রোমান্টিক উপন্যাস: ছায়া এসে পড়ে পর্ব ৮ ও ৯

রোমান্টিক উপন্যাস: ছায়া এসে পড়ে পর্ব- ৮ ও ৯

রোমান্টিক থ্রিলার ঘরানার বইটি মধ্যবয়সী পুরুষ তৈয়ব আখন্দকে ঘিরে। জীবন সংসারের প্রতি খানিকটা উন্নাসিক কিন্তু বুদ্ধিমান এ মানুষটা পালিয়ে বেড়াতে চায়। কিন্তু আচমকা টাঙন নদী ঘেঁষা গ্রাম পদ্মলতায় এসে সে আটকা পড়ে চাঁদের আলোয় ঝুলতে থাকা একটা লাশ আর লাবনীর জালে। তৈয়ব নিজেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। চলতে থাকে জড়িয়ে পড়া ও ছাড়িয়ে আনার মাঝে এক সমঝোতা।

রোমান্টিক প্রেমের গল্প ও একই সঙ্গে থ্রিলার স্বাদের উপন্যাস ছায়া এসে পড়ে । লেখক ধ্রুব নীল

কুরিয়ারে হার্ড কপি পেতে এই পেইজে অর্ডার করুন

 

ছায়া এসে পড়ে পর্ব -১  এর লিংক

ছায়া এসে পড়ে পর্ব -২  এর লিংক

ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৩  এর লিংক

ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৪  এর লিংক

ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৫  এর লিংক

ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৬  এর লিংক

ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৭  এর লিংক

 

 

 

‘হ্যালো।’

‘মিনু আছে?’

‘ও স্কুলে। ফিরলে ফোন দিও।’

‘ঘরে কে?’

‘ঘরে আরিফ। কাল রাতে ছিল। একসঙ্গে ড্রিংকস করেছি। আমাদের মধ্যে সেক্সও হয়েছে। ডিটেইলস জানতে চাও?’

‘মিনু?’

‘মিনুকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আরিফ যখন আসে, মিনুকে মায়ের কাছে দিয়ে আসি। ওর আলাদা রুম আছে। ওর জন্য একজন উচ্চশিক্ষিত গভর্নেসও রেখেছি। তার বেতন তোমার চেয়ে বেশি।’

‘আমার তো চাকরিই নেই। যাই হোক, ও ফিরলে ফোন দিও।’

‘কেন? ফোন দেব কেন? হু আর ইউ?’

‘একটু আগে বললে ফোন দিতে।’

‘বললে বলেছি। এখন বললাম, দিবো না।’

‘না দিলে ভয়ানক কাণ্ড ঘটবে। তোমাকে খুন করার জন্য লোক পাঠাবো। আমার হাতে এখন একজন ভাড়াটে খুনি আছে।’

‘তোমার মতো চামচিকা মার্কা লোক কী ঘটাতে পারে আমি দেখতে চাই। নাহ, ভুল বললাম। দেখার কোনও আগ্রহ বোধ করছি না।’

‘আরিফ ছেলেটা এখনও আছে?’

‘কেন থাকবে না। আমি তার কোলের ওপর বসে আছি। ভিডিও কল দেব? দেখবে?’

হাই তুললো তৈয়ব। এ হাই কি অভিনয়? সে নিজেও বুঝতে পারছে না। মাথায় চাপা ব্যথা ছিল। ক্লোনাজেপামের ডিব্বা নিয়ে এসেছে সঙ্গে। কয়েকটা ফার্মেসি ঘুরে কিনতে হয়েছে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেউ দিতে চায় না। একসঙ্গে অনেকগুলো কিনে বক্সে পুরে রেখেছে।

‘শোনো রেবেকা। ঘরে আরিফ নেই আমি জানি। তুমি মনযোগটা এখন আমার কথায় দাও। কিছুদিন একটু  গুলশানে তোমার বাবার প্রাসাদে গিয়ে থাকো। ওইখানে বডিগার্ডের অভাব নাই। আরিফ ছেলেটার বাসায় গিয়েও থাকতে পারো। তবে মিনু থাকবে তার নানীর কাছে।’

‘আমাকে জুজুর ভয় দেখাচ্ছো?’

‘জুজু না, ওর নাম রবিউল। ধুরন্ধর ভাড়াটে খুনি। আমার কাছে মুক্তিপণ চায়। তোমাদের সব কিছু জানে। ঠিকানাও জানে।’

‘সেটা নিশ্চয়ই তুমি দিয়েছো।’

‘শোনো দুনিয়ার সব বাবার কাছে তার মেয়ে একদিকে, বাকি মহাবিশ্ব আরেক দিকে। এমনি এমনি বলছি না কথাগুলো।’

‘ঘটনা কী বলতো? কদিন আগে তোমার অফিসের পিয়ন এসে বলে গেলো তুমি নাকি অফিসের টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়েছো?’

‘লোকটা দেখতে বেঁটে? চোখের মণি মারবেলের মতো?’

‘জানি না। হতে পারে।’

‘ওর কথাই বলছি। রবিউল। ভাড়াটে খুনি। বিশ হাজার টাকা দিলে কপ করে কল্লা ফেলে দেয়।’

‘মাই গড!’

‘আর আমাদের অফিসে কোনও পিয়ন নেই। তুমি অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো।’

অপরপ্রান্তে নীরবতা।

‘আমি না বলা পর্যন্ত তুমি আর মিনু গুলশানে চলে যাও। পরে কথা বলবো। আর হ্যাঁ, একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। তোমার ওই বয়ফ্রেন্ড। ওর কাছ থেকে মিনুকে দূরে রাখবে। ওকে আমার সুবিধার মনে হয়নি। তুমি যেদিন ওর সঙ্গে হোটেলে গেলে, ব্রেকফাস্টের সময় আমি তাকে দেখেছি। একটা বাচ্চা মেয়ের দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল। তার ভেতর অস্বাভাবিকতার মাত্রা দশের মধ্যে নয়।’

লাইন কেটে দিল রেবেকা।

মিনুর জন্য আপাতত যেকোনও গল্প সাজাতে পারে তৈয়ব। তবে আরিফের অংশটা পুরোপুরি গল্প নয়। ছেলেটাতে পেডোফাইল জাতীয় মনে হয়েছে।

আপাতত রেবেকার চিন্তা বাদ। এখন বড় চিন্তা এসআই শামীম। ছেলেটাকে যেমন ভেবেছিল তেমন সুবোধ বালক সে মোটেও নয়।এদিকে রবিউল আবার বলে দিয়েছে লাখ টাকা দিলেও সে কোনও পুলিশকে মারবে না।

 

ভর সন্ধ্যায় লাবনীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো টাঙন নদীর পাড়ে। নদীর পাড়ে আজ বিষণ্নতা নেই। পানির কারণে সম্ভবত। উথালপাথাল ঢেউয়ের সঙ্গে সন্ধ্যার মন খারাপ ভাবটাও চলে যাচ্ছে।

‘লোকমান আলী কই? তাকে নিয়ে আসতে। এমন সুন্দর জায়গায় একা কেন তুমি?’

‘নদী দেখতেসঙ্গে কাউরেলাগে না আমার।’

‘মন খারাপ মনে হচ্ছে।’

‘আমার একটা মেয়ের খুব শখ। তোমার যেমন মিনু আছে। আমার মেয়ে হইলে নাম রাখতাম..জানি না। নাম একটা হইলেই হইলো।’

তৈয়ব তাকিয়ে আছে নদীর ওই পারে। খুব একটা বড় না। ঢেউয়ের মাপজোক কষছে মনে মনে।

‘মেয়ের নাম রাখতে শ্রাবণী?’

‘মন পড়তে পারো দেখি।’

‘তোমার বাচ্চা হচ্ছে না লোকমান আলীর কারণে। লোকটার সঙ্গে দেখা করেই বুঝেছি। আমি মানুষ পড়তে পারি লাবনী। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর হাসি শুনেই বুঝেছিলাম, ওই রাতে লোকমান আলী আমার সঙ্গে অভিনয় করেছে। বোঝাতে চেয়েছে সে বিরাট কিছু। অভিনয়টা কেন করেছে সেটা পুরোপুরি ধরতে পারছি না। আর অল্পবয়সী স্ত্রী হলে সে লোকমান আলী টাইপের স্বামী নিয়ে হাসাহাসি করবেই। কারণ তার মধ্যে এখনও মা হওয়ার খায়েশ নেই। যেটা তোমার আছে। তোমার বয়স কত লাবনী?’

লাবনীর ভাবান্তর নেই। হালকা রসিকতায় হাসলো না। তৈয়ব তার মনের কথাপড়ে ফেললেও কিছু যায় আসে না এখন।

তৈয়বের নিজের মাথাটাওএখন আবার হালকা পালকের মতো লাগছে। নদীর পাড়ে আসার আগে কয়েকটা ট্যাবলেট গিলে এসেছে। ঘুম ঘুম লাগছে। নদীর তীরে লাবনীর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লে কেমন হয়? গ্রামবাসী এসে জড়ো হবে। দূর থেকে কেউ বাঁশ দিয়ে গুঁতোও দিতে পারে। দেখার মতো জিনিসের বড়ই অভাব লোকের। তা না হলে এমন মাতাল সন্ধ্যায়নদীর পাড়ে আর কেউ নেই কেন!

‘তুমি চাইলে মা হতে পারো লাবনী। স্পার্ম ব্যাংক বলে একটা বিষয় আছে। ঢাকায় আছে কিনা জানি না। তবে তোমার সন্তান জানবে না, তার বাবা কে। তুমিও জানবে না।আবার চাইলে দত্তকও নিতে পারো।’

‘গ্রামে কে কারে দত্তক দেয়।’

‘এখন আমার কাজ হলো তোমার সন্তানের বাবা হওয়া?’

লাবনীর দিকে তাকালো না তৈয়ব। মেয়েটার অতিরহস্যময় আচরণ এখন ভনিতার মতো লাগছে।

মনের মধ্যে গুনগুন করে একটা কবিতা উড়ে বেড়াচ্ছে তৈয়বের।

যেই সব ছায়া এসে পড়ে,

দিনের রাতের ঢেউয়ে তাহাদের তরে

জেগে আছে আমার জীবন…

ঠাস করে মাছির মতো কবিতাটাকে মেরে ফেলতে পারলে হতো। লাবনীর সঙ্গে কবিতাটা যাচ্ছে না। তারপরও মাথা থেকে সরছে না। ভাঙা রেকর্ডের মতো বেজে যাচ্ছে।

‘লাবনী তুমি হলে নদীর মতো। ডেঞ্জারাস।’

‘জি। কথা সইত্য। আমি রবিউলের চাইতেও ডেঞ্জারাস। মা হওনের জইন্য আমি খুন করতেও রাজি। তাতে অবশ্য কাজ হইব না।’

‘তোমারনদীর স্রোত বোঝা যায় না। নামলে আবার সাঁতরে কূলও পাওয়া যাবে না।’

‘সাঁতার কাটবেন কেন? নদীতে ভেসে বেড়াবা। মাছ ধরবা। তারপর সুযোগ বুঝে পাড়ে উঠে পড়বা।’

তৈয়বের ইচ্ছে করলো লাবনীর হাত ধরে নদীর তীরে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ায়। লাবনী একটা কালো শাড়ি পরে এসেছে। শাড়ির রং নিয়ে মাথাব্যথা নেই তৈয়বের। শাড়ি না পরে সেলোয়ার কামিজ পরলেও বা কী যায় আসে। আবার যায় আসেও। নদী, নারী, শাড়ি এগুলো কি প্রতিশব্দ? তৈয়ব জীবনেও কবিতা লেখেনি। এখন লিখতে ইচ্ছে করছে। কাগজে কলমে নয়।

‘চলো লাবনী, দুইজনের মিলে একটা কবিতা লিখি। আজ রাতে। নৌকায়।’

হঠাৎ কী হলো লাবনীর। ঝট করে তৈয়বের বাহু খামচে ধরলো।

‘তুমি এখুনি ঢাকা চইলা যাও। রাতে ডাইরেক বাস না পাইলে এই বাস ওই বাস ধরে যাও। অটো নিয়া অন্য গেরামে যাও। তারপর…।’

‘আমাকে কেউ মারতে আসছে নাকি। যে এসেছিল তাকে তো বুঝিয়ে শুনিয়ে বিদেয় করেছি। সে এখন আমার কবজায়।’

‘যা কইতাছি করো। একবার ফাঁইসা গেলে শেষ।’

‘কে ফাঁসাবে আমাকে? তোমার সঙ্গে আজ সারারাত মাঝনদীতে নৌকায় থাকবো ঠিক করেছি। সারারাত ভাড়া পাঁচ শ টাকা। এক শ টাকা বখশিশ দিতে হবে। ছইওয়ালা নৌকা। কেউ কিচ্ছু টের পাবে না।’

‘তুমি রাতেই যাইবা। অনুরোধটা রাখো।’

শেষ মুহূর্তে একেবারে রুদ্রের পত্নীর মতো হয়ে গেলে যে?’

‘তোমারে আমি খুব মনে করবো তৈয়ব। তুমি…।’

শেষবাক্যে এক ফোঁটা রহস্য রেখে দ্রুত চলে গেল লাবনী। দুয়েকবার পেছন ফিরে দেখলেও তৈয়বকে আর দেখা যাওয়ার কথা নয়। মেঘ এসে ভরে গেছে আবার। ঝড়ের আগের শান্ত প্রকৃতির ব্যাপারটা টের পাচ্ছে তৈয়ব। নাহ, সে লাবনীর মতো নয়।

একা একা নদী দেখতে ভালো লাগছে না। হাঁটা দিল বাড়ির পথে।

 

সকাল আটটা না বাজতেই দরজায় খটাস খটাস। এমন করে ধাক্কা দেয় কারা? হয় ঢাকা থেকে রেবেকা আর মিনু এসেছে আর না হয়…। চিন্তা শেষ হওয়ার আগেই দরজাটা মোটামুটি ভেঙেই গেলো।

‘তৈয়ব সাহেব। আপনারেএরেস্ট করা হলো। থানায় চলেন।’

এসআই শামীমের সঙ্গে দুজন কনস্টেবলও আছে। তাদের একজন লাথি দিয়ে একটা টুল ফেলে দিলো। শরবানু তেড়ে এলো ভেতর থেকে। পুলিশ দেখে চুপসে গেল। তাকে ইশারায় শান্ত থাকতে বলল তৈয়ব।

হাতকড়া জিনিসটাকে যেমন ভেবেছিল তেমন না। বেশ ভারী। চুলকানোর সুযোগ নেই। এসআই শামীমের পাথরের মতো চোখ দেখে তৈয়ব ধারণা করতে শুরু করেছে, তার বিরুদ্ধে কেইসটা কড়া। তার শ্বশুরকেও নিশ্চয়ই ব্যাপারটা জানানো হয়েছে। তিনি সব শুনে জামাতার কাছ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছেন নিশ্চয়ই।

তা হলে কি মিজান আলীকে খুন করার অভিযোগ? রবিউলের কথামতো ঘটনাস্থলে প্রমাণ পেয়েছে? ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট চলে এসেছে? তাকে কি কোর্টে চালান দেওয়া হবে? নাকি তার আগে খানিকটা উত্তম-মধ্যম চলবে। দেখা যাবে উকিল আর জামিনের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে বছর পার। এই এক বছরে তাকে যদি মিনু ভুলে টুলে যায়? বড় হয়ে দেখা যাবে একজন দাগী আসামিকে সে বাবা পরিচয় দেবে না কিছুতেই।

দেওয়াটা ঠিকও হবে না। তার মানে হিসাবে হাতে আছে দুই থেকে তিনদিন। এর মধ্যে এই জটলা থেকে বের হতে হবে তৈয়বকে। জটলা না খুললেও সমস্যা নেই। জেলখানায় নতুন আরেক জীবন শুরু করবে তৈয়ব। সে তো জীবনের সন্ধানে আছে। তবে জেলখানায় মিনুর দেখা পাবে না। রেবেকা মিনুকে নিয়ে ভুলেও কারাগারে আসবে না তাকে দেখতে।

‘আমার ওষুধের ব্যাগটা…।’

‘সজোরে লাথি পড়লো তৈয়বের পায়ে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সময় লেগে গেলো। উঠানে পুলিশের গাড়ি। পেছনে শরবানু বিলাপ জুড়ে দিয়েছে।

‘এতো বড় মাছটা কিনলিরে বাপ, এইডা খাইয়া যাইতে পারলি না..।’

‘এক কাজ করো চাচী। তুমি না খেলে মাছটা লাবনীকে দিয়ে আসো।’

‘ওই হারামজাদীরে দিমু ক্যান। ওই মাগীই তরে ফাঁসাইছেরে বাপ। আমি কইসিলাম সাবধানে থাকতে।’

চাচী কবে সাবধান করেছিল মনে পড়ছে না তৈয়বের। তবে এসআই শামীমের চেহারা দেখে তৈয়ব আঁচ করছে, ঘটনা মিরাজ আলী সংক্রান্ত না-ও হতে পারে। তবে কি শামীম বুঝে গেছে বিষয়টা? তৈয়ব যে ঝরনার খুনের সূত্র পেয়ে গেছে, এটা জানা মাত্রই সে তৈয়বকে গ্রেফতার করতে ছুটে আসেনি তো? এবার নিশ্চয়ই জানা যাবে ঝরনার মৃতদেহের পাশে তৈয়বের হাতের ছাপওয়ালা সিগারেটের প্যাকেটও পাওয়া গেছে।

 

সায়েন্স ফিকশন ২০২১ রক্তদ্বীপ

হাজতবাসের দ্বিতীয় দিন। প্রথম দিন বিশেষ কিছু ঘটেনি। রবিউল ছিল সঙ্গে। তাকেও ধরে আনা হয়েছে। সম্ভবত খুনের সহযোগী হিসেবে।

অবাক কাণ্ড। মারধর করার পরও রবিউলের চুলের পরিপাটি ভাবটা যায়নি। তৈয়বও ধরে নিয়েছিল তাকেও মারা হবে। তা হয়নি। পরে আবার ঝামেলা হতে পারে, এই ভেবে হয়তো। ক্ষমতাধর শ্বশুর থাকার সুফল।

রেবেকাও চাইবে না মিনু বড় হয়ে জানুক যে তার বাবা পুলিশের হাতে মার খেয়েছে।

‘তৈয়ব সাহেব। আপনার কেস খুব ঘোরালো। পুলিশের পরিবারকে খুন করেছেন। আপনি মিনিস্টারের নাতি হলেও লাভ নাই। আপনার কেউস হ্যান্ডল করবে উপর থেকে। আজমল সাহেবের টেকাটুকার জোর সেইখানে খাটবে না।’

‘উনি কি আপনাদের টাকাপয়সা দিয়েছেন? না দিলেও খুব তাড়াতাড়ি পাঠাবেন। চিন্তার কারণ নাই।’

ওসি জবাব দিল না। তৈয়ব গত দুুদিন হলো ক্লোনাজেমপাম খাচ্ছে না। মগজ বিদ্রোহ শুরু করেছে। আগের সেই উটকো প্রতিভা বার বার ফিরে আসতে চাইছে। তৈয়ব বহু কষ্টে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছে। নিজের প্রতিভাকে নিজেই ভয় পায়।

এতদিন প্রতিভা ছিল ছাই চাপা। এখন সেই ছাই পড়ে আছে শরবানুর ঘরের একটা টেবিলের ড্রয়ারে।

‘কাউকে বলে কি আমার ওষুধটা এনে দেওয়া যায়?’

‘ওই ওষুধ আমরা দেখেছি। ওটার প্রেসক্রিপশন নেই আপনার কাছে তৈয়ব সাহেব। আমরা হাজতিদের ড্রাগ সাপ্লাই দেওয়ার জন্য বেতন নিই না।’

‘ওষুধ ছাড়া আমি আবার…।’

‘খামোকা কতা কন ক্যান। চুপ কইরা থাকেন।’

কথা ফুটলো রবিউলের মুখে। রবিউল যথেষ্ট চুপচাপ। গাছের কাজ করতে করতে গাছের মতো হয়ে গেছে।

পান খাওয়া ভুড়িওয়ালা ওসি নন এই ভদ্রলোক। তৈয়ব তার দিকে তাকাতে পারছে না। তাকালেই একগাদা তথ্য ধরা দেবে যেন। ওষুধটা ছাড়া তার মাথা বেয়াড়া রকম আচরণ শুরু করে। সব পড়ে ফেলে খোলা বইয়ের মতো।

ওসি এখন খোলা একটা সমাজবিজ্ঞান বই। সব পরিপাটি। সাজানো গোছানো সংসার। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, তা নিয়ে আমাদের ওসি সাহেব।

‘বিড়বিড়ানি বন্ধ করেন।’

‘চুপ থাক! রবিউলের বাচ্চা রবিউল। না হয় তোর বাবা যেমন ছোটবেলায় তোকে মারধর করতো, আমিও তেমন শুরু করবো।’

সবাই সমাজবিজ্ঞানের বই নয়। রেবেকা হলো কঠিন মেটাফিজিক্সের বই। রবিউল হলো হরর গল্প। সে খুন করতে মজা পায়। সারাক্ষণ তার মাথায় কেবল খুন করার নিত্য নতুন ফন্দি ঘোরে।

লাবনী কোন বই? মাঝে মাঝে সস্তাদরের উপন্যাস মনে হয়। মাঝে মাঝে জীবনানন্দের কবিতা।

ওসির বইয়ের প্রথম পাতাতেই লেখা তিনি ধূমপান ছেড়েছেন বেশিদিন হয়নি। চাপা অস্থিরতা। ঠোঁটে কালশিপে দাগটা উবে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই বাম পাশে কাত হয়ে কাজ করছেন। ডান পাশে চাপ লাগতেই চেহারা কুঁচকে যাচ্ছে। লিভারে সমস্যা আছে মনে হচ্ছে।

‘ওসি সাহেব আপনার স্ত্রীকে ফোন দিন। উনি সম্ভবত বেকায়দায় আছেন। মানে হাসপাতালে যেতে হতে পারে। আপনি কন্যাসন্তানের পিতা হতে চলেছেন।’

তৈয়বের সব খবর নিয়ে ওসি সিরাজউল্লাহ। সে দুদিন ধরে হাজতে। ওসির ঘরবাড়ি কোথায় সেটাও তার জানার কথা নয়। জানলেও তার এটা জানার কথা নয় যে মেরিনার ডেট ঘনিয়ে আসছে। যখন তখন হাসপাতালে নিতে হবে ডেলিভারির জন্য।

‘আপনার প্রথম সন্তান.. যাই হোক.. দেরি করবেন না। থানার কাজ এসআই শামীম সামলাতে পারবেন।’

ওসি এবারও কথা বললেন না। কাঁপা হাতে ফোন ডায়াল করলেন। কয়েকবার হু হা করলেন। তারপর আগুনচোখে তাকালেন তৈয়বের দিকে।

‘জ্যোতিষগীরি মারাস আমার সঙ্গে? হারামজাদা তুই কী করে বুঝলি আমার স্ত্রী প্রেগনেন্ট? এইমাত্র কথা বললাম, সে ভালো আছে। কোনো বিপদ হয় নাই। আমারে মিছামিছি ভয় দেখাস শালা?’

‘আমি এমনি এমনি সব জানি। পীর বংশের ছেলে।’

গালি খেয়ে চুপসে গিয়েছিল রবিউল।এবার সামান্য সরে বসলো। লোকটা এমনিতে কুসংস্কারে বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। তবে তৈয়বপীর বংশের শুনে সম্ভবত সামান্য সমীহ করছে। পেশাদার খুনি হয়েতৈয়বের কাছাকাছি বসাটা তার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে না। এদিকে ওসি দাঁত চিবিয়ে বলেই যাচ্ছেন।

‘আজমল সাহেব না থাকলে এর মধ্যে তোর জন্য সেদ্ধ ডিম আনাতাম হারামজাদা।’

‘ডিমের কাজটা কে করে? কনস্টেবল হাদি নাকি আকমল? আহারে কী ভয়াবহ একটা কাজ করতে হয় বেচারাদের।’

ওসি ধমক দেওয়ার আগেই ফোন বেজে উঠলো। অস্থিরচিত্তে এদিক ওদিক হাত ছুড়তে গিয়ে পেপারওয়েট ফেলে দিলেন। ওটা গড়িয়ে চলে এলো রবিউলের পায়ের কাছে। রবিউল লুফে নিলো ওটা।

‘পানি ভেঙেছে মানে কী। আচ্ছা আচ্ছা। সাইফুলকে গাড়ি নিয়ে পাঠাচ্ছি। তুমি এককাজ করো। পাশের বাড়ির মাজেদা না সাজেদা তাকে বলো একটা অটো ঠিক করে হাসপাতালে যেতে। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি।’

গাড়ি পাঠাচ্ছি বললেও ওসি সিরাজউল্লাহ নিজেই গাড়ি নিয়ে রওনা হলেন। তৈয়ব জানে ঘটনা সিরিয়াস না। মিনুর জন্মের সময় সেও এমন অস্থির হয়ে গিয়েছিল। বারবার অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করার পর তার মনে পড়েছিল গ্যারেজে রেবেকারই একটা গাড়ি আছে।

‘ভাইজান, আপনে আসলেই পীর বংশের? সব আগাম দেখেন?’

রক্তবন্দি

‘জ্বি না। আমি পীর বংশের না। আমার মাথা একটু জট পাকানো। এটাই সমস্যা। তবে রবিউল তোমার মাথা পরিষ্কার। যা ভাবো তাই করো। মানুষকে যন্ত্রণা দিতে বড়ই মজা পাও। ছোটবেলায় তোমাকে যেমন যন্ত্রণা দিয়ে মজা পেততোমার বাবা। তারপর তুমি বোধহয় তোমার বাবাকে মেরে ফেলছো। সম্ভবত গাছ ছেনার কাটাইল দিয়া। ঠিক বলেছি না?’

রবিউল আরও খানিকটা দূরে সরে বসলো। এবার আর তৈয়বের দিকে সরাসরি তাকাচ্ছেও না। তৈয়বও সটান শুয়ে পড়লো মেঝেতে। বেশিক্ষণ বসে থাকলে আবার ব্যাক পেইন শুরু হবে। শুয়ে শুয়েই ব্যাখ্যা করলো-

‘শোনো রবিউল। পীর দরবেশের কারবার না। চোখকান খোলা রাখলে তুমিও পারব। ওসির টেবিলে একটা পুরান ছবি। তাতে একটা বাচ্চা আর তার বউ। বউসহ নতুন ছবিও দেখলাম। কিন্তু বাচ্চার আর কোনও ছবি দেখলাম না। বুঝলাম প্রথম বাচ্চাটা কোনও কারণে মারা গেছে। ডেস্ক ক্যালেন্ডারে আজকের আর গতকালের তারিখটা দেখলাম গোল করা। গতকাল তো পার হয়ে গেছে। আজকে মে’র ১৭ তারিখ। ওসি বারবার মোবাইল দেখছে। ওসির মতো মানুষ বারবার মোবাইল দেখবে কেন। তারা মোবাইলের ওপর থাকবে বিরক্ত। আবার তিনি চাইলেই তো ফোন করতে পারেন। তা করেননি। তারমানে তিনি অপেক্ষায় আছেন ফোন আসার।ওসি সিগারেট ছেড়েছেন সম্ভবত নয়-দশ মাস আগে। স্ত্রীর পেটে বাচ্চা বলেই সিগারেট ছেড়েছেন। এটা একটা বিশাল কাজ। এসব দুয়ে দুয়ে চার দুয়ে ছয় করতে করতে অন্ধকারে একটা ঢিল ছুড়ে দিলাম। ঢিল লেগে গেছে।’

রবিউল শুনলো কিনা বোঝা গেল না। তবে কিছু বললো না। সে পড়ে আছে তার অতীতে। সে বুঝে গেছে তার পাশে শুয়ে থাকা সাধাসিধে লোকটা পীর দরবেশের চাইতেও ডেঞ্জারাস। রবিউলের ব্যাপারে যা যা বলেছে সবই প্রায় সত্য। তবে রবিউলকে যন্ত্রণা দেওয়া লোকটা তার বাবা ছিল না, ছিল আপন চাচা। তার বাবাও ছিল গাছি। বাবা মারা গিয়েছিল গাছ থেকে পড়ে।এরপর চাচার ঘরে যায় সে। যন্ত্রণার সীমা-পরিসীমা ছিল না। কাউকে বলাও যেতো না সে কথা।

এক রাতে ঘরে আর কেউ ছিল না। চাচার মাথায় গুনে গুনে পঞ্চাশটা বাড়ি দেয় হাতুড়ি দিয়ে।এরপর আফসোসে রবিউলের ঘুম হয়নি অনেক রাত। হাতুড়ির দুটো বাড়িতেই চাচা মারা যায়। লোকটা এত সহজে মারা যাবে এটা চায়নি রবিউল।

হাতুড়ির বাড়িগুলো পায়ের গোড়ালি থেকে দেওয়া শুরু করতে পারতো। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটুতে, তারপর উরুতে, তারপর অণ্ডকোষে। এসব ভাবলে রাগ চড়ে রবিউলের। রাগ কমাতে সে হাতের পেপারওয়েটটা নাড়াচাড়া করতে থাকে। তৈয়বের মনে সূক্ষ্ম সন্দেহ রবিউল পেপারওয়েট দিয়ে তাকে আঘাত করার চেষ্টা করবে। এসব সিরিয়াল কিলার আটকা পড়ে গেলে বিড়ালের মতো হয়ে যায়। হাতের কাছে যাকে পায় তাকে খামচি দেওয়ার চেষ্টা করে।

সন্ধা নাগাদ খবরটা এলো থানায়। কন্যার বাবা হয়েছে ওসি সিরাজউল্লাহ।রবিউলের ভেতরে প্রশ্নটা এতক্ষণ ছাইচাপা ছিল। লাফিয়ে উঠে তৈয়বের কাছে জানতে চাইল, ‘মাইয়া হইব, এইটা জানলেন কেমনে? এইটা কই লেখা ছিল?’

‘এটা পুরোপুরি আন্দাজে বলিনি। ছবিতে দেখলাম ওসির স্ত্রীর আঙুলগুলো বেশ লম্বা। লম্বা আর চিরল আঙুলের মেয়েদের কন্যাসন্তান বেশি হয় জানি।’

চুপ হয়ে গেলো রবিউল। হাতের পেপারওয়েটটার ওজন পরীক্ষা করছে বারবার। কত জোরে বাড়ি দিলে মানুষ মরবে, সেটা বুঝতে পারছে না বোধহয়।

এসআই শামীম মিষ্টি বিলাচ্ছেন। তৈয়বকেও হাজতের শিকের ভেতর হাত গলিয়ে মিষ্টি দিল একটা। রবিউল চাইল। তাকে দিল না। তৈয়ব নিজেরটাই বাড়িয়ে দিল রবিউলের দিকে। রবিউল পেপারওয়েটের মতো মিষ্টিটাকেও চেপে থেবড়ে ফেলল। তৈয়বের ভয় কিঞ্চিৎ বেড়ে গেল তাতে।

মিষ্টির রস চুইয়ে পড়ছে শামীমের গাল বেয়ে। তার চেহারায় এখন আর ফুলবাবু ভাব নেই। কুতকুতে একটা ভাব আছে। কালকেউটের মতো। সে জানে, তৈয়ব আখন্দ বুঝতে পেরেছে সে-ই ঝরনাকে খুন করেছে। তবু ভাবান্তর নেই শামীমের।

‘তৈয়ব ভাইয়ের তবিয়ত ভালো?’

‘জি ভালো। মারধর হয়নি তো। তাই ভালো। তবে আপনাকে নিয়ে চিন্তায় আছি।’

‘আমাকে নিয়ে তো চিন্তা করবেনই। আমিই তো আপনারে থেরাপি দিবো আজকে। থেরাপি দেওয়ার পর আপনি সব স্বীকার যাবেন।’

‘জ্বি অবশ্যই। আপনি বললে আমি মহাত্মা গান্ধীরও খুনি। টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে গিয়ে তাকে খুন করে এসেছি।’

‘ঘটনাস্থলেই প্রমাণ পাওয়া গেছে।’

‘জ্বি অবশ্যই। আমি ঝরনা বেগমকে সার্জিকেল ব্লেড দিয়ে গলা কেটে খুন করেছি। তারপর বরফকল থেকে বরফ এনে ভিজিয়ে রেখেছি যাতে লাশ অনেকক্ষণ তাজা থাকে। বরফকলের লোকজন সবাই আমারে চিনে ফেলেছে এতোক্ষণে। তারপর আপনার সঙ্গে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছি মোটরসাইকেলে। হোটেলে চা খেয়েছি। চা খেতে খেতে দাবা খেলেছি। হোটেল কর্মচারীকে ৫০ টাকা বখশিসও দিয়েছি যেন আমার চেহারাটা মনে রাখে। একটা জিনিসই বুঝতে পারছি না আপনার স্ত্রীকে মেরে আমার লাভ কী? আপনার স্ত্রীর প্রেম ছিল পাশের পাড়ার এক স্কুলটিচারের সঙ্গে। বেচারা লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কতবার চোখ মুছলো। সেই কথা আপনার কাছে স্বীকার করে ফেলল। এ কারণে তারে খুন করেছি। বেচারি…।’

‘চুপ একদম চুপ! একটা কথা বলবি..।’

‘জি ভুল হয়েছে। আপনাকে তুমি করে বলে ফেলেছিলাম আগে। বাই দ্য ওয়ে দাবা খেলায় আমি ইচ্ছা করেই হারতাম। আপনার মন ভালো করার জন্য। এখন শেষ চালে আপনার মন্ত্রী আটকা পড়েছে।’

‘একদম চুপ হারামির বাচ্চা।’

‘জি, আর একটা কথাও বলবো না। যা বলার আদালতে বলবো।’

‘কীসের আদালত! তুই ভাবছস তোরে কোর্টে চালান দিমু? এতো কিছু বুঝোস, আর রবিউলরে ধইরা আনসি ক্যান এটা বুঝস না?’

তৈয়ব সত্যিই লজ্জা পেল। তার এটা বোঝা উচিৎ ছিল। যাই হোক, সে তো আর কম্পিউটার না। মানুষের ভুল হবেই। রবিউল কি এখন তার পেছনে? পেপারওয়েট দিয়ে মাথায় বাড়ি দিতে পারে যেকোনও সময়?

ছায়া এসে পড়ে পর্ব -১০  এর লিংক

 

storiesউপন্যাসগল্পছায়া এসে পড়েধ্রুব নীল