ভুতের গল্প Bhuter Golpo : বাঁশঝাড়ের নিঃশ্বাস

ধ্রুব নীলের ভুতের গল্প Bhuter Golpo । দুর্বল চিত্তের পাঠক আশা করি এ গল্প পড়বেন না।

নব্বই কি একানব্বই সালের কথা। কালীডাঙ্গা গ্রাম সন্ধ্যা পেরোতেই সুনসান। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, নিশিবকের ওড়াওড়ি, তেঁতুল গাছে ভূতের ভয়; সবই আছে এ গ্রামে। জয়নাল রাত করে বাড়ি ফেরে। সবসময় যে দোকানের কাজে রাত হয় তা নয়। ইচ্ছে করেও রাত করে। নিশুতি রাতে গ্রামের শ্মশান, গোরস্থান আর ঘন ঝাঁকড়া বাঁশঝাড় ঘেঁষা মাটির চিকন রাস্তায় সাইকেল চালানোর মধ্যে এক ধরনের শিহরণ টের পায়। রাতে এ পথে আরও অনেকে আসা-যাওয়া করে। সবাই তো আর শিহরণ বোঝে না।


আশ্বিনের এক ঝিরঝির বৃষ্টির রাত। সাইকেলের সামনে কায়দা করে তিন ব্যাটারির টর্চলাইট লাগিয়েছিল জয়নাল। হেডলাইটের মতো দেখায়। শ্মশান পেরোতেই ওটা নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কড়া ব্রেক কষল জয়নাল।

ভুতের গল্প ( Bhuter Golpo )

‘পানি ঢুকল নাকি!’


টর্চটায় থাপ্পড় মারল। মেরেই বুঝল ভুল হয়েছে। একটা ব্যাটারি খুলে গড়িয়ে পড়ল খালের পানিতে। সামনে মিশমিশে কালো। চাঁদ তো দূরে থাক তারাও দেখা যাচ্ছে না। আশ্বিন মাসের ঝড়-বাদলা কখন হয় ঠিক নাই। বিড় বিড় করে পানি পড়তেই থাকে। তবে ভাগ্য ভালো যে এ সময়টায় ঝড়ো বাতাসটা থাকে না।
গত বছরের কথা আলাদা। এ সময়ই শুরু হয়েছিল আচমকা বৈশাখি বাতাস। শোঁ শোঁ করে ঝাড়ের বাঁশগুলোর সে কি গোত্তা। আর সেই গোত্তার মাঝে পড়েছিল হারু মাঝি। একটা চিকন বাঁশ কে যেন অর্ধেকটা কেটে রেখেছিল। বাকি কঞ্চিটা বাতাসের চোটে পাগলের মতো এ পাশ ওপাশ করছিল।

ভুতের গল্প Bhuter Golpo

হারুমাঝি মাছের খলুই হাতে অন্ধকারে ভাবল বাঁশঝাড়ের তলায় আশ্রয় নেবে। ঝাড়ের নিচে দাঁড়াতেই কঞ্চিটা এসে কপ করে মাথাটা দিল কেটে। মিহি একটা দাগ পড়ল শুধু। ধড় থেকে কেটে মুণ্ডুটা আলাদা হয়ে যায়। সেই মুণ্ডু আবার ঝড়ো বাতাসে গড়িয়ে চলে যায় কোথায় যেন। বাকি শরীরটা দেখে গ্রামবাসী ভেবেছিল হারু মাঝি বুঝি টেরই পায়নি কখন সে মরে গেছে। আর ঘটনা যে সত্য সেটা কদিন পরই টের পেল গ্রামের লোকজন। যখন কিনা শুরু হলো হারু মাঝির ভূতের উপদ্রব। অনেকেই দেখতে শুরু করল হারু মাঝির কাটা মুণ্ডু।

জয়নাল সাইকেল থেকে নামল। আন্দাজ করে এগোচ্ছে। পেছন থেকে আচমকা ঠান্ডা হাওয়া এসে কাঁপুনি দিচ্ছে শরীরে।

ভুতের গল্প Bhuter Golpo

জয়নাল জানে সে সহজে ভয় পায় না। গ্রামের এ রাস্তা নিয়ে অন্তত একশটা গল্প শুনেছে। ভয়ানক সব গল্প। এর মাঝে হারু মাঝির কাটা মাথার গল্পটাই বেশি। হারু মাঝি ছিল জয়নালের বন্ধু। রাতে মাঝে মাঝে একসঙ্গে ফিরত। বিচিত্র সব গল্প হতো দুজনের। ভূত দেখার জন্য দুজন একবার একসঙ্গে শ্মশানেও ঢুকেছিল। বাঁশঝাড়ের গহীনে ঢুকে ‘কেউ আছো নাকি’ বলে ডাকও দিয়েছিল। কিন্তু গ্রামের অনেকে দেখলেও হারুমাঝির কাটা মুণ্ডু জয়নাল কোনোদিন দেখেনি।

মাঝে কোনো এক রাতে রবা নামের এক জেলে রাত করে ফিরছিল। হারুর কাটা মাথাটা নাকি তার সঙ্গে কথা বলেছিল। মুণ্ডুটা জানতে চেয়েছিল, আমার বাকি শইলডা পাইতাসি না। হাত, পাও, পেট কোথায় কইতে পারবেন? ও ভাই আমার গলাটা কই! গলাটা তো মনে হয় শুকাইয়া আসতেসে। ও ভাই কন না!

ওই জেলে নাকি পরে জ্বরে পড়ে মরেই গেছে। জয়নাল অত খবর রাখেনি। সে ভাবল, হারু মাঝি মানুষ ভালো ছিল। রবার কোনো ক্ষতি তো করেনি। বাকি শরীরটা খুঁজে পেতে চেয়েছিল শুধু।

‘থপ থপ থপ।’
মাটিতে একটা কিছুর আঘাতের শব্দ। দরজা হলে শব্দটা হলো ঠক ঠক। কিন্তু ভেজা মাটিতে হলো থপ থপ। জয়নালের মনে হলো সে এতদিন নিজেকে ভুল জানত। সে আসলে সাহসী না। ভয়ে সিঁটিয়ে আছে এখন। সাইকেলটাকে ঠেলে গায়ের জোরে এগোতে চাইছে। জোর পাচ্ছে না।
‘থপ থাপ থপ।’
পেছনে ফিরে তাকাবে? জয়নাল ঢোক গিলল।
‘কে?’
না ফিরেই জানতে চাইল।
শোঁ করে বাতাস বয়ে গেল পাশের ভাঁটফুলের ঝোপের ওপর দিয়ে। বাতাসে বয়ে এসেছে জুঁই ফুলের কড়া ঘ্রাণ।
‘থপ থপ থপ থপ।’
কথা না বলে বরং শব্দটার বেগ বেড়েছে। বাঁশঝাড়ের গোড়া থেকেই আসছে।
জয়নালের মন চাইল সাইকেল ফেলে ছুট দেয়। ঘুরে তাকানোর জন্য আরেকটু সাহস সঞ্চয় করতে হবে। এ সময় আবার শীতল বাতাসের ঝাপটা। এবার সঙ্গে হাসনাহেনার ঝাঁঝাল ঘ্রাণ। মেঘ কাটিয়ে বেরিয়ে এলো অর্ধেকটা চাঁদ। পেছনে তাকাল জয়নাল।
যা দেখল তাতে ক্ষণিকের জন্য সময়জ্ঞান হারাল। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল বলতে পারবে না। ধীরে সুস্থে আবার ঘুরল।

এবার আর পা আটকাল না কাদায়। হন হন করে সাইকেল নিয়ে হেঁটে চলে গেল বাড়ি। ভাত খেয়ে ঘুমন্ত শিশুকন্যাকে এক ঝলক দেখে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল। জয়নাল আপাতত ঠিক করেছে বাঁশঝাড়ের গল্পটা কাউকে বলবে না। একটা গল্প বলে ফেললে সেটা গল্প হয়ে যায়। তারপর সবাই সেটাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে। অথচ জয়নাল নিশ্চিত যে সে ভুল কিছু দেখেনি।

তিনদিন খেটে জয়নাল খুঁজে বের করল সেই রবা জেলের বাড়ি। বাড়িতে এক বৃদ্ধা ছাড়া কেউ নেই। দাদি হবে হয়ত। ঠিকঠাক গুছিয়ে কিছু বলতে পারেন না।
‘ও.. হ্যাঁ.. কইবার পারি। রবার লগে ভূতের মাতা কতা কইসিল। রবারে অনেক টেকাপয়সার কথা কইসিল মনে হয়।’
‘টাকা পয়সা না রে দাদি, সে রবারে বলসিল তার শরীরটা কোথায়? মানে শইলডা কই জানবার চাইছিল।’
‘হইতে পারে। বুড়া হই গেছি। মনে থাকে না। তুমি কি জানি জিগাইলা।’
বুড়ির সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কথা চালিয়ে জয়নাল বুঝতে পারল রবা সেদিন বাঁশঝাড়ে নয়, গোরস্থানের পাশের একটা নালার কাছে কাটা মুণ্ডুটার সঙ্গে কথা বলেছিল। কারণ বুড়ি দুয়েকবার বলেছে রবাকে বেতফল খাওয়াতে বলেছিল। জয়নাল ভালো করেই জানে, বেতগাছের ঝোপগুলো আছে গোরস্থানের শেষ মাথার আগের একটা খানাখন্দ ভরা রাস্তার পাশের নালায়। সেই নালার পানি মিশমিশে কালো। সাপখোপে ভরা ওই বেতের ঝাড়ে বেতফল খেতে গ্রামের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেমেয়েরাও যায় না।

কয়েক দিন পরের কথা। এ কয়দিন বিশেষ কিছু করেনি জয়নাল। দোকানেও যায়নি। গভীর রাতে বাঁশঝাড়ও মাড়াতে হয়নি তাকে। ওই রাতের দৃশ্যটা নিয়ে বার বার ভেবেছে। কী করতে চলেছে সেটাও ঠিক করেছে।

টর্চে নতুন ব্যাটারি লাগাল। জয়নালের বউ স্কুলে মাস্টারি করে। সে ছুটি পেয়ে মেয়েকে নিয়ে গেছে মামার বাড়ি। জয়নাল ভাবল আজকেই তবে সে দেরি করে ফিরবে। দরকার হলে রাত একটায় আসবে।
বিকালের দিকে সাইকেল নিয়ে বের হলো জয়নাল। ডানে বামে না তাকিয়ে সোজা গঞ্জের দোকানে। বেচাকেনা চলল রাত নয়টা পর্যন্ত। কাস্টমার না থাকলেও ঝাঁপ ফেলল না। বসে বসে অহেতুক হিসাব মেলাল। অন্য দিনের চেয়েও ধীরেসুস্থে বন্ধ করল দরজা। যেন সে চায় আরও দেরি হোক।
গোরস্থান পেরোনোর সময় শুরু হলো বৃষ্টি। কোথাও দাঁড়াবে কিনা ভাবল। বটতলায় একটু ব্রেক কষল। সাইকেল থেকে নেমে মুখ মুছতেই চমকে উঠল। এক বুড়ো হা করে তাকিয়ে আছে। সোজা দাঁড়িয়ে না থাকলে ধরেই নিত মরে গেছে।
‘চাচা মিয়া এত রাইতে?’
‘কত রাইত?’
‘বারোটা তো বাজে।’
‘অ। আমি যামু কই।’
‘বাড়িঘর নাই?’
‘বাইর কইরা দিসে।’
‘তাইলে আর কি। বেশি দিন তো নাই। গোরস্থানেই থাকেন।’
বুড়ো তার পরিবারের লোকজনকে উদ্দেশ করে খানিকক্ষণ গালাগাল করল।
‘চাচা ডর করে না?’
‘কারে ডরামু। কাউরে ডরাই না।’
‘এদিকে নাকি একটা কাটা কল্লা আছে।’
‘বৃষ্টি কমসে। আমি যাই। অনেক কাম। বাড়িত চিন্তা করবো। এত রাইতে ওই বাঁশঝাড়ের তলা দিয়া যাইস না। একবার চাইয়া বসলে না দিয়া পারবি না। মরণতক চাইব। পরে জ্বরে পইড়া মরবি।’
‘কে চাইব চাচা? কী চাইব?’
‘জানি না। কইতে পারি না। দুর দুর। আমি যাই।’
বুড়ো চলে যেতেই স্বস্তি পেল জয়নাল। সাইকেল নিয়ে হেঁটেই গেল সেই বেতঝোপের নালায়। পানিতে টইটম্বুর খালের এদিকটা। টর্চ জ্বালালো। রাস্তার খানাখন্দে অনেকগুলো কই মাছ খাবি খাচ্ছে। অন্যসময় খুশিই হতো। আজ সে খুঁজছে অন্য কিছু।
সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ল পানিতে। ঢোড়া সাপ-টাপ থাকবে। ওদের বিষটিস নেই। এক হাতে টর্চ ধরে অন্যহাতে পানি হাতড়াতে লাগল। বেতের ঝোপের তলা থেকে সর সর করে সরে গেল অনেকগুলো জলজ প্রাণী। গোড়া থেকে ভুস ভুস করে উঠে এল জমে থাকা বুদবুদ। হাত পিছলে পিছলে ছুটে চলেছে মাছ নাকি সাপ। ভাবছে না জয়নাল। ঝুম বৃষ্টি শুরু আবার। মাথা চুইয়ে পড়া পানি ঢেকে দিতে চাইছে দৃষ্টি। ওদিকে মাটিতে কই মাছের লাফালাফি বেড়েছে। টর্চের আলোয় যতটা পারছে দেখে নিচ্ছে।
একটার পর একটা বেতের ঝোপ ধরে পাগলের মতো ঝাঁকাচ্ছে জয়নাল। কতকটা এগিয়ে যেতেই কচুরি আর টোপাপানার একটা দলা। নাড়া দিতেই টুপ করে ভেসে উঠল কী যেন। আলো ফেলতেই চিনে ফেলল জিনিসটা।
‘হারু মাঝি!’
কথা বলল না কাটা মুণ্ডু। মরে গেছে বছরখানেক আগেই। মুখটা ফ্যাকাসে। চোখও কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে যেন।

ভুতের গল্প Bhuter Golpo


‘মাঝি কিছু কইবা?’
কথা বলল না কাটা মুণ্ডু। টর্চের আলো পড়ায় রক্তহীন মুখটা চকচক করে উঠল। জয়নাল হাঁটুপানি মাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে মুণ্ডুটাকে পানি সেঁচে কাছে টেনে আনল। আলগোছে তুলে নিল কুড়িয়ে পাওয়া নারকেলের মতো। মুণ্ডুটাও বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে জয়নালের দিকে। কোনো সাড়াশব্দ নেই তার। ফেরত চাইছে না বাকি শরীর।
মুণ্ডুটাকে এক হাতে আলগোছে ধরে হেঁটে চলেছে জয়নাল। সাইকেল পরেও নেওয়া যাবে। আর মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই সেই বাঁশঝাড়।
এর মাঝে মুণ্ডুটা শুধু দুয়েকবার পলক ফেলল। তাতে কোনো আকুতি নেই। আছে রাজ্যের নির্বিকারত্ব। এতদিন পার হওয়ায় বোধহয় নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নিজেই দ্বিধাগ্রস্ত হারুমাঝির কাটা মুণ্ডু। সেটার সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর চেষ্টা করেও তাই ব্যর্থ হলো জয়নাল।
বাঁশঝাড়ের কাছে এসে টর্চ জ্বালিয়ে খুঁজল জিনিসটা। ওই রাতে যা সে দেখেছিল। ওই তো। থপ থপ থপ থপ করে মাটি থাপড়ে চলেছে মুণ্ডুহীন দেহটার একটা হাত। হারু মাঝির বাকি শরীর ওটা। কঞ্চিতে কেটে কুটে যাওয়া হাত ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে যেন। কাদামাটিতে থাপ্পড় মেরে ইশারা করছে কাছে আসার। মুণ্ডুটাকে ঘুরিয়ে শরীর বরাবর ধরল জয়নাল।
ও মাঝি! তোমার বাকি শইল! ওইদিনই দেখছিলাম। তাই তোমারে খুঁইজা বাইর করলাম। দেখলা মাঝি!’
মুণ্ডুটা সামান্য নড়ে উঠল। কাতর চোখে তাকিয়ে আছে জয়নালের দিকে। সেই চোখে কি কৃতজ্ঞতার চিহ্ন?
বৃষ্টিতে কাকভেজা জয়নাল। হারুমাঝির কাটা মুণ্ডুও ভিজে একাকার। থপ থপ থপ। শরীরটা টের পেয়েছে তার মুণ্ডু কাছে আসছে।
বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে চোখ বড় বড় করে দৃশ্যটা দেখছিল একটা পেঁচা। একদম নড়ছে না। জয়নাল মুণ্ডুটাকে আলগোছে বসিয়ে দিল ধড়ের পাশে। সটান উঠে দাঁড়াল। এবারও পেছনে তাকাল না। সাইকেলটা পড়েই রইল পেছনে থাকুক। তিন ব্যাটারির টর্চের আলোয় ভিজতে ভিজতে চলল বাড়ির পথে। পেছন হতে একবার শুনল কে যেন ফ্যাকাসে গলায় কাকে যেন ডাকল। তবু তাকাল না জয়নাল। জলদি বাসায় যেতে হবে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে তার।

bhuter golpohorrorstoriesগল্পধ্রুব নীলভুতের গল্পভুতের গল্প bhuter golpoভূতের গল্প