যৌন আসক্তি বলে কি সত্যিই কিছু আছে? : বিবিসি বাংলা

ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির অভিযোগের বন্যা শুরু হওয়ার পর ঠিক একবছর আগে চলচ্চিত্র মুঘল হার্ভে উইনস্টেন একটি যৌন আসক্তি ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন থেকেই শুরু হয় ‘মি টু আন্দোলন।’ বিবিসি এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে, যারা বলেছেন যে, তারাও যৌন আসক্তিতে ভুগেছেন এটা জানার জন্য যে, সত্যিই এটা আছে কিনা? থাকলে সেটা কেমন?

যেমন মধ্য এশিয়া থেকে ১৫ বছর আগে যুক্তরাজ্যে আসা নেইলার প্রথম চাকরি হয় একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ট্রেডিং ফ্লোরে। যেখানে বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ সহকর্মী, যারা মিলিয়ন পাউন্ড বোনাস অর্জন করতেন।

পুরো দলে ছিল মাত্র দুইজন নারী। ফলে তাদের পুরুষ সহকর্মীরা প্রায়ই বড় পর্দায় পর্ন চালিয়ে তাদের উস্কানোর চেষ্টা করতেন।

”আমি সেটা পছন্দ করতাম না, কিন্তু আমার প্রথম চাকরি, এই শহরে প্রথম এসেছি। বেতন ভাতাও ভালো এবং বেশ গর্বের চাকরি, সুতরাং আমি সেটা হারাতে চাইনি,” বলছেন নেইলা।

”আমি জানি, অফিসের পুরুষ সহকর্মীরা আমার প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করছে। সুতরাং আমি বাসায় চলে গিয়ে নিজে থেকেই পর্ন ভিডিও দেখা শুরু করি, যাতে অফিসে সবার সামনে বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগতে না হয়।”

কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি নেইলা এতে আসক্ত হয়ে পড়েন। সামাজিক এবং রক্ষণশীল নেইলার পরিবারে কখনো যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হতো না।

ফলে এ বিষয়টি তার জন্য অনেকটা প্রতিরোধহীন হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিদিন সে চিন্তা করতো, কত তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে পারবে এবং একটি পর্ন চলচ্চিত্র বেছে নিয়ে দেখতে শুরু করতে পারবে। সে সময় তিনি সেক্স টয় ব্যবহার করে স্বমেহন করতেও শুরু করেন।

”এটা আস্তে আস্তে শুরু হয়, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি আপনি তাতে জড়িয়ে পড়বেন। পুরো ব্যাপারটার ওপর আপনার নিয়ন্ত্রণ থাকবে, কারণ আপনি জানেন, আপনি বাটন না চাপা পর্যন্ত সেটা বন্ধ হবে না। এটা আপনাকে তৃপ্তি দিচ্ছে, যা আপনি অন্য কোন মানুষের সঙ্গে পাবেন না- কোন পুরুষের সঙ্গে তো নয়ই,” বলছেন নেইলা।

এ জন্য তিন চার ঘণ্টা করে পর্ন দেখতেন নেইলা, সপ্তাহের প্রতিদিন। এমন হয়েছে, পর্ন না দেখলে তার অস্থির লাগতে শুরু করতো।

কিন্তু নিয়মিত পর্ন দেখা একসময় তাকে আরো অন্ধকার দিকে নিয়ে যায়।

”প্রথম প্রথম হয়তো আপনি স্বাভাবিক পর্ন দেখতে শুরু করেন, যেমন পুরুষ-নারী বা নারীদের সঙ্গে নারী। কিন্তু কিছুদিন পরে সেটি আর কাজ করে না। আপনার শরীর তখন আরো কিছু চাইতে শুরু করে- অনেকটা মাদকে আসক্তির মতো, ক্রমেই আপনাকে ডোজ বাড়াতে হয়। সুতরাং পর্নের ক্ষেত্রেও দিনে দিনে আরো কড়া পর্নের দিকে আসক্তি বাড়ে।”

”সুতরাং এরপর আপনি অ্যানাল, গ্যাং ব্যাং বা এ ধরণের চরম যৌনতার পর্নের দিকে আসক্ত হয়ে পড়বেন।”

এটা ছিল নেইলার জন্য খুবই অস্বত্বিকর, যিনি তখন নিজেকে একজন ‘বিকৃত’ মনের মানুষ বলে ভাবতে শুরু করেন।

এই লজ্জার বিষয়টি তাদের সবার জন্যই একটি বড় বিষয়, যারা নিজেদের যৌন আসক্ত বলে মনে করেন। লজ্জা তাদের নিজেদের লুকিয়ে রাখার তাড়না দেয় এবং আরো গভীরতার দিকে ঠেলে দেয়।

পর্নের কারণে মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে দেয়। নেইলা যখন একজন সম্ভাব্য সঙ্গীর দিকে তাকাতেন, তার ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্র বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার কাছে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হতো।

”আমি হয়তো তাদের শার্টের ভেতর দিয়ে তাকাতাম যে, তার শরীরে পেশি কতটা আছে? যুক্তরাজ্যের পুরুষদের স্বাভাবিক যৌনাঙ্গের আকার আমার জন্য যথেষ্ট ছিল না… কিন্তু এটা তো একজন জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার জন্য ভালো হতে পারে না,” বলছেন নেইলা।

বেশ কয়েকটি সম্পর্ক তার ভেঙ্গে যায়।

”আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করি, এরপরে কি?”

নেইলা শহর ছেড়ে চলে যান এবং একজন বিশেষজ্ঞ পরামর্শক হিসাবে পুনরায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এখন তার বয়স ৪০, অন্য যৌন আসক্তদের চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। যুক্তরাজ্যে যে হাতেগোনা কয়েকটি ক্লিনিক এ ধরণের সেবা দিয়ে থাকে, তিনি তার একটিতে কাজ করেন।

কিন্তু এ ধরণের চিকিৎসা নিতে হলে অর্থ খরচ করতে হয়। কারণ যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এখনো এ ধরণের সমস্যাকে রোগ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু দেশটিতে প্রতিবছর কয়েকশো মানুষ এ সমস্যার চিকিৎসা নিয়ে থাকে।

এর কারণ হতে পারে, নারীরা এই বিষয়ে বেশি লজ্জায় ভোগে এবং সমস্যাটি স্বীকার করতে বেশি দ্বিধায় পড়ে।

যেসব পুরুষ এই চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের একজন যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা পল। তিনি পর্ন চলচ্চিত্রে নয়, যৌনতায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন।

এখন ৫০ বছরের পলের আসক্তি শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, তার ৩০ বছর বয়সে। তখন তার একজন বান্ধবী ছিলেন, কিন্তু একসময় পল অনুভব করতে পারেন যে, তিনি তার জন্য যথেষ্ট নন।

”আমি তাকে সত্যিই ভালবাসতাম, কিন্তু যে কারণেই হোক, আমি একজন যৌনকর্মীর কাছে যাই,” তিনি বলছেন, ” আমি একটা বেপরোয়া যৌন অভিজ্ঞতার জন্য অনেকটা ব্যাকুল ছিলাম। আমি জানতাম, এটা আমার করা উচিত না, কখনোই আমি তার প্রতি অবিশ্বস্ত হইনি, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে আলাদা মনে হচ্ছিল।”

কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তার আচরণ পুরো বদলে যায়।

”সে সময় ছয়জন বান্ধবী ছিল এবং সপ্তাহে আমি দুই বা তিনজন যৌনকর্মীর কাছেও যেতাম। এটা যেন একটা পিৎজ্জার অর্ডার করার মতো ব্যাপার, যেহেতু আমি ক্ষুধার্ত। আমি কিছু চাইছি, অর্ডার দিচ্ছি এবং পরে সেটা ভুলে যাচ্ছি।”
Image caption পল বলছেন, একটি সময়ে তার মনে হয়েছে, যৌন আসক্তি তাকে একাকী করে ফেলছে।

তিনি বলছেন, তিনি জানতেন যে তিনি ভুল কিছু করছেন। যখন তিনি ভাবতে শুরু করেছেন যে, এ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনবেন, তখনি তিনি লন্ডনে প্রথম চাকরিতে ফিরে যান। সেখানে এমন পরিবেশে জড়িয়ে ফেলেন, যা তাকে এধরণের কাজে উদ্বুদ্ধ করে।

”জীবন ছিল অবিশ্বাস্য। বিশ্বের নানা স্থানে ঘোরাফেরা করা, অনেক টাকা আয় করা, লন্ডনের নাচের বারগুলোয় ঘুরে বেড়ানো-আপনি এমন সব লোকজনের মাঝে নিজেকে দেখতে পাবেন যারা যৌন উত্তেজনা নিয়ে কাজ করে।” পল মনে করছেন, ”সুতরাং তখন মনে হলো, এটা নিশ্চয়ই কোন সমস্যা নয়, আমি স্বাভাবিক একজন মানুষ।”

নেইলার মতো পলও বলছেন, ক্রমেই তিনি আরো ”গভীরতা’র দিকে যেতে থাকেন।

”আমি নারী থেকে পুরুষের প্রতি আকর্ষিত হলাম। এটা যেন এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ের উত্তেজনা খোঁজা। সে সময়েও আমার অনেক চমৎকার সব বান্ধবী ছিল।” পল বলছেন।

নেইলার মতো পলও বলছেন, যৌনতায় না জড়ালে তিনি যেন অস্থির হয়ে পড়তেন।

তবে পর্নের প্রতি পল আকর্ষিত হয়েছেন অনেক পরে। বারো বছর বয়সে বাসায় প্রথম একটি পর্ন ম্যাগাজিন দেখলেও, উচ্চগতির ইন্টারনেট আসার পর তিনি পর্নের প্রতি আসক্ত হন। তখন যৌনকর্মীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি বাসায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পর্ন দেখতে শুরু করেন।

লন্ডনের লরেল সেন্টার থেকে দীর্ঘদিন ধরে পরামর্শ নিয়েছেন পল এবং এখন তিনি ভালোর পথে রয়েছেন বলে মনে করেন। গত কয়েক বছর ধরে তিনি কোন যৌনকর্মীর কাছে যাননি এবং গত কয়েকমাসে কোন পর্ন সিনেমাও দেখেননি।

এখন তার লক্ষ্য শুধুমাত্র একজন নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানো।

“এটা আসলে একাকীত্বের একটি রোগ… একটা সময়ে আপনার মনে হবে, আপনি এই পৃথিবীতে আর অল্প কিছুদিন বেঁচে আছেন। আমার কখনো এমন কারো সঙ্গে যৌন সম্পর্ক হয়নি যাকে নিয়ে আমি ভাবি এবং যাকে ভালোবাসি। গত ত্রিশ বছর ধরে এটাই আমি পাইনি।”

গত জুনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অস্বাভাবিক যৌন আচরণকে একটি রোগ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। এরপরেও অনেক দেশে এখনো এটি যথাযথ স্বীকৃতি পায়নি। এমনকি যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগ একে এখনো রোগ বলে মেনে নেয়নি।

তবে দেশটির এমন অনেক বাসিন্দা বলেছেন, তাদের বিশ্বাস, তারা যৌন আসক্ত। কিন্তু এটা রোগ কি রোগ নয়, তার চেয়েও জরুরী বিষয়, এই মানুষগুলো এমন একটি সমস্যায় ভুগছে, যা তাদের জীবনকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।