সোমবার সন্ধ্যা। ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপন কুমার রায় ফোনে জানতে পারলেন ধুরং খালের একটি ছোট্ট দ্বীপের মতো জায়গায়
বৃষ্টি-পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন নারী শিশুসহ আটজন। তাঁদের এখনই উদ্ধার করা প্রয়োজন। না হলে স্রোতে ভেসে নিশ্চিত সলিল সমাধি।
এমন তথ্য জেনেই তিনি ফোন করেন জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেনকে। জেলা প্রশাসক তাত্ক্ষণিক তাঁদের উদ্ধারের নির্দেশ দেন। এরপরই পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মী বাহিনী নিয়ে ধুরং খালের তীরে হাজির হন ইউএনও দীপন কুমার রায়। কিন্তু বিধি বাম। ঘটনাস্থলে যাওয়ার উপায় তো নেই, খরস্রোতা খালটিই যেন উল্টো মৃত্যু ভয় দেখাচ্ছিল উদ্ধারকারী দলকে।
এরই মধ্যে সময় রাত ১০টা পেরিয়েছে। এবার ইলিয়াস হোসেন ফোন করেন সেনাবাহিনীর জিওসি, নৌবাহিনীর কর্মকর্তা, কোস্টগার্ড কর্মকর্তা ও ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে। ওই ঘরে বন্দি হয়ে পড়া মানুষদের উদ্ধারের অনুরোধ জানালেন।
জেলা প্রশাসকের ফোন পেয়ে সেনাবাহিনী আটকে পড়াদের উদ্ধার করতে রাজি হয়। কিন্তু বিপত্তি বাধে রাতের অন্ধকারে অভিযান হবে কীভাবে? এক পর্যায়ে সিপডবোট পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। ট্রাকে নেওয়া হবে সিপডবোট। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে সেটা কঠিন বলে জানালেন সেনা কর্মকর্তারা। এরপর নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড কর্মকর্তারাও জানালেন, দুর্গম ফটিকছড়ির ধুরংখালে রাতের অন্ধকারে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর মতো নৌযান নেই। জেলা প্রশাসক আবারও ফোন করেন ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসিকে। এবার সিদ্ধান্ত হলো হেলিকপ্টার যাবে সেখানে। হেলিকপ্টার উড়াল দেওয়ার আগেই বাঁধে নতুন বিপত্তি। রাতের অন্ধকারে ওই দ্বীপ আকাশ থেকে শনাক্ত করা এবং ঘর থেকে মানুষ তোলো আনা কঠিন বলে জানালেন সেনাবাহিনী। কিন্তু মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত অপেক্ষার সুযোগ দিচ্ছে না প্রকৃতি। পাহাড়ি ঢলের কারণে ধুরংখাল তখন খরস্রোতা। দ্বীপে মৃত্যুমুখে আটটি প্রাণ। এপারে উদ্ধারকারী দল। কিন্তু উদ্ধারের অভিযানের জন্য নৌকা, ট্রলার বা সিপডবোড কিছুই নেই।
এক পর্যায়ে এগিয়ে এলেন ধুরং নদীর তীরের ২০ তরুণ। নানুপুর এলাকার বাসিন্দা মহসিন, মেহের আলী, ওসমান, দৌলত মিয়া, তাজুল ইসলাম ও মনসুরের নেতৃত্বাধীন দল জোগাড় করে ফেললেন বাঁশ। এবার বাঁধা হলো চার ভেলা।
ভেলা বাঁধার খবর জানানো হলো জেলা প্রশাসককে। ভেলা নিয়ে ২০ তরুণের উদ্ধার অভিযানের কথা শুনে কিছুটা বুকে সাহস জোগাড় করেন মাদারীপুর জেলার বাসিন্দা ইলিয়াস হোসেন। সঙ্গে কিছু নির্দেশনা দেন। তাঁর নির্দেশনায় ফায়ার সার্ভিস ২০টি লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করে। প্রত্যেকের কোমরে রশি বাঁধা হয় ভেলার সঙ্গে। এরপর উদ্ধারকারী দল যাত্রা শুরু করে।
খরস্রোতা নদীর উজানের দিকে উঠে যাত্রা শুরু করে রাত ১২টার দিকে। চারদিকে ভয়ানক অন্ধকার। খালে খরস্রোত। এরই মধ্যে চার ভেলায় যুদ্ধ শুরু করেন ২০ তরুণ। হাতে টর্চলাইট নিয়ে যাত্রা শুরুর পর পানির সঙ্গেই যুদ্ধ চলে তাঁদের। অবশেষে তাঁরা পৌঁছে যান দ্বীপের ওই বাড়িতে। চারটি ভেলায় তোলা হয় আটকে পড়া আটজনকে। এরপর ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করেন।
এবারও দেখা দেয় বিপত্তি। যেখান থেকে যাত্রা শুরু, সেখানে আর পৌঁছতে পারেননি উদ্ধারকারী দল। জীবন বাঁচাতে সবাই গিয়ে ঠেকে নদীর অন্য তীরের পাহাড়ের ঢালুতে। সেখান থেকে হেঁটে পৌঁছতে তাঁদের সময় লাগবে চার পাঁচ ঘণ্টা। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা নিরাপদে ওই পাহাড়েই ছিলেন।
শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আটজনকে বাঁচানোর উদ্যোগ নেওয়া যুবকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন। তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের পুরস্কৃত করব।’