২০৪১ স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্মার্ট নাগরিক তাদের সিংহভাগই কিন্তু এখন প্রাথমিকের শিক্ষার্থী। স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সমাজ নির্মাণে তাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। জানি না, হরিণাকুণ্ডুর প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আমার সব স্বপ্ন পূরণ হবে কি না! শিক্ষকরা আমার পাশে থেকে সেই স্বপ্নকে পূরণ করবে আশা করি। লিখেছেন সুস্মিতা সাহা। সূত্র: কালবেলা
প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি, একটি শিশুর শিশুকালের সবচেয়ে কোমল ও কঠিন সময়। শিশুর মায়ের কোল থেকে বাইরের পৃথিবীতে পা রাখার প্রথম সোপান আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী আমি ছিলাম না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে পারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের পর।
এই এক বছরে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি প্রাথমিক শিক্ষা কোনো দেশের জাতি গঠনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিশুকাল মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়। কোমল শিশু মন তখন থাকে কাদামাটির মতো।
তাকে তখন যেভাবে গড়া যাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার জীবনটা সেদিকেই ধাবিত হবে। এরকম একজন একজন শিশুর হাত ধরেই এগিয়ে যাবে পুরো সমাজ, জাতি তথা দেশ।
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু প্রত্যন্ত একটি অঞ্চল। ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে এখানেও শুরু হয়েছে উন্নয়নের ছোঁয়া। পুরো উপজেলার আটটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় সব মিলিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৩৪টি। নব্য সরকারিকৃত ৮৪টি।
এখানে অনুমোদিত ৮৫৪ শিক্ষকের পদের মধ্যে কর্মরত আছেন ৭৭৪ জন। মোট শিক্ষার্থী ২২ হাজার ১৯৮ জন। ক্যাচমেন্ট এলাকায় শিশু ভর্তির হার ৯৯.৯৭% জন। ঝরেপড়ার হার ৩.৯০ শতাংশ। এই এলাকায় দারিদ্র্যের হার ৪৮.৯ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দারিদ্র্যের কারণে শিশুর উপস্থিতি কম, এ কথা আর ধ্রুব সত্য নয়।
কেননা সরকার অবৈতনিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ উপবৃত্তি, নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন বই নিশ্চিত করেছে। তদুপরি গ্রামের অনেক প্রত্যন্ত স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থী পাই না। বিদ্যালয়ে গিয়ে মন খারাপ হয়ে যায়। যেখানে শিশুদের কলরবে মুখরিত হবে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, সেখানে গিয়ে দেখি মনমরা শিশু, শিক্ষকদের অবস্থাও তথৈবচ।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সমস্যার গভীরে ঢোকার জন্য নিজের মেয়েকে ভর্তি করলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। চাক্ষুষ করলাম একটি কেজি স্কুল এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মৌলিক পার্থক্য। যখন আমি দুটি সিস্টেমকে মুখোমুখি দাঁড় করালাম, আমার কাছে কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নীতিমালাই এগিয়ে থাকল।
কেজি স্কুলের বুকলিস্ট অনেক বড়। বইয়ের বোঝা নিতে নিতে বাচ্চারা ক্লান্ত। পড়াশোনা পাহাড়সম; বাচ্চাদের ধারণক্ষমতার বাইরে। কেজি ক্লাসের ১০-এর ঘর পর্যন্ত নামতা, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, কঠিন কঠিন ইংরেজি শব্দের বানান এবং অর্থ ইত্যাদি ইত্যাদি পাঁচ বছরের বাচ্চার জন্য অমানবিক।
পড়াশোনা হয়ে যায় ভয়ের তখন। শিটের পর শিট মুখস্থ আর সপ্তাহে সপ্তাহে পরীক্ষা। ক্লান্ত অবসন্ন শিশু তখন একটা খেলার মাঠ খোঁজে; কিন্তু পায় না। কারণ স্কুল যে শুধু ইট-কাঠের তৈরি একটি ভাড়া বিল্ডিং। একচিলতে জায়গাও যে বাড়তি নেই।
অন্যদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বইগুলোর বিষয়বস্তু এত আনন্দদায়ক, এত প্রাঞ্জল এবং বস্তুনিষ্ঠ যে, বাচ্চারা একে অন্যের সঙ্গে খেলতে খেলতে তা শিখতে পারে।
বাচ্চাদের মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতার এই পাঠ্যক্রম বাচ্চাদের চিন্তা করতে শেখায়, সৃজনশীল হতে শেখায় এবং মনের অজান্তেই শেখায় নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম এবং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি।
আমি এখানে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখেছি খেলার মাঠ; বাচ্চারা স্কুল শুরু হওয়ার অনেক আগে আসে। যেসব স্কুলে খেলাধুলার উপকরণ আছে, সেখান থেকে সহজে বাসায় যেতে চায় না। তবুও প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা ভালো না এখানে। তার অনেক বড় একটা কারণ অভিভাবকদের অসচেতনতা।
তারা বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করেন কিন্তু আর কোনো খোঁজখবর নেন না। হাড়-কাঁপানো শীতেও স্কুলে গিয়ে দেখেছি বাচ্চাদের গায়ে শীতের কাপড় নেই, পা খালি। ওদের জিজ্ঞেস করলেই বলে স্কুল ড্রেস বানাতে দিয়েছে অথবা ভেজা। তার মানে বাবা-মা উদাসীন।
স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও খুব জোর করতে পারে না। আমি যেদিন যাই সেদিন অনেক ক্লাসে বাচ্চাদের উপস্থিতি কম থাকে, স্কুল ইউনিফর্ম ঠিকঠাক নেই বলে।
আবার অনেক অভিভাবক ভাবেন, সরকারি স্কুলে পড়ে এত নিয়মকানুন কী? এর অনেক বড় একটা কারণ এরা নিজেরা পড়াশোনা করেনি। জ্ঞানের যে আলো মনকে প্রজ্বলিত করে, মনের অন্ধকার গুহার তালা খুলে দেয়, সেই আলোর স্পর্শ তারা পায়নি।
তাদের নিজেদের জীবনে কোনো স্বপ্ন নেই; লক্ষ্য নেই। তাদের বাচ্চারাও তাই সেই স্বপ্নবিহীন জীবন কাটায়। কারণ, স্বপ্নও দেখা শিখতে হয়। বাবা-মার স্বপ্নই ক্রমে পুঞ্জীভূত হয় শিশুমনে। অভিভাবক সমাবেশে, উঠান বৈঠকে অভিভাবকদের নিয়ে কথা বললাম।
মনে হলো স্কুলে দিতে হয় তাই তারা বাচ্চাকে স্কুলে পাঠায়। এরপর আর তাদের কোনো দায় নেই। কত বোঝাই, কত স্বপ্ন দেখাই, কিছুতেই কিছু হয় না। হতাশ হয়ে ভাবতে থাকি এর থেকে উত্তরণের উপায়! মনে হলো একমাত্র শিক্ষকরাই পারে এ সমস্যার সমাধান করতে।
স্কুলটা, ক্লাসটা যদি তাকে চুম্বকের মতো টানে তবেই আর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো স্কুলের ঘণ্টার শব্দ শুনলেই বাচ্চারা সব কাজ ফেলে স্কুলে দৌড় দেবে। এবার বসলাম শিক্ষকদের নিয়ে। ওরে বাবা! এ দেখি জং ধরা ট্রাঙ্কের তালা। কোনোভাবেই খোলে না।
প্রথমেই সবাইকে দেখালাম একটা সিনেমা, ‘Madam Geeta Rani’. একজন প্রধান শিক্ষক কীভাবে একটা স্কুলের পরিবেশ পাল্টে দিতে পারেন, তার উদাহরণ দিলাম।
স্কুল ঘুরে ঘুরে উপলব্ধি করলাম, শিক্ষক-ছাত্র এ সম্পর্কটা যতদিন গাঢ় না হবে, ততদিন প্রাথমিক শিক্ষার ভিত মজবুত হবে না। মজবুত হতে হলে শিক্ষককে সন্তানের মতো ভালোবাসতে হবে ছাত্রকে। বাচ্চারা খুব ভালোবাসা বোঝে। স্যার যদি তাকে নিয়ে ভাবে, স্বপ্ন দেখে সে অবশ্যই স্কুলে আসবে।
একজন শিক্ষক একজন ছাত্রের জীবনের নায়ক হয়ে উঠতে পারে। আমার এখানে একটি বিদ্যালয় শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানকার বাচ্চারা বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় বিভাগসেরা হয়ে ঢাকায় খেলতে গিয়েছিল। এটা আমাদের জন্য বিরল সম্মানের।
আমি ওদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখলাম, এ কৃতিত্ব সিংহভাগই ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যারা ওদের জন্য বাড়তি সময় দিয়েছে; কোচিং করিয়েছে; পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে; ওদের সুবিধা-অসুবিধা দেখেছে সর্বোপরি ওদের মনে একটি জেদ তৈরি করেছে। এ জেদটারই বড় অভাব।
শিক্ষক যদি তার জীবনের অপূর্ণ জেদটা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গেঁথে দিতে পারে, তবেই সে সার্থক। ২০৪১ স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্মার্ট নাগরিক তাদের সিংহভাগই কিন্তু এখন প্রাথমিকের শিক্ষার্থী। স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সমাজ নির্মাণে তাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে।
জানি না, হরিণাকুণ্ডুর প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আমার সব স্বপ্ন পূরণ হবে কি না! শিক্ষকরা আমার পাশে থেকে সেই স্বপ্নকে পূরণ করবে আশা করি। ২০৪১-এর উন্নত বাংলাদেশে হরিণাকুণ্ডুর শিক্ষার্থীদের অবদান কতটুকু হবে তার ভার এসব শিক্ষকের হাতেই দিলাম।
লেখক : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, হরিণাকুণ্ডু, ঝিনাইদহ