হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার : হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলন

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার ওই সময়কার স্মৃতির কথা, আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস বলে যেটা মনে হয়, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, সেখানে কোনো কোনো অংশ আছে, যেখানে লেখক নিজেই যুক্ত হয়েছেন। তাঁর নিজের কথা, পরিবারের কথা আছে_তাঁর বাবার কথা আছে, ভাইবোনের কথা আছে, এমনকি শর্ষিনার পীরের ঘটনাও সেখানে আছে। তারপর কি আপনি ঢাকায় ফিরে এলেন? হল থেকে আর্মি আপনাকে ধরে নিয়ে গেল, সেই সময়টা কখন?

হুমায়ূন আহমেদ : আমি ঢাকায় ফিরে আসিনি। আমার নানা আমাদের ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জে নিয়ে গেলেন। সেখানে যখন মিলিটারির আনাগোনা শুরু হলো, তখন আতঙ্কে আতঙ্কে দিন পার করা। পাকিস্তানি মিলিটারির কাছে যুবক ছেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মানে ভয়ংকর জিনিস। ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে এই অবস্থা। নানাবাড়িতে যুবক ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র তখন তিনজন- আমি, আমার ছোট ভাই জাফর ইকবাল এবং আমার মামা রুহুল আমিন। মিলিটারির হাত থেকে বাঁচার জন্য শেষ পর্যন্ত ঢাকায় চলে এলাম। গ্রাম থেকে ঢাকা অনেক বেশি নিরাপদ মনে হলো।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার ছোট ভাই তো তখন ছোট? আহসান হাবীব?

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, বেশ ছোট, সে ধর্তব্যের মধ্যে না।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি জাফর ইকবালকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন, সেটা কোন মাস? মুক্তিযুদ্ধের মধ্য পর্যায়ে বা যুদ্ধ যখন একেবারে তুঙ্গে তখন?

হুমায়ূন আহমেদ : না, আসলে ঠিক মনে নেই।

ইমদাদুল হক মিলন : আচ্ছা, আমার তো মনে হয়, তখন মে-জুন হবে।

হুমায়ূন আহমেদ : হতে পারে, তখন বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাও শুরু হয়ে গেছে। এ রকম অবস্থা। মোটামুটি পাকিস্তানিরা পরিস্থিতি সামলে ফেলেছে প্রায়। এই অবস্থায় এলাম। আসার পর সরাসরি হলে উঠলাম।

ইমদাদুল হক মিলন : দুজনই?

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, দুজনই। আমি মুহসীন হলে আর সে মুহসীন হলের পাশে_তখন হলটার নাম ছিল জিন্নাহ হল। কিছুদিন পরই মিলিটারি আমাকে রুম থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি কি এই ঘটনাটা বলবেন?

হুমায়ূন আহমেদ : এটা আমি বিভিন্ন জায়গায় লিখেছি। এই প্রসঙ্গটা থাকুক, আমার জন্য খুবই বেদনাদায়ক।

ইমদাদুল হক মিলন : ঠিক আছে। আর দু-একটি কথা এ ক্ষেত্রে জিজ্ঞেস করব, সেটা হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যে বিতর্কটা চলে, আপনি কি স্বাধীনতার ঘোষণাটা আপনার নিজের কানে শুনেছেন?

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, শুনেছি। তখন আমি ছিলাম পিরোজপুরে। আমি আমার বইপত্রেও লিখেছি।

 

ইমদাদুল হক মিলন : এখানে বিতর্কটা হচ্ছে, জিয়াউর রহমান কি তাঁর নিজের ব্যাপারটা বলেছিলেন, নাকি On behalf of our great leader Sheikh Mujibur Rahman এটা বলেছিলেন?

হুমায়ূন আহমেদ : শুরুতেই বলেননি। তবে পরে বলেছেন।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি শুনেছেন?

হুমায়ূন আহমেদ : এর মধ্যে কিন্তু কয়েকবার বলে ফেলেছি যে শুনেছি। আবারও বলছি তবে শোনো মিলন, জিয়ার ভক্তরা খুব রাগ করতে পারে, তার পরও আমি বলব, জিয়াউর রহমান যখন যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তখন কিন্তু আরো অনেকেই  যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় ছিলেন। জিয়াউর রহমান খুবই ভাগ্যবান একজন ব্যক্তি। তাঁর কাছে একটা রেডিও স্টেশন ছিল। তিনি প্রচারটা করতে পেরেছেন। আর বাকি যাঁরা যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের সামনে রেডিও স্টেশনটা ছিল না। তাঁরা প্রচারটা করতে পারেননি। তাঁরা কিন্তু যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন। সেই অর্থে আমি বলব, জিয়াউর রহমান  ভাগ্যবান একজন মানুষ, যিনি এই ঘোষণাটি রেডিওতে দিয়েছেন। ঘোষণাটি আমাদের জন্য খুবই জরুরি ছিল। আমাদের দেশের মানুষের নৈতিক শক্তি ও মনোবল ভেঙে পড়েছিল। তিনি সেটাকে শক্তভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। এই সম্মান তাঁকে দিতে হবে। কাউকে সম্মান জানিয়ে কেউ ছোট হয় না। আওয়ামী লীগের যাঁরা, তাঁরা হয়তো ভাবছেন, জিয়াউর রহমানকে এই সম্মান জানালে তাঁরা ছোট হবেন। ব্যাপারটা মোটেই সে রকম নয়। সেই দুঃসময়ে জিয়াউর রহমান নামের সাহসী মানুষটির ঘোষণা জাতির জন্য প্রয়োজন ছিল।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি জিয়াউর রহমানের বেশ ভালো একটা মূল্যায়ন করলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়নটা কী? তাঁকে কি আপনি জাতির পিতা মনে করেন?

হুমায়ূন আহমেদ : যিনি জাতির পিতা তাঁকে কেন জাতির পিতা বলব না?

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি মনে করেন, তিনি জাতির পিতা বা তাঁকে সেই মর্যাদা দেওয়া উচিত?

হুমায়ূন আহমেদ : অবশ্যই সেই মর্যাদা দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে কারো মনে কোনো সংশয় থাকা উচিত নয়।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার পরিবারের ক্ষেত্রে যেটা হলো, দেশ স্বাধীন হলো এবং আপনার বাবা মারা গেলেন। আপনার বাবার মৃত্যু পুরো পরিবারকে একেবারে ছারখার করে দিল। তারপর আপনার মা আপনাদের ছয় ভাইবোনকে নিয়ে টিকে থাকার সংগ্রাম করতে থাকেন। স্বাধীনতার পরপর আপনার পরিবারের কতকগুলো পেইনফুল ঘটনার কথা আমরা সব সময় শুনি। বাড়িওয়ালা বা পুলিশ এসে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে, অথবা রাস্তায় বসে থাকলেন। এই ঘটনাগুলোর ব্যাপারে কি আপনি বলবেন?

হুমায়ূন আহমেদ : সে সময় বাংলাদেশ সরকার আমাদের একটা বাড়ি দিয়েছিল থাকতে, মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে দোতলা বাড়ির দোতলাটা। ওই ফ্ল্যাটে না ছিল বিদ্যুৎ, না ছিল পানি। গ্যাস তখনো আসা শুরু হয়নি। তো, নিচ থেকে আমরা বালতিতে করে পানি আনতাম খুব কষ্ট করে। তার পরও একটা বাড়ি তো। ভাড়া দিতে হচ্ছে না। এতেই আমরা আনন্দিত ছিলাম। কোনো এক রাতে রক্ষীবাহিনী এসে বাড়ি থেকে সবাইকে বের করে দিল।

ইমদাদুল হক মিলন : রক্ষীবাহিনী তো ১৯৭৪ সালের কথা। তার মানে এটা ‘৭৪ বা ‘৭৫ সাল, তাই না?

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, সে সময়ই। রক্ষীবাহিনী বাড়ি থেকে বের করে দিল। সমস্ত ভাইবোন নিয়ে রাস্তায় বসে আছি আমরা। একজন তো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে। কেউ সেভাবে আশ্রয় দিচ্ছে না। তখন আমরা কাদের সিদ্দিকীর কাছে গিয়েছিলাম, তিনি কিছু করতে পারেন কি না। তিনি তখন ক্ষমতাবান। বাবর রোডেই থাকেন সরকারের দেওয়া বিশাল এক বাড়িতে। তিনি খুবই বিরক্ত হলেন আমাদের ওপর। এসব ঝুটঝামেলা কেন যে তাঁর কাছে আসে_এই ধরনের আর কি!

ইমদাদুল হক মিলন : মানে আপনাদের ওপর সরাসরি বিরক্তি প্রকাশ করলেন উনি?

হুমায়ূন আহমেদ : তা করলেন। তখন দুনিয়ায় মানুষ নানা দেনদরবার নিয়ে তাঁর কাছে যেত। বিরক্ত হতেই পারেন।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসসমগ্র উৎসর্গ করেছেন কাদের সিদ্দিকীকে, সেটার কারণটা কী? তাঁর ওই সময়ের বীরত্বের জন্য?

হুমায়ূন আহমেদ : অবশ্যই।

ইমদাদুল হক মিলন : আর আপনার সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগত যে আচরণ করেছেন, সেটা মাথায় রাখেননি?

হুমায়ূন আহমেদ : না, রাখিনি। আমার সঙ্গে ক্ষুদ্র ব্যবহারের কারণে তাঁর বড় জীবনকে আমি ক্ষুদ্র করে দেখব এত ছোট আমি না।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার যে বইগুলো বেরোল তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসও রয়েছে। আমার ধারণা, আপনার প্রথম মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হচ্ছে ‘নির্বাসন’।

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, ‘নির্বাসন’।

ইমদাদুল হক মিলন : ‘নির্বাসন’-এর নামটা উল্লেখ করছি এ জন্য যে ‘নির্বাসন’ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ঠিকই, এটি এক অর্থে একটি প্রেমের উপন্যাসও।

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ।

ইমদাদুল হক মিলন : এরপর আপনি কতগুলো গল্প লিখলেন ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’, ‘ফেরা’, ‘সৌরভ’; মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প লিখলেন। তারপর ‘আগুনের পরশমণি’ লিখলেন। ‘শ্যামল ছায়া’ আর ‘অনীল বাগচীর একদিন’ লিখলেন। মুক্তিযুদ্ধকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার একটা চেষ্টা আপনি করলেন। এই যে মুক্তিযুদ্ধকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলেন, সেখানে মূল সুরটা কী কাজ করল? একজন লেখক হিসেবে আপনি কী বলতে চাইলেন লেখার মধ্যে?

হুমায়ূন আহমেদ : জটিল প্রশ্ন হয়ে গেল না?

ইমদাদুল হক মিলন : প্রশ্নটি যদি জটিল হয়ে থাকে, তাহলে বলি, আপনার মুক্তিযুদ্ধের লেখাগুলোতে, ধরুন আপনার একটি গল্পের কথা বলি, ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ এই গল্পটার কথা তো আপনার মনে আছে? এই গল্পটার বক্তব্যটাই আপনি বলেন যে আপনি আসলে এই লোকটার মধ্য দিয়ে কী কথাটি বলার চেষ্টা করেছেন। কিংবা ‘শ্যামল ছায়া’র অন্তর্নিহিত বক্তব্যটা কী? মানে লেখকের ব্যাখ্যাটা আমাদের জানা দরকার।

হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, আমার মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘শ্যামল ছায়া’ যখন লিখেছি, সে সময় একদল মুক্তিযোদ্ধা, যারা যুদ্ধ করছে, তাদের প্রচণ্ড ভালোবাসা দেশের জন্য এবং দেশের জন্য যেকোনো সময় তারা তাদের জীবন বিসর্জন দিতে তৈরি তাদের সেই ডেডিকেশন, সেটাই আমি আনতে চেয়েছি। ‘সৌরভ’-এ আমি লিখেছি একদল মানুষের কথা, যারা যুদ্ধে যেতে পারেনি। একজন খোঁড়া লোক, সে কিন্তু ঘরে বসা যুদ্ধে যেতে পারছে না। তার পরও তার সমস্ত মন, সমস্ত ইন্দ্রিয়, সমস্ত শরীর কিন্তু পড়ে আছে যুদ্ধের ময়দানে। সে মানসিকভাবে একজন যোদ্ধা। একদল যারা সরাসরি যোদ্ধা, আরেক দলও যোদ্ধা, যারা মানসিকভাবে যুদ্ধ করছে। ‘অনীল বাগচীর একদিন’-এ ধরার চেষ্টা করেছি হিন্দু সম্প্রদায়ের অবস্থাটা। ‘আগুনের পরশমণি’ উপন্যাসে বলার চেষ্টা করেছি ঢাকায় যখন গেরিলা অপারেশন শুরু হলো, ওই যে একদল ছেলে, যাদের মাথার ভেতরে চে গুয়েভারা; এদের কাছে দেশের চেয়েও হয়তো বড় হচ্ছে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা। দেখো আমরা কী করছি। দেশপ্রেম অবশ্যই আছে। কিন্তু ওই জিনিসটিও আছে। এটাই বলতে চেয়েছিলাম ‘আগুনের পরশমণি’তে। আর সব কিছু মিলে পরে লেখার চেষ্টা করলাম আমার ‘জোছনা ও জননীর গল্প’।

ইমদাদুল হক মিলন : ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ ছাড়াও ‘১৯৭১’ নামেও খুব ভালো একটা লেখা আছে আপনার। এই লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা। আর আপনার লেখার একটা মূল সুর হচ্ছে, সর্বত্রই মানুষের প্রতি আপনার একটা অন্য রকমের মূল্যায়ন থাকে, মানুষের প্রতি এক রকম মমত্ববোধ থাকে। আপনি খারাপ দিকটা দেখাতে চাননি। প্রথম দিকের লেখাগুলোতে চানইনি। মধ্য পর্যায়ের লেখাগুলোতেও চাননি। আপনার কাছে সব মানুষ একটি পর্যায়ে এসে মহৎ হয় যাচ্ছে_মানুষকে আপনি একটি মহত্ত্বের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেন। সে জিনিসটা আপনার মুক্তিযুদ্ধের কোনো কোনো লেখার ক্ষেত্রে আমরা খেয়াল করেছি। যেকোনো দেশদ্রোহী, সেই সময় আমরা যাদের রাজাকার বলতাম, শান্তিবাহিনীর লোক বলতাম, তাদের প্রতিও আপনি মমত্ব দেখিয়েছেন। এটার কারণটা কী?

হুমায়ূন আহমেদ : মানুষের দুটি দিক আছে। অন্ধকার দিকও আছে, আলোকিত দিকও আছে। মানুষের আলোকিত দিক নিয়ে কাজ করার একটা আনন্দ আছে। আলোর স্পর্শটা শরীরের দিক থেকে বোঝা যায়। মানুষের অন্ধকার দিক নিয়ে কেউ যখন কাজ করে, সে ওই অন্ধকার দিকের স্পর্শটা শরীরে কিন্তু অনুভব করে। আমি মনে হয় এই স্পর্শ এড়ানোর জন্যই বেশির ভাগ সময় আলোকিত অংশ নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। আমার নিজের ভেতরেই তো অন্ধকার আছে, বাড়তি অন্ধকার স্পর্শ করব কেন? বরং আলো স্পর্শ করি, অন্ধকারটা কমাই। এটি একটি কারণ হতে পারে।

 

সাক্ষাৎকারসাহিত্যহুমায়ূন আহমেদ