সেন্ট্রাল হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এ এফ এম সেলিমের পরামর্শ : শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিতে গ্রোথচার্ট

শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিতে গ্রোথচার্ট

শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক হচ্ছে কি না, তা জানার জন্য শিশুর ওজন, দৈর্ঘ্য বা উচ্চতা মেপে নির্ধারিত গ্রোথচার্টে নিয়মিত চিত্রিত করতে হয়। এই চার্ট সম্পর্কে বিশদভাবে জানা দরকার। গ্রোথচার্ট, এর গুরুত্ব ও মাপার সঠিক পদ্ধতি নিয়ে লিখেছেন সেন্ট্রাল হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ এফ এম সেলিম

 

নবজাতক ভূমিষ্ঠের পর প্রথম সপ্তাহে ওজন কমে এবং দু-তিন সপ্তাহে ওজন স্থির থাকে। এরপর ধীরে ধীরে ওজন বাড়তে থাকে। প্রথম তিন মাসে প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০ গ্রাম করে ওজন বাড়ে। পরবর্তী মাসগুলোতে আরেকটু কম হারে ওজন বাড়তে থাকে, ৩-১২ মাস বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৪০ গ্রাম ওজন বাড়ে। ৫-৬ মাস বয়সে শিশুর ওজন জন্ম ওজনের দ্বিগুণ হয়, এক বছরে তিন গুণ, দুই বছরে চার গুণ, তিন বছরে পাঁচ গুণ, পাঁচ বছরে ছয় গুণ এবং ১০ বছর বয়সে ১০ গুণ হয়। তবে জন্ম ওজনের পার্থক্যের কারণে একই বয়সী দুটি শিশুর ওজনের কিছু তারতম্য ঘটতে পারে। সঠিক পরিচর্যা ও পুষ্টি পেলে আবার স্বাভাবিক ওজনে পৌঁছে যায়।

 

ওজন নেওয়া কতটা জরুরি

তিন বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসেই শিশুর ওজন নেওয়া উচিত। পর পর দুই মাস শিশুর ওজন যদি না বাড়ে, তবে খেয়াল করতে হবে শিশু পর্যাপ্ত পুষ্টি পাচ্ছে কি না। পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করার পরও যদি অবস্থার পরিবর্তন না হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

 

ওজন ও উচ্চতার চার্ট

শিশুর বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে কি না তা জানতে হলে নিয়মিত ওজন, উচ্চতা নিয়ে গ্রোথচার্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। গ্রোথচার্ট হচ্ছে বৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি একটি চার্ট, যাতে বয়স অনুযায়ী ওজন, উচ্চতা, মাথার পরিধি গ্রাফের সাহায্যে সন্নিবেশিত থাকে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণীত গ্রোথচার্টটি সর্বজনস্বীকৃত। ছেলে ও মেয়ে শিশুর জন্য আলাদা আলাদা  চার্ট রয়েছে।

 

শিশুর বয়স জানা

শিশু কত সপ্তাহ মায়ের গর্ভে অবস্থান করে জন্ম নিয়েছে এবং শিশুর জন্ম তারিখ কবে তা জানতে হবে।

শিশু মায়ের গর্ভে পুরো মেয়াদ অবস্থান করে জন্ম নিলে চিকিৎসা হিসাব মতে, সে প্রায় ৪০ সপ্তাহ মায়ের গর্ভে ছিল। তবে কোনো শিশুর মায়ের গর্ভে অবস্থান কমপক্ষে ৩৭ সপ্তাহের ওপরে হলে এবং এর পর থেকে ৪২ সপ্তাহের মধ্যে যেকোনো সময় জন্ম নিলে সে শিশু পূর্ণমেয়াদি।

 

দৈর্ঘ্য মাপার পদ্ধতি

চিকিৎসকরা শিশুর দৈর্ঘ্য মেপে দেন। এ ছাড়া ঘরোয়াভাবেও দৈর্ঘ্য মাপা যায়। এর জন্য একটি কাঠের টেবিল দেয়ালের সঙ্গে ঠেকিয়ে স্থাপন করুন। একটি মাপার ফিতা নিন। কাপড় মাপার ফিতার চেয়ে ইস্পাতের ফিতা বা লম্ব্বা কাঠের রোলার হলে ভালো হয়। সঙ্গে একটি সাধারণ খাতার আকারের পিসবোর্ড বা খাতার শক্ত মলাট নিন। এবার ফিতাটি টেবিলের ওপর লম্বাভাবে দুটি স্কচ টেপ দিয়ে আটকে দিন। এবার শিশুর কাপড় খুলে চিৎ করে টেবিলের ওপর শুইয়ে দিন। আলতোভাবে তাকে সরিয়ে এমনভাবে দেয়াল বরাবর নিন, যেন তার মাথাটা হালকাভাবে দেয়াল স্পর্শ করে। এবার দুই হাঁটুতে আলতো চাপ দিয়ে এবং কোমর ধরে তাকে একেবারে সোজা করুন। দুই পায়ের পাতা ওপর দিয়ে সোজা করে ধরে খাতার মলাটের মতো পিসবোর্ডটা পায়ের পাতার সঙ্গে লাগিয়ে সোজা করে ধরে রাখুন। এবার শিশুকে মাপুন। এটাই শিশুর দৈর্ঘ্য।

 

উচ্চতা মাপার পদ্ধতি

উচ্চতা মাপার জন্য একটি ছোট বোর্ড বা শক্ত খাতার মলাট নিন। শিশুকে খালি পায়ে দেয়ালের সঙ্গে পিঠ লাগিয়ে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিন। এ ক্ষেত্রে তার পুরো পিঠ, মাথার পেছন দিক এবং পায়ের গোড়ালি দেয়ালে লেগে থাকতে হবে। এবার তাকে সোজা নাক বরাবর সামনের কোনো জিনিসের দিকে তাকাতে বলুন, যাতে ঘাড় খাড়া থাকে। এবার শক্ত বোর্ডটি তার মাথায় তালু স্পর্শ করে এমনভাবে  ধরুন যেন তা সমান্তরালভাবে দেয়াল স্পর্শ করে। যেখানে বোর্ডটি দেয়াল স্পর্শ করল, সেখানে একটি চিহ্ন দিন। এবার শিশুকে সরে যেতে বলুন। এখন নিচ থেকে চিহ্ন দেওয়া স্থান পর্যন্ত দেয়ালের উচ্চতা মাপলেই শিশুর উচ্চতা পাওয়া যাবে।

 

ওজন মাপার পদ্ধতি

ওজন মাপার যন্ত্র দ্বারা শিশুর ওজন মাপা যায়। তা ছাড়া যেকোনো নিক্তি বা পাল্লা দিয়েও শিশুর ওজন মাপা যায়। ছোট শিশুর ওজন মাপার জন্য বাজারের পণ্য বিক্রি করার পাল্লাও ব্যবহার করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিশুকে একটি বড় পাত্রে বসিয়ে নিয়ে ওজন নেওয়া যায়।

বড় শিশুদের জন্য সাধারণত বাথরুম স্কেল ব্যবহার করা হয়, যদিও এ স্কেল সঠিক ওজন দেয় না। তা ছাড়া এ স্কেলে একটি দাগ ১০০ গ্রাম বোঝায়, যা খুবই বেশি। তবে এর চেয়ে উন্নত ধরনের কোনো যন্ত্র না থাকলে বাথরুম স্কেল দিয়েই ওজন মাপা যেতে পারে। ওজন মাপার আগে নিক্তির বা স্কেলের মান শূন্যতে রয়েছে কি না তা ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে।

মাথার পরিধি মাপার পদ্ধতি মাথার পরিধি মাপার জন্য চিকিৎসককে বলা ভালো। ঘরোয়াভাবে মাথার পরিধি মাপলে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

 

কতটা লম্বা হবে

একটি শিশু বড় হয়ে কতটা লম্বা হবে, তা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। যেমন—তার মা ও বাবা কতটা লম্বা, তার খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টি, তার শারীরিক সুস্থতা, পরিবেশ ইত্যাদি অনেক কিছুই এ জন্য দায়ী। তবে মা-বাবার উচ্চতা নির্ণয় করে শিশুর সম্ভাব্য উচ্চতার একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

 

শিশুর সম্ভাব্য উচ্চতা নির্ণয়ের জন্য মা ও বাবার উচ্চতা সেন্টিমিটারে আলাদাভাবে মেপে নিন। এবার সন্তান ছেলে হলে, বাবার উচ্চতা সন্তানের উচ্চতা চার্টের ডান দিকের লাইনে ঋ লিখে চিহ্নিত করুন। এবার মায়ের উচ্চতার সঙ্গে ১২.৫ সেন্টিমিটার যোগ করে একইভাবে ওই লাইনের ওপর মায়ের উচ্চতা M লিখে চিহ্নিত করুন। এবার F ও M-এর মাঝামাঝি জায়গাটি X দিয়ে চিহ্নিত করুন এবং তা কত সেন্টিমিটার হলো তা দেখে নিন। ছেলের সম্ভাব্য উচ্চতা হওয়া উচিত এই X চিহ্নিত উচ্চতা অথবা তার চেয়ে ৮.৫ সেন্টিমিটার কম অথবা বেশির মধ্যে।

 

 

শিশুটি যদি মেয়ে হয়, তবে প্রথমে মায়ের উচ্চতা M দ্বারা সন্তানের উচ্চতা চার্টের ডান দিকের লাইনের ওপর চিহ্নিত করুন। এবার বাবার উচ্চতা থেকে ১২.৫ সেন্টিমিটার বিয়োগ করে বাবার উচ্চতা F দ্বারা চিহ্নিত করুন। এবার M ও F-এর মাঝামাঝি জায়গাটি X দিয়ে চিহ্নিত করুন এবং তা কত সেন্টিমিটার হলো তা দেখে নিন। আপনার মেয়ের সম্ভাব্য উচ্চতা হওয়া উচিত এই X চিহ্নিত উচ্চতা অথবা তার চেয়ে ৮.৫ সেন্টিমিটার কম অথবা বেশি।

https://www.youtube.com/watch?v=Geg0SPadJxM&feature=youtu.be&fbclid=IwAR28UxjTLzBH6rq0RRf7t_WsGFM0gx642XSx29cf1G-DNOoqXl6-mLqW1eo

শিশুশিশুর শারীরিক বৃদ্ধিস্বাস্থ্য