পাখির গানে বাংলা সুর

FacebookTwitterEmailShare

মো. আশতাব হোসেন 

কনকনে পৌষ ও মাঘ মাসের শীতের পাতা আসন ভেঙ্গে দিয়েছে ফাল্গুনের দক্ষিণা বাতাস।  শীত ভয়ে পালিয়ে গেছে। পাখিরা মত্ত হয়ে উঠেছে রঙ্গের খেলা করতে।  কোকিল-কোকিলা, দোয়েল, ময়না বাংলার সকল পাখি  নেচে নেচে ঘোষণা করছে, বাংলার আনাচে কানাচে রাজ এসেছে রাজ এসেছে ।  সোনার বাংলার অঙ্গজুড়ে প্রকৃতি যেনো কোমল বসনে জড়িয়ে নিয়েছে তারই বুকে। বসন্তের ফুলের সৌরভ আকাশ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে । সবুজ পাতার শাড়ি পরে গাছে গাছে ফুলকলিরা উকি দিচ্ছে। কিছু  গাছে কলি থেকে ফুল বেরিয়ে হেসে হেসে শোভা বিলাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে আশে পাশের এলাকাজুড়ে । আমের বাগিচায় মৌমাছির প্রেমের প্রেমের গান গেয়ে গেয়ে ফুলের মধু সংগ্রহ করে চলছে প্রতিযোগিতা করে এই বাংলার বসন্ত পাড়ায়। সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের চত্বর পেরিয়ে আশেপাশের এলাকাতে গুঞ্জন,  কী করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি আদায় করে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা যায়। বাংলার দামাল ছেলেরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে সংগঠিত হতে থাকে দাবি আদায় করতে হবে সংগ্রামের মাধ্যমে।  জোয়ান বুড়ো শিশু কিশোর সবারই একই অঙ্গীকার রাষ্ট্রভাষা বাংলা হতে হবে। সবাই মিলে শপথ করে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে হলেও আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা, মায়ের মুখে শেখা ভাষা অফিস আদালতসহ সর্বত্রই স্থান করে দিতে হবে। আমাদের অঙ্গীকার ব্যর্থ হতে দেব না । ছাত্র জনতা সম্মিলিতভাবে বের হয়ে যায়, যার যার মতো করে ভাষা আন্দোলনের  মিছিলে মিছিলে, প্রকম্পিত হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়সহ চারদিক। পাখিরাও যেনো গাছে গাছে বসে একই সুরে বলে যাচ্ছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সকাল সন্ধ্যা বরণ করতে চাই বাংলা গানের সুরে সুরে। 

চলছে মিছিল, ছড়াচ্ছে খবর বাংলার আকাশে বাতাসে। সখিনা জরিনা হালিমার কোলের নব্য বুলি ফোটা শিশু সন্তানরা তাদের মায়ের বুকের দুধ পান বন্ধ রেখে বলে মা, মাগো, ওমা আমরা নাকি তোমার মুখে শেখা কথা বলতে পারব না আর কখনো? ওরা কেনো আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে চায় মা? সখিনা, হালিমা,জরিনারা মন খারাপ করে চুপ করে থাকে আর চিন্তা করে কি দিয়ে উত্তর দেব এই অবুঝ শিশুদের। নীরবতা ত্যাগ করে মা তার শিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, বড় হও সোনামনি। বড় হয়ে ভাষা রক্ষার দাবিতে তোমরাও সংগ্রাম করবে। সংগ্রাম করে বাংলা ভাষা রক্ষা করে সবাই একসাথেই বাংলাতে কথা বলবে গান গাইবে সোনা। ছোট শিশু বলে, না মা তা হতে পারে না! আমিও যাব সংগ্রাম করে তোমার মুখের ভাষা রক্ষা করব মা! সন্তানের এমন দাবির কথা শুনে মা সান্ত্বনা দিয়ে বলে বড় হও বাবা। বড় হলেই যেতে দিব ভাষা আন্দোলনে। সন্তান বলে আচ্ছা মা, তা হলে বড় হতে থাকি। বড় হয়েই ঝাপিয়ে পড়ব ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য। কেড়ে নিতে দিবনা তোমার মুখের ভাষা মা এই তোমার বুকের দুধের কসম করে বলছি !

১৯৫২ সালের ২১ জানুয়ারি দুপুর সোয়া তিনটার সময় সংগ্রামী ছাত্রজনতার মিছিলে পুলিশ গুলি ছুঁড়লে প্রথমে শহীদ হন রফিক উদ্দিন আহমেদ! 

শোকের ছায়ার সাথে নেমে আসে জনতার ঢল। রফিক উদ্দিনকে  ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করেন সঙ্গীরা ধরাধরি করে। ডাক্তার মৃত্যু নিশ্চিত করলে, আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। ঐ একই দিন সকালের দিকে পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে শফিউর রহমান ঢাকামেডিকেলে চিকিৎসারত অবস্থায় সন্ধ্যার আঁধার অধিক গাঢ় করে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি বুকে চেপে নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১৪৪ ধারা জারি অবস্থায় ছাত্র জনতা মিছিল চলছেই। আব্দুস সালামের ভিতরের রক্ত টগবগিয়ে যেনো দাবি করছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই! পুলিশ থেমে নেই গুলি চালিয়ে যাচ্ছে ভাষা আনন্দলন রুখে দেয়ার জন্য। এমতাবস্থায় পুলিশের ছোঁড়া গুলি এসে আব্দুস সালামকে  মারাত্মকভাবে  আহত করে। আহত দামাল ছেলে আব্দুস সালামকে  ঢাকামেডিকেলে ভর্তি করলে চিকিৎসারত অবস্থায় এপ্রিল মাসের সাত তারিখে শোকের ছায়া এবং দাবি আদায় ও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকার বুকে চেপে ধরে  চলে যান না ফেরার দেশে শহীদ স্মৃতি ইতিহাসের পাতার ভাঁজে ভাঁজে রেখে দিয়ে। সংগ্রাম চলছে বাংলার বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিক।  পুলিশের গুলিও থেমে নেই, পাক-হানাদার পুলিশ বাহিনীর গুলিতে মারাত্মক আহত হয়ে আবদুল জব্বার ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তরিখের  রাতেই অমরত্বের চিহ্ন রেখে সেও চলে যান না ফেরার দেশে!  বাংলার দোয়েল, কোয়েল, ময়না শ্যামা সকল পাখিরা গাছে গাছে গাইতে থাকে বাংলার সুমধুর গান। সে গান থেমে নেই, আজো সবুজ শ্যামল বাংলার প্রান্তজুড়ে পাখিদের কণ্ঠে বেজে ওঠে সকাল সন্ধ্যা বেলায়।  বাংলার আকাশে বাতাসে ভাষা শহীদের রক্তে ভারি।  ভাষা শহীদের রক্ত মেখে উদয় হওয়া শুরু করে শিশু সূর্য বাংলার পূব গগণে। দিন শেষে গোধূলী নিয়ে আসে রক্তিম আভা, সোনার বাংলার পশ্চিম আকাশে ভাষা শহীদের স্মৃতি উজ্জল করে নিদ্রা রস পান করতে যায় বাংলার সূর্য। বাতাস বহন করে চলছে ফেব্রুয়ারির  শহীদ ভাইদের তাজা রক্তের গন্ধ এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বাংলায় ফোটা বসন্তের পুষ্প শহীদের পবিত্র রক্ত মেখে উজ্জ্বল থেকে অধিক উজ্জ্বল হয়ে সারাবাংলায় সৌরভ বিলাচ্ছে এবং বিলাবে যুগে যুগে। পাখির কণ্ঠে বাজে ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ, ভুলবনা, শহীদ ভাইদের বীরত্ব  গাঁথা স্মৃতির কথা। আমরাও মৌসুমে মৌসুমে বয়ে নিয়ে চলব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে ভাষা শহীদের রক্তমাখা উজ্জ্বল বাংলা বর্ণমালা রক্ষার কথা।

লেখক: মো. আশতাব হোসেন গ্রাম: ইসলামাবাদ, ডাকঘর: বলদিয়া, ভূরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম 

storiesগল্প