ফলিত গণিত নিয়ে যতো জিজ্ঞাসা

ফলিত গণিত: গাণিতিক বিজ্ঞান এবং বিশেষ জ্ঞানের সংমিশ্রণ
বিজ্ঞানের এক অনন্য শাখা ফলিত গণিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো বহুল প্রচলন না থাকলেও এই বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করার সুযোগ করে দিয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্প খরচে পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়ায় অনেকেই সুযোগ পায় অনন্য এই বিষয়ে পড়ার।
গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী আফসানা মিজান মিমির সাথে একান্ত আলাপচারিতায় ফলিত গণিত সম্পর্কে নানান প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দিয়েছেন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কনক চন্দ্র রায়।
প্রশ্ন: গণিত কি বা গণিত আপনার চোখে কতটা প্রশস্ত বলে মনে হয়?
উত্তর: গ্রিক ‘ম্যাথেমা’ শব্দ থেকে এসেছে ইংরেজি ‘ম্যাথমেটিক্স’ শব্দটি। গ্রিক ম্যাথেমা এর অর্থ জ্ঞান বা শিক্ষা। জ্ঞানের সমার্থক হবার কারণে গ্রিসে জ্ঞানী বা শিক্ষক প্রত্যেককেই গণিতবিদ বা ম্যাথমেটিসিয়ান বলা হত। আর সেজন্য প্রাচীন ও মধ্যযুগের সকল পণ্ডিত – তিনি ধর্মবিদ, ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদ, দার্শনিক, চিকিৎসক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজতাত্ত্বিক যাই হোন না কেন- প্রায় সকলেই গণিতে দক্ষ হতেন। আসলে গণিত ছাড়া কারোই পেশাগত দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব না।
প্রশ্ন: গণিতের অন্যান্য শাখা থেকে ফলিত গণিতকে কিভাবে এগিয়ে রাখবেন?
উত্তর: ফলিত গণিতে অধ্যায়নরত করে শিক্ষার্থীরা আবহাওয়া অধিদপ্তর, নদী গবেষণা অধিদপ্তর, প্রোগ্রামিং, নেটওয়ার্কিং এ পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে যা অন্যান্য শাখার শিক্ষার্থীরা পারবে না। এছাড়াও ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের আধুনিক শাখা। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন জীবনের সফলতাকে একটি সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন, ‘সফলতা= ঢ+ণ+ত; যেখানে, ঢ = কাজ, ণ = খেলাধুলা এবং  ত = অন্যের বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য থেকে বিরত থাকা’। দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো গাণিতিক মডেল দ্বারা উপস্থাপন করা যায়। এই উপস্থাপন করার দক্ষতাই কোনো জাতির গাণিতিক জ্ঞানের গভীরতা প্রকাশ করে। আমাদের অঙ্ক অনুধাবন করার ক্ষমতা আশাব্যঞ্জক, তবে অঙ্ক শেখার মধ্যে পদ্ধতিগত ঘাটতি রয়েছে। আমরা অঙ্ক শুধু অনুশীলন করে যাই, কিন্তু ওই অঙ্কের ব্যবহারিক বা ফলিত বিষয়গুলো মোটেও ভেবে দেখি না। এ কারণেই ছাত্রজীবনে অঙ্কে খুব ভালো করার পরেও গণিত ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন: ফলিত গণিত বিভাগে কোন কোন বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়?
উত্তর: বীজগণিত, জ্যামিতি, ক্যালকুলাস, গাণিতিক বিশ্লেষণ, রৈখিক বীজগণিত, সংখ্যাতত্ত্ব, অন্তরীকরণ সমীকরণ ইত্যাদি স্নাতক পর্যায়ের প্রাথমিক কোর্স হিসেবে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে পড়ানো হয়। সম্পূরক বিষয় হিসেবে থাকে পরিসংখ্যান, পদার্থবিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে কিছু ল্যাব কোর্স রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবহার করে গণিতের প্রাথমিক বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করার সুযোগ থাকে। এ জন্য কিছু ল্যাব কোর্স রয়েছে। এ ছাড়া সি, সি প্লাস প্লাস, ম্যাটল্যাবসহ বেশ কিছু প্রোগ্রামিং ভাষা শেখানো হয়।
অধিকাংশ বাস্তব ক্ষেত্রে গাণিতিক সমীকরণগুলোর সমাধানের সঠিক মান বের করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বিচ্যুতি নিয়ন্ত্রণে রেখে আসন্ন মান নির্ণয় করা হয় এবং এই পদ্ধতিকে সংখ্যাসূচক বিশ্লেষণ বলে। এই পদ্ধতিতে এলগরিদমের মাধ্যমে সমীকরণ সমাধান করা হয় এবং গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিচ্যুতির নিয়ন্ত্রণ এবং নিরূপণ করা হয়। হিসাব কষে বা ক্যালকুলেটরের মাধ্যমে মান নির্ণয় প্রায় অসম্ভব। তাই কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে মান নির্ণয় শেখানো হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখার সমস্যাগুলোকে অন্তরীকরণ সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় এবং সমাধান করা হয়।
চতুর্থ বর্ষে, আংশিক অন্তরীকরণ সমীকরণের তাত্ত্বিক ও সংখ্যাসূচক বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয় কোর্স হিসেবে ফাংশনাল অ্যানালাইসিস শেখানো হয়। মহাকাশ বিজ্ঞানের গাণিতিক বিশ্লেষণের গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে অন্তরীকরণ জ্যামিতি ও টেনসর বিশ্লেষণ পড়ানো হয়। প্রকৌশল, জীববিজ্ঞান, প্রবাহ বলবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে গুণগত বিশ্লেষণের জন্য কিছু কোর্স করতে হয়। এ ছাড়াও আরও নানা বিষয় থাকে। চতুর্থ বর্ষে গণিতের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণামূলক প্রতিবেদন লিখতে হয়। স্নাতকোত্তর পর্যায়েও উচ্চতর গাণিতিক বিশ্লেষণের বিভিন্ন কোর্স চালু রয়েছে।
প্রশ্ন: ফলিত গণিত এ উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ গমনের হার কতটা প্রশস্ত?
উত্তর: দেশের বাইরে সুযোগের অভাব নেই। দেশের বাইরে মাস্টার্স করার ক্ষেত্রে ফলিত গণিত বিভাগ ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে অনেক দিকেই শিফট হওয়া সম্ভব, যেমন- থিওরেটিকাল ফিজিক্স, ইকোনমিকস, নিউরোলজি, এস্ট্রোফিজিক্স, ডেটা সাইন্স, স্পেস সাইন্স,স্ট‍্যাটিসটিকস ইত্যাদি। এক কথায় গণিত প্রয়োজন হওয়া প্র‍্যাক্টিকাল ফিল্ডের অভাব নাই।
প্রশ্ন: শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিতে না পড়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন পড়বে? অন্যদের থেকে আপনাদের আলাদা বিশেষত্ব কী?
উত্তর: বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মধ্যে একমাত্র গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিত বিভাগে স্নাতক কোর্স পড়ানো হয়। ফলিত গণিত বিভাগের কোর্স কারিকুলাম দেশ ও দেশের বাইরের কোর্স কারিকুলাম যাচাই-বাছাই করে অত্যন্ত আধুনিক ও যুগোপযোগী করে প্রনয়ণ করা হয়েছে। আমাদের বিভাগে কোর্স কারিকুলামে গণিত বিষয়ের পাশাপাশি প্রতিটি সেমিষ্টারে কম্পিউটার কোর্স (ব্যবহারিক) সহ বাংলা, ইংরেজি এবং বাংলাদেশের যুক্তিযুক্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা আছে, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
প্রশ্ন: আপনাদের ফান্ডের ব্যবস্থা কেমন থাকে?
উত্তর: ফলিত গণিত বিভাগে অতি স্বল্প খরচ যে অধ্যায়নরত পাশাপাশি দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ রয়েছে। নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিতি ও ভালো রেজাল্টের ওপর বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রশ্ন: চাকরির বাজারে ফলিত গণিতের চাহিদা কেমন?
উত্তর: ফলিত গণিত বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকতা পেশা, ব্যাংকি, বীমা কোম্পানি, সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সহ সকল কর্পোরেট চাকরি কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন: উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে যারা ফলিত গণিতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক তাদের জন্য কি পরামর্শ থাকবে?
উত্তর: উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে যারা ফলিত গণিতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক তাদের জন্য পরামর্শ হলো, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ধারণা থাকলে ফলিত গণিতে চলার পথ সহজ হবে।
প্রশ্ন: সর্বোপরি, যারা ফলিত গণিত নিয়ে লেখাপড়া করছে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
উত্তর: বর্তমান বিশ্বের চাকরি ব্যবসা অর্থনীতি ও সমাজ প্রক্রিয়ায় সকল ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে গণিতের প্রয়োগ হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতোই বাংলাদেশেও ফলিত গণিতের সুবিধা সমূহ বিস্তার লাভ করছে। বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বের ফলিত গণিতের চাহিদা সমন্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাই যারা ফলিত গণিতের ছাত্র ছাত্রী তাদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলার আছে- বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ফলিত গণিত একটা সম্ভাবনাময় পছন্দ, তাই মুখস্ত নয় আত্মস্থ করার মধ্যেই সফলতা অর্জন সম্ভব।
hsc math