি জোরে একটা চুমু খেতে। কিন্তু ঠোঁট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। চুমু খেতে পারলাম না। তার হাত শক্ত করে ধরে রাখলাম। তারপর খানিকটা উপহাসের কণ্ঠে বললাম, ‘তোমার ক্রিমানিবাস না অমনিবাস, কী যেন হন উনি। তার সঙ্গে একটু আগে দেখা হলো।’
কেঁপে উঠল রেনুর হাত।
‘কে হয় তোমার? বাবা টাইপ কিছু নাকি?’
‘হুমম। ওই রকমই বলতে পারো।’
‘আমাকে তো বেশ হুমকি ধামকি দিল। তোমাকে নাকি ছেড়ে দিতে হবে।’
রেনু নাক সিঁটকালো। একদম মানুষের মতোই। এসবের তোয়াক্কা করবে না ঠিক করেছে ও। বাহ, এমন প্রেমিকা কে হাতছাড়া করবে শুনি!
‘তবে আমার মনে একটা বড় ফাইট দিতে হবে। একটা ঝড় আসছে কী বলো। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তুমি কোথায় গিয়েছিলে।’
‘তুমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলে। এরপর দেখি জ্বর। আমি গেছি থার্মোমিটার আনতে।’
‘এর মধ্যে এতকিছু ঘটে গেল।’
‘কিছু না। স্বপ্ন দেখেছো। স্বপ্নও তো দেখার জিনিস। মগজ দেখায়। প্রজেকশন টাইপ। স্বপ্নটাও একটা মহা জটিল ব্যাপার। পৃথিবীতে জটিল জিনিসের ছড়াছড়ি।’
‘মোটেও জটিল কিছু না। তুমি জটিল করে তুলছো। সহজ সরল জিনিসটা হলো আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
‘তুমি তো তোমার নীল ফুল পেয়েই গেছো। এখন কী হবে?’
রেনু হাসল। রহস্যময় হাসি না। ছেলেভোলানো টাইপ হাসি। আমাকে কী ভোলাতে চাইল সেটাই বুঝলাম না।
‘নাকি ফুল এখনো বহু দূর।’
‘নাহ, আসলেই বহু দূর। তোমার সঙ্গে হিজলের বনে ঘুঘুর ডাক শোনা হয়নি, ফাল্গুনের রাতে ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ দেখা হয়নি, সব হয়ে গেলে জীবনানন্দের মতো একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায় ঝরে যাব। আচ্ছা, কৃ দের কি সব শেষ হবে একদিন? মানুষের মতো।’
‘বক বক করো না। কিছুই শেষ হয় না। কিছুই শুরু হয় না।’
‘তুমি যে বললে আগে…।’
‘সব ভুলে যাও। মিথ্যে বলেছি।’
এবার আমি মেয়েভোলানো হাসি হাসলাম। মানে রেনুর কথা একবর্ণ বিশ্বাস করলাম না। এরপর আবার চোখে নেমে এলো রাজ্যের অন্ধকার। ঘুম নয়, ভয় নয়, এ এক অন্য আঁধার। মাথার ভেতর অসংখ্যা মানুষের কথা। সব বদলে যাচ্ছে। বদলে কোথায় যাচ্ছে তা জানি না। অনেকগুলো মানুষের কথা শুনতে পাচ্ছি। থেমে থেমে যাচ্ছে। আটকে যাচ্ছে। চিকুনগুনিয়া জ্বর হলে ভয়াবহ এ অনুভ‚তিটা হয়। আমার হয়েছিল। এবারও কি ওরকম কিছু?
কোনো ব্যথা পাচ্ছি না। আমার মনে হচ্ছে আমি একটু কিছু করেছি, সেটাই ঘটতে যাচ্ছে। বিড়বিড় করে সেই মন্ত্রটাই আবার পড়তে লাগলাম। কেন মন্ত্র পড়ছি আমি? আমি নিশ্চয়ই পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছি। মাথায় পানির ঠাণ্ডা ¯্রােত পড়তেই আবার সব ঠিক। চোখ মেলে তাকালাম। নাহ, কৃ এখনো দেখতে অবিকল লুনার মতোই। হাসছে। স্পষ্ট শুনলাম, জ্বর তো চলে গেছে। চলো একটু উড়িয়ে নিয়ে আসি তোমাকে।
১৭
ঘুম ভাঙলো ঘাসের খোঁচায়। রাতে আমাকে নিয়ে কোথাও আসার আগেই সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পকেটে ফোন বেজে উঠতেই দেখি রেশমার বাবা।
‘তুষার, হ্যালো তুষার! ঘটনা কী কওতো আমারে।’
ঘটান যে কী ও কত প্রকার উনাকে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। কৃর কে যেন একজন এসেছিল আমার কাছে। তিনি আমাকে অনেক কিছুই বোঝাতে পারেননি। অগত্যা ফোন কেটে দিলাম।
এদিক ওদিক তাকালাম। কৃ নেই। পরিচিত সেই কাশবন। তারমানে ঢাকার খুব দূরে যাইনি। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর মনে হলো একটা কিছু হয়েছে।
বাস পেলাম একটা। দৌড়ে উঠে পড়লাম। আপাতত বাসায় যেতে হবে। বাসা ছাড়া যাওয়ার আর জায়গাই বা কোথায়।
ঘুম পাচ্ছে খুব। এত ভোরে ওঠার অভ্যাস নেই। গাড়ির মৃদু কম্পনের সঙ্গে ঘুমের গভীর সম্পর্ক আছে। ঘুম ভাঙল আমার বাসার সামনের স্টপেজে। এরপর রিকশায় চড়ে এলাম বাসায়।
বেডরুমে এলাম। রেশমা নেই। কিন্তু তার ছাপ রয়ে গেছে এখনো। জিনিসপত্র রয়ে গেছে অনেকগুলো। তারমানে পুরোপুরি চলে যায়নি। আবার ফিরে আসতে পারে। জীবনানন্দের সেই শালিকের বেশে আসলেই ভালো। মানুষ হয়ে আসলে মহা ঝামেলা। ডিভোর্সের কথাবার্তা তুলতে হবে। তাকে সাংসারিক ঝামেলা থেকে একটা চিরস্থায়ী মুক্তি দেওয়া জরুরি হয়ে গেছে। যদিও তাকে আমি বেঁধে রাখিনি। কিন্তু ও হয়তো সেটাই ভাবছে।
কৃকে দেখলাম নাশতা বানাচ্ছে। আলু পরোটা নামের একটা সুস্বাদু বস্তু। সঙ্গে আরো কী কী যেন। টক দই দিয়ে সসের মতো একটা জিনিসও আছে। ওটা দিয়ে ভিজিয়ে খেতে হবে।
‘তোমার ঘটনাটা কী বলতো? এই সাত সকালে গিয়েছিলে কোথায়? তোমাকে তো জগিং করা পাবলিক বলে মনে হয় না।’
‘নিয়েই গেলে যখন, তখন উড়িয়ে নিয়ে আসতে। বাস জার্নিটা করতে হতো না।’
কৃ অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। যেন আমার কথা একবর্ণ বুঝতে পারছে না। তারপর আবার নাশতা বানানোয় মন দিল।
‘বাইরে গেলেই যখন তখন বাজার করে আনতে। ঘরে মাছ সবজি কিছু নেই।’
আমি শেষ কবে বাজার করেছি মনে পড়ে না। কৃর মুখেও কখনো এসব শুনিনি।
কলিং বেল বাজল। চমকে উঠলাম। তবে কৃকে বিচলিত হতে দেখলাম না।
কী-হোলে চোখ রাখতেই অপরিচিত একটা মুখ। যাক, বাঁচলাম। নিশ্চয়ই ভুল বাসায় এসেছে।
দরজা খুলতেই মেয়েটা আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে।
‘জ্বি বলুন।’
মেয়েটার চোখ আশ্চর্যরকম টলমল টাইপের। আমাকে আরো অবাক করে টপ করে দুফোঁটা পানি পড়েও গেল।
‘কে আপনি! কী হয়েছে আপনার? কোনো সমস্যা?’
‘তুমি আমাকে চিনতে পারছো না? সাত দিন না যেতে ভুলে গেছো? সাত বছরের সংসার আমাদের।’
নানা ধরনের প্রতারণার কথা শুনেছি। নিত্য নতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হয় প্রতারক দল। ঠাস করে দরজাটা লাগানোর আগেই মেয়েটা হুড়মুড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। প্রতারকের কান্নার মতো মনে হলো না। প্রতারণার কান্নায় এক ধরনের তাল লয় আছে। আসল কান্নায় থাকে না। এত নিখুঁত করে কান্নার দমক ওঠারও কথা নয় কোনো প্রতারকের। আমি সাবধানে মেয়েটাকে ছাড়ালাম।
‘আপনি বোধহয় ভুল করছেন। কী নাম আপনার?’
‘কী হয়েছে তোমার তুষার! আমি রেশমা! আমাকে চিনতে পারছো না!’
শব্দ শুনে এগিয়ে এলো কৃ। ঝামেলার ওপর সোয়া ঝামেলা। কৃকে দেখে কান্না থেমে গেল রেশমার। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ যাকে বলে। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার পরবর্তী কাজ কী হবে। কৃ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি রেশমাকে বলোনি আমাদের কথা?’
‘কাকে?’
‘ওকে.. রেশমাকে?’
‘কিন্তু এ..।’
মাথা চেপে বসে পড়লাম। গোটা মহাবিশ্ব গ্যালাক্সি বø্যাকহোল সব কিছুকে মনে হচ্ছে একটা ময়দার দলা। রুটি বানানোর আগে যেমন ইস্টের গুড়ো মিশিয়ে দলাটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা হয় ওই রকম। এখন কেউ একজন সেই দলাটাকে ধরে মলতে শুরু করেছে। আর বেচারা আমি চাপ খেয়ে ভর্তা হচ্ছি। জটিলতর অবস্থা।
মানুষ হিসেবে নিজেকে ভীষণ ক্ষমতাবাণ ভাবার চেষ্টা করলাম। সব কিছু সহজে নিতে শিখতে হবে। দ্রæত সামলে নিলাম। কিছুই হয়নি এমন ভাব করে রেশমাকে ভেতরে আসতে বললাম। ও হতভম্বের মতো এখনো কৃর দিকে তাকিয়ে আছে।
‘তোমরা বিয়ে করেছো?’
‘ও.. ও হচ্ছে মালতি।’
আমার মাথায় আর কোনো নাম এলো না। কেউ কোনো মেয়ের নাম জানতে চাইলে কেন যেন মালতি নামটাই চলে আসে।
‘আমি মালতি না। আমি লুনা। আমরা বিয়ে করিনি এখনো। তবে করবো। আপাতত লিভ টুগেদার করছি। আপনি তো ওকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন। ডিভোর্সও হয়ে গেছে। আবার ফিরে এসেছেন কেন?’
কৃর কণ্ঠ কেমন স্বাভাবিক শোনাল। কিন্তু ও ওর নাম লুনা বলল কেন? তার মুখে কেমন যেন মানুষ মানুষ টাইপ কথাবার্তা। কৃ তো এমন ছিল না। রেশমা নাম বলা মেয়েটা চোখ মুছতে মুছতে হুট করে কঠোর হয়ে গেল।
‘আমার কিছু জিনিস আছে। সেগুলো নিতে এসেছি। এরপরই চলে যাব।’
আমার অবচেতন মন ভীষণ ব্যস্ত। পিক আওয়ারে কাজ শুরু করেছে যেন। ছুটে গেলাম ড্রয়ারে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করে দিলাম জিনিসটা। মাঝে একবার কৃ জানতে চাইল কী খুঁজছি, তাকে বললাম, বাড়ি ফেরার ঠিকানা। লাল রঙের একটা নোটবই। পারলে খুঁজে দাও।
‘তোমার কালো প্যান্টের পকেটে দেখো। কী সব হাবিজাবি লিখে রেখেছো। তোমার মাথা দেখানো দরকার। যাবে নাকি ডাক্তারের কাছে?’
নোটবইটা পেলাম অবশেষে। পাতা ওল্টাতেই আমার মাথার ভেতর যেন বোমা ফাটল। পুরো নোটবই জুড়ে আমারই হাতের লেখা। কোনো মন্ত্র ফন্ত্র নেই। সব কবিতা। কোথাও দুই লাইন শায়েরি, কোথাও তিন লাইনের জাপানি হাইকু স্টাইলের কবিতা, আবার কোথাও এক লাইন। একটা মন্ত্রও নেই! একেবারে শেষ পাতা পর্যন্ত ওল্টালাম। তাতে বেশ গুছিয়ে লিখেছি, ‘নিরিবিলি পুকুর, ঝ^পাং করে লাফ দিল ব্যাঙটা, আবার নিরব নিথর।’ মানে কী এসবের! গোটা মহাবিশ্ব আমার সঙ্গে ফাজলামো শুরু করেছে? নাকি মহাবিশ্বের চেয়েও বড় কিছু।
অন্তত গোটা দশেকবার চোখ বোলানো হলো নোটবইটায়। নতুন চেহারার রেশমা কিংবা কৃ কোন ফাঁকে লুনা হলো তা নিয়ে ভাবছি না। কারণ আমার নিজের সব কিছু মনে আছে। ওদের নেই। সবশেষ মন্ত্রটা আওড়ে গিয়েছিলাম আমি নিজেই। তারপর শুধু অন্ধকার আর স্বপ্নের মতো অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছিল। আমার মনে পড়েছে সেই প্রথম রাতের কথাও। কিন্তু অল্পের জন্য মনে হচ্ছে ভজগট পেকে গেছে। কৃ যদি মনে করতে না পারে সে কৃ, তবে আমার কৃকে আমি হারাবো। এটা মেনে নিতে পারছি না। মানুষ মানেই স্মৃতি। স্মৃতি ছাড়া মানুষ হয় না।
সময় বা বাস্তবতার তালগোল পাকাক ইচ্ছেমতো। কৃকে আমার চাই।
এমন সময় আবার কলিং বেল বাজল। ছুটে গেলাম। দরজা খুলতেই ফের স্থবির হয়ে গেলাম। এবার ভর করলো আরেক অশরীরি আতঙ্ক। দরজার ওপাশে স্বাস্থ্যবান হাসিখুশি লোকটা আর কেউ নয়, কালিপ্রসন্ন প্রামাণিক!
১৮
আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল, এবার দেখলেন তো ঘটনা। তারপর পকেট থেকে হুবহু আমারটার মতোই আরেকটা নোটবই বের করে বলল, আপনে যেটা খুঁজতেসেন সেটার আসল কপি এইখানে আছে। এবার সইরা খাড়ান। ডাকিনিরে বিদায় করি।
‘বিদায় করি মানে? কীসের ডাকিনি!’
‘মানে ওদের মরণ তো আর মানুষের মতো না। বহুত ঝামেলা। এমন ভাবে সরাইতে হবে, যাতে আর কারো জীবনে ব্যাঘাত ঘটাইতে না পারে। সরেন, ঢুকতে দেন। আমি আপনার মঙ্গলের জন্যই এসেছি।’
আমি সিন ক্রিয়েট করি না। এ শব্দটাকে রীতিমতো ভয় পাই। যাকে বলে স্যোশাল ফোবিয়া। এ টাইপের লোকজনের রাগ উঠলে কাঁপতে থাকে। আমারও তাই হতো। তবে কৃ আসার পর অনেক কিছু বদলে গেছে। আমার সাহস বেড়েছে অনেক। তাই আমি খপ করে কালিপ্রসন্নের শার্টের চেপে ধরলাম। এক ধাক্কায় সামনের দেয়ালে ছিটকে পড়ল। এত শক্তি আমার! অবাক হয়েছি খুব। সেকেন্ডের ব্যবধানে আবার ছুটে গিয়ে খপ করে ধরে ফেললাম ওর দুই পা। এসব আমাকে কেউ শিখিয়ে দেইনি। নিজে নিজে বের করেছি। আক্রমণের শিকার হওয়া লোকটার ব্রেইনটাকে অপ্রস্তুত করে দিতে। সে হয়তো আশা করছিল আমি ঘুষি বাগাবো। তা না করে পা ধরে দুপাশে ছড়িয়ে ধরবো, সেটা আশা করেনি। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মোক্ষম সেই লাথি। কালিপ্রসন্নের কী অতীতের সেই স্মৃতি মনে পড়ল? না পড়লে নেই। এক লাথিতেই কাজ হয়েছে। নাক চেপে বসে পড়েছে হারামজাদা মন্ত্রবাজ।
গোটা জগৎ যেখানে এলোমেলো হয়ে গেছে সেখানে পুলিশি ঝামেলা নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাচ্ছি না। এ কারণেই বোধহয় আলাদা একটা মানসিক শক্তি তৈরি হয়েছে। চাইনিজরা যাকে বলে ‘চি’ ক্ষমতা। ভারতে বলে প্রাণা। কালিপ্রসন্নের এসব ভালোই জানার কথা। তার প্রাণায়ামের আগে প্রাণবায়ু বের করে দিতে হবে। কিন্তু এ যাত্রা কাজটা সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। প্রামাণিককে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিতে চাইলাম। কীভাবে যেন ব্যালেন্স করে নিল ব্যাটা। মাধ্যাকর্ষণকে ফাঁকি দেওয়ার মন্ত্র জানে নাকি! অনেকটা উড়ে এসে আঘাত করলো আমাকে। সোজা চেপে ধরল গলা। ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো একটা অনুভ‚তি হলো।
‘তুই আমার দুলাভাই লাগস না যে তরে আমি বাঁচামু। তবে ওই পেত্নিটারে ছাড়ূম না।’
পেত্নি বিশেষণটা শুনে আমার হাসি পেলেও সেটা আটকে গেল। কারণ গলায় প্রামাণিকের কঠিন হাত।
ঠন করে একটা শব্দ হলো। লুটিয়ে পড়ল প্রামাণিক। বাড়িটা মেরেছে কৃ।
আমি গলা ডলতে ডলতে বললাম, ‘পেত্নি বলায় খেপে গেলে নাকি। আরো আগে আসলেই পারতে।’
প্রামাণিকের জ্ঞান কখন ফিরবে বোঝা যাচ্ছে না। তাকে খাটের হাত বেঁধে রাখা হয়েছে। নোটবইটা নিয়ে নিলাম।
‘ঘটনা কী বলতো? কে এই লোক। দেখেতো সাধু সন্ন্যাসী মনে হচ্ছে।’
‘ঘটনা সত্য। সে এসেছিল তোমাকে ভ্যানিশ করে দিতে।’
‘পাগলের মতো বকো না। আমি পুলিশে ফোন করছি। বড় মামাকে বললেই হবে।’
আমি চোখ কুঁচকে তাকালাম। ‘বড় মামা?’
এবার আমার কাছে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে চলেছে সব। নোটবইয়ের একটা মন্ত্র আমি পড়েছিলাম। তাতেই বদলে গেছে বাস্তবতা। নতুন এক রেশমা এসে হাজির যে এখনো আমার বেডরুম শুয়ে ফোঁপাচ্ছে। সম্ভবত একটু পর কাপড়চোপড় গোছাবে। এর মধ্যে বাস্তবতা আবার বদলে দিতে পারলে ভালো হতো। মেয়েটার জন্য মায়া লাগছে। আমার একটা ভার্সন হয়ত এ জগতে এভাবেই থাকবে। হয়তো আবার ওই আমি এই রেশমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসবে। চট করে বুদ্ধিটা এলো মাথায়।
‘রেশমা! রেশমা!’
ইচ্ছে করে চেঁচিয়ে ডাকলাম। ডাক শুনে তাড়াহুড়ো করে এলো। চোখের পানিতে কাজল লেপ্টে আছে।
‘শোনো, মন দিয়ে শোনো। আসলে তোমাকে সব বলা হয়নি। ও মালতি নয়। ওর আসল নাম তোমাকে বলা যাবে না। অফিসিয়াল সিক্রেট। আমি দুঃখিত। প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাকে কিছু বলবো না। এখন বলছি। তুমি এখুনি জামাকাপড় গুছিয়ে আবার তোমার বাবার কাছে চলে যাবে। গিয়ে বলবে, তুষার একটা বড় ঝামেলায় পড়েছে।’ আবার ভাবলাম কয়েক সেকেন্ড। ‘বলবে পুলিশি ঝামেলায় পড়েছে।’
‘তুমি সত্যি করে বলো কী হয়েছে। আর এই মেয়েটা…।’
‘না এই মেয়েটা আমার বউ না। আমার কলিগ। তার পরিচয় দেওয়া যাবে না। টপ সিক্রেট।’
কৃ কী মনে করে যেন ফোনটা হাত থেকে রেখে স্ট্যাচুর মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ। আমার প্ল্যানটা ধরতে পারার কথা নয় তার।
রেশমা চলে গেল দ্রæত। আমি তাকে কথা দিলাম যে ঝামেলা মিটলে আমি গিয়ে তাকে নিয়ে আসবো।
এবার কৃকে বোঝানোর পালা।
‘তোমার নাম লুনা? একেবারে সার্টিফিকেট নাম?’
‘আমার নাম লুনা! যার পেছন পেছন তুমি ঘুর ঘুর করতে! যার জন্য তুমি হাত কেটে নামটাম লিখতে। যাকে জ্বালাতে জ্বালাতে শেষপর্যন্ত তুমি পটিয়ে ফেলেছিলে। যার জন্য তুমি কেঁদে বুক…।’ আর বলতে পারলো না। তার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠল কৃ। আমার কৃ। এখনকার মতো কান্নাটা উপেক্ষা করতেই হলো।
‘আচ্ছা। তুমি উড়তে জানো তো?’
‘অবশ্যই জানি। এখন উড়ে উড়ে আমি চলে যাব। রেশমা গেছে। আমিও যাব।’
‘তারমানে তুমি আসলেই জানো না?’
‘তুমি ভুলে যাচ্ছো সব তুষার। প্লিজ মনে করার চেষ্টা করো। তোমার কি আলঝেইমার্স বা শর্ট টার্ম মেমোরি লস…।’
‘ওসব কিছু না।’ কালিপ্রসন্নকে দেখিয়ে বললাম, ‘এই লোকটাকে চিনতে তুমি?’
‘না, জীবনেও দেখিনি।’ কান্না থামাল কৃ ওরফে লুনা। কঠিন মেয়ে ছিল লুনা। কান্নাকাটি তাকে মানাত না। এই লুনাকেও দেখে মনে হচ্ছে কান্নাকাটিতে অভ্যস্ত নয়। কোনো পার্থক্য দেখছি না।
‘তবে মনে হয় এ লোকটা আমাকে ফলো করতো। পাত্তা দিতাম না। আমি মামাকে ফোন করছি।’
‘না, না। দরকার নেই। আমি ওর ব্যবস্থা করছি।’
প্রামাণিকের নোটবইই এখন ভরসা। বাস্তবতা বদলাতে হবে আবার। কিভাবে কী বদলাবো জানি না। তবে একজন হয়তো জানতে পারে। তাকে ডেকে আনলে কেমন হয়। কী যেন নাম। রিরিসা!
কৃরও তো একই ক্ষমতা আছে। সে তো নিখুঁতভাবে হিসেব নিকেশ করে বদলে দিতো বাস্তবতা। আমার স্মৃতি আমারই থাকতো। সমস্যা হলো আমি এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে বড় ভুল করে ফেলেছি।
আচমকা মনে হলো প্রামাণিক আমাকে আবার পেঁচিয়ে ধরেছে। ওহ না, কৃ। আমাকে পেঁজা তুলোর মতো করে তুলে নিল। তারপর সোজা নিয়ে গেল বেডরুমে। আমি প্রামাণিকের দিকে তাকালাম।
‘ও থাকুক ওর মতো। সকালে পুলিশে দেব। বলবো চুরি করতে এসেছিল। ধোলাই দিয়ে আটকে রেখেছি।’
‘কিন্তু আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছো কোথায়?’
‘তুমি না বললে আমি উড়তে পারি কিনা। এখন দেখবে তোমাকে কিভাবে ওড়াই।’
কৃর রূপক অর্থে ওড়ানোর কথা শুনে আমার মাথায় শায়েরি চড়তে লাগল, ‘ওহে বোকা মদ। মাতাল হওয়ার আনন্দ তুমি কী করে বুঝবে!’
আমার নিজেকে মনে হচ্ছে সেই মদ। যা পান করতে চলেছে নতুন লুনা। কৃ নয়। লুনার প্রতি টানটা অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। তবে কৃর জন্য ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। আবার মনে হলো কৃ-ই নিজেকে লুনা ভাবছে। এ বাস্তবতা আগাগোড়া মিথ্যেয় ঢাকা। কিন্তু এ মিথ্যেটাও এক প্রকারের সত্যি।
আধ ঘণ্টা পর। আমার মনে হলো আমি সত্যিই উড়ছি। খুব হালকা লাগছে, সঙ্গে ক্লান্তিও। কৃ আমাকে তার বুকে চেপে ধরে শুয়ে থাকতে চেয়েছিল। দম আটকে আসছিল দেখে খানিকটা সাইড পেলাম। জড়িয়ে ধরে রাখলাম ওর পেলব শরীরটা। এই একই বিশেষণ দিয়েছিলাম সেন্ট মার্টিনে থাকতে। ওই স্মৃতি নিশ্চয়ই এখন এই লুনার নেই। হায় স্মৃতি! মানুষ এই স্মৃতির কাছে কত অসহায়! কবিতা নয়, কঠিন বিজ্ঞানসম্মত কথা।
লুকানে শক্ত করে চেপে বোঝার চেষ্টা করলাম, কোনো অনুভ‚তির কণার আদান-প্রদান ঘটে কিনা। কণা টের পেলাম না। পেলাম একগাদা উত্তাপ।
ড্রয়িং রুমের খুটখাট শব্দে সচকিত হই। ছুটে গেলাম। আশঙ্কা সত্য হলো। প্রামাণিক ব্যাটা ভেগেছে। ড্রয়ারে থাকা ওর মন্ত্র লেখা নোটবইটাও নিয়ে গেছে। তবে আমার কবিতাওয়ালা নোটবইটা মেঝেতে পড়ে আছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম।
১৯
কৃ ওরফে নতুন লুনার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাকে ঠিক দাম্পত্য বলা যায় কিনা জানি না। তবে একটা কিছু যে নেই সেটা আমি দিনের পর দিন বুঝতে পেরেছি। আমার একটা চেষ্টা ছিল যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার।
তবে একটা দিনও বাদ যায়নি যে আমি কালিপ্রসন্নকে খুঁজিনি। লোকটার একটা আনুমানিক স্কেচ এঁকে সন্ধান দিন টাইপের পোস্টারও ছেপেছিলাম। তাতেও কাজ হয়নি।
সম্ভবত এভাবে বছরখানেক কেটেছে। আমার কয়েকটা চুল পেকেছে। যার কারণে আমি বুঝতে পারলাম, এবার বুঝি সময়টা নিজস্ব গতিতে চলতে শুরু করেছে।
আমি আরেকটু হলে হয়তো এটাকেই আমার আসল বাস্তবতা বলে মেনে নিতে শুরু করতাম। কিন্তু যা ঘটল তাতে আমি একই সঙ্গে পুলকিত ও চিন্তিত হয়ে পড়লাম। রাতে অফিসে বসে বসে ম্যাগাজিনের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। ফোন এলো কৃর। সে আবার এর মধ্যে একটা স্কুলে চাকরিও জুটিয়েছে। ভীষণ ভয় পেয়েছে এমনভাবে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাসায় আসো। জলদি!
‘কী হয়েছে!’
‘একটা ঘটনা ঘটেছে।’
‘বাসায় চুরি হয়েছে?’
‘না। তুমি আসো। আসলে দেখবে। জলদি আসো।’
‘ফোনে বলো। টেনশনে বাসায় আসার আগেই দেখা যাবে হার্টফেল করে বসে আছি।’
কৃ আমাকে আরো বেশি টেনশনে ফেলার জন্যই বোধহয় লাইনটা কেটে দিল। আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এটা কৃর একটা চালাকি হতে পারে। কীসের চালাকি সেটাও আঁচ করতে পারছি। আমাকে মাঝে মাঝে তার এসব আহ্লাদ মেনে নিতে হয়। আগের কৃ হলে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। পারলে উড়ে উড়ে চলে যেতাম। কিন্তু যতক্ষণ আমি আমার হারানো কৃ’কে ফেরত পাচ্ছি, ততক্ষণ স্বস্তি পাচ্ছি না আসলে।
একবার ভেবে দেখুন যে আপনার জীবনসঙ্গীর মস্তিষ্কটা কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের মতো ফরম্যাট হয়ে গেল। তার মাথায় ভরে দেওয়া হলো অন্য কোনো মেয়ের স্মৃতি। তারপর আবার নতুন করে তাকে আপনার সঙ্গে একটা সম্পর্কে যেতে হলো। আপনার সঙ্গী কি আগের মতো থাকবে? জটিল এ মুহূর্তগুলো আমি এতদিন কিভাবে পার করেছি জানি না। তবে বাসায় আসার পর মনে হলো একটা বিরাট সমাধান পেয়ে গেছি।
কয়েকবার কলিং বেল চাপার পর যখন কৃ দরজা খুলল না। তখন মনে পড়ল পকেটের এক্সট্রা চাবিটার কথা। দরজা খুলে ড্রয়িং রুমে ঢুকেই হা হয়ে গেলাম। কৃ ভাসছে। বেলুনের মতো শূন্যে ভাসছে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজের ব্যালেন্স ঠিক করার। নিচে নামতে গিয়ে আবার উঠে যাচ্ছে। আমি ছুটে গিয়ে খপ করে ধরে ফেললাম তাকে। তারপর ওকে চমকে দিয়ে দীর্ঘ চুম্বন। মনে পড়ে গেল হৈমন্তীর সেই লাইন। আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।
কিন্তু কৃকে ঠিক পাওয়া গেল না শেষ পর্যন্ত। কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না। তার ধারণা বাসা জিন-ভ‚ত টাইপের একটা কিছু ঢুকেছিল। ওরাই তাকে ভাসিয়ে রেখেছিল। ভাগ্য ভালো যে ওই সময় তার হাতে ফোন ছিল। আমি কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না যে সে নিজেই জিন-ভ‚ত টাইপের একটা কিছু।
কৃকে বললাম, মনটাকে স্থির করে ফোকাস করতে। তারপর ওড়ার কথা ভাবতে। কিন্তু কোনো টোটকা সিনেমাটিক পদ্ধতিতে কাজ হলো না। সে ফোকাস তো দূরের কথা উল্টো বলল, আমার মাথাটাই নাকি গেছে।
একবার ভাবলাম কৃকে ছাদ থেকে ফেলে দিলে কেমন হয়? শেষ মুহূর্তে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে সে আবার উড়তে জানবে।
‘কী উল্টোপাল্টা ভাবছো তুমি! খবরদার আমাকে আর ওই নামে ডাকবে না!’
আমি এবার জোকারের মতো গাল চওড়া করে হাসলাম। কৃ আমার হাসির কারণ ধরতে পারল না।
‘কী হলো, এভাবে হাসছো কেন? তুমি আমাকে ছাদ থেকে সত্যিই ফেলে দেবে?’
‘তার আগে বলো তুমি আমার মনের কথা বুঝলে কী করে! আমি তো মুখে কিছু বলিনি।’
খানিক পর মাথা আঁকড়ে ধরলো কৃ। আমি আলগোছে তাকে বুকের কাছে টেনে নিলাম। একটু নাটুকে হলেও দৃশ্যটা মন্দ হলো না। কৃর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর ভাবছি, আমি তোমাকে জীবনেও ধাক্কা দেব না। তুমি না উড়লেও আমার ক্ষতি নাই। যেভাবে আছি সেভাবেই চলুক না সব।
মাথা তুলল কৃ।
‘আই অ্যাম স্যরি। আমি একটু তোমাকে.. ইয়ে মানে.. ভয় পেয়ে গেছিলাম। তুমি চাইলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে টেস্ট করতে পারো। আমি উড়তে পারি কিনা।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
‘চলো ছাদে যাই, তোমাকে ধাক্কা দেব।’
কৃর চোখ আবার বড়বড় হয়ে গেল। স্যরি বলে ভুল করে ফেলেছে এমন একটা ভাব।
‘ঠিকাছে চলো!’
আমি আর তাকে আমার মন পড়ার সুযোগ দিলাম না। হিজিবিজি ভাবতে লাগলাম।
ছাদে অর্ধেক চাঁদের আলো। কার্নিশের কাছে এসে দাঁড়ালাম দুজন। নিচে তাকিয়ে গলা শুকিয়ে গেল। যে প্ল্যানটা করে এসেছি সেটা বাদ দেব কিনা ভাবছি। আগের বাসাটা ছিল পাঁচ তলার। এখন এ জগতের বাসা দেখি বারো তেল তলা। নিচে পিঁপড়ের মতো মানুষ।
অন্ধকারে কেউ দেখবে না।
‘কই ধাক্কা দাও। আমি চোখ বন্ধ করছি। এক দুই তিন গুনবে, নাকি হুট করে ধাক্কা দেবে?’
আমি আবার কৃর দিকে তাকিয়ে জোকারের মতো হাসলাম। তারপর হুট করে খুলে দিলাম মনের দরজা। কৃ আমার দিকে চোখ বড় বড় তাকিয়ে আছে। ওর ‘না..’ বলে চিৎকার কানে আসার আগেই সেকেন্ডে নয় দশমিক আট মিটার ত্বরণে নিচে পড়তে লাগলাম আমি। চিৎ হয়ে পড়ছি। পা নিচে থাকলে বেঁচে থাকার একটা সম্ভাবনা আছে। তাতে আরো বড় ঝামেলা। চোখ বন্ধ করলাম। ঠিক দুই সেকেন্ডের মাথায় ঘটনাটা ঘটল। কড়া একটা ব্রেক টের পেলাম। তারপর উঠছি তো উঠছি।
‘থামো! আরেকটু উঠলে স্ট্রাটোস্ফিয়ার পার হয়ে যাবে। পরে দম আটকে মরবো! নামো জলদি।’
নেমে এলাম মাওয়া ঘাট থেকে মাইল খানেক দূরের একটা চরে। জায়গাটা আমি চিনি। অনেক আগে এসেছিলাম। সামনে পদ্মার বালিয়াড়ি। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে পানি। কৃ আমাকে এখনো ছাড়েনি। আমি নিশ্চিত ছাড়ার পর কী ঘটবে। আমার ধারণা একটু বেশিই সত্য প্রমাণ হলো। আমাকে ছেড়েই প্রথম এলোপাতাড়ি চড় থাপ্পড়। তারপর কিল ঘুষি। তারপর চুমুর পর চুমু। কৃকে এখন আসলেই পেত্নির মতো দেখাচ্ছে। চুমুটা ঠিক উপভোগ করতে পারলাম না। তার শক্তিশালী চড়ে সম্ভবত কোনো একটা দাঁত নড়ে গেছে।
কপাল খারাপ। সে রাতে কৃ আর শত চেষ্টা করেও উড়তে পারলো না। আশপাশে উঁচু ছাদও নেই যে লাফ দেব। আর আমাকে বাঁচানোর তাগিদে কৃ ওড়া শিখে যাবে। যাই হোক লাফ দেওয়ার চিন্তা বাদ। রাতটা কাটিয়ে দিলাম খিদে নিয়েই। ধু ধু চর। কোথাও কেউ নেই।
বীরপুরুষের মতো কৃর দিকে তাকালাম, ‘ভয় করছে?’
‘না করার তো কারণ নেই। এখন ডাকাত ধরলে কী করবে!’
‘ডাকাতের হাত থেকে রামদা কেড়ে নিয়ে তার কল্লা ফেলে দেব।’
‘অ্যাঁ.. আসছে আমার… আচ্ছা.. এমনটা কি আগে.. না না দূর.. কী ভাবছি।’
অন্যমনষ্ক হলো কৃ। আপাতত এটাই দরকার ছিল।
এটাই সুবর্ণ সময়। আমি নিজেকে যতটা সম্ভব সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের মতো উপস্থাপন করে প্রথম থেকে সব বলে গেলাম কৃকে। তাকে কৃ বলেও ডেকেছি কয়েকবার। রাগ করলো না। তবে লুনা হিসেবে তার এতদিনকার স্মৃতি যে মিথ্যা, এটা সে মানতে একদমই রাজি না। আমারও মনে হলো এসব স্মৃতি মিথ্যে নয়। ¯্রফে অন্য জগতের অন্য এক লুনার ভেতর ঢুকে পড়েছে কৃ। সম্ভবত এটাকেই বলে ‘ভর করা’। নিজের অদ্ভুত যুক্তিতে নিজেই হেসে ফেললাম।
রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি দুজন জানি না। ভোরের দিকে গায়ে জোয়ারের পানি লাগতেই উঠে পড়ি। একটা নৌকাও দেখি দোল খাচ্ছে। মাঝি নৌকার ভেতরে সকালের নাশতা বানাচ্ছে। তার সঙ্গে খাতির জমালাম। বললাম বিপদে পড়েছি। রুটি আর চা মিলল। নৌকায় দুলতে দুলতে এমন মজার নাশতা আর খেয়েছি কিনা মনে পড়ে না। কৃ কোন ফাঁকে আবার নদীতে গোসলও সেরেছে। শাড়ি ভেজা। ভেজা শড়িতে তাকে দেখাচ্ছে গ্রামের সেই রেনুর মতো।
উড়তে না পারলেও মানুষের মন পড়াটা কৃর জন্য এখন সহজ কাজ। উঠতে বসতে সবার মন পড়তে পড়তে যখন তার নিজের মনটাই বিষিয়ে উঠল তখন বাদ দিল। আর তখুনি ঝট করে আমার মাথায় আইডিয়াটা এলো। কালিপ্রসন্নকে ধরার একটা রাস্তা পাওয়া গেছে! জটিল কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাট রাস্তা!
‘শোনো, ভালো করে মনে করার চেষ্টা করো ওর চেহারাটা।’
‘করলাম। ফর্সা করে চেহারা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বেঁটে করে। ভুড়িওয়ালা। আর বর্ণনা করত পারবো না! চেহারা আমার বেশ মনে আছে।’
এবার কৃকে নিয়ে গেলাম বাসার নিচের রাস্তায়। আমার বুদ্ধিতে সবার মাথার ভেতর একবার করে ঢুকছে ও। লোকটা পালিয়েছে রাতের বেলায়। রাস্তার লোকজনের খেয়াল করার কথা নয়। তবে সারাদিন খায়নি ও। আশপাশের রেস্তরাঁগুলোতেই গেলাম আগে। কৃকে বললাম, প্রামাণিকের চেহারায় ফোকাস করতে। লোকে অনেক কিছু ভাববে, সেসব অগ্রাহ্য করতে। রাস্তার লোকেদের মন পড়তে পড়তে ভীষণ ত্যক্ত বিরক্ত কৃ, সন্দেহ নেই। তবে একটা রেস্তরাঁর সামনে গিয়ে ইশারা করলো। এখানকার এক ওয়েটারের মগজে প্রামাণিকের স্মৃতিটা আছে। সে প্রামাণিককে একটা বাসে উঠতে দেখেছে। কৃ তার কপালের দুপাশে চেপে ধরলো। স্মৃতিটা আরো পরিষ্কার করতে চায়। পরে আমাকে সে জানাল, বাসের ড্রাইভারের চেহারাও দেখেছে সে। আমরাও ওই রুটের ওই ড্রাইভারকে খুঁজতে বের হলাম। ভাগ্যক্রমে পেয়েও গেলাম। লাস্ট ট্রিপ দিচ্ছিলেন তিনি। কথা না বলে উঠে পড়লাম। উত্তরা পর্যন্ত যেতে হবে কিনা জানি না। তবে কন্ডাক্টরের দিকে তাকিয়েই হাসল কৃ। আহা! মানুষ হিসেবে আমার যে এত বুদ্ধি এটা যদি কৃরা জানত!
কন্ডাক্টরের স্মৃতির কোনো এক জায়গায় প্রামাাণিক রয়ে গেছে, কারণ সে ভাড়া দেয়নি। তার সঙ্গে বাক বিতÐা হয়েছিল। প্রামাণিক নেমে গিয়েছিল বনানীর দিকে। আমরাও নামলাম। পাশের দোকানদারদের স্মৃতিতে নেই। হালকা এক টুকরো স্মৃতি পাওয়া গেল মোড়ের এক ট্রাফিক পুলিশের মস্তিষ্কে। সেটার ওপর ভরসা করে রাস্তা পার হয়ে একদিকে হাঁটতে লাগলাম। আচমকা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল কৃ। আমি তাকে ধরে আইল্যান্ডে বসালাম।
‘ওই লোকটা, কী যেন নাম। একটা কিছু করছে। সে আশপাশেই আছে। নজর রাখছে। আমাদের ওপর।’
আমার মানবমস্তিষ্ক আবার তৎপর হয়ে উঠল। কৃকে ধরে দাঁড় করালাম। খানিকটা হাঁটলেই একটা বসার মতো জায়গা। এমন সময় তিন যুবক পথ আগলে দাঁড়াল। বুঝলাম ছিনতাইকারী। কিন্তু কে তাদের এত রাতে বোঝাবে যে…। আমার কিছু বলার আগেই কৃ তিনজনের দিকে তাকাল। ‘আশফাক, তুমি কি চাও আমি তোমার শিরিন আপাকে সব বলে দেই। কাল থেকে যদি প্রমিজ করো এসব বাদ দেবে, তা হলে আমি কাউকে কিছু বলবো না। আর হ্যাঁ, রিয়াজ তুমি যে আমাদের খুন করার প্ল্যান করছো সেটাও বাদ দাও।,এখানে পাঁচটা সিসিটিভি ক্যামেরা আমাদের দিকে তাক করা। ভালো চাও তো কেটে পড়ো।’
যাক আপদ বিদেয় হতেই ভাবনায় মন দিলাম। প্রামাণিক বনানীর মতো অভিজাত জায়গায় থাকতেই পারে। ওর ক্ষমতা অনেক। টাকাপয়সা বানানো দুই মিনিটের কাজ।
আমি কোথায় যাচ্ছি জানি না। কৃ আমাকে পথ দেখাচ্ছে। নাকি আমরা যেতে প্রামাণিকের কোনো ফাঁদে পা দিতে চলেছি। সেটাও হতে পারে। কৃকে বেশ দুর্বল মনে হচ্ছে। ওই হারামজাদা নিশ্চয়ই আবার মন্ত্রটন্ত্র পড়তে শুরু করেছে।
‘কৃ, চলো আমরা ফিরে যাই।’
‘নাহ.. তোমার বাস্তবতা তোমাকে..।’
‘জাহান্নামে যাক বাস্তবতা। আমার এখন তোমাকে নিয়ে রিকশায় ঘুরতে ইচ্ছে করছে।’
‘মিথ্যে বলো না, তোমার এখন প্রামাণিকের কাছ থেকে নোটবইটা নেওয়ার ফন্দি ঘুরছে মাথায়। তবে তোমার মাথায় একটা কিছু পেয়েছি আমি। তোমার অবচেতন মনে।
‘বলো কী! কী পেয়েছো।’
‘তোমার নিজের নোটবইটা।’
‘ওতে তো হাবিজাবি সব কবিতা লিখেছি। আমি নিজেও জানি না কখন লিখেছি।’
‘কোনো একটা বাস্তবতায় ওটা তুমি লিখেছিলে। তুমি যখন নোটবইটা হারাতে যাচ্ছিলে। তার আগে তুমি কবিতার কোড আকারে লিখেছো। সম্ভবত কোনো একটা বাস্তবতায় আমরা অনেক বছর বেঁচেছিলাম, সেখানে তুমি বসে বসে মন্ত্রের পাঠোদ্ধার করে সেটাকে কবিতার মতো সাজিয়েছো।’
কৃর এসব জানার কথা না। আমার মাথাতেই কোথাও না কোথাও এসব ইনফরমেশন সে পাচ্ছে। এখন দরকার সাইফারের কোড। মানে অনেকগুলো তালার একটা চাবি। সেটা কি বের করতে পারবে কৃ?
একটা অ্যাপার্টমেন্ট। নিচে গেট খোলা। দারওয়ান নেই। সেটাতেই আমাকে নিয়ে অনেক জোর করে ঢুকে পড়ল কৃ। মনে হলো তার নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই। যথারীতি লিফটে উঠে চেপে দিল টপ ফ্লোরের সুইচ। আমরা গিয়ে উঠলাম ছাদে। ছাদের এক প্রান্তে আমাদের দিকে পেছন ফিরে আরামে দাঁড়াও স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছে প্রামাণিক। তার হাতে সেই খঞ্জর। বাঁকানো ছোরা। যেটা দিয়ে সে রেনুকে মারতে চেয়েছিল!
আগের মতো হাসিমুখের বালাই নেই। চোখজোড়া যেন সাদা পাথর। কৃর দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন। এগিয়ে আসতে শুরু করেছে কালিপ্রসন্ন। বিপদের সময় সবার আগে কাজ হলো বড় করে শ্বাস নেওয়া। মাথায় যতটা সম্ভব অক্সিজেন পাঠাতে হবে। মানুষের মগজের শিরায় শিরায় বুদ্ধি। বেশিরভাগই কুবুদ্ধি। যেগুলো আমাদের মাঝে মাঝে মহাবিপদ থেকে বাঁচায়।
কৃ নড়ছে না। সম্মোহীতের মতো তাকিয়ে আছে তান্ত্রিকের দিকে। আমি আলতো করে আমার ব্যাকপকেটে হাত রাখলাম। মানিব্যাগের আড়ালেই ছিল নোটবইটা। বের করে আনলাম দ্রæত। মনে মনে কৃকে সঙ্কেত দিলাম, আমার মাথার আনাচে কানাচে ঢুকে বের করে আনতে বললাম, ঠিক কোন চাবিটা আমি লুকিয়ে রেখেছি আমার লাইনগুলোতে। কৃও আমার ভেতর ঢুকে ফিসফিস করে একটা নাম বলল, ‘কবিতা!’
নোটবই ওল্টালাম। লাইনগুলো আগে কেন পরিচিত লাগছিল পরিষ্কার হলো। এসবই যে আমার কবিতার লাইন তা নয়। অনেকগুলো জীবনানন্দের। চট করে ধরে ফেললাম মন্ত্ররহস্যের বিষয়টা। যখনই কেউ কবিতা বুঝতে যাবে, তার মগজ থেকে একটা সিনক্রোনাইজড তরঙ্গ বের হবে। আমি জানি না। হতে পারে সেটাই আমাদের সঙ্গে অন্য কোনো জগতের এক অদ্ভুত সেতু খুলে দেয়। তাল লয় সুর ঠিক রাখা চাই!
আমার আর কৃর মনে মনে কথা চলছে খুব দ্রæত। প্রামাণিক আর পাঁচ হাত দূরে হবে। তার এগিয়ে আসার ধরনটা ¯েøা মোশন টাইপ। হাতে সময় আছে কিছুটা।
কৃ দাঁড়াতেই পারছে না। আমার কাঁধে মাথা রেখেছে হাঁপাচ্ছে। এতদিন সে আমাকে হাজারটা বিপদ থেকে বাঁচিয়ে এসেছে। আজ আমাকে একটা কিছু করতেই হবে। অদ্ভুত কিছু। প্রামাণিক ব্যাটাকে কবজায় আনতে হবে।
‘পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে, আকাশে আকাশে।’
ভুল হলো না। নোটবইয়ের এমন এক পাতায় লেখা কবিতাটা, যার ওপর ছোট্ট করে প্রামাণিকের নামটা লেখা।
থেমে গেল তান্ত্রিক। আমার দিকে ফিরল। আহত চোখে তাকাল। হাত থেকে খসে পড়ল খঞ্জর। তারপর বিড়বিড় করে পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। ওরা চায় না কৃকে বাঁচিয়ে রাখি।’
‘ওদের গিয়ে বল, পৃথিবীর একজন কবি আমার আলসার বানিয়ে দিয়েছে।’
লুটিয়ে পড়ল প্রামাণিক। এই সুযোগ। ছুটে গিয়ে আলগোছে তুলে নিলাম ওকে। পেছনে কৃ একটা কিছু বলতে চাইল। কে শোনে কার কথা। সোজা দশ তলা থেকে ছুড়ে ফেলে দিলাম ময়লার বস্তার মতো। গভীর রাত। নিচে রাস্তায় কারো গায়ে পড়ার চান্স নেই ভেবে নিশ্চিন্ত হলাম। ফিরে এলাম কৃর কাছে। আগের চেয়ে সুস্থ দেখাচ্ছে তাকে। বরং বলা চলে একেবারে সুস্থ।
‘একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?’
‘আরে নাহ, হারামজাদা একটা বিড়াল। আবার ফিরে আসবে। বিড়ালরা সহজে মরে না। তবে আর কেয়ার করি না। আসুক!’
ধড়াম করে আমাকে জড়িয়ে ধরল কৃ। ধড়াম করে বললাম কারণ জড়িয়ে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ব্যালেন্স হারিয়ে ছাদে পড়ে গেলাম। আকাশ ভর্তি তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মনে হলো কোনো এক গ্রহ থেকে এলিয়েনরা আমাদের কাÐ দেখছে এখন। বড় লজ্জার কথা। অবশ্য আসল এলিয়েন তো আমার গায়ের ওপরই। আমি সবুজ ঘাসের দেশে দারুচিনি দ্বীপের ভেতরটা দেখার মতো অন্ধকারে দেখছি কৃর শরীর। আগে কখনো এতটা মায়াবী মনে হয়নি তাকে। আস্তে আস্তে উপরে উঠতে শুরু করলাম আমরা। ছাদ ছাড়িয়ে আরো উঁচুতে। নিচের স্ট্রিট ল্যাম্পগুলোর আলো মলিন হতে লাগল। এখন শুধু আমাদের মুখোমুখি থাকার অন্ধকারটুকু থাকলেই হয়।
‘বনলতা সেন?’
‘চিনি না। কে সে?’
‘আমি কে তোমার?’
‘তুমি আমার নীল ফুল। আমার এক সমুদ্র নীল ফুল।’
‘আর তুমি আমার অন্ধকার। অন্ধকার রজনী।’
২০
আমি জানতাম সময়টা আসবে। সময়কে এর মাঝে কত কিছুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আমার হাতের হাতঘড়িও বদলেছে অনেকবার। তবু সময়টা কী করে যেন ফসকে গেল।
‘কতদিন উড়ি না আমরা।’
‘এখন উড়তে গেলে তোমার হাড় ভেঙে ফেলতে পারি। এই বয়সে হিপ বোন ভাঙলে বুঝবে কী যন্ত্রণা।’
‘হুমম। তোমার আসল বয়সটা জানা হলো না।’
‘এত শখ কেন, শুনি!’
‘আমি তো বুড়ো হয়ে গেলাম।’
‘আমি হইনি? গোটা এক জীবন কাটিয়ে দিলাম তোমার সঙ্গে। সিনেমা হলে গিয়ে বলিউডের সিনেমাও দেখলাম। বাকি রাখিনি কোনো নদী। বিচিত্র সব খায়েশ আধবুড়োদের।’
‘তারপরও শেষ বলে কিছু নেই।’
‘ইশশ.. এই সত্তরেও শখ মেটেনি?’
‘কে বলবে তুমি কৃ। মানুষ হয়ে গেছো একদম!’
‘বয়সের কথা বললেই মানুষ?’
‘তুমি কি তোমার সেই নীল ফুলের খুব কাছে?’
বিষন্ন হয়ে গেল কৃ। আমি তার ভাঁজ পড়া হাত ধরলাম। আমারও হাতও শুকিয়ে কাঠ। তবু মাঝে মাঝে এখন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক আবেশের আদান-প্রদান ঘটে আমাদের মাঝে।
‘চিন্তুা করো না। তোমাকে তোমার নতুন বাস্তবতার সঙ্গে একটা উপহারও দিয়ে যাব।’
‘আমি তোমার সঙ্গে…।’
‘সেটা তো সম্ভব না মশাই। আমার আর আপনার জীবন এক নয়, মৃত্যুও এক নয়। আমি আমার সব রেখে যাব তোমার জন্য।’
‘আমার আসল বাস্তবতা? যেটাতে আমি যেতে চাই না?’
‘তোমাকে ঘাড় ধরে পাঠানো হবে।’
‘কৃ! প্লিজ!’
কৃ আমার কথার পাত্তাই দিল না। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এ নিয়ে আমাদের অনেকবার কথা হয়েছে, আলাপ হয়েছে, যুক্তিতর্ক, ঝগড়া কত কী। এর মাঝে সেই রিরিসা এসেছিল আরেকবার। পাঁচ ছয় বছর পর পর এসে কী যেন বলে যেত কৃকে। কৃ পাত্তাই দিত না। ততদিনে জীবনানন্দ মুখস্থ করে ফেলেছিল ও। রিরিসাকে একটুও ভয় পেত না। রিরিসার চোখে আমি এক ধরনের ব্যথা দেখতাম। মানুষের মতো নয়। মানুষের মনের ব্যথায় রাগ থাকে না, থাকে লুকানো প্রেম।
কৃ আমাকে সেভাবে কিছু বুঝিয়ে বলতো না। আমিও তেমন বুঝতে চাইতাম না। আমাদের জীবন চলছে ঠিক আগের মতোই।
হাসপাতালের শেষ দিনগুলোতে কৃ আমার পাশে বসে থাকত। সারাক্ষণ বক বক করতো। শেষের দিকে সেও ভুলে যেতে শুরু করলো অনেক কিছু। মানুষের দেহে থাকতে হচ্ছে বলে মানুষের পরিণতিটাই তার হচ্ছিল।
আমি ভয়াবহ সব ভাবনা খুব সহজে ভাবতে লাগলাম। কৃ কি মারা যাবে? কৃ মারা গেলে কী হবে? আমার কী হবে? কৃ আমাকে সবকিছু দিয়ে যাওয়ার কথা বলতো। সেই সব কিছু কী? প্রেম তো সে যা দেওয়ার দিয়েছেই। এক জীবনে এমন নিখুঁত ভালোবাসা আর কোথায় পাবো?
আমার শ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে গিয়েছিল শেষের দিকে। ওই সময় আবার সেই পুরনো কৃকে ফিরে পেলাম। আমার হাত ধরে হাউ মাউ করে কান্না। নার্সরা ভয় পেয়ে ছুটে আসতো। জলদি করে চেক করতো আমার হার্টবিট আছে কিনা। আমি তাদের দিকে সলজ্জ চোখে হাসতাম। বেঁচে থাকার জন্য খানিকটা লজ্জিত বোধ করতাম।
কৃকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো কৌশলই খাটত না। তার দিকে তাকাতে পারতাম না। সে তার নীল ফুল ছুঁয়ে ফেলার খুব কাছে চলে এসেছে। সমস্যা হলো নীল ফুলটা মরবে নাকি কৃ হারিয়ে যাবে সেটা পরিষ্কার না।
তারপর একদিন সেই মুহূর্তটা চলে এলো। আমি বুঝতে পেরেছি ডাক্তারদের মুখের দিকে তাকিয়ে। কৃ পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হতো তাকে। তার কষ্ট দেখে আবার বাঁচার হাহাকার যে আমায় জেঁকে ধরতো না, তা নয়। কিন্তু আজীবন বেঁচে থাকাটা বোধহয় আমাদের এই প্রেমের পরিণতি হতে পারে না। এ এক সূ² প্যারাডক্স।
সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। আমি আসলে জানি না চাঁদটা কত বড় ছিল। তবে হাসপাতালের জানালা দিয়ে আলো আসছিল যথেষ্ট।
কৃ আমার কাছে এসে দাঁড়াল। ঠিক যেমনটা তাকে প্রথম দেখেছিলাম। অবিকল লুনার মতো। বয়সটাও ঝপ করে নেমে এসেছে পঁচিশ-ছাব্বিশের ঘরে। এরপর তার হাত ধরে আমার বলার সময় হলো, ‘তোমার মুখ যেন আমাকে নিয়ে জীবনের অনেক সহজ সৌন্দর্যের ওপর হাত রাখে।’
‘এই এক জীবনানন্দ তোমার মাথা খেয়েছে।’
কৃ আমার কপালে হাত ছোঁয়াল। আজ কি সেই বিশেষ ক্ষণ? মানে আজ সে আমাকে একটা কিছু দিয়ে যাচ্ছে? কৃর চোখে মুখে নেই কষ্টের ছাপ। নাকি এটাও তার প্ল্যান করা। আমাকে হাসিমুখে বিদায় দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র। অনেক আগের সেই অনুভ‚তির কণা টের পাচ্ছি আবার। লাল নীল কণাগুলো আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে ক্রমশ। কানে ঘোলাটে হয়ে প্রতিধ্বণিত হচ্ছে নার্স ডাক্তারদের কথাবার্তা। এরপর একরাশ আলোকিত অন্ধকার যেন আমাকে গ্রাস করে নিল।
২১
চোখ মেলতেই মনে হলো, মাঝে মাঝে এভাবে চোখ মেলেই ঘুমিয়ে থাকা যায়। শর্ত হলো, পাশে কোমল মায়াবি এমন একটা মুখ থাকতে হবে। ঘূর্ণিজলের মতো চোখ মেলে যে কিনা এখন তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি তার গাল স্পর্শ করলাম। সে চোখ বন্ধ করলো না। সেও আমার গাল স্পর্শ করলো। আমি তার চিবুক ধরলাম। সেও। এ এক মজার খেলা বটে।
‘খবরদার, যদি উল্টোপাল্টা..।’
‘আমার কী দোষ। শুরু করেছো তুমি!’
‘ঘুমের মধ্যে কার নাম বিড় বিড় করছিলে শুনি? প্রথম প্রেমিকা?’
‘প্রথম প্রেমিকা মানেই স্পেশাল কিছু এটা কে বলল? তুমিও আমার প্রথম প্রেমিকা। প্রতিটা প্রেমই প্রথম প্রেম।’
‘এটা বাস্তবতা না, বুঝলে সোনা?’
এবার তার ঘাড়ে হাত রাখলাম। বাস্তবতা শব্দটার সঙ্গে যেন বুকের কোণে একটা হাহাকার বেজে উঠলো। সেই হাহাকারটা আবার অন্ধকার নদীর ওপাশে একটা পাখির মতো হারিয়ে গেল। আমি গভীরভাবে তাকিয়ে আছি রেশমার চোখে। তার চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। কেমন যেন একটা প্রবল প্রেম আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আজ সাহস করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। রেশমাও মজা পেয়ে গেল। আরো কাছে নিয়ে এলো মাথা। চোখাচোখি শব্দটা বেশ কঠিন। তাই আমরা এর নাম দিয়েছি চোখচুম্বন।
এরপর রেশমা আমায় শক্ত করে আঁকড়ে খুব কাছ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমার চোখ ফেরানোর জো নেই। তাকিয়ে থাকতেই হবে।
আলতো করে রেশমার পেটে হাত রাখলাম। এটা আমার ইদানীংকার রুটিন। তার গর্ভে আমাদের সন্তান। ইদানীং হাত-পাত ছোড়াছুড়ি শুরু করেছে। ছেলে হলে কী নাম রাখব জানি না, মেয়ে হলে রাখব রেনু। নামটা কেন যেন মাথায় ঢুকে গেছে। যেন এই নামটা মাথার কোনো এক কোণে বেঁচে আছে। একটা নাম হয়ে।