গল্প : ঘুরপথে – তনুশ্রী দাস

‘এই পরাগ, শুনে যা একবার। পালাচ্ছিস কোথায়?’’

পরাগ গলাটা শুনে ফিরে তাকাল না। কিন্তু দাঁড়িয়ে পড়ল। খেপিটা আবার পাকড়েছে। তোয়া ডাকলে পালানো মুশকিল।

স্বচ্ছতোয়া লাফাতে-লাফাতে এসে হাজির, ‘‘কী রে, দু’দিন ধরে হুটপাট কেটে পড়ছিস? আমার ভাইরাল ফিভার হল, একবার খোঁজও নিলি না। কেমন বন্ধু তুই?’’

 

পরাগের খুব অপরাধবোধ হল। তোয়া মেয়েটা খুব ভাল। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে পরাগের প্রথম যে বন্ধু হয়েছে, সে হল তোয়া। তোয়া খুব মেধাবী। ও সবসময় পরাগকে হেল্প করেছে। শুরুতেই পরাগের জন্ডিস হয়েছিল। তখন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক থিওরির ক্লাসনোট্স ওকে হোয়াটসঅ্যাপ করে পাঠিয়েছিল তোয়া। পরাগ খুব অবাক  হয়েছিল, ওর ফোন নম্বর ও তো তোয়াকে দেয়নি। পরে জেনেছিল, লাইব্রেরিয়ান সুধাম্যাডামের কাছ থেকে নম্বরটা ম্যানেজ করেছে তোয়া। লাইব্রেরির ফর্ম ফিল আপের সময় পরাগ ফোন নম্বর দিয়েছিল।

আসলে পরাগ ছোটবেলা থেকেই একটু লাজুক আর মুখচোরা স্বভাবের। আর মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সাহসও ওর ছিল না। তাই মেয়ে-বন্ধু দূরের কথা, ওর তেমন কোনও বন্ধুই নেই। সহপাঠীরা বলত, ও খুব হ্যান্ডসাম। একটু চেষ্টা করলেই ক্যাসানোভা হতে পারবে। পরাগ মুখ ফুটে বলতে পারেনি, যে ক্যাসানোভা হতে ও কোনওদিন চায়নি। ও এমন একটা মেয়ে চায়, যাকে দেখেই ও তার প্রেমে পড়ে যাবে। ওর বুকের মধ্যে বৃষ্টি পড়বে সেদিন। এবং সেই  মেয়েটার কাছেই ওর সব সুখ-দুঃখ উজাড় করে দেবে। এতদিন বন্ধু না-থাকায় ও ওর মনের কথা কাউকে বলতে পারেনি। সেই মেয়েটাকে ও সব বলবে। তবে আপাতত, সেই মেয়েটা কবে এন্ট্রি নেবে ও জানে না। সরি, একটু ভুল হল। ও জানত না। ও বুঝতেও পারেনি। ওকে বুঝিয়েছে তোয়া। ও যেদিন আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের সোলাঙ্কিকে দেখে হাঁ করে তাকিয়েছিল, সেদিন তোয়া বুঝে নিয়েছিল। সোলাঙ্কি খুব সুন্দরী। গ্ল্যামারাস। মোম দিয়ে পালিশ করা যেন। তীক্ষ্ণ নাক, ভরাট গোলাপি ঠোঁট।

পরাগ অবশ্য বেশিক্ষণ তাকায়নি। ওর হঠাৎ মনে হয়েছিল, কোনও ফিল্মস্টার যেন, ওদের কলেজে চলে এসেছে। ও খানিকক্ষণ তাকিয়েছিল বলে বেশ লজ্জাও পেয়েছে। চোখ সরিয়ে কেটেই পড়ছিল, হুট করে কোথা থেকে তোয়া এসে দাঁড়াল ওর সামনে। বলল, ‘‘মেয়েটাকে হাঁ করে দেখছিলি? সবাই দ্যাখে। চল, আলাপ করবি।’’

সোলাঙ্কিকে তোয়া আগে থেকেই চিনত। সোলাঙ্কি ওর স্কুলের জুনিয়র। এবছরই কলেজে ভর্তি হয়েছে। ওরা একসঙ্গে কফি খেল। আর তোয়া প্রচুর গল্প করল। বাকি দু’জন অবশ্য চুপ করেই ছিল।

এরপর থেকেই তোয়া ওকে ধরেছে, ‘‘কী রে কতদূর এগোলি?’’ পরাগ অবশ্য দেখা হলে সোলাঙ্কির সঙ্গে একটু হাসি বিনিময় ছাড়া কিছুই করে উঠতে পারেনি। তবে ভিতরে-ভিতরে ওর সোলাঙ্কিকে ভাল লাগতে শুরু করেছে। বোধ হয় সোলাঙ্কিরও। কিন্তু কাছে গিয়ে গল্পগুজব করতে সাহস পাচ্ছে না পরাগ। পরাগ ভাল কথা বলতে পারে না। শেষকালে প্রেমটাই না কেঁচে যায়। তার চেয়ে একটু ধৈর্য রাখাই ভাল। যদি সোলাঙ্কিও পরাগকে পছন্দ করে, তা হলে হয়তো ও নিজেই এগোবে। আর তাতে পরাগ একটু ভরসা পাবে।

কিন্তু ইলেকট্রিক্যালের রোহনের সঙ্গে সোলাঙ্কিকে ঘুরতে দেখে পরাগ আবার তোয়ার শরণাপন্ন হল।

ও তোয়াকে বলেছিল, ‘‘একটা উপায় বাতলে দে প্লিজ়।’’

তোয়া বলল, ‘‘চল, কাল আইনক্সে মুভি দেখতে যাব। সোলাঙ্কিকেও ডেকে নেব। তারপর আমি ঠিক সময় একটা কাজের অজুহাত দেখিয়ে কেটে পড়ব। তারপর তুই বুঝে নিস। মুভি দেখিস। গল্প করিস। কোথাও ঘুরে আসিস। যা তোর ইচ্ছে। বি স্মার্ট। ওকে?’’

ওরা মুভি দেখেছিল। তারপর বেরিয়ে অনেকক্ষণ উদ্দেশ্যহীন হেঁটেছিল। রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে ভাঁড়ে করে চা খেয়ে জোক্‌স শেয়ার করেছিল আর প্রচুর হেসেছিল। তোয়া আসবে বলেও আসেনি। ও সোলাঙ্কিকে ফোন করে জানিয়েছিল, ওর খুব মাইগ্রেনের ব্যথা হচ্ছে। ও যেতে পারবে না।
পরদিন খুব উৎসাহ নিয়ে পরাগ তোয়ার কাছে এসেছিল গল্প করতে। তোয়া আর উৎসাহ দেখায়নি। শুধু মুচকি হেসে বলেছে, ‘‘এবার নিজেরটা নিজেই সামলে  নিস। আমাকে আর দরকার হবে না।’’

তা পরাগ অবশ্য সামলেছিল ভালই। কিছুদিনের মধ্যেই সারা কলেজ ওদের প্রেমকাহিনি জেনে গেল।

দিব্যি চলছিল। কিন্তু সব হিসেব বোধ হয় এত সহজে মেলে না। একদিন ক্লাস শেষ করে পরাগ সোলাঙ্কিকে নিয়ে কলেজের লাগোয়া কফিশপে ঢুকেছে, দেখে রোহন আর তোয়া দু’জন-দু’জনের হাতে হাত রেখে মগ্ন হয়ে গল্প করছে। যেন আশপাশের বাকি পৃথিবীটা শূন্য। কেন জানি না, পরাগ আর সোলাঙ্কির সেদিনের ডেটটা ভাল জমল না। তাল কেটে যাচ্ছিল।

তার পরের দিন সোলাঙ্কি গম্ভীর মুখে স্বীকার করল, কাল রাতে ও ঘুমোয়নি। কারণ তোয়ার সঙ্গে রোহনকে দেখে ও ফিল করেছে, ও রোহনকে কত ভালবাসে। তাই পরাগের সঙ্গে আর সম্পর্কটা টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পরাগ প্রথমটা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই ও সোলাঙ্কিকে জড়িয়ে ধরল। বিমূঢ় সোলাঙ্কিকে ছেড়ে একগাল হেসে বলল, ‘‘থ্যাঙ্ক ইউ!’’ বলেই পিছন ফিরে দৌড়। থামল গিয়ে ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের সিঁড়ির সামনে। যেখানে রোহন আর তোয়া বসে আছে। তোয়ার মাথাটা রোহনের কাঁধে। দেখেই পিত্তি জ্বলে গেল পরাগের।

এক হ্যাঁচকা টানে তোয়াকে টেনে সে বলল, ‘‘ফিজ়িক্যাল মেটালার্জিটা বুঝতে পারছি না। আজ সন্ধেয় তোর বাড়ি যাব।’’

তোয়া যেন একটু বিরক্ত। বলল, ‘‘আজ তো রোহনের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাচ্ছি। আজ হবে না রে।’’

পরাগ ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘‘কাল তা হলে!’’

তোয়া ঘাড় নাড়ল, ‘‘কাল অসুস্থ মেসোমশাইকে দেখতে যাব।’’

‘‘তবে পরশু?’’

তোয়া রোহনের দিকে ফিরল। বলল, ‘‘রোহন, পরশু আমাদের কোথাও যাওয়ার নেই তো?’’

রোহন বলল, ‘‘এক কাজ করি। আমরা বরং পরশু সিনেমা দেখতে যাই। আজ তুই পরাগকে পড়াটা বুঝিয়ে দে। আফটার অল, সবার আগে লেখাপড়া।’’

 

তারপর সন্ধেবেলা পরাগের আগমন। সব কথা খুলে বলে পরাগ বলল, ‘‘আমি বুঝতে পেরেছি, তুই ছাড়া আমার চলবে না। তোকেই আমি সব কথা উজাড় করে বলতে পারি। আই লাভ ইউ তোয়া। একটু ভুল করে ফেলেছিলাম। সরি ফর দ্যাট। আমাকে প্লিজ় ক্ষমা করে দে।’’

এক নিঃশ্বাসে বলে পরাগ হাঁফাতে থাকে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পরাগ ফিল করল, ওর বুকের মধ্যে বৃষ্টি পড়ছে।

 

স্বচ্ছতোয়া গম্ভীর। ওকে এই মুহূর্তে দেখে বোঝা সম্ভব নয়, ওর বুকের মধ্যে নায়াগ্রার জলপ্রপাত। প্ল্যানটা এত অসাধারণ কাজ করবে ও আর রোহন ভাবতেই পারেনি। তোয়ার মনে হত, পরাগ ওকে ভালবাসে। ওকে  বোঝে। কিন্তু মাঝে সোলাঙ্কি এসে পড়ায় ও একটু পরাগকে বাজিয়ে দেখতে গিয়েছিল। নিজেই ওদের হেল্প করতে গিয়েছিল। কিন্তু বুদ্ধুটা সুন্দরী দেখে গলে গেল। তোয়া রূপে সাধারণী হলেও ওর মন, বুদ্ধি, মেধা তো সাধারণ নয়। তবে তোয়া বড় অভিমানী। চুপচাপ, নিজেকে ওদের মধ্য থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু রোহন যে-রাতে মনের দুঃখে মাল খেয়ে তোয়াকে ফোনে গালাগাল দিল, পরাগ আর সোলাঙ্কির সেটিং করিয়ে দেওয়ার জন্য, তার পরদিনই প্ল্যানটা মাথায় আসে। রোহনকেও বলেছিল, ‘‘জাস্ট একটা চান্স নিই। ধরে নে, কাজ হবে না। তবু…’’

স্বচ্ছতোয়া পরাগকে থেমে-থেমে বলল, ‘‘আজ তুই বাড়ি যা। আমি আজ একটু ভাবি। রোহনের সঙ্গেও কথা বলতে হবে।’’

পরাগ ম্লান মুখে বেরিয়ে গেল। তোয়ার বুকটা মুচড়ে উঠলেও ও আটকাল না। থাক, এত তাড়াতাড়ি তোয়া নিজেকে প্রকাশ করবে না। ও এত হালকা নয়। তা ছাড়া রোহনকে ফোন করাটা জরুরি। গাম্বাটটা যেন কোনওদিন ব্যাপারটা ফাঁস না করে। ভাল ওরা যে যাকেই বাসুক, এই ছোট্ট দুষ্টু-মিষ্টি ষড়যন্ত্রটা যেন ওর আর রোহনের মধ্যেই থাকে।

storiesগল্প