১৪ বছর পর অপি করিম

অপি করিম

১৪ নভেম্বর কলকাতার ফোরাম মলের সামনে অপেক্ষা করছিলেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী অপি করিম । উদ্দেশ্য রাতের খাবার খাওয়া আর খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ডেব্রি অব ডিজায়ার–এর গল্প শোনা। গল্পের জন্য বেছে নেওয়া হলো দেশপ্রিয় পার্কের পাশেই নায়ক দেবের টলি টেলস রেস্টুরেন্ট। জানতে চাই, আপনি কি দেবের ভক্ত, না তাঁর রেস্তোরাঁর?

চেনা হাসি দেন অপি। বললেন, ‘এই রেস্তোরাঁ সিনেমার উপাদান দিয়ে সাজানো। এমন পরিবেশে আমার সিনেমা নিয়ে গল্প করতে ভালো লাগবে মনে হয়।’

নিজে একজন স্থপতি বলেই কিনা যেখানে যান সবার আগে তাঁর নজর কাড়ে ইন্টেরিয়র। আমরা বসতে বসতে আলাপ শুরু করি। ততক্ষণে সঙ্গের আরেক বাংলাদেশি অভিনেতা মুস্তাফিজ শাহীন এবং ডেব্রি অব ডিজায়ার-এর বাংলাদেশের নির্বাহী প্রযোজক অম্লান বিশ্বাসও যোগ দিয়েছেন। মেন্যু হাতে তুলে নিলেন অপি করিম।

কলকাতার গল্প

খবরটা আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। ১৪ বছর পর নতুন ছবিতে অভিনয় করতে যাচ্ছেন অপি করিম। অবশ্য যেদিন সকালে খবর বেরোল তিনি কলকাতায় শুটিং শুরু করেছেন, সেদিনও তিনি বেলা ৩টা অবধি ছিলেন ক্লাস নিতে ব্যস্ত। অপিকে সেই ঘটনা মনে করিয়ে দিতেই মুচকি হাসলেন। এমন সংবাদ প্রায়ই বের হয়। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, আমার ছবির নাম ডেব্রি অব ডিজায়ার। যৌথ প্রযোজনার এ ছবিটি পরিচালনা করছেন কলকাতার পরিচালক ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী। প্রযোজনা করছেন বাংলাদেশের জসিম আহমেদ এবং পরিচালক ইন্দ্রনীল স্বয়ং। ছবিতে আমার সহশিল্পী হিসেবে পেতে যাচ্ছি কলকাতার ঋত্বিক চক্রবর্তী, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলীকা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি গল্প ‘ব্লেন্ড’ করে করা হয়েছে চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য। সেই গল্পের একটি চরিত্রে অভিনয় করতে যাচ্ছি আমি। আমার চরিত্রের নাম ‘সোমা’। জানেন, সোমা চরিত্রটা কোথাও কোথাও ব্যক্তি অপি করিমের মতো। মানুষকে আশা নিয়ে বাঁচতে হয়, স্বপ্ন দেখতে হয়। সোমাও অনেকটা এ রকম। তার আশা আছে, স্বপ্ন আছে। ওটাকে অর্জন করার জন্য জীবনটা চালিয়ে নেয়। সোমা স্বপ্ন দেখে তার সন্তানটা ভালো স্কুলে পড়বে। একটা সুন্দর জীবন হবে তার। সেই স্বপ্নের পথ সুন্দর করতেই অন্যের বাড়িতে কাজ করে। আপাতত এতটুকু বলে মুখে কুলুপ আঁটলেন। ‘আর নয়।’

আবার সেই পরিচিত হাসিটি হেসে বললেন, ছবির শুটিং শুরু হবে জানুয়ারিতে। বাংলাদেশে হবে ফেব্রুয়ারি বা মার্চের দিকে। আর মুক্তি পাবে বিশ্বজুড়েই।

ডেব্রি অব ডিজায়ার–এর মহড়ায় অপি (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)। ছবি: ভাস্কর মুখার্জিযে কারণে ১৪ বছর পর

অপি করিমের সব শেষ ছবি ব্যাচেলর। কিন্তু ১৪ বছরে চলচ্চিত্রের জন্য ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি। কারণটা কী? প্রশ্ন শেষ করার আগেই বললেন, যদি কামব্যাক করা নিয়ে প্রশ্ন করেন, তাহলে আমি সত্যি সত্যি চলচ্চিত্রে কামব্যাক করলাম। নিঃসন্দেহে আমার এই কামব্যাকে সুখের মাত্রাটা বেশি। আর এখন দুই বাংলাতেই ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে। আমিও ভালো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চাই।

তবে ডেব্রি অব ডিজায়ার চলচ্চিত্রে সম্মত হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে পরিচালকের নামটি। অপি বললেন, কবিদার (ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরীর ডাকনাম) ফড়িং ও ভালোবাসার শহর আমার খুব পছন্দের কাজ। এ ছবিটি করার পেছনে ৬০ ভাগ কারণ পরিচালক। বাকি ৪০ ভাগ চিত্রনাট্য। সেই সঙ্গে আছে সোমা চরিত্রটি। এ ছাড়া কলকাতার অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তীকে সহশিল্পী হিসেবে পাওয়াও এই ছবিতে রাজি হওয়ার অন্যতম কারণ। আর সব শেষ কারণ দুই বাংলার ছবিতে কাজ করার সুযোগ।

পুরোনো স্মৃতিজানতে চাই, অনেক দিন পর চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন। ব্যাচেলর ছবির কোনো স্মৃতি মনে পড়ছে? অপি কয়েক সেকেন্ড ভাবেন। এরপর বলেন, নাহ্‌, তেমন কিছু মনে পড়ছে না। আসলে ওই সময় আমরা ৫১ বর্তী নামে একটি ধারাবাহিক করতাম। ওই ইউনিটের বেশির ভাগ মানুষই ব্যাচেলর ছবির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাই একই চেহারা, একই ডিরেক্টর, একই অভিনয় প্যাটার্ন—এ কারণে নতুন কিছু মনে হয়নি। তবে চলচ্চিত্রটি ৩৫ মিলিমিটার ক্যামেরায় শুট হতো, এ কারণে শুটিংয়ের সময় একটা ঘড় ঘড় শব্দ হতো। আর ব্যাচেলর–এর বেলায় ডাবিংও করতে হয়েছে। ৫১বর্তীর সময় শব্দ কিংবা ডাবিং কোনোটাই লাগেনি।
বলেই হাসতে থাকেন অপি। দেবের রেস্টুরেন্টের চারদিকে সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ে।

বদলে যাওয়া অপি

ব্যাচেলর থেকে ডেব্রি অব ডিজায়ার। এই ১৪ বছরে কতটা বদলেছেন অপি?
আগে আমি খুব সংবেদনশীল ছিলাম। অভিমান হতো মুহূর্তেই। পরে দেখেছি কাছের মানুষ ছাড়া এই অভিমানের মূল্য কেউ দেয় না। এখন শুধু পরিবারের ওপর অভিমান আর ছাত্রদের ওপর রাগ হয়। আসলে সব দিক থেকেই খানিকটা বদলে দিয়েছে সময়। আমার পেশা, আমার অভিজ্ঞতা, অভিনয়, জীবন যাপন—সবই একটু একটু করে বদলে গেছে। আমি এখন সবকিছুই পজিটিভ চিন্তা করি। নেতিবাচক চিন্তা একেবারেই নেই। অশান্তির ধারেকাছে থাকতে চাই না।
তবে হাসতে হাসতে বলেন, একটা জায়গায় দুই অপির মিল আছে। এখনো ক্লাস রুমে আছি। আগে বসতাম শিক্ষকদের সামনে, এখন দাঁড়াই শিক্ষার্থীদের সামনে। আগে শিক্ষকদের কাছে প্রজেক্ট জমা দিতাম, এখন জমা নিই। শিক্ষকতার বাইরে আমার আর্কিটেকচার ফার্ম আছে। নাম ‘মৃ’। সেটা নিয়েও বেশ ব্যস্ত থাকতে চায়।ততক্ষণে খাবার চলে আসে। গরম নান, পনিরের পদ, ফিশ কাবাব, সবজির পদ। অপি বলেন, সব কথা এক সাক্ষাৎকারে না নিয়ে চলুন, খাওয়া শুরু করি। না হলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।

কাজের পার্থক্য কতটুকু

এর আগে একটি বিজ্ঞাপন করতে এসেছিলেন কলকাতায়। পিছুটান নামে টেলিছবির একটি দৃশ্যে অভিনয়ের জন্যও কলকাতায় আসতে হয়েছিল। কারণ, সেই টেলিছবিতে সহশিল্পী ছিলেন সবার প্রিয় ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার। এ বছরের একটি ভ্যালেন্টাইন ডে নাটকের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন তিনি। সেখানে সহশিল্পী কলকাতার ভাস্কর চ্যাটার্জি। সেই স্মৃতি হাতড়ে আর এখনকার মহড়ার তাজা গল্প মিলিয়ে বললেন, এখানকার ইউনিটের প্রতিটি মানুষ জানে তার কী কাজ। অনেক গোছানো। অনেক প্রস্তুতি এবং বিস্তারিত। এখানে বিভাগে পেশাদারত্বের ছাপ। আমাদের দেশে প্রস্তুতির বড় অভাব। তবে অভিনয়শিল্পী হিসেবে এতটুকু বুঝেছি মানসিক চাপ নিয়ে আসলে অভিনয়টা হয় না। আমি মন দিয়ে অভিনয় করতে চাই। প্লিজ, আমাকে সুন্দর চরিত্র দিন, আমি আরামে অভিনয় করতে চাই।

মহড়া ও প্রস্তুতি

পরদিন অপি করিমের সঙ্গে দেখা হয় কলকাতার একটি আবাসিক এলাকায়। সেখানকার ৪৫তলা একটি ভবনের ১৫তলায় চলছিল মহড়া। মহড়া শেষ হলে অপির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ মেলে।

জানতে চাই, সোমা হয়ে ওঠার জন্য প্রস্তুতি কেমন ছিল? অপি জানালেন, সোমার ব্যাকগ্রাউন্ড, সে কী চায়, কী হতে পারত, কী স্বপ্ন দেখে—সেটা আগেই বর্ণনা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। তারপর ছবির সঠিক লুক বিষয়ে পরিচালকের সবশেষ সিদ্ধান্তের জন্য নানা পোশাক ও মেকআপে বারবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। পরিচালকের সহযোগিতার কারণেই সব সম্ভব হচ্ছে। চোখেমুখে প্রশান্তির ছাপ এনে অপি বলেন, মোটকথা, প্রস্তুতি বলতে যা বোঝায়, সেটা করে দিয়েছেন কবিদাই। কবিদা সব বোঝানো শেষ করে বলেছেন, এত টেনশনের কিছু নেই, সোমাকে বুঝতে পেরে তার মতো কথা বলতে পারলেই হলো। আমি এখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে শুধু অভিনয় করে যাব মন দিয়ে।