অতিপ্রাকৃতিক গল্প : খোলস | লেখক : ধ্রুব নীল

সকাল সকাল সাইকেলের প্যাডেল দাবিয়ে চলেছেন তৈয়ব আখন্দ। চকচকে টাক, পেছনে কয়েক গাছি চুল, গোলগাল মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সামান্য ভুড়ি; এমন একটা মানুষের নাম তৈয়ব আখন্দ হওয়াই তো স্বাভাবিক!

 

তৈয়ব আখন্দ সম্ভবত কোনো একটা ছোটখাট কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছোটখাট পদে। বড় পদ হলে চকচকে স্যুট টাই পরতেন। তৈয়ব আখন্দের এসব নেই। আছে একটা পুরনো বাইসাইকেল।

 

অফিসে যাওয়ার সময় কোনো দিকে তাকান না তৈয়ব। এক সপ্তাহ হলো তাকাচ্ছেন। গুলিস্তানের এক কোনায় ফুটপাতের পাশে সুড়ঙ্গের মতো সরু একটা চায়ের দোকানের সামনে বসে থাকে লোকটা। সাধু সন্ন্যাসীর মতো। তৈয়ব আখন্দের মতোই মাথাভর্তি টাক। খানিকটা ভুড়িও আছে।

 

চিরকুমার তৈয়ব আখন্দ আয়না দেখেন না বহুদিন। দেখলে অবাক হতেন। সন্ন্যাসীর মতো লোকটা অবিকল তার মতো দেখতে। অবিকল মানে অবিকল। দাড়ি কমায় মিল। নিজের চেহারা কেমন সেটা ভুলে গেছেন বলেই লোকটার দিকে কেবল ভুরু কুঁচকে আবার দৃষ্টি ফেরান তৈয়ব।

 

লোকটা গত এক সপ্তাহ ধরে একটি নির্দিষ্ট সময় চায়ের দোকানের সামনে পায়ের ওপর পা তুলে নাচায়। মানে ঠিক যে সময়টা তৈয়ব আখন্দ রাস্তা পার হন। অষ্টম দিন দোকানের সামনে সাইকেল দাঁড় করন তৈয়ব। লোকটা তৈয়বের দিকে তাকাল। তার মুখে ঈষৎ চওড়া হাসি। এ সন্ন্যাসী নিজেও মনে হয় আয়না দেখে না। কারণ তিনিও অবাক হননি।

 

লোকটার গা ভর্তি মালা। পরনে লাল একটা কাপড় জড়ানো। হাতে একটা বিচিত্র কিসিমের লাঠি।

‘আপনের পরিচয়?’

‘আজ্ঞে আমার নাম তৈয়ব আখন্দ।’

প্রথম প্রশ্নটা করেছিলেন সাইকেলওয়ালা তৈয়ব আখন্দ। উত্তর শুনে বেশি অবাক হলেন না। তিনি মনে হয় অবাক হতে জানেন না। পৃথিবীর সব কিছু তার কাছে সহজ সরল ব্যালান্স শিট। তার মতে, আরেকটা লোক যদি দেখতে হুবহু তার মতো হয়, তবে তার নাম তৈয়ব আখন্দ হতেই পারে।

রক্তবন্দি

‘আমার নামও তৈয়ব আখন্দ।’

‘জ্বি আমি জানি। আপনি ইছামতি কোম্পানিতে চাকরি করেন। আপনার কাম হইল হিসাব মিলানো। আপনে হাকিমপুরি জর্দা খান।’

এবার অবাক হলেন তৈয়ব। তার মতো একটা সাধাসিধে লোকের ব্যাপারে কেউ কিছু জানে কেন!

‘আইচ্ছা। ঠিক আছে আমি যাই।’

প্রথম দিন এটুকুই। দ্বিতীয় দিনও গুলিস্তানের দোকানটার সামনে দিয়ে একটু জোরে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলেন। ইচ্ছে করেই। তৃতীয় দিন ঘটল আরেক ঘটনা। তৈয়ব আখন্দ সাইকেল চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে সাইকেল চালাচ্ছেন দ্বিতীয় তৈয়ব আখন্দ। এবার আর পরনে গেরুয়া কাপড় বা মালা নেই। তৈয়ব আখন্দ আয়না না দেখেও বুঝে ফেললেন দ্বিতীয় তৈয়ব আখন্দ হুবহু তার মতো করেই সেজেছে। বার বার ধোয়ার কারণে ধূসর হয়ে আসা হালকা সবুজ রঙা একটা শার্ট। সঙ্গে নরমাল কালো প্যান্ট। ঘিয়া কালারের তিনবার সেলাই করা একটা রেক্সিনের স্যান্ডেলও আছে। এমনকি হাতের ভারি ধাতব বেল্টের ঘড়িটাও এক।

প্রথম তৈয়ব আখন্দ অবাক হলেন এই ভেবে যে, দ্বিতীয় তৈয়ব আখন্দ তার মতো হুবহু আরেকটা মরিচা পড়া পুরনো ফোনিক্স সাইকেল পেল কোথা থেকে!

 

দ্বিতীয় তৈয়বের সাইকেল চালানোর গতি বেশি। মনে হলো প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। প্রথম তৈয়ব জীবনেও কারো সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতা করেননি।

জোরে সাইকেল চালানোর কারণে দ্বিতীয় তৈয়বই আগে অফিসে পৌঁছে গেলেন। প্রথম তৈয়ব কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্বিতীয় তৈয়ব তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন দোতলায়। পলেস্তারা খসে পড়া দেয়ালের যে টেবিলটার পাশে ভুরভুর করে বাথরুমের গন্ধ আসে সেখানে গিয়ে ফট করে বসে পড়লেন লোকটা। যেন রাজ্য জয় করেছেন। প্রথম তৈয়ব সাইকেল পার্ক করে উপরে উঠতে উঠতে ততক্ষণে প্রথম তৈয়ব দুটো ফাইল তৈরিও করে ফেললেন। কাজ করছেন তরতর করে। প্রথম ও আসল তৈয়ব আখন্দ যখন দ্বিতীয় তৈয়বের মুখোমুখি পান চিবুতে চিবুতে বসে পড়লেন, তখন তার চোখে আরেকটা পার্থক্য ধরা পড়ল, দ্বিতীয় তৈয়ব পান খান না।

সায়েন্স ফিকশন ২০২১ রক্তদ্বীপ

‘আপনে কী চান?’

‘আমি আপনে হইতে চাই। হইয়া গেছিগা কইতে পারেন। আমি এখন এই কোম্পানির তৈয়ব আখন্দ।’

‘আপনি আমার মতো হইতে চান ক্যান?’

‘কারণ আপনে আমার মতো হইতে চান না। আপনে অন্য কিছু হইতে চান।’

প্রথম তৈয়ব চুপ করে গেলেন। তিনি বিভ্রান্ত। তিনি মনে হয় সত্যিই দ্বিতীয় তৈয়ব আখন্দের মতো হতে চান না। মানে তার প্রথম জীবন তার পছন্দের না। এ কারণেই এত কিছু? কেন ঘটেছে, কীভাবে ঘটেছে সেটা বড় কথা নয়। ঘটেছে এটাই আসল কথা।

 

দ্বিতীয় তৈয়ব বললেন, ‘আমি সাধু সন্ন্যাসী না। ধান্দাবাজ মানুষ।’

‘আপনে সাধু সাজলেন কেমনে? এই কাপড় কই পাইছেন? বঙ্গবাজারে?’

‘অর্ডার দিয়া বানানো। আপনারে আমি একখান ঠিকানা দিমু। আপনি ওই ঠিকানায় যাইবেন, আপনারে কোনো টেকাটুকা দিতে হইব না। ওইখানে গেলে সব পরিষ্কার হইয়া যাইব। কাপড়চোপড় সব পাইবেন।’

প্রথম তৈয়ব আখন্দ খেয়াল করলেন, তার মধ্যে কৌতুহল তৈরি হচ্ছে। তার কাছে এও মনে হচ্ছে তিনি ধান্দাবাজ কিসিমের দ্বিতীয় তৈয়ব আখন্দের ফাঁদে পা দিতে চলেছেন। ইচ্ছে করেই।

দ্বিতীয় তৈয়বের দেওয়া ঠিকানা মতো পৌঁছালেন প্রথম তৈয়ব আখন্দ। সূ² সন্দেহ ছিল ভুলভাল একটা ঠিকানা ধরিয়ে দেবে লোকটা। তা করেনি। একটা পুরনো আমলের বিশাল বাড়ি। মনে হয় কেউ থাকে না। যেকোনো মুহূর্তে ডেভেলপার এসে ভেঙেচুরে এপার্টমেন্ট বানিয়ে ফেলবে।

‘আসেন।’

দরজায় মৃদু টোকা দিতেই ভেতর থেকে শোনা গেল ভারি কণ্ঠটা।

ভেতরে এদিক ওদিক ছড়ানো স্ট্যান্ড ল্যাম্প। আলোর অভাব নেই। লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে। কারো চেহারা দেখা যাচ্ছে না। সবাই অদ্ভুত একটা মুখোশ পরে আছে। সাদা কাপড়ের মুখোশ। চোখ আর নাকের কাছে ফুটো। সবার সামনে তৈয়ব আখন্দের নিজেকে কেমন অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে।

অভ্যর্থনা জানানো লোকটাকে অনুসরণ করে একটা আলো-আঁধারি রুমে ঢুকলেন তৈয়ব। এরপর লোকটা বলল, ‘এইবার কাপড়চোপড় সব বদলান। মানিব্যাগ, চেইন, ঘড়ি কিছুই থাকা চলব না।’

মৃদু অথচা কড়া নির্দেশ। অমান্য করার সাহস বা ইচ্ছে কোনোটাই হলো না তৈয়বের।

‘আপনি যা চাইবেন সেটাই পাইবেন। এখন বলেন কী চান? বড়লোক হইবেন? কোম্পানির মালিক? গাড়িবাড়ি?’

তৈয়বের সাধাসিধে মন জানান দিল, তিনি কী চান তা তিনি জানেন না। তারপরও উপরনিচ মাথা নাড়লেন। বড়লোক হওয়াটা তো দোষের কিছু না।

‘চলেন আপনের রুমে। ওইখানে খানাদানা, বাথরুম সব সারবেন।’

বন্দিদশায় কেটে গেল এক মাস। একদিন আবার সেই লোক হাজির। হাতে অনেকগুলো ফাইলপত্র।

‘এগুলা পড়বেন। মুখস্থ করবেন। এরপর টিভি চালু করবেন। দেখতে থাকবেন। ঘুম আসলে বন্ধ করবেন। তারপর আবার দেখবেন।’

ছায়া এসে পড়ে

‘আমার আগে যে তৈয়ব আখন্দ ছিল, সে কে?’

লোকটা চুপ। মনে হলো তার বলার ইচ্ছে নেই। তৈয়ব আখন্দ প্রশ্নটা করেছেন কারণ তার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। গত এক মাস তিনি কারো সঙ্গে কথা বলতে পারেননি।

‘উনি খুনের আসামি। উনার একটা চাকরির দরকার ছিল। আর..।’

‘আর কইতে হইব না। বুঝছি। এখন কী করতে হইব সেটা কন।’

‘আপনের কী করা লাগব, সেটা ফাইলেই দেখতে পাইবেন।’

‘আর কয়দিন থাকতে হইব?’

‘জানি না। বছর গড়াইতে পারে।’

তৈয়ব আখন্দ অসহায় বোধ করলেন। এক বছরের জায়গায় এক মাস শুনলেও অসহায় বোধ করতেন। বন্দিদশা তার বরাবরই অহস্য লাগে।

 

নিয়মিত টিভি দেখছেন তৈয়ব। সারাক্ষণ একজন মানুষের কথাবার্তা আর নানান ধরনের ভিডিও। সবই মনে হলো গোপনে ধারণ করা। ওই লোক কী খায়, বউয়ের সঙ্গে কীভাবে কথা বলে, ড্রাইভারকে কীভাবে ধমকায়, কীভাবে থুথু ফেলেন। বেশ সুন্দর করে বানানো শিক্ষণীয় একটা ভিডিওর মতো। কিছু পুরনো ছবির অ্যালবামও আছে।

তিন-চার বেলা খাবার, চা নাস্তা সবই আসে। সঙ্গে কিছু খবরও আসে। সব খবর ওই লোকটাকে ঘিরে। সে কোথায় কার সঙ্গে দেখা করল, কোন রেস্তরাঁয় খেল, কোন কোম্পানির কার সঙ্গে কী আলাপ করল সবই জানতে থাকেন তৈয়ব।

চার মাস না যেতেই তৈয়বের মনে হলো তিনি পাগলটাগল হয়ে গেছেন এবং তাকে পাগলাগারদে আটকে রাখা হয়েছে। তার পালিয়ে যাওয়াটা জরুরি। না পালালে জাহানারা বেগম তার জন্য টেনশনে হার্ট অ্যাটাক করবেন। তৈয়ব ভুলে গেছেন যে জাহানারা বেগম নামে তার কোনো স্ত্রী নেই। তাকে যে লোকের ভিডিও দেখতে দেওয়া হয়েছে, জাহানারা বেগম তার-ই স্ত্রী। তারপরও তৈয়বের মন জাহনারা বেগম ও তার দশ বছর বয়সী কন্যা নুসাইবার জন্য আকুপাকু করতে লাগল। তার এটাও মনে হলো তিনি তাদের দেখতে না পেলে সত্যি পাগল হয়ে যাবেন। এদিকে মিরন গ্রæপে সঙ্গে যে চুক্তিটা করার কথা চলছে সেটা সময়মতো না করলে তার কোম্পানির কয়েক কোটি টাকা লস হবে। এটাও তিনি কিছুতেই মানতে পারছেন না। ডিলটা হলে তৈয়ব আখন্দ ঠিক করেছেন সপরিবারে মালদ্বীপ যাবেন। আস্ত একটা দ্বীপ ভাড়া নেবেনে দশ হাজার ডলার দিয়ে।

এক বছর পর। স্যুট টাই পরা কেতাদুরস্ত তৈয়ব আখন্দ। কয়েকদিন হলো ঠিক রাত দশটায় অপেক্ষা করেন একটা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে। এখানে প্রতিদিনই হুবহু তার মতো দেখতে টাক মাথাওয়ালা একটা লোক আসেন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন। বদ্ধ মাতাল অবস্থায় গাড়িতে চড়ে বসেন। তারপর ড্রাইভারকে শাসাতে থাকেন অকারণে। ড্রাইভার র্স্টাট দেয় পাজেরোর ইঞ্জিন। লোকটা ড্রাইভারকে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আরজু মিয়া! আরজু মিয়া! আমাকে ফ্ল্যাটে নিয়া যাইবা না! খবরদার! আমি ওদের কারো মুখ দেখতে চাই না। আমার ঘর সংসার নাই। আমি ইছামতির নদীর তীরে থাকতে চাই। আমার তিন ক‚লে কেউ নাই। আমি শান্তির জীবন চাই! শান্তির জীবন চাই! আমারে বাঁচাও!’

এরপর একদিন জাফর আহমেদকে আর গাড়িতে উঠতে দেখা গেল না। বমি করতে করতে হুঁশ হারিয়ে পড়ে রইলেন নর্দমার পাশে।

জাফর আহমেদের গাড়িতে চড়ে তৈয়ব আখন্দ ড্রাইভারকে বললেন, ‘আরজু মিয়া, দেখেশুনে চালাও। কেউ গাড়ি থামাতে বললে থামাবে না। টেকো মাথার ভুড়িওয়ালা কোনো মানুষ, যার পেছনে কয়েক গাছি চুল, এমন কাউকে দেখলে ঘুণাক্ষরেও তাকাবে না!’

storiesঅতিপ্রাকৃত গল্পধ্রুব নীলধ্রুব নীলের বই