তবে রেডিওতে কী গান হচ্ছে সেদিকে নীলার খুব একটা আগ্রহ নেই। তার চোখে এখন তেপান্তরের স্বপ্ন। চরম আগ্রহ নিয়ে কোন কিশোরী যে কোন সুদর্শন যুবকের দিকে চেয়ে থাকে নীলার স্বপ্ন তার চেয়েও দৃঢ়। এই ইট কংক্রিটের ঢাকা শহরে তার স্বপ্ন চাপা পড়েনি। মনের কোনে অতি যত্নে লালন করে সেই স্বপ্ন। ছাপোষা পরিবারের মেয়েগুলোর অধিকাংশই এরকম হয়ে থাকে, হিমালয় সমান স্বপ্ন আর সর্ষে দানা পাথেয়। তবে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড যতটুকু এগিয়েছে তা অবশ্য নীলার স্বপ্নের ওপর ভর করেই। এই ভ্যাপসা গরমে বসেও সে ভাবছে ছোট ভাইকে মানুষ করতে হবে, ছোট বোনের অনেক বই কেনার বাকী আর বাবার ঋণের কিস্তির টাকা!
হঠাৎ খটখটানি আওয়াজ। দাঁত খেঁচিয়ে কনডাকটর বলল, ‘আপা, কই নামবেন?’
কান থেকে এয়ারফোন সরিয়ে নীলা ভাবলেশহীনভাবে বলল, ‘কী?’
আবারও বলল, ’কই নামবেন?’
– শাহবাগ।
– কী কন? শাহবাগ তো আরও দুই স্টোপেজ আগে ফালায়া আইছি।
– ওহ! সরি মামা, তাহলে এখানেই আমাকে নামায়া দেন।
হেলপার মহা বিরক্তি নিয়ে বাসের গায়ে জোরে একটা থাবা দিয়ে দরাজ গলায় বলল, ‘ওস্তাদ, আস্তে লেডিজ নামবো।’
নীলা বাস থেকে নামার পরেও কন্টাক্টর বিরবির করে গালমন্দ করেই চলেছে। আসলে কন্টাক্টরেরই বা কী দোষ? যাত্রীরা ভুল করে অতিরিক্ত পথ এলেও তো আর অতিরিক্ত ভাড়া দেয় না, তাই এটুকুই বাস মালিকের লস বলা যায়।
আজকে নীলার দিনটাই ভাল যাচ্ছে না। সকালে এ্যালার্ম মিস করায় ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে। নাস্তা না করেই একরকম দৌড়ে ক্লাসে গিয়েও ক্লাসটা ধরা যায়নি। পানি থাকায় দুপুরে ঠিকঠাক গোসলটাও করা হয়নি। ক্যান্টিনে গিয়ে সেই কলা-আলুর তরকারিতে এত্তবড় একটা তেলাপোকা পেয়ে ক্ষুধাটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। টিউশনির বাসায় যদি চা-বিস্কুট না দিত তাহলে আজ সেন্সলেস হয়ে পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। শাহবাগের দিকে হাঁটতে হাঁটতে নীলার এরকম হাজারো কথা মাথায় আসছে। একবার তাঁর মনে হলো আজ বুঝি ‘চিন্তা দিবস’! তা না হলে এত চিন্তা আসবে কী করে? সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগে থেকেই চিন্তা শুরু হয়েছে, এখনও চলছে। হয়ত রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্তই চিন্তা তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। বাড়তি পথটুকু ফিরতে নীলা রিক্সা বা বাসের সাহায্য নিল না। এমনিতেই সারাটা দিন নানান জিনিস মাথায় ঢুকেছে এখন তাই ওগুলো একটু বের করার চেষ্টা করা আর কি। তবে কয়েকজন বখাটের আগমনে সেই চেষ্টায় ভাটা পড়ল। নীলা কিছুটা বিরক্ত নিয়েই বললঃ কী ভাই, কিছু বলবেন?
– না, মানে.. আপনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
-কিন্তু আপনাদের কোনভাবেই আমার চেনা মনে হচ্ছে না।
– না, মানে.. কোথাও দেখা হয়েছিল মনে হয়।
– তাহলে আমার মামার বাসায় দেখা হয়েছিল। মামা তো রাস্তার কন্ট্রাকটারির কাজ করে তাই অনেক লেবারই মামার বাসায় কামলা দিতে আসে, আমি তো মামার বাসায় থাকলে তাদেরকে খাবার দেই। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আপনারাই তো ওখানে ছিলেন। হ্যঁ, হ্যাঁ- আপনার রমজান না? আর উনি তো কাসেম? আপনারা ভাল আছেন? এখন কোথায় কামলা দেন? যাইহোক, আপনাদের কাজ কিন্তু খুব ভাল ছিল। মামা আপনাদের খুব সুনাম করে এখনও!
দুই বখাটে এমন সেয়ানার হাতে মনে হয় এই প্রথম। কী বলবে আন্দাজ করতে না পেরে সোজা হাঁটা দিল।
ছোট বেলা থেকে বখাটে তো কম দেখেনি নীলা, এদের শায়েস্তা করতে করতেই এক প্রকার বড় হয়েছে বলা যায়।
নীলার মনে হলো গরম কমেছে একটু। অবশ্য শরতের আগে সন্ধ্যার সময়টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটু ঠান্ডা পড়ে বৈকি! তাছাড়া এসময়ের সন্ধ্যার একটা গন্ধ আছে। হালকা বাতাসের সঙ্গে মিশে একটা মাদকতার আবহ সৃষ্টি করে এই গন্ধ। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় শাহবাগের কাছাকাছি চলে এসেছে নীলা। শাহবাগ ফুলের দোকানের কাছে এসে মনটা ভরে যায় নীলার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টি তার ভাল লেগেছে তা হলো শাহবাগের ফুলের দোকান। ইট-কংক্রিটের এ শহরে এত এত ফুল যেভাবে সাজিয়ে রাখা তাতে মনে হয় ভালবাসা এখনও মরেনি। নীলা ফুলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। একটা বেলি ফুলের মালাও কিনে নিল। পাশ ফিরে দেখে অনন্ত। অনন্ত, তুই এখানে?
অনন্ত নীলার ছোটবেলার বন্ধু। একটু অগোছালো টাইপের ছেলেটি নীলার ব্যাপারে খুব অন্য টাইপের। মাঝে মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নীলার হলের পাশে বসে থাকে। যদি কালক্রমে নীলার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তাহলে বসে গল্প করে, খোঁজ খবর নেয়, বাড়ি যাবে বলে নীলার বাসায় কিছু দিতে হবে কিনা জানতে চায়। তবে এপর্যন্ত অনন্ত কখন যে বাড়ি যায় তা অবশ্য কেউ ঠিক ঠাক বলতে পারেনি। এবার অনন্ত অনেক দিন পর এলো। চুল-দাড়ি ঠিক মতই কাটা এবং বরাবরের মতই ভাবলেসহীন। নীলার প্রশ্নে খুব একটা বিচলিত না হয়েই বলল, ‘এই তো, ব্রিটিশ কাউন্সিলে আসছিলাম।’
-বাড়ি যাবি এর মধ্যে?
-হ্যাঁ। তোর কিছু পাঠাতে হবে?
-ছোট ভাইয়ের কয়টা বই পাঠানো লাগত। কিন্তু .. আচ্ছা, পরে দেখা যাবে। আয়, মন্টু মামার দোকানে চা খাই।
অনন্তর আসলে চায়ের তৃষ্ণা পায়নি। কয়েক দিন নীলাকে না দেখে থাকতে পারে না সে। কোন একটা অজুহাতে নীলার কাছে চলে আসে। নীলা কখনই বিরক্ত না হলেও অনন্ত আজ পর্যন্ত হলের সামনে এসে তাকে ফোন দেয়নি। অনেকদিন না দেখা পেয়ে চলেও গেছে কিন্তু তারপরও ফোন দেয়নি। চরম ভালবাসা থাকলেও এরকম হয় কিনা তা হয়ত গবেষণা করে বের করতে হবে তবে নীলার যে অনন্তর প্রতি ভালবাসা টালোবাসা নেই তা মোটামুটি পরিস্কার।
চায়ের দোকানে এগিয়ে যেতে যেতে অনন্ত বললঃ চা খাবো না, চল লেবু পানি খাই।
-ভর সন্ধ্যাবেলা লেবু পানি?
-হ্যা, সমস্যা কি?
-না, সমস্যা নেই। চল।
সারাদিন নীলার যে বাজে অবস্থা গেছে এখন তার অনেকটাই কেটে গেছে। অনন্ত আসলে নীলার খুব ভাল কাটে। ছোট বেলার বন্ধুরা অনেকেই হারিয়ে গেছে কিন্তু অনন্ত এখনও নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবেই নীলার সঙ্গে দেখা করে। এদিন অনেকটা সময়ই অনন্ত নীলার সঙ্গে ছিল, কিছু একটা বলতে চেয়েছিল হয়ত কিন্তু নীলার বকবকানিতে তা আর সম্ভব হয়নি। নীলার পরিবারের খোঁজ নেওয়া ও ভাই বোনদের কোন জিনিস পাঠানোর ছুতোই যতবারই অনন্ত এসেছে নীলার সঙ্গে দেখা করতে ততবারই কিছু একটা বলতে গিয়ে আর বলা হয়ে ওঠে নি। এভাবে চলেছে কয়েকটা বছর।
নীলার এখন ব্যস্ততা বেড়েছে। অনন্ত এখনও আসে আগের মতই হঠাৎ হঠাৎ। কখনও দেখা হয় আবারও কখনও হয় না। কোন কোন দিন নীলাকে দেখেও ডাকে না অনন্ত। হয়ত নিজেকে যোগ্য ভাবে না অথবা কোন দ্বিধা কাজ করে মনে। এই সেদিনই নীলার জন্য বেলি ফুলেরও মালা এনে তাকে না দিয়েই চলে গেছে অনন্ত। এ ব্যর্থতায় যে কোন কষ্ট আছে তা অনন্তকে দেখে বুঝার জো নেই। নীলার সঙ্গে দেখা করে খুব বেশি গল্পও করে না অনন্ত। নীলার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে, মাঝে মধ্যেই মাথা ঝোঁকায় বিজ্ঞের মত, আর যাওয়ার সময় বলে ‘ভাল থাকিস’। নীলা-অনন্তর সাক্ষাতের ব্যাপ্তী এটুকুই, যদিও এর বেশি কিছু হলেও তা কোন বিখ্যাত প্রেমের উপন্যাস হত না কারণ অনন্ত চিরকালই নিজেকে নিজের কাছে রেখেছে।
এভাবেই কেটে যায় পাঁচ বছরের বেশি সময়। ব্যস্ততার ভীরে প্রিয় ক্যাম্পাসেও আর আগের মত আসা হয় না। জীবন এরকমই। কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক জীবনের প্রত্যেকটা অভিজ্ঞতাই মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। এক সন্ধ্যায় অনন্ত বসে ছিল ক্যাম্পাসে মন্টু মামার দোকানে। চা খাবে কি খাবে না সেই চিন্তার মধ্যেই ঢুকে পড়ল লাল চকচকে গাড়ি। অনন্তের যে জগৎ ও ব্যক্তিত্বেও প্রসারতা তাতে অবশ্য গাড়িওয়ালা কারও আসার কথা নয়। জ্বানালার কাঁচ নামিয়ে ফুটফটে বাচ্চা কোলে নীলা বললঃ অনন্ত? তুই এখানে?
সেই ভাবলেসহীনভাবেই অনন্ত বললঃ এই তো, এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম মন্টু মামার দোকানে এক কাপ চা খেয়ে যাই।
নীলা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বাচ্চার কান্নায় আর কিছু বলা হলো না। গাড়িটা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় নীলার দিকে তাকিয়ে অনন্ত বললঃ ‘ভাল থাকিস।’
নীলার চোখ অবশ্য তখন আর দেখা যাচ্ছিল না।