আধিভৌতিক হরর গল্প : তিনি
ধ্রুব নীল
চুলায় ডাল ফুটে উঠতেই রাবেয়ার বুক কাঁপতে শুরু করে। বারবার মিলির দিকে তাকায়। মনের মধ্যে কু-প্রশ্ন ভর করে—এই ডাল যদি মিলির গায়ে ছিটকে পড়ে! মিলি রাবেয়ার একমাত্র মেয়ে। বয়স ছ-সাত হবে।
মিলি চায় রাতের বেলায় মায়ের পাশে গুটিসুটি মেরে বসবে আর মাটির চুলায় লাকড়ি ঠেলবে। রাবেয়া সেটা হতে দেয় না। কড়া ইশারায় মিলিকে বুঝিয়ে দিল চুলার আসপাশ আসলে তার পিঠে লাকড়ি ভাঙা হবে। রাবেয়া নিজেও জানে তার এ ভয় অহেতুক। ফুটন্ত ডাল খামাকা মেয়ের গায়ে পড়বে কেন?
‘আম্মা, একটা হিয়াল।’
‘কোনো দিক যাবি না কইলাম। চুপচাপ ঘরে বইসা থাক। কোন দিকে হিয়াল?’
‘জানি না।’
‘কই দেখছস? সামনে যাইস না কইলাম।’
‘ঘরের পিছে। ডেউয়া গাছের তলায়।’
রাবেয়ার মনে হলো তার লাফিয়ে উঠে এগিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু নড়তে পারল না। হাত-পা অবশ লাগছে।
চোখ বন্ধ করে দোয়া-দুরুদ পড়ল কিছুক্ষণ। তারপর জগ থেকে সরাসরি পানি খেতে গিয়ে মনে হলো গলায় পানি আটকে সে মারা যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো এখন সে মরে টরে গেলে মিলি যদি চুলা থেকে ডালের পাতিল তুলতে আসে…। মনটাকে শান্ত করার জন্য নিজে নিজে কিছু টেকনিক বের করেছিল রাবেয়া। আজ কোনো টেকনিক কাজে আসছে না। বারবার বীভৎস সব চিন্তা ভর করছে।
খানিক আগে বৃষ্টি হয়েছে। তবে চাঁদ নেই বলে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শিয়াল নেই। তবে আবছা আলোয় রাবেয়া দেখল লোকটাকে। সাদা এক প্রস্থ কাপড় আলখেল্লার মতো জড়িয়ে আছে। কাপড়ের দুই পাশে অদ্ভুত কায়দায় ফিতা ঝুলছে।
‘কে আপনি? কী চান? মিলির বাবা নাই। সে গেছে বাজারে। ফিরতে রাত দুইটা।’
হারিকেনের তেল শেষের দিকে। মিটমিট করে জ্বলছে। সামান্য আলোতেও রাবেয়ার মনে হলো লোকটার চেহারা সাধারণ না। দেখে অনেক দিনের চেনা মনে হয়। আবার মনে হয় এমন চেহারা হয় না।
‘মানুষটা কারে এমন করে দেখে। আর কেউ তো নাই। মিলি, তুই ভিতরে যা। বাইরে আবি না।’
মিলি ভেতরে যায় না। মায়ের কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। রাবেয়ার মনে হলো কিছুটা এগিয়ে হারিকেনের আলোয় লোকটার চেহারা দেখার মতো সাহস তার আছে। কিন্তু বয়স্ক লোকটা নড়েচড়ে না, কিছু বলেও না।
‘মা, ও মা। ঘরে ঢুকবা? আমার ঘুম করে। ভাত দিবা?’
রাবেয়া হারিকেন উঁচু করে ধরে। কাজ হয় না। লোকটার মুখের কাছে আলো গেলেই মনে হচ্ছে আলোটা হারিয়ে যাচ্ছে।
‘পানি খাব।’
কথা বলল লোকটা। ফ্যাসফ্যাসে গলা। তবে মতলববাজ লোকের মতো নয়। মনে হলো কথাটা তার মুখ থেকে বাতাস হয়ে বের হয়েছে।
রাবেয়ার বুক কাঁপা বেড়ে গেল। চুলাটা বন্ধ করে আসেনি। টগবগ করে ডাল ফোটার শব্দ পাচ্ছে দূর থেকে।
এগিয়ে যেতে থাকে রাবেয়া। সামনে ঝোপঝাড় আর কয়েকটা আম-জামের গাছ। ফলের লোভে মাঝে মাঝে রাতে এটাসেটা আসে। আজ কারও সাড়াশব্দ নেই। দূরে একটা শেয়াল। তবে কাছে ঘেঁষছে না ওটা। ঠায় তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। রাবেয়াকে এগিয়ে আসতে দেখে অবশ্য চলেও গেল।
রাবেয়ার মনে হলো, এখন আর ভয়ের কারণ নেই। লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো যাক। হারিকেনের আলোয় কি লোকটা বিরক্ত হবে? চাবি ঘুরিয়ে সলতেটা আরেকটু ছোট করে দিল রাবেয়া।
‘মা! ও মা! কই যাও!’
‘খাড়া। নড়বি না। দেইখা আসি।’
‘মা। যাইও না। আমার ডর করে।’
‘ডরের কিছু নাই। তাগোরে ডরের কিছু নাই।’
কাদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই সেটা রাবেয়া জানে না। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে কথাটা। মিলি ভেতরে ঢুকে গেল।
‘আসেন ভেতরে আসেন।’
‘পানি খাব।’
‘ভেতরে না আসলে পানি খাবেন কেমনে।’
লোকটার মুখের দিকে না তাকিয়েই বলেছে রাবেয়া। একবার কোনোরকম তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিয়েছে। শূন্য চাহনীওয়ালা মুখটার দিকে কেন যেন তাকানো গেল না। তাছাড়া মুখে অস্বাভাবিক বিষয়টা রাবেয়া ধরতেও পারছে না ঠিকমতো।
‘আপনি কে? নাম কী? পথ হারাইসেন? এইটা কী জামা পইরা আছেন?’
লোকটা এবার রাবেয়ার দিকে তাকাল। তবু রাবেয়ার মনে হলো লোকটা তার দিকে তাকায়নি। সে তাকিয়ে আছে অনেক দূরে। আবার মনে হয় সে কারও দিকেই তাকিয়ে নেই।
লোকটার হাঁটছে ধীরেসুস্থে। রাবেয়া পথ দেখিয়ে ঘরে নিয়ে গেল। লোকটা আলগোছে বসল পুরনো খাটে। কোনো শব্দ হলো না। রাবেয়া পানি খুঁজছে। সামনেই জগ আর গ্লাস। কিন্তু সেটা নিতে গিয়েও নিচ্ছে না।
‘পানি খাব।’
‘আপনার মুখ তো বন্ধ। পানি খাইবেন কেমনে?’
লোকটা রাবেয়ার দিকে তাকাল। হারিকেনের আলোয় দৃশ্যটা দেখে এবার অপার্থিব ভয় চেপে ধরল রাবেয়াকে। লোকটার নাকে তুলা গুঁজে দেওয়া।
‘আপনার নাকে তুলা ক্যান! ও আল্লাহ! কী হইসে আপনার! নাকে তুলা ক্যান!’
‘আমি মইরা গেছি। মুর্দার নাকে তুলা দিতে হয়।’
‘ইন্নালিল্লাহ! আপনে কবে মারা গেছেন! কেমনে মারা গেছেন!’
‘আমার মনে নাই। পানি খাব।’
রাবেয়া হন্তদন্ত হয়ে পানি খুঁজছে। মরা একটা মানুষ পানি চাচ্ছে, তাকে পানি দিতে না পারলে যেন মহা অমঙ্গল হবে।
‘মা এই লও পানি।’ পানিভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিল মিলি।
‘তুই পানির জগ তুলতে গেলি ক্যান! দিমু একটা থাপ্পর!’
লোকটার পাশে খাটের ওপর গ্লাস রাখল রাবেয়া। লোকটা গ্লাস না নিয়ে বসে রইল। যথারীতি শূন্য দৃষ্টিতে।
মিলি মায়ের দিকে তাকাল ভয়ে ভয়ে। চলে গেল পাশের আরেকটা ঘরে। সেখানে তার ছোট একটা খাট পাতা। খিদে পেলেও আপাতত চেপে গেল। বাবা এলে একসঙ্গে খাবে ঠিক করল মিলি। ওই ঘর থেকেই জানতে চাইল মিলি।
‘মা, ও মা। কেডা মরসে?’
‘হ রে মা, লোকটা মইরা গেছে।
‘আমি কোনোদিন মরা মানুষ দেখি নাই। আমারে দেখাইবা মা?’
‘তুই তোর খাটে গিয়া শো মা।’
‘আমার ডর করে।’
‘ডর নাই মা। আমি আছি। লিপি খালারে ডাক দে।’
‘লিপি খালা নাই মা। বাড়িত তালা মারা।’
পাশের টিনের চালাঘরটায় অন্ধকার। রাবেয়া বুঝতে পারল কোনো কারণে তার ভেতর ভয়ের ব্যাপারটা কাজ করছে না। এমন পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড ভয় পাওয়ার কথা। লোকটা কি তবে কাফনের কাপড় পরে আছে?
‘আপনার গা থেইকা আগরবাতির গন্ধ আসতেসে। আপনারে কি আরেকটা জামা দিমু? মিলির বাপের শার্ট আপনার গায়ে লাগব?’
লোকটার চেহারা এবার ভালো করে দেখার চেষ্টা করল রাবেয়া। খোঁচা খোঁচা পাকা দাঁড়ি। কপালের দিকে চুল কিছুটা কম। ত্বক যথারীতি রক্তশূন্য। তবে খুব চেনা মনে হলেও মেলাতে পারছে না রাবেয়া।
‘আপনের তো নাকে তুলা গুঁজা। দম নিতাসেন কেমনে? তুলা খুইলা দিমু?’
লোকটা ফ্যালফ্যাল করে দেখলো রাবেয়াকে। ব্যাপারটা ধরতে পেরে রাবেয়ার হাঁসফাঁস করতে লাগল রাবেয়া। লোকটা দম নিচ্ছে না। দম নেওয়ার জন্য আকুলিবিকুলিও করছে না। সে শুধু চেয়ে আছে।
‘আপনারে ওরা কবর দিয়া দিসে?’
মাথা নাড়ল লোকটা।
‘কবর থেইকা উইঠা আসছেন?’
এবার মাথা না নাড়লেও রাবেয়া বুঝলো লোকটা হ্যাঁ বলেছে।
‘আমার ঘরে আইসেন কেন? পানি খাইতে? পানি তো খান নাই। এখন কী করবেন? আবার কবরে গিয়া শুইয়া পড়বেন?’
লোকটা কিছু বলল না। মিলি এগিয়ে এসে মায়ের আঁচল ধরে টানাটানি করল কিছুক্ষণ। রাবেয়ার সাড়া না পেয়ে পাশের ছোট ঘরটায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
‘আপনে কি চাইরটা ভাত খাইবেন? গরম ডাইল রানসি। লগে দুইটা শুকনা মরিচ দিমু?’
লোকটা উপর-নিচ মাথা নাড়ল।
ভাতের কথা শুনে মিলি এগিয়ে এলো। পরে আবার কী ভেবে চলে গেল ভেতরে। ঠিক করলো বাবার জন্য বসে থাকবে আজ যে করেই হোক।
লোকটার সামনে থালাভর্তি ভাত। গরম ডালও বেড়ে দিল প্লেটে রাবেয়া। লোকটা তাকিয়েই রইল প্লেটের দিকে। সাদা কাপড়ের ভেতর থেকে ক্ষুধার্ত কোনো হাত বেরিয়ে এলো না।
‘ও। আপনি তো মইরা গেছেন। মইরা গেলে তো খাওন বন্ধ।’
লোকটার কাতর দৃষ্টি দেখে রাবেয়ার কষ্ট লাগল খুব। তার ইচ্ছে করলো লোকটাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। লোকটা ধীরেসুস্থে বেশ সময় নিয়ে দাঁড়াল। রাবেয়া ভাবল, মরে গেছে বলে বয়স্ক লোকটার হাঁটাচলায় সামান্য কষ্ট হতেই পারে।
‘আমাকে আবার কবর দিতে পারবা মা?’
কথাটা রাবেয়ার বুকে তীরের মতো বিধল যেন। পরিষ্কার গলায় বলল লোকটা। গলাটাও আর্দ্র। রাবেয়া বুঝে নিল তাকে কী করতে হবে।
ধীরেসুস্থে হারিকেন ধরাল। তেল ভরে নিল বেশি করে। এক হাতে হারিকেন আরেক হাতে মিলিকে ধরে লোকটাকে পথ দেখিয়ে চলল।
‘মা কই যাই?’
‘গোরস্থানে যাই মা।’
‘গোরস্থান কী?’
‘ওই মানুষটার ঘর।’
‘আমার ডর করে। ঘরে চলো।’
‘ডরাইস না মা। আমি আছি তো।’
লোকটা সামনে সামনে হাঁটছে। ধীরস্থির এগিয়ে যাচ্ছে চেনা পথ ধরে। রাবেয়া খুব একটা মাড়ায়নি এদিক। সব অচেনা ঠেকছে। একটু আগে সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল বলে মানুষজন নেই। নির্জন পথ ধরে গোরস্থানের কাছে থামল লোকটা। ঘাস মাড়িয়ে খালিয়ে পায়ে একটা চিকন পথ ধরে এগিয়ে চলল। রাবেয়ার হাত খামচে ধরে আছে মিলি। খানিকটা এগিয়ে থামল লোকটা। বৃষ্টিতে ভেজা মাটি আর ভাটফুলের ঝাঁঝাল গন্ধ নাকে বাড়ি দিল রাবেয়ার। ঠিক সামনেই তরতাজা একটা কবর। সেটার আশপাশে ঘুর ঘুর করছে কয়েকটা শেয়াল। রাবেয়ার হারিকেনের আলো দেখে খানিকটা দূরে সরে দাঁড়াল ওরা।
লোকটা ইশারায় শেয়ালগুলোকে দেখাল। তার নির্লিপ্ত মুখে ফুটে উঠতে শুরু করেছে কাতরতা।
‘চিন্তার কারণ নাই। হিয়ালের দল ভাগাইতেসি আমি। ওই যা। হুশশ।’
‘মা। হিয়াল ক্যান আসছে?’
‘এমনে আসছে মা। ডরাইস না। হিয়ালরে আবার ডর কীয়ের।’
লোকটা রাবেয়ার দিকে তাকাল। যেন কিছু বলতে চায়।
‘আপনে কবরে নামবেন?’
লোকটা মাথা নাড়ল। রাবেয়ার মনে হলো লোকটার সম্ভবত নামতে ইচ্ছে করছে না। রাবেয়া এগিয়ে এসে হারিকেন ধরল। লোকটা রাবেয়ার দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। কী করবে বুঝতে পারছে না বোধহয়।
‘ধরেন, আমার হাত ধরেন বাবা। আস্তে ধীরে নামেন। তাড়াহুড়া নাই।’
কাপড়ের ভেতর থেকে জীর্ণ একটা হাত বেরিয়ে এলো। লোকটার বয়সও মনে হলো আচমকা অনেক বেড়ে গেছে। বেড়েছে মুখের কাতর ভাবটাও। শীতল হাতটা ধরতেই শিউরে উঠলো রাবেয়া। লোকটার চেহারা এখন তার আরও চেনা মনে হলো। মন বলছে, লোকটার হাত ছেড়ে দেওয়াই দরকার। তবু ছাড়তে পারছে না রাবেয়া।
‘মা! ঘরে যাই। চলো! চলো! ডর করে।’
রাবেয়ার আঁচল নিজের হাতে পেঁচিয়ে নিয়েছে মিলি। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে মা। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে রাবেয়া বলল, ‘যামু রে মা। ঘরেই যামু। আগে তোর নানাভাইরে কবরে শোয়াইয়া দিয়া লই।’