আসাদুজ্জামান খান মুকুল
মানুষ গড়ার কারিগররাই আজ হতাশায়ঃ
প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের জাতির ভবিষ্যতের মূল চাবিকাঠি। একটি শিশু যখন বিদ্যালয়ে পা রাখে,তখন থেকে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানার্জনের কাজটি শুরু হয়। এই সময়টাতেই শেখানো হয়- কীভাবে চিন্তা করতে হয়, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে হয়,কীভাবে সমস্যা সমাধান করতে হয়। এই মহান দায়িত্বটি যিনি পালন করেন, তিনি হলেন আমাদের প্রাথমিক শিক্ষক। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হলো, এই মানুষ গড়ার কারিগররাই চরম হতাশা আর বঞ্চনার অন্ধকারে ডুবে আছেন।
সরকার প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়াতে আন্তরিক। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত চলছে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। তৈরি হচ্ছে ঝকঝকে নতুন অট্টালিকা ও আধুনিক শ্রেণিকক্ষ। কিন্তু শুধু অবকাঠামো আর প্রশিক্ষণে হাজার কোটি টাকা ঢাললেই কি শিক্ষার মান বাড়ে? যদি শিক্ষকের মন ভালো না থাকে, যদি তাঁর মনে থাকে গভীর ক্ষোভ আর অস্থিরতা, তবে সেই প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান শ্রেণিকক্ষে কতটা ফলপ্রসূ হবে? যদি নিম্নোক্ত সমস্যায় শিক্ষকরা ভোগেন :
১) একই ডিপার্টমেন্ট, দুই গ্রেডের বৈষম্যঃ
প্রাথমিক শিক্ষকদের বঞ্চনার সবচেয়ে কদর্য দিকটি হলো- একই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দৃশ্যমান বৈষম্য।
একদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রি এবং তাঁরা জাতীয় কারিকুলাম অনুসরণ করে পড়ান, তাঁরা বেতন পান ১৩তম গ্রেডে। এই গ্রেডটি সাধারণত এসএসসি বা এইচএসসি পাস তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা পান।
অন্যদিকে, একই অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, তাঁরাও কিন্তু একই যোগ্যতা সম্পন্ন এবং হুবহু একই কারিকুলাম পড়ান। কিন্তু তাঁরা পাচ্ছেন দশম গ্রেডে বেতন!
এখন প্রশ্ন ওঠে, একই যোগ্যতা, একই কাজ এবং একই প্রশাসনিক কাঠামোর নিচে কাজ করেও এই চরম বেতনের বৈষম্য কেন? এটা কি শিক্ষকদের কাজ করার উৎসাহকে একেবারে মাটি করে দেয় না? এই বৈষম্য শিক্ষকদের কেবল আর্থিক ক্ষতি করছে না, তাঁদের সামাজিক ও পেশাগত মর্যাদাও ভূলুণ্ঠিত করছে।
২) আটকে আছে জীবনের গতিঃ
বেতন গ্রেডের এই বৈষম্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্যান্য পেশাগত জটিলতা। দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি আটকে থাকা এবং শিক্ষকদের প্রাপ্য টাইমস্কেল, অর্থাৎ ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে যে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার কথা, তা না পাওয়া- শিক্ষকদের জীবনকে এক গভীর অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে একই পদে, একই বেতনে, হতাশা নিয়ে কীভাবে একজন শিক্ষক শতভাগ মনোযোগ দিয়ে ক্লাস নেবেন?
শিক্ষকদের এমন অস্থিতিশীল মন নিয়ে আগামী প্রজন্মের জন্য উপযুক্ত ভিত্তি গড়ে তোলা অসম্ভব। অস্থিরতা ও অসন্তোষের এই বাতাবরণে শিক্ষার পরিবেশ কখনোই উন্নত হতে পারে না।
শিক্ষকদের দাবি, ক্লাসের মুক্তিঃ
এই চরম বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য প্রাথমিক শিক্ষকেরা আবার মাঠে নামতে বাধ্য হচ্ছেন। সামনেই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে বার্ষিক পরীক্ষা। এর মধ্যেই শিক্ষক সমাজের প্রধান দাবিগুলো সরকারের কানে পৌঁছানো অত্যন্ত জরুরি:
১)দশম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ: শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিত করতে এটি প্রথম ধাপ।
২) ১০০% বিভাগীয় পদোন্নতি: দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে শিক্ষকদের কর্মজীবনের গতি ফিরিয়ে আনা।
৩) বকেয়া টাইমস্কেল প্রদান:
১০ ও ১৬ বছরের প্রাপ্য সুবিধা অবিলম্বে কার্যকর করা।
সরকারের উচিত প্রশিক্ষণে হাজার কোটি টাকা খরচের পাশাপাশি শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিগুলিকে দ্রুত মেনে নেওয়া। শিক্ষকদের আর্থিক সচ্ছলতা ও সম্মান নিশ্চিত করতে পারলে, তাঁদের মন থেকে অস্থিরতা দূর হবে। তখনই তাঁরা প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান এবং সম্পূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে শ্রেণিকক্ষে ফিরবেন এবং শিক্ষার মজবুত ভিত্তি গড়ে তুলতে পারবেন। শিক্ষকদের উপযুক্ত মূল্যায়ন করে ক্লাসমুখী করাই এখন শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রথম ও প্রধান শর্ত।
গ্রাম- সাভার
পোস্ট – হেমগঞ্জ বাজার
উপজেলা – নান্দাইল
জেলা – ময়মনসিংহ
বিভাগ – ময়মনসিংহ
পেশা – শিক্ষকতা
সাহিত্য সম্পাদক ঃ সাপ্তাহিক দেশগ্রাম পত্রিকা ও বাংলাদেশ খবর প্রতিদিন।
কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক।