পাউলো কোয়েলহোর গল্প :  সৃষ্টিকর্তা মায়েদের সৃষ্টি করছিলেন

মহান সৃষ্টিকর্তা যখন মায়েদের সৃষ্টি করছিলেন, তখন তিনি টানা ষষ্ঠ দিনের মতো নির্ধারিত সময়ের অধিক পরিশ্রম করে চলেছেন। এমন সময়ে একজন পরী (দেবদূত) এসে ঈশ্বরকে বললেন :

“এই সৃষ্টির পেছনে আপনি বৃথা অনেক সময় নষ্ট করছেন।”

সৃষ্টিকর্তা বললেন, “তুমি কি এর বৈশিষ্ট্যগুলোর তালিকা পড়ে দেখেছ?”

* তাকে হতে হবে এমন কিছু যাকে পুরোপুরি ধুয়ে-মুছে পরিস্কার করা যায়, কিন্তু সে প্লাস্টিকের তৈরি হবে না;

* তার শরীরে থাকবে ১৮০টি সচল অঙ্গ যার সবগুলোই আবার হবে প্রতিস্থাপন যোগ্য;

* কালো কফি আর উচ্ছিষ্ট খাবারে যে দিব্যি বেঁচে থাকে;

* একটা কোল থাকবে তার, তবে সে উঠে দাঁড়ালেই কোলটা অদৃশ্য হয়ে যাবে;

* তার এক চুম্বনে ভাঙা পা থেকে শুরু করে হতাশায় নিমজ্জিত প্রেমিক- সব, সবাই সুস্থ হয়ে উঠবে;

* তার ছয়জোড়া হাত থাকবে।

পরী আস্তে আস্তে তার মাথা দুলিয়ে বলল, “ছয় জোড়া হাত! অসম্ভব!”

“না, না, ওর হাতের সংখ্যা আমাকে সমস্যা করছে না,” সৃষ্টিকর্তা বললেন। “একজন মায়ের যে তিনজোড়া চোখ থাকতে হবে- সেটাই আমাকে ভাবিত করে তুলেছে।”

“আপনার সৃষ্ট মাতৃ-প্রতিরূপে কি সেরকমটাই তৈরি করেছেন?” পরী জিজ্ঞাসা করল।

সৃষ্টিকর্তা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

“ একজোড়া চোখ দরজার ভেতর দিয়ে ওপাশটা পর্যন্ত দেখতে পাবে যখন মা জিজ্ঞাসা করবে, ‘ঘরের মধ্যে দরজা আটকে কী করছ সোনামণিরা?’

“একজোড়া চোখ তার মাথার পেছনে থাকতে হবে, যা দিয়ে সে শুধু ততটুকু দেখবে যা তার জানা প্রয়োজন, কিন্তু দেখা উচিত নয়।“

“আর একজোড়া চোখ তো সামনের দিকে থাকবেই, যেন সে তার সন্তানের দিকে তাকিয়ে, তাদের ভুলগুলো দেখতে পায়, আর বিনা বাক্যব্যয়ে, চোখের ইশারায় তাদের একথা বুঝিয়ে দিতে পারে যে, ‘সোনামণিরা, আমি তোমাদের বুঝতে পারি, আর তোমাদের ভালোবাসি।”

সৃষ্টিকর্তার জামার হাতা আলতো করে টেনে ধরে পরী বলল, “প্রভু, ঘুমোতে যান, আগামীকাল।”

“আমি যে ঘুমোতে পারছি না!” সৃষ্টিকর্তা বললেন। “আমি আমার মতো করে কাউকে সৃষ্টির এতটাই নিকটে পৌঁছে গেছি যে, ইতিমধ্যে যে মাতৃ-প্রতিরূপ আমি তৈরি করেছি, সে এমন একজন—

-যে অসুস্থ হয়ে পড়লে নিজেকে আপনা-আপনি সুস্থ করে তুলতে পারে;

-এক পাউন্ড বার্গার দিয়ে ছয়জনের একটা পরিবারকে আহার করাতে পারে;

-আর, নয় বছরের সন্তানকে গোছলের জন্য ঠিকঠাক ঝর্নাকলের নিচে স্থির দাঁড় করিয়ে দিতে পারে।”

মায়ের এই প্রতিরূপের চারপাশে পরী আস্তে আস্তে করে একবার ঘুরে দেখল। এরপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “এটা আসলে খুব বেশিই তুলতুলে।”

“কিন্তু ও তো একেবারে অদম্য।” উত্তেজনার স্বরে সৃষ্টিকর্তা বললেন। “তুমি চিন্তাও করতে পারবে না, এই মা কী কী করতে পারে আর কত কী সইতে পারে!”

“সে কী চিন্তা করতে পারে?”

“শুধু চিন্তাই নয়, যুক্তি-বুদ্ধি দেখাতে, সমঝোতা আর আপস করতেও জানে,” সৃষ্টিকর্তা বললেন।

পরিশেষে, পরী নিচু হয়ে মাতৃরূপের গালে হাত দিল।

“কোথাও কোনো একটা ছিদ্র হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে,” সে বলল। “আমি আপনাকে আগেই বলেছি, এই এক প্রতিরূপের মধ্যে আপনি অত্যধিক কিছু একসাথে ঠেসেঠুসে ভরে দিতে চাইছেন।”

“না, ওটা কোনো ছিদ্র দিয়ে বের হওয়া পানি নয়,” সৃষ্টিকর্তা বললেন। “এটা ওর অশ্রুজল।”

‘এটা আবার কী কাজের?”

“এটা ওর আনন্দের জন্য; ওর দুঃখ, হতাশা, যন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতা আর ওর অহংকারের জন্য আর এভাবেই সৃজিত হলো ‘মা’– সৃজনশীল বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি।

paulo coelhostoriesগল্প