কলকাতায় বসে কথা হচ্ছে বাংলাদেশের এক মেয়ের সঙ্গে। নাম লাকি সাদাত। মুখোমুখি বসেছি দেশপ্রিয় পার্কের এক দক্ষিণ ভারতীয় রেস্তোরাঁয়। বাংলাদেশ, কলকাতা আর দক্ষিণ ভারতের রেস্তোরাঁ—এসব ছাপিয়ে মেয়েটির সঙ্গে আমাদের আলাপ জমে গত মাসের মাঝামাঝিতে। গত তিন-চার মাসে ফাগুন বউ, জয়ী, আমলকী ও কৃষ্ণকলির মতো বেশ কয়েকটি বাংলা ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন লাকি। বাংলাদেশের মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বাওট গ্রাম থেকে লাকির সেই টালিগঞ্জ পর্যন্ত পথ চলার গল্পটি থাকছে এই প্রতিবেদনে। সিরিয়ালে
যেভাবে শুরু
মাধ্যমটা ফেসবুক। লাকির ছোট বোনের খুব শখ ছিল অভিনয় করার। বড় বোন হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে ফেসবুকে খুঁজছিলেন অভিনয় শেখার একটা স্কুল বা গ্রুপ। খুঁজতে গিয়েই পেয়ে যান কলকাতার এফসিপি অ্যাকটিং স্কুলের ঠিকানা ও ফোন নম্বর। যোগাযোগ করে কলকাতায় চলে আসেন ছোট বোনকে নিয়ে। থাকার ব্যবস্থা হয় স্কুলের হোস্টেলে। সেখানে এক সপ্তাহ ছিলেন। এ সময়টায় বোন শিখতেন আর দেখতেন লাকি। তখনই সম্ভবত নিজের গোপন স্বপ্নটা পূরণের চিন্তা করেন তিনি। বোনের সঙ্গে বিভিন্ন শুটিং স্পটে যেতেন লাকি। সেখানেই পরিচয় হয় টালিউড ইন্ডাস্ট্রি নামের এক প্রতিষ্ঠানের কাস্টিং ডিরেক্টর অনিমেষ বাপুলির সঙ্গে। সেখানে দুই বোন মিলে ছবি জমা দেন। তত দিনে ছোট বোন কাজ শুরু করেছেন। পরীক্ষার কারণে দুই বোনই বাড়ি চলে যান।
বাড়ি যাওয়ার সাত দিনের মাথায় ডাক আসে লাকির। ছবি দেখে তাঁকে পছন্দ করেছেন পরিচালক। দ্রুত কলকাতার পথ ধরেন লাকি। যেদিন কলকাতা আসেন, তার পরদিনই দাঁড়াতে হয়েছে ক্যামেরার সামনে। অভিনয়ে হাতেখড়ি বা দক্ষতা ছাড়াই হুট করে ক্যামেরার সামনে? জানতে চাই, ‘আপনার তো অভিনয় সম্পর্কে ধারণা ছিল না। হুট করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে ভয় করেনি?’
লাকি চায়ে চুমুক দেন। তারপর লাজুক মুখে বলেন, ভয় তো ছিলই। কিন্তু সবাই খুব সহজে আপন করে নিয়ে শিখিয়েছেন। এ কারণে সম্ভব হয়েছে।
লাকির পাশে বসে ছিলেন অনিমেষ বাপুলি। বললেন, ‘লাকি সাদাতের মধ্যে একটা অভিনয় প্রতিভা ছিল। এটা আমরা তাঁকে দেখেই বুঝেছি।’ লাকি জানালেন, টালিউড ইন্ডাস্ট্রি থেকে প্রতি সপ্তাহের রোববার অভিনয়ের জন্য কর্মশালা করা হয়, নিজেকে দক্ষ করতে সেখানে নিয়মিত কর্মশালায় অংশ নেন তিনি। তিনি বলেন, ‘অভিনয়ে এখনো দক্ষ হইনি। কিন্তু ভয়টা আপাতত কেটে গেছে।’
লাকি সাদাতলাকি সাদাত
সিরিয়াল ও চলচ্চিত্রের হাত ধরে
লাকি প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন কুসুম দোলা সিরিয়ালের জন্য। সিরিয়ালটির অন্যতম চরিত্র অপার বান্ধবীর চরিত্রে দেখা গেছে লাকিকে। তারপর সাংবাদিক চরিত্রে অভিনয় করেছেন অন্দরমহল সিরিয়ালে। ফাগুন বউ নামের সিরিয়ালে ডাক্তার চরিত্রে। এরপর জয়ী, আমলকী ও কৃষ্ণকলিতেও অভিনয় করেছেন। এখন নিয়মিত শুটিং করছেন ফাগুন বউ এবং ময়ূরপঙ্খী নামের দুটি ধারাবাহিকে। লাকি বললেন, ‘এখানে কখন কোন সিরিয়ালের জন্য ডাক আসে, বলা কঠিন। আগের দিন ফোন করেও ডেট চাওয়া হয়। ফ্রি থাকলে শুটিং করে আসি। এভাবেই চলছে।’
শুধু ধারাবাহিকে নয়, লাকি অভিনয় করেছেন অনুরাগ বসুর একটি চলচ্চিত্রে। চরিত্রটা ছোট, কিন্তু লাকির জন্য এটা অনেক বড় পাওয়া। অনিমেষ জানালেন, অনুরাগ বসুর লাইফ ইন এ মেট্রোর সিক্যুয়েল হচ্ছে। মোট চারটি গল্প মিলিয়ে নির্মিত হচ্ছে ছবিটি। লাকি যে ছবিতে অভিনয় করেছেন, সেটার নাম বিট্টুর স্টোরি। এই ছবিতে অভিনয় করেছেন বলিউডের অভিনেতা অভিষেক বচ্চন। দক্ষিণ ভারতের একটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন লাকি। সেই ছবিতে অভিনয় করেছেন দক্ষিণ ভারতের অভিনেতা পুনিত রাজকুমার।
লাকি জানালেন, বাংলা সিনেমায় অভিনয়ের ব্যাপারেও তাঁর কাছে প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু করা হয়নি। সামনে হয়তো কলকাতার বাংলা সিনেমাতেও দেখা যাবে তাঁকে।
আছে পেছনের গল্প
লাকি গাংনী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী। জানতে চাই, আপনি বাংলাদেশের মেয়ে, সেখানকার নাটকে অভিনয় না করে চলে এসেছেন কলকাতায়। দেশে কাজ করবেন না?
লাকি খুব সহজ করে জবাব দেন, ‘আমি বাংলাদেশে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। এখানে পেশাদার প্রতিষ্ঠান আছে। এটাই সুবিধা। তবে বাংলাদেশে আমার কাজ করার খুব ইচ্ছা।’
লাকি জানালেন, তাঁর বাবা সিঙ্গাপুরপ্রবাসী। মা গ্রামে থাকেন। আরও দুটি বোন আছেন। তাঁরা চাইছেন, লাকি অভিনেত্রী হন। পরিবারের চাওয়া তো আছেই, লাকি নিজেও চাইছেন বড় অভিনেত্রী হতে। সেটা দেশে হোক বা দেশের বাইরে।
এলাকাবাসীও তাঁকে নিয়ে গর্বিত। মেহেরপুরের মেয়েটি কলকাতার টিভি সিরিয়ালে নিয়মিত, এটা কম গর্বের নয়।