জয়নুল আবেদিনবিরুদ্ধ বাস্তবতায় শিল্পী : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

জয়নুল আবেদিনবিরুদ্ধ বাস্তবতায় শিল্পী

লিখেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (সূত্র: কালবেলা)

করাচিতে জয়নুল আবেদিনের যে প্রদর্শনী চলছে তার চিত্রকর্মগুলোর দিকে তাকালে তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয় যে, শিল্পী নিশ্চিত তাঁর মূল সুরেই আছেন—সেটা সাদাকালোতেই স্কেচ করেন কিংবা রংতুলিতে। তাঁর সর্বশেষ কাজটিও স্কেচ।

একই ক্যানভাসে তেলরঙের চেয়ে স্কেচ করতে সময় অনেক কম লাগে। কিন্তু স্কেচের দ্রুত বয়ে চলার একটা প্রবণতা আছে। আর এ ব্যাপারটি সম্ভবত জয়নুল আবেদিনের ক্ষেত্রে আরও বেশি সত্য, আর শিল্পের এই বিশেষ রীতিতেই তাঁর কল্পনা ও শৈল্পিক প্রতিভা আত্মপ্রকাশের সবচেয়ে উপযুক্ত ফর্মটি খুঁজে পায় বলে মনে হয়। সেজন্যই তিনি তৈলচিত্রকে অতটা পছন্দ করেন না; একজন ব্যক্তির একান্ত আবেগিক অভিজ্ঞতার বিশদ বিবরণ দেওয়ার যে ধারণা তা তিনি এড়িয়ে চলেন এবং যখনই তিনি সুবিশাল আকারের কোনো পেইন্টিংয়ের কাজে হাত দেন, তিনি এর খুঁটিনাটি বিবরণের একঘেয়েমি থেকে রক্ষা পেতে চান। আর বড় কোনো ক্যানভাসে কাজ করতে বাধ্য হলে তিনি অসুখী বোধ করেন এবং সম্ভবত পথও হারিয়ে ফেলেন। তারপর তাঁর কল্পনাশক্তি একটি একক ধারণায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং থমকে যায়, যার ফলে তিনি রং ব্যবহারের অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলেন এবং তাঁর যে স্বাধীনতার অনুভূতি তা বাধাপ্রাপ্ত হয়—যা আবার একজন শিল্পী হিসেবে সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী একটি দিক।

আধুনিক সময়ে আমরা অলরাউন্ডারদের বর্জন করেছি, উল্টোদিকে বিশেষায়ণকে দুর্বলতা হিসেবে না দেখে বরং শক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে শিখে গেছি। সাধারণ চর্চাকারীদের দিন অবশ্য শেষ। যে কারণে, নির্দিষ্ট একটি ক্ষেত্র, রেখা ও শৈলীর রসাস্বাদনের স্বার্থে স্বাতন্ত্র্য নির্মাণের যৌক্তিকতা ও প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

তাঁর সেরা সময়ে

এ কারণেই আমার এই বিশ্বাস এবং উপলব্ধি জন্মেছে যে, জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলার ধরনকে যখন তাঁর কল্পনার সঙ্গে অবাধে চলতে দেওয়া হয়, তখন তিনি তাঁর সেরা সময়েই থাকেন। তিনি সবচেয়ে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন যখন তিনি তাঁর আয়ত্তকৃত ফর্মে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন। এই তীক্ষ্ণ, অনলংকৃত এবং অনাবৃত রেখা ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমেই তিনি এত গভীর অনুভূতি এবং আকুলতা নিয়ে কথা বলতে পারেন না, যেমনটা তিনি বলেছেন বারো বছর আগে বাংলায় ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষ নিয়ে। সম্ভবত আমরা প্রায়শই এই দুর্ভিক্ষের স্কেচগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি, যা তাকে হঠাৎ খ্যাতি এনে দিয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে আমরা শিল্পীকে একই স্কেচ বারবার প্রদর্শন করতে বাধ্য করেছি। এমনকি করাচিতে এখন যে প্রদর্শনী হচ্ছে সেখানেও সেগুলোর কিছু কিছু প্রদর্শন করা হচ্ছে। দুর্ভিক্ষের স্কেচ তৈরির পরের বছরগুলো অবশ্য তাঁর জন্য তুলনামূলকভাবে অনুর্বর ছিল।

সম্প্রতি শিল্পী আমাদের চোখের আড়াল হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলে গিয়েছিলেন; যেখানে তিনি দ্রুত জলরঙের স্কেচগুলো শেষ করেছেন। সেখানে তিনি সরল, সৎ কিন্তু রঙিন পাহাড়ি মানুষদের সঙ্গে থেকেছেন (সম্ভবত নান্দনিকভাবে বলতে গেলে, সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র রঙিন মানুষ)। সেখানে তিনি উপহার পেয়েছেন একটি উন্মুক্ত পাহাড়ি পরিবেশ এবং বিষাক্ত কিছু পোকামাকড়ের কামড়ও তিনি খেয়েছেন, যার চিহ্নগুলো তিনি যুদ্ধের দাগের মতো এখনো গর্বের সঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছেন।

পার্বত্য অঞ্চল

পার্বত্য চট্টগ্রামে করা জলরঙের স্কেচগুলো তাঁর সর্বশেষ কাজ, আর যেহেতু সেগুলো তিনি সবচেয়ে বেশি দক্ষতার সঙ্গে করেছেন, সেহেতু এই কাজগুলো বিশেষ মনোযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নিঃসন্দেহে, এই স্কেচগুলোতে দেশের একটি অংশকে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে শিল্পের সঙ্গে পরিচিত করিয়েছেন, যে অংশটি পূর্বে অজানা ছিল। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে এগুলো শৈল্পিক আগ্রহ জাগিয়ে তোলার পরিবর্তে ভৌগোলিকতাকে বেশি জাগিয়ে তোলে বলে মনে হয়। সম্ভবত গঁগার একটি প্রসঙ্গ আমার এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা করতে পারবে। দক্ষিণ সাগর দ্বীপপুঞ্জের মানুষদের ছবি আঁকার জন্য গঁগা যখন ফ্রান্স ছেড়েছিলেন, তখন তিনি ইউরোপকে এমন এক মানুষদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, যারা তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, পশ্চিমাদের ভেতর আইডিয়ালিক রোমান্টিসিজমের এক চমৎকার সৌরভ ছড়িয়েছিল এই ছবিগুলো, ফলে বস্তুবাদী শিল্প সমাজের প্রথম প্রভাব দ্বারা বিভ্রান্ত পশ্চিমা বিশ্বের মানুষদের ভেতর পলায়নপরতার একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গঁগা যেভাবে দ্বীপবাসীদের চিত্রিত করেছেন, তা বহিরাগতদের প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তোলার পরিবর্তে দুর্দান্ত শৈল্পিক অনুভূতি জাগাতে সক্ষম হয়েছিল। এখানে এই শিল্পীর প্রতিভা বিরল জিনিসের প্রতি কোনো সাধারণ কৌতূহল প্রদর্শন করেনি; তিনি একজন নিছক পর্যটকও ছিলেন না, যিনি উদ্ভট কিছুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। মূলত তিনি যা দেখেছেন, তাই বলার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, সম্ভবত একটি আত্মশ্লাঘা নিয়ে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতাকে অতিরঞ্জিত করেছিলেন। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন একজন সমাজের আবদ্ধতা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত শিল্পী হওয়ার মিশন নিয়ে। কেননা তিনি অনুভব করছিলেন যে, তিনি নিজেকে প্রকাশ করার জন্য পর্যাপ্ত স্বাধীনতা পাচ্ছেন না। তিনি একজন সৃজনশীল শিল্পীই থেকে গিয়েছিলেন, আপাতত এই পরিবেশে তিনি সমৃদ্ধ হয়েছেন বলেই মনে হয়; যে পরিবেশকে তিনি তাঁর শৈল্পিক অভিব্যক্তির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেছিলেন।

জয়নুল আবেদিনের পার্বত্য অঞ্চলের স্কেচগুলো দেখলে যে কারও মনে এই প্রশ্নটি আসে : তিনি কী উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন? তিনি কি নতুন কোনো বিষয়বস্তুর প্রলোভনে পড়ে গিয়েছিলেন, যা তাঁর কল্পনাকে উসকে দেওয়ার জন্য অভূতপূর্ব বলে তিনি মনে করেছেন? তিনি কি শৈল্পিক আগ্রহের চেয়ে ভৌগোলিকতা দ্বারা বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন? নাকি তিনি সেখানে এমন কিছু উপাদান খুঁজে পেয়েছিলেন, যা আবেগ ও আদর্শগতভাবে তাঁর কাছাকাছি?

একটা জিনিস বোধ হয় নিশ্চিত। আর সেটা হলো যে, শিল্পী সেখানে এমন কোনো পরিবেশ খোঁজার জন্য যাননি, যা তাঁর শৈল্পিক প্রতিভা প্রকাশের জন্য আরও সুবিধাজনক হবে। তাহলে তাঁর সেখানে যাওয়ার কারণ সম্ভবত শুধু একটি ছোট্ট পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে চিত্রিত করার ইচ্ছা, যা ধর্মীয়, সামাজিক ও জাতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে পাকিস্তানের বাকি অংশ থেকে আলাদা। স্পষ্টতই, তিনি নতুন উপাদানের সন্ধানে ছিলেন, তাঁর ধারণা প্রকাশের জন্য আরও বেশি উপযুক্ত কোনো নতুন ধরন খোঁজার জন্য নয়।

এই উপলব্ধি এই স্কেচগুলোর বিরুদ্ধে কিছু পক্ষপাতমূলক ধারণা প্রদান করতে পারে যদিও এটা স্বীকার করতেই হবে যে, তাঁর সেরা স্কেচগুলোর যে গুণমান তার অধিকাংশই এই স্কেচগুলোতেও রয়েছে। স্কেচগুলোতে পাহাড়ি লোকেরা বসে আছে বাঁশের খুঁটির ওপর নির্মিত বাড়ির কাছে, শান্তভাবে ধূম্রপান করছে; তাদের সুন্দরী রমণীরা রঙিন পোশাক বুনছে। এই সব মানুষ, তাদের পাহাড়, দ্রুত প্রবহমান নদী এবং নৌকা নিঃসন্দেহে বিশ্বস্তভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, যা প্রথমবারের মতো আমাদের কাছে প্রকাশ করছে এক মোহনীয় জগৎকে। কিন্তু যে কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে, এই কাজটা তো একজন নৃতাত্ত্বিকই একটি ক্যামেরা আর রঙিন ফিল্ম নিয়ে করতে পারতেন।

মূল কারণ

জয়নুল আবেদিন নিঃসন্দেহে একজন শক্তিশালী শিল্পী; কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক স্কেচগুলো দুর্ভাগ্যবশত যে কাউকেই বাধ্য করবে এই প্রশ্ন করতে যে, একজন শিল্পী হিসেবে জয়নুলের যে পথ বেছে নেওয়ার কথা, সে পথ তিনি হারিয়েছেন কিনা।

আমি বিশ্বাস করি, বিগত বছরগুলোতে শিল্পীর ব্যর্থতা এবং ত্রুটিগুলোর জন্য আমরা আংশিকভাবে দায়ী। এই বছরগুলোতে, আমরা তাঁকে তার শৈল্পিক নিরীক্ষা ও তা সংগ্রহের জন্য বাধ্য করেছি, ক্রমাগত সচেতনভাবে আমরা তাঁর ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছি। তাঁর কাজের জন্য অধিক পরিমাণ একান্ত নিজস্বতার প্রয়োজন ছিল। আমি মনে করি তিনি হলেন ক্ষমাহীন উচ্চস্বর ঢক্কানিনাদের সামনে একজন শৌর্য এবং বিক্রম হারানো বাঘের মতো।

আমাদের শিল্পীর ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও জটিল হয়েছে, কারণ এরকম লোকচক্ষুর মধ্যমণি একজন ব্যক্তির ওপর জনসাধারণের নিরন্তর তাকিয়ে থাকাটা একজন শিল্পীর কাজের জন্য এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা। ঐতিহ্যবাদের যে প্রবল প্রতাপ, জনসাধারণ কর্তৃক ঐতিহ্যবাদের যে উচ্চ প্রশংসা এবং এর প্রতি সমর্থন সেখানে একজন মেধাবী শিল্পীর নতুন ভিত্তি তৈরির যে আকাঙ্ক্ষা—তার সঙ্গে একটা বিরোধ তৈরি হয়; আর শিল্পী যদি তেমন উদ্যোগ নিয়েও থাকেন, তাহলে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া পেতে তাঁকে একটা বিরক্তিকর অনিশ্চিত সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। একজন শিল্পী তার বিশ্বাসে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, এই দ্বন্দ্ব তাকে এতটাই দুর্বল করে দিতে বাধ্য যে শেষ পর্যন্ত তিনি বর্ণহীন এবং অর্থহীনভাবে, একেবারে মূলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।

ঐতিহ্যবাদের পুনরাবৃত্তির পক্ষে যে অনালোকিত জনমত তা এই বিভ্রান্তিকে আরও গুরুতর করে তোলে। আমি এটাকে অনালোকিত বলি এই কারণে যে শিল্পের প্রতি আমাদের যে মনোভাব তার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, আমরা শিল্পে কী খুঁজি তা আমরা জানি না। আমরা শিল্পে ঐতিহ্যবাদকে গ্রহণ করি, যা আমাদের দেশে নতুনভাবে আমদানি করা হলেও, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শৈল্পিক প্রকাশের একটি বহুল চর্চিত রীতি। এই শৈলী সম্পর্কে আমাদের যে উপলব্ধি তা পূর্বগৃহীত বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ, আর এই পরিবর্তন ঘটেছে পেইন্টিংয়ের একমাত্রিক পরিপ্রেক্ষিত-বিহীন শৈলী পরিত্যাগ করার পর থেকে যে—কোনো কিছুকে আকর্ষণীয়ভাবে দেখার জন্য যা তৈরি করা হয়, তা-ই ভালো শিল্প। আর এ কারণেই একজন পাকিস্তানির ড্রয়িংরুমে লাল জ্যাকেটে ব্রিটিশদের রঙিন, সুন্দর ফ্রেমবন্দি ছবি, শিয়াল শিকারের ছবি দেখে আমরা অবাক হই না।

জয়নুল আবেদিনের জলরঙের স্কেচ যে জনসাধারণের দ্বারা গৃহীত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেগুলোর প্রতি আমাদের প্রশ্নাতীত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সেগুলো শিল্পের উদ্দেশ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হবে, যার লক্ষ্য হলো গুরুত্বপূর্ণ নান্দনিকতা তৈরি করা, যা সাংস্কৃতিকভাবে সুপ্ত মানুষের জীবনধারা পরিবর্তন করতে সক্ষম। আমরা একটি আমদানি করা মৃতদেহ দিয়ে জীবন তৈরি করার আশা করতে পারি না।

আমি এ সম্পর্কে আরও নিশ্চিত বোধ করি যখন আমি কয়েক মাস আগে তার করা কয়েকটি কাজ দেখি যেগুলোকে মোটামুটিভাবে অ-অ্যাকাডেমিক হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। এখানে ক্ষীণ রঙের কিউবিস্টিক গ্রাফগুলো পটভূমি তৈরি করেছে, এই কয়েকটি নিরীক্ষামূলক কাজে শিল্পী এমন একটি শৈলীতে মানুষকে এঁকেছেন, যা অবশ্যই একটি মৌলিক কাজ এবং তা অনুসরণযোগ্য। তাঁর এই নতুন প্রয়াসের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ‘নারী এবং বেড়াল’, ‘সাপুড়ে’ যা গত বছর ঢাকায় পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল আয়োজিত প্রদর্শনীতে প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল।

এগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় তিনি কেবলমাত্র স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রং ব্যবহার করে বেতের মাদুরে অপ্রচলিত নকশার ধারণাও গ্রহণ করেছিলেন (তিনি ইতিমধ্যে ব্যাপক পুনরুৎপাদনের জন্য বেতের মাদুর কারিগরদের একটি নকশাও দিয়েছেন)। আমি মনে করি, এখানে অত্যন্ত মৌলিক কিছু কাজ হয়েছে যা একাডেমিক ঐতিহ্যবাদ থেকে একটা বিরতি এবং একই সঙ্গে এর শেকড় মাটির গভীরে প্রোথিত। তবুও আমরা শিল্পীকে দেখতে পাই, মূল শৈলী আবিষ্কারে সমস্ত শক্তি ও কল্পনার প্রয়োগ করার পরিবর্তে (যা তার ‘নারী এবং বেড়াল’ এবং বেতের-মাদুরের নকশায় প্রকাশিত হয়েছে) পরবর্তীকালে জলরঙের স্কেচের স্তূপ নিয়ে আবির্ভূত হওয়ার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে ছুটে যেতে। আশ্চর্যের কিছু নেই যে এই স্কেচগুলো তাদের শিল্পের মূল্য সম্পর্কিত সাধারণ সমালোচনার পরিবর্তে তাদের উৎপাদনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে।

আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, ঐতিহ্যের অবিরাম পুনরাবৃত্তি, কিংবা তাকে অপরিবর্তিত বা অবিকৃত রাখলে শিল্প এবং সংস্কৃতির প্রস্ফুটন হয় না; কিন্তু যখন এটা একটা গ্রহণযোগ্য সংশ্লেষণের একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়, যা গতিশীলভাবে প্রগতিশীল, তখন এর প্রস্ফুটন ঘটে। আমাদের জনগণের শিল্পের সম্ভাবনা ততক্ষণ সুপ্ত থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই একই ছাঁচে ছবি আঁকা চলতে থাকবে, উদাহরণস্বরূপ, অ্যা স্পেনিশ সিটি লেন অথবা অ্যা ফ্রেঞ্চ গার্ডেন কর্নার, যা জয়নুল আবেদিন তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের সময় এঁকেছিলেন। কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের সুনিপুণ জলরঙে আঁকা স্কেচগুলোও মানুষের কল্পনায় ধরা দেবে না। একদিকে বহুল ব্যবহৃত, বহুল-বিস্তৃত শৈলীর পুনরাবৃত্তি এবং অন্যদিকে, দেশের পাহাড়ি ঐতিহ্যের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্নতার ভেতরই তাদের ব্যর্থতার মূল কারণ নিহীত।

অন্য কথায়, তারা নতুন শিল্প ভাব অর্থাৎ মানুষের কল্পনাকে জাগিয়ে তুলতে পারে এমন কিছু করতে অক্ষম।

এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক যে, আমাদের দেশে সমালোচনামূলক প্রগতিশীল কোনো সাংস্কৃতিক বিভাগ নেই সে যে আকারেরই হোক। যদি দু-একটাও থাকত, তাহলে জয়নুল আবেদিনের মতো নিঃসঙ্গ প্রতিভাবান শিল্পীর কাঁধের বোঝা অনেকটাই লাঘব হতো। এ মুহূর্তে তাদের কাঁধে বিশাল বোঝার ভার চেপে আছে কারণ তাদের যুদ্ধটি একাকী এবং তাদের একাই বেছে নিতে হচ্ছে। সম্ভবত তাঁরা সেই জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতো, যেখানে সংকটের মুহূর্তে কোনো সাহায্য ও সরঞ্জাম ছাড়াই তাদের কাঁধে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাহাজভর্তি মানুষকে ফেলে আসা ভূমির চেয়ে আরও উত্তম কোনো ভূমিতে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে।

তবে জয়নুল আবেদিন শেষ পর্যন্ত বস্তুগত বাধা অতিক্রম করে তাঁর দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করতে সক্ষম হবেন বলে আমরা হয়তো যুক্তিসংগতভাবে আশা করতে পারি। তাঁর প্রতিভা আছে। তাঁর নিজের মানুষ সম্পর্কে, তাদের আবেগ, স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে তার প্রগাঢ় জ্ঞান রয়েছে। তিনি তাদের ত্রুটিগুলোও জানেন; জানেন কোথায় শূন্যতা সবচেয়ে বেশি এবং ফর্ম ও রং সম্পর্কে সংবেদনশীলতার অভাব কোথায় এবং জানেন জীবনযাপনের চেতনাহীনতা আর কদর্যতা সম্পর্কে তাদের অসচেনতা। আর এসবকে বাস্তবে রূপান্তর করার জন্য তার দূরদর্শিতা ও শক্তিমত্তাও রয়েছে।

artstoriesশিল্পশিল্পকলা