প্রেম নয়, ভাইবোনের সম্পর্ক ছিল: শাবনূর

শাবনূর তাঁর সময়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী একজন চিত্রনায়িকা। ২৫ বছর আগের আজকের দিনে ‘চাঁদনি রাতে’ ছবির মধ্য দিয়ে ঢালিউডে অভিষেক ঘটে এই নায়িকার। প্রথম ছবি ‘চাঁদনি রাতে’ দিয়ে সাফল্য না পেলেও একসময় ঠিকই বাংলাদেশি সিনেমার রানি হয়ে ওঠেন শাবনূর। ববিতা, কবরী, শাবানা, চম্পা, দিতির পরবর্তী সময়ে দেশের সিনেমায় রাজত্ব করেছেন এই নায়িকা। ২৫ বছরের পথচলা কেমন ছিল—জানালেন এই নায়িকা।

আজ কার কথা বেশি মনে পড়ছে?

কখনো ইচ্ছে ছিল না সিনেমার নায়িকা হব। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়েছিলেন গুণী নির্মাতা এহতেশাম। তিনি ছিলেন আমার অভিভাবক। তাঁকে দাদু বলে ডাকতাম। আজকের এই দিনে তাঁর কথাই বেশি মনে পড়ছে। চলচ্চিত্রের কারণে দেশের মানুষ এখনো আমাকে ভালোবাসেন। ২৫ বছর আগে দাদু তা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমার মধ্যে শাবানা আপুর প্রতিচ্ছবি আছে। একদিন আমার নামও শাবানা আপু, ববিতা আপুদের নামের সঙ্গে উচ্চারিত হবে। তা-ই তো হচ্ছে। অভিনয় দিয়ে চেষ্টা করেছি মানুষের মন জয়ের, জানি না, কতটা পেরেছি।

প্রথম দিন শুটিংয়ে কোন দৃশ্যটি ধারণ করা হয়?
ছোট্ট এক সংলাপ, নায়ককে বলতে হবে, ‘এই চোর, চোর বেটা!’ প্রথম শট ওকে। এরপর ছিল গানের দৃশ্য। ফাইনাল দৃশ্য ধারণের আগে মহড়া করেছিলাম। অনেকে ভেবেছিলেন, এই পিচ্চি মেয়ে আবার কী এমন নাচবে? ঠিকমতো নাচের মুদ্রা তুলতে পারবে তো। কত এনজি শট হবে, তার কোনো ঠিক নেই। পরদিন শুটিংয়ে মেকআপ করা আমাকে দেখে কে একজন বলল, এ দেখি পুরাই ববিতা! এরপর যখন নাচ শুরু করলাম, সবাই অবাক।

শুটিংয়ের আগে যতটা আলোচনা ছিল ‘চাঁদনি রাতে’, মুক্তির পর সেভাবে হয়নি। মন খারাপ হয়েছিল?
একদমই না। মন খারাপের কিছু তো নেই। ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সাফল্য না পেলেও আমাকে নিয়ে কিন্তু ঠিকই আলোচনা হয়েছিল। আমাকে এহতেশাম দাদুও উৎসাহ দিয়েছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন। আমিও বিশ্বাসী ছিলাম, মন দিয়ে কাজ করে গেলে ঠিকই সফল হব। পরের বছর ঠিকই সাফল্য পাই। আমাদের ছবিটি তো সুপারডুপার হিট হয়।

শাবনূর

ছবিটির নাম ‘তুমি আমার’?
ঠিক বলেছেন। ১৯৯৪ সালে এই ছবি ঈদে মুক্তি পেয়েছিল। ছবিটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছিলেন জহিরুল হক ও তমিজ উদ্দিন রিজভী। এটি ছিল আমার আর সালমান শাহ অভিনীত প্রথম ছবি। তার আগে সালমান শাহ অবশ্য মৌসুমী আপার সঙ্গে সুপারহিট খেতাব পেয়ে যায়। ‘তুমি আমার’ ছবিটি হিট হওয়ার পর সালমান আর আমাকে নিয়ে অনেকগুলো ছবি বানান নির্মাতারা। চার বছরের অভিনয়জীবনে সালমান ২৭টি ছবিতে কাজ করেছেন, এর মধ্যে জুটি হয়ে আমরা অভিনয় করি ১৪টি সিনেমায়। সব কটি সিনেমাই ব্যবসায়িকভাবে সফল হওয়ার পাশাপাশি দর্শকপ্রিয়তা পায়।

‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে সালমান শাহ ও মৌসুমীকে জুটি হিসেবে পায় দর্শক। আপনি নাকি মৌসুমীকে হটিয়ে সালমানের সঙ্গে নিজের জুটি প্রতিষ্ঠিত করেন?
আমি হটিয়ে দেওয়ার কেউ নই। আমি আমার মতো অভিনয় করে গেছি। তবে এটা ঠিক যে সালমানের সঙ্গে আমার অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করা হয়েছে, দর্শক চাহিদা না থাকলে পরিচালকেরা নিশ্চয় এমন ঝুঁকি নিতেন না।

সালমানের সঙ্গে প্রেম হওয়ার কারণে আপনি নাকি তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতেন?
প্রেম নয়, সালমানের সঙ্গে আমার ভাইবোনের সম্পর্ক ছিল। সালমানের নিজের ছোট বোন ছিল না, তাই আমাকে ছোট বোনের মতোই দেখতেন। এটাও ঠিক, সালমান শাহ আর আমাকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু এসবের কোনোটিই সত্য নয়। ছোট বোন হিসেবে আমাকে তিনি ‘পিচ্চি’ বলে ডাকতেন। সালমানের মা-বাবাও আমাকে আদর করতেন। সালমানের কারণে আমাকে তাঁদের মেয়ে হিসেবেই দেখতেন। সালমান খুব আন্তরিক আর কাজপাগল ছিলেন। আমাদের দুজনের বোঝাপড়াটা ছিল চমৎকার। বলতে পারেন, একে অন্যের চোখের ইশারা বুঝতে পারতাম।

সালমান শাহর মৃত্যুর পর আর কারও সঙ্গে আপনার জুটি গড়ে উঠছিল না। এটা নিয়ে কোনো আতঙ্ক কাজ করেছে?
সালমানের সঙ্গে অভিনয়ের পাশাপাশি ওমর সানী ভাইয়ের সঙ্গেও কাজ করা হয়। কিন্তু চলচ্চিত্রে কাজ শুরুর তিন বছরের মাথায় সালমান শাহর মৃত্যুতে আমার অভিনয়জীবন চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখোমুখিও হতে হয়। সবকিছু সামলে নিয়ে আমি এগিয়ে চলি। কোনো অপপ্রচারকে পাত্তা দিইনি। আমি আমার মতো কাজটা করে গেছি। সিনেমায় ওমর সানীর পাশাপাশি আমিন খানের সঙ্গেও পরিচালকেরা আমাকে নিয়ে কাজ শুরু করেন। একসময় রিয়াজের সঙ্গে আমার জুটি দর্শক দারুণভাবে গ্রহণ করে। এ ছাড়া ফেরদৌস, মান্না ভাই ও শাকিব খানের সঙ্গে ছবি করেছি।

সালমান শাহ, ওমর সানী, মান্না, রিয়াজ, ফেরদৌস, শাকিব খান—সবার সঙ্গেই অভিনয় করা হয়েছে। জুটি হিসেবে কার সঙ্গে আপনার বোঝাপড়া চমৎকার ছিল?
জুটি হিসেবে দর্শক আমার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছে সালমান শাহকে। এখনো সবাই সালমান-শাবনূর জুটির কথা বলে। এরপর রিয়াজ ও আমার জুটি নিয়ে অনেক সুন্দর স্মৃতি আছে। এর বাইরে ওমর সানী, মান্না, ফেরদৌস, শাকিব—সবার সঙ্গে অভিনয় করেছি, কিন্তু জুটি হিসেবে নয়। তবে সবাই খুব দারুণ অভিনয়শিল্পী।

শাবনূর

কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে, আপনি পরিচালনায় আসছেন।
পরিচালনা করব, সেই ইচ্ছে থেকে এমন ঘোষণা দিয়েছিলাম। সংসারের সব কাজ গুছিয়ে নেওয়ার পর পরিচালনার বিষয়টা নিয়ে আবার ভাবতে হবে।

২৫ বছরের অভিনয়জীবনে প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব কতবার পেয়েছেন?
প্রথম বিয়ের প্রস্তাব কবে পেয়েছিলাম, তা অবশ্য মনে নেই। কিন্তু এই জীবনে কতবার যে প্রেম আর বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছি, তার সঠিক হিসেব নেই। এতটুকু বলতে পারি, হাজারেরও বেশি বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছি।

২৫ বছরের চলচ্চিত্রজীবন, পেছন ফিরে তাকালে কী দেখেন?
দেশের মানুষ এখনো ভালোবাসে, সম্মান করে—এসব কজনের ভাগ্যে জোটে। এই চলচ্চিত্র আমাকে শাবনূর বানিয়েছে। নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ—সবই দিয়েছে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছি ১০ বার। আরও কত কত সম্মাননা যে পেয়েছি, তার হিসাব নেই। অনেক প্রিয় মানুষকে হারিয়েছি, তাঁদের অনেকের কথা মনে পড়ে। তবে ইদানীং সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে চলচ্চিত্রে বর্তমান অবস্থা দেখে। কী সুন্দর ছিল আমাদের চলচ্চিত্র। এখন নানা রেষারেষি, কত অপ্রীতিকর ঘটনা এফডিসি ঘিরে। তবে বিশ্বাস করি, এসব কেটে যাবে। চলচ্চিত্রের আকাশেও আবার ঝলমলে সূর্যের দেখা পাব।