ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই, জীবন-মৃত্যুর ভেলায় ভেসে চিঠি ইরফানের

কয়েকমাস আগেই ইরফান খানের নিউরো এন্ড্রোক্রাইন টিউমারে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। পরে ইরফান নিজেই তাঁর নিউরো এন্ড্রোক্রাইন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার খবর জানালে অনেকেই হতবাক হন। তাঁর ভক্তরা, সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, শুভাকাঙ্খীরা অনেকেই তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। পরবর্তীকালে টুইটার, ইরফানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব সূত্রে বিভিন্ন সময় খবর মেলে লন্ডনে তাঁর চিকিৎসা চলছে এবং তিনি চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন। কখনও বা ইরফান নিজেই সোশ্য়াল সাইটের মাধ্যমে তাঁর অসুস্থতা, ও চিকিৎসার খবরা খবর দেন। যদিও এই সময়টা তিনি সমস্ত কিছু সবকিছু থেকে দূরে একান্তে থাকার জন্য সবার কাছে আবেদন করে। তবে এই প্রথমবার তিনি তাঁর অসুস্থতা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সরাসরি কথা বললেন। একটা আবেগঘন খোলা চিঠিতে টাইস অফ ইন্ডিয়াকে ইরফান তাঁর অসুস্থতা ও ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

ইরফান লিখেছেন,

যখন আমি এই বিরল রোগের কথা জানলাম…

” বেশ কিছু সময় কেটেছে আমার নিউরো এন্ড্রোক্রাইন ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছে। এই শব্দটা আমার  শব্দভাণ্ডরে নতুন। এই রোগটা ভীষণ একটা বিরল রোগ। এটা নিয়ে গবেষণাও কমই হয়েছে, তাই এবিষয়টি নিয়ে তুলনামূলকভাবে তথ্যও কম রয়েছে। এটার চিকিৎসাও তাই অনুমানের ভিত্তিতে চলছে। আর আমিই এই বিরল রোগের চিকিৎসার জন্য জন্য চিকিৎসকদের নানান পরীক্ষামূলক পদ্ধতির মাধ্যম।”

(যেন মনে হচ্ছে) আমি একটা অন্য খেলায় ছিলাম, একটা স্পিডে চলা ট্রেনে যাত্রা করছিলাম। যেখানে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল, পরিকল্পনা ছিল, অনেক লক্ষ্য ছিল আমি সেগুলির সঙ্গে ব্যস্ত ছিলাম, হঠাৎ যেন কেউ আমার কাঁধে হাত রাখল আমি তাঁর দিকে তাকালাম, আর সে আমার বলল তোমার গন্তব্য এসে গেছে, এবার নেমে যাও। আমার যেন সবকিছু গুলিয়ে গেল, আমি বলল, না, না আমি এখনও পৌঁছয়নি। সে যেন পাল্টা বলল, না, না এটাই তোমার গন্তব্য।

এই আকষ্মিক ঘটনাই আমায় উপলদ্ধি করালো যে যেন সমুদ্রের মধ্যে অনিশ্চয়তার সঙ্গে তুমি একটা কর্কে ভেসে রয়েছো। অথচ তুমি বেপরোয়াভাবে এটার সঙ্গে লড়াই করার চেষ্টা করছো।

আমার উপর দিয়ে কী গেছে …

এই সময়টা যখন আমি হাসপাতালে গিয়েছে তখন যেন আমার চারপাশে অনেক কোলাহল, একটা ভয়, একটা আঘাত, আতঙ্ক ঘোরাফেরা করছে। সেসময় শুধু একটাই জিনিস আমি নিজের কাছে চাইছিলাম, আমি এই বর্তামান সঙ্কটের মুখোমুখি হতে চাইছিলাম না। আমি আমার পায়ের উপর ভর করে শক্তভাবে দাঁড়াতে চাইছিলাম। ভয়, আতঙ্ক যেন আমার উপর ভর করতে না পারে, আমাকে যেন দুঃস্থ না করে তুলতে পারে।এটাই ছিল আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। আর এটা ঠিক সেসময় যখন এই রোগটা ব্যাথা, কষ্টের কথা আমি জানতে পেরেছিলাম। আর তখন কোনও কিছুই কাজ করে না, কোনও সান্তনা, প্রেরণাই কাজ করে না। তখন সমস্ত পৃথিবী এক হয়ে শুধু কষ্টটাই অনুভব করার থাকে। ঈশ্বরের থেকেও তখন তুমি কষ্টটাই বেশি উপলব্ধি করবে।

চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাত্রা …

আমি যখন হাসপাতালে পৌঁছলাম, এরকম নিখুঁত, থমথমে হাসপাতাল খুব কমই দেখেছি যেটা আমার লর্ডস স্টেডিয়ামের একেবারে বিপরীতে। এটা যেন ‘মক্কা’ (সৌদি আরবের পবিত্র শহর), আমার ছোটবেলার স্বপ্ন। সমস্ত কষ্ট আমার হৃদয়ের মধ্যে রেখে আমি হাস্যরত ভিভিয়ান রিচার্ডসের পোস্টারের দিকে তাকালাম। কিছুই হল না। যেন মনে হল আমি কোনও পৃথিবীর মধ্যেই নেই। হাসপাতালের কোমা ওয়ার্ড টাও আমার ঘরের ঠিক সামনেই ছিল। যখন হাসপাতালে ঘরের ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতাম তখন এক অদ্ভুত উত্তেজনা আমার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। যেন জীবনের খেলা, জীবন মৃত্যুর খেলার মাঝে আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি।  আর আমার একদিকে হাসপাতাল, অন্যদিকে খেলার স্টেডিয়াম। আর যখন কেউ এসবের কোনও কিছুরই আর অংশ থাকে না, তখনই সবকিছ শান্ত হয়ে যায়। না হাসপাতাল, না খেলার মাঠ, আর এটাই আমায় আঘাত করল। …….

জীবনের সঙ্গে লড়াই …

এই অনুভূতিগুলোই আত্মসমপর্ণ করতে শেখালো, বিশ্বাস করতে শেখালো। আজ থেকে ৮ মাস, কিংবা ৪ মাস, কিংবা ২ বছর। যেন মনে হল পিছনের আসনে বসে আমি আমার ভাগ্য দেখতে পাচ্ছি।  এই প্রথমবার আমি অনুভব করলাম স্বাধীনতা আসলে কী?  এটা যেন একটা সিঁড়ির মতো। যেন তুমি তোমার জীবনকে প্রথমবার চেখে দেখার চেষ্টা করছো। এটার একটা জাদুও আছে। এই সময় আমার আত্মবিশ্বাস, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে যেন নিসর্গের উপর পরম আস্থা তৈরি হয়। আর এটাই যেন আমার শরীরের প্রতিটা সেলের মধ্যে বিঁধে যায়। সময়ই বলবে এটা থাকবে কি থাকবে না। এটাই সেই অনুভূতি যেটা আমি অনুভূব করেছিলাম।

আমার এই গোটা যাত্রা পথে মানুষ আমার আরোগ্য কামনা করেছে। এরাঁ সেই সমস্ত মানুষ যাঁদের আমি চিনি আবার অনেককেই আবার চিনি না। আমার বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে প্রার্থনা করেছেন অথছ প্রার্থনা কিন্তু একটাই। এটা বড় শক্তি যেটা আমার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে শিরার মাধ্যমে আমার মাথাক মুকুট হয়ে দাঁড়িয়েছে।…..

এসব থেকেই আমার অনুভূতি হয়েছে যে সমুদ্রের মধ্যে ভেসে থাকা কর্কটি আর আয়ত্তের মধ্য রাখার দরকার নেই। তুমি প্রকৃতির নিয়মের মধ্যে জীবনকে উপভোগ করতে পারো।