হেপাটাইটিস ভাইরাস আক্রমণ সমন্ধে জানুনঃ সচেতন হোন

হেপাটাইটিস ভাইরাস আক্রমণ সমন্ধে জানুনঃ সচেতন হোন

প্রতি বছর ২৮ জুলাই সারা বিশ্বে  পালিত হয় ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস’৷ চিকিৎসা বিজ্ঞানে ৫ ধরণের হেপাটাইটিসের কথা বলা হয়।

হেপাটাইটিস-এ, বি, সি, ডি এবং ই। দিবসটির উদ্দেশ্য হচ্ছে সারাবিশ্বে হেপাটাইটিসের এ, বি, সি, ডি ও ই সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি,  রোগনির্ণয়,  প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা ৷

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) আহ্বানে ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছরের ২৮ জুলাই সারাবিশ্বে এই দিবসটি পালন করা হয়। ঘাতক হেপাটাইটিস ভাইরাসের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়।

 

হেপাটাইটিস হলো ভাইরাসজনিত লিভারের রোগ। হেপাটাইটিসের সবকটি প্রকারেরই অস্তিত্ব বাংলাদেশে রয়েছে। তবে, সব ধরণের হেপাটাইটিস প্রাণঘাতী নয়। প্রাণঘাতী হচ্ছে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসের সংক্রমণ। অন্যদিকে,  হেপাটাইটিস এ এবং ই স্বল্পমেয়াদী লিভার রোগ। এটি বিশ্রাম নিলে এক পর্যায়ে সেরে ওঠে।

অজ্ঞান করে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ , চিকিৎসক গ্রেপ্তার

হেপাটাইটিসের ভাইরাসগুলো কিভাবে ছড়ায় সে সম্পর্কে জানেন কি?  

হেপাটাইটিস-এ ভাইরাসটি মলের মাধ্যমে ছড়ায়। মলত্যাগের পর হাত ভালোভাবে পরিষ্কার  না করলে মুখের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। শুধু তাই না,  দূষিত পানি এবং খাদ্যের মাধ্যমেও ছড়িয়ে থাকে এ ভাইরাস। তবে,  এই ভাইরাসে আক্রান্ত অনেক রোগীই সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়।

হেপাটাইটিস বি একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ যা যকৃত বা লিভারকে আক্রমণ করে। হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস ছড়ায় মূলত রক্ত এবং মানবদেহের তরল পদার্থের মাধ্যমে।   এটি আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত ইনজেকশানের সিরিঞ্জ, ব্লেড, কাঁচি, অপারেশনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে যেমন  ছড়াতে পারে তেমনি  আক্রান্ত রোগীর রক্তগ্রহণ, যৌন সংসর্গের মাধ্যমেও অন্যের দেহে প্রবেশ করতে পারে। আক্রান্ত মায়ের গর্ভস্থ শিশুও আক্রান্ত হতে পারে। রোগীর বুকের দুধ, গায়ের ঘাম, প্রস্রাব ও বীর্যের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে এ ভাইরাস।  এ ভাইরাসটিকে ঘাতক বলা হয়।  এর আক্রমণে শেষ পর্যন্ত  লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারও হতে পারে।

রোগীর লিভার বি-ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে কেবল তখনই হেপাটাইটিস-ডি ভাইরাস দেহে প্রবেশ করে বিস্তার লাভ করে এবং রোগের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়।

হেপাটাইটিস-ই-এর মিল রয়েছে হেপাটাইটিস-এ ভাইরাসের সাথে।  তবে কখনো কখনো বেশ  জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে এ ভাইরাস।

বাংলাদেশে এক নীরব ঘাতকের নাম হচ্ছে হেপাটাইটিস সংক্রমণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে প্রায় এক কোটি মানুষ আক্রান্ত।  বাংলাদেশে প্রতি বছর হেপাটাইটিসে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয় ।  নীরব ঘাতক এই রোগের কারণে  বিশ্বে যত মানুষের লিভার ক্যান্সার হয় তার ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী হচ্ছে এই হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস। পৃথিবীতে গড়ে প্রতিদিন ৪ হাজার মানুষ লিভার রোগে মারা যায়।

ভাত না খাওয়ায় মায়ের ‘থাপ্পড়ে’ শিশুর মৃত্যু

হেপাটাইটিস নিয়ে উদ্বেগের সবচে বড় কারণ হচ্ছে সারা বিশ্বে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে সংক্রমিত দশজনের মধ্যে নয়জনই জানেন না যে শরীরে এই ভাইরাস তারা বহন করছে। এছাড়া এ রোগে আক্রান্তরা অনেকক্ষেত্রেই সুচিকিৎসা পান না। বাংলাদেশে হেপাটাইটিসে আক্রান্তদের একটা বড় অংশ ঝাড়ফুঁক, পানি পড়া, ডাব পড়া নেয়ার মতো কবিরাজি চিকিৎসা নেন। কবিরাজি চিকিৎসা বিশ্বাসের একটা ভিত্তি হলো হেপাটাইটিস এ এবং ই যথাযথ বিশ্রাম নিলে এমনিতেই সেরে যায়। এ ভাইরাসে সংক্রমিতরা ঝাড়-ফুঁক, ডাব পড়া পানি পড়া নিয়ে মনে করেন কবিরাজি চিকিৎসায় কাজ হয়েছে। হেপাটাইটিস সংক্রমণ বাংলাদেশে জনসাধারণের মধ্যে জন্ডিস রোগ হিসেবে পরিচিত।

হেপাটাইটিস সংক্রমণের বিষয়ে মানুষকে সচেতনতা করা অনেক জরুরী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার  গাইডলাইন অনুযায়ী নবজাতক শিশুকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হেপাটাইটিস প্রতিরোধে বার্থ ডোজ দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে শিশু জন্মের ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে এ টিকা দিতে। যেহেতু রক্তের মাধ্যমে এটি সবচে বেশি ছড়ায় তাই নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে রক্তদানের আগে যে পরীক্ষা করা হয় সেখানে সবসময় হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস ধরা পড়ে না। বি ও সি ভাইরাস রক্তে সংক্রমণের পর ২ থেকে ৬ মাস সময়ে সাধারণ রক্ত পরীক্ষায় এ ভাইরাস ধরা পড়ে না। এ সময় কেউ যদি রক্ত আদান-প্রদান করলে অগোচরেই ভাইরাসে  সংক্রমিত হয়ে পড়ে। এটি নিরূপণে ডিএনএ ভাইরাল মার্কার বা এইচভিসি টোটাল টেস্ট প্রয়োজন হয়। তাই, আই  প্রাণঘাতী রোগ  নির্মূল করতে চাইলে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালনের কোনো বিকল্প কোনো কিছু নেই।

হেপাটাইটিস বি এর উপসর্গ হলো জ্বর, দুর্বলতা, অবসাদ, বমি ভাব বা বমি হওয়া। হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস রক্তে সংক্রমিত হলে লিভার সিরোসিস এবং শেষ পর্যন্ত লিভার ক্যান্সার হয়ে মৃত্যু হতে পারে। এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া দরকার। সাধারণত এর কোনো কার্যকরী চিকিৎসা নেই। চিকিৎসকরা শুধু লক্ষণের উপশম করবেন মাত্র। তবে, প্রতিষেধক হিসেবে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা এখন সর্বত্র পাওয়া যায়। সব বয়সীরাই এই টিকা নিতে পারবেন এবং হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পারবেন। হেপাটাইটিস বি-এর প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিনের ডোজ ৪টি। প্রথম ৩টি এক মাস পরপর এবং চতুর্থটি প্রথম ডোজ থেকে এক বছর পর। পাঁচ বছর পর বুস্টার ডোজ নিতে হবে। এর মাধ্যমে শরীরে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। সচেতনতা প্রয়োজন বাংলাদেশের বিরাট জনগোষ্ঠীকে হেপাটাইটিস থেকে রক্ষা করতে।

তবে, আশার কথা হলো, বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস প্রতিরোধ ও নির্মূলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বেশকিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

হেপাটাইটিস এমনই  একটি রোগ যা প্রাথমিক ভাবে নির্ণয়  করতে না  পারলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই এর বিরুদ্ধে সচেতনতা এবং এর প্রতিরোধ প্রয়োজন। জেনে নিন কিছু প্রতিরোধের উপায়।

নিশ্চিত হয়ে নিন আপনি  বিশুদ্ধ পানি  গ্রহণ করছেন কিনা

শুধু পানিই নয় গ্রহণ করতে হবে বিশুদ্ধ খাবারও

অন্যের ব্যবহৃত ব্লেড, কাঁচি, ক্ষুর ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন

সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন

খাবার গ্রহণ এবং মলত্যাগের পর হাত সাবান দিয়ে পরিষ্কার করুন

রক্ত গ্রহণের পূর্বে নিশ্চিত হয়ে নিন তাতে কোন ভাইরাস আছে কিনা

ইনজেকশান গ্রহণের সময় নতুন সিরিঞ্জ ব্যবহার করুন

সময়মতো প্রতিরোধের জন্য টিকা নিন

হেপাটাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে দৈহিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকুন

যদি আক্রান্ত হয়েই যান এই ভাইরাসে তবে, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন

তবে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। তাই হেপাটাইটিস ভাইরাস সম্পর্কে আপনি নিজে সচেতন হোন এবং অন্যদেরকেও সচেতন করুন। তবেই সম্ভব হবে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকা।

 

https://www.youtube.com/watch?v=Geg0SPadJxM&feature=youtu.be&fbclid=IwAR0Qouw2MT6soO7tS3BRTGOEhGxYt6Rk72mzzSPuYzQLEfKrMroa4ZIu14Q

 

হেপাটাইটিস ভাইরাস