বস্তিতে রবিদাস সম্প্রদায়ের অজস্র নারী পুরষ আর শিশুকিশোরদের সঙ্গে নিত্য বসবাস ছিলো কিছু কুকুরের। ওরা ছিলো ছিন্নমূল শরণার্থী ধরনের কুকুর। ওদের কোনো ঔনার বা মালিক-অভিভাবক ছিলো না। বেওয়ারিশ এই কুকুরগুলো পুরো বস্তি দাপিয়ে বেড়াতো। দু’পাশের বস্তির দুই সমাপ্তিমুখ ছিলো একদিকে যোগীনগর অন্যদিকে টিপু সুলতান রোড পর্যন্ত। আমাদের হেয়ার স্ট্রিটও ছিলো ওদের এখতিয়ারে। এর বাইরে অন্য পাড়া থেকে কোনো একটা কুকুরেরও প্রবেশাধিকার ছিলো না এই মহল্লায়। কেউ এলে ওরা তাড়া করতো দলবদ্ধ হয়ে।
মুচি পরিবারের সদস্যরা ছিলো গরিব। ওই গরিব মানুষদের এঁটো-কুটো খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকতো কুকুরগুলো। ঘুমুতো ওরা মুচিপাড়ার ফ্রন্ট আর ব্যাকইয়ার্ডের নোংরা গলিঘুঁপচি আর ড্রেনের কিনারে। মুচিপাড়ার মুচিরা কিংবা আমরা ভদ্রলোকেরা কুকুরদের কোনো দায়িত্ব না নিলেও কুকুরগুলো আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতো নিষ্ঠার সঙ্গে। রাত জেগে তারা পাহাড়া দিতো পুরো মহল্লাটা। কোনো চোর বা নিশিকুটুম্বের সাধ্য ছিলো না এলাকায় ঢোকার।
এই কুকুরগুলোর কোনো নাম ছিলো না। ওদের আমরা চিনতাম ওদের গায়ের রঙ দেখে। কিন্তু ওরা আমাদের প্রত্যেককেই চিনতো। আমরা যে এই এলাকার বাসিন্দা সেটা ওরা জানতো। কোনো দিন তাই আমাদের কারো ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েনি ওরা কেউ। মুচি পাড়ার কোনো কোনো কিশোর ওদের একটি দুটি কুকুরের নাম অবশ্য দিয়েছিলো। যেমন একটা কুকুরের নাম ছিলো মিঠুয়া। অনাদর অবহেলায় থাকা এই কুকুরগুলোর বংশ বৃদ্ধি হতো নিয়মিতই। নতুন জন্ম নেয়া শিশু কুকুরগুলোও মহল্লাবাসীর এঁটো-বাসি খেয়ে বড় হতো দিনে দিনে। এক পর্যায়ে কুকুরের সংখ্যা যেতো বেড়ে। আর তখনই বলা নেই কওয়া নেই আচমকা কোনো এক সকালে ওদের ওপর নেমে আসতো কেয়ামত। বড় ভয়ংকর হতো সেই কেয়ামতের দিনটা।
ঢাকায় তখন(স্বাধীনতার আগে এবং পর পর, ১৯৭০-১৯৭৩)মিউনিসিপ্যালিটির দায়িত্বে একটা বিশাল স্কোয়াড ছিলো কুকুর নিধনের জন্যে। এই স্কোয়াডের ঘাতকরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় হানা দিতো বেওয়ারিশ কুকুরের সন্ধানে। বড় বীভৎস ছিলো সেই কিলিং স্কোয়াডের কর্মকাণ্ড। মুচিপাড়ায় আমাদের ভদ্রলোকদের কোনো বাড়ি থেকে অভিযোগ পেয়ে মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি আসতো সকাল বেলায়। দু’ধরণের গাড়ি আসতো। গরুর গাড়ি কিংবা পিক আপ ভ্যান। গরুর গাড়ির পেছন দিকটায় পিক আপ ভ্যানের মতোই চৌকোনা ট্রাংক টাইপের বিশাল স্পেস থাকতো।
মুচিপাড়ার নিত্য কোলাহলের মধ্যে নতুন একটা সকাল শুরু হলো। শান্ত স্নিগ্ধ ছিলো সেই সকালটা।
ভোরের নরম আলোয় রোদের ঝিকিমিকি বাড়ছে।
মুচিপাড়ার কুকুরগুলো আড়মোড়া ভেঙে এদিক ওদিক হেলে দুলে চলাচল করছে। ওরা জানে না আর কিছুক্ষণ পরেই নিভে যাবে ওদের জীবন প্রদীপ। সকালের খাবার হিশেবে ডাস্টবিন কিংবা এখানে ওখানে পড়ে থাকা সম্ভাব্য খাদ্যবস্তুর সন্ধানে ওদের কৌতুহলী দৃষ্টি। আজ কী জুটবে সকালের খাবার হিশেবে?
হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামলো মিউনিসিপ্যালিটির। কুকুরদের সিক্সথ্সেন্স খুব প্রখর থাকে। মিউনিসিপ্যালিটির রঙ ওঠা নীলচে পিক আপ ভ্যানটা দেখেই এক ধরণের ত্রস্ত ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেলো। প্রাণ বাঁচাতে কুকুরগুলো পড়িমরি পালাতে লাগলো। কিন্তু কোথায় পালাবে? মুচিপাড়ার ব্যাকইয়ার্ডকে নিরাপদ ভেবে ওদিকেই ছুটলো ওরা।
কিন্তু পিক আপ ভ্যান থেকে নেমে আসা বুদ্ধিমান মানুষদের সঙ্গে ওরা পারবে কেনো? এই বুদ্ধিমান মানুষদের সঙ্গে আছে বিশাল সাইজের একেকটা কাঁচি। দর্জি বাড়ির কাঁচির আদলেই বানানো কাঁচিগুলো সাত আট ফুট লম্বা একেকটা। দু’হাত দিয়ে কাঁচিটার মুখ হাঁ করিয়ে ওরা ছুট লাগালো কুকুরদের পেছনে। এবং বেশ দূর থেকেই নিপুণ নিশানায় কুকুরের কোমরের দিকটায় কাঁচির মুখটাকে বন্ধ করা মাত্রই কুকুরটা আটকে গেলো। কোমরের পেছন দিক থেকে পেটের দু’পাশে কাঁচির দুটি অংশ এসে এমন ভাবে আটকে ফেলে একটা কুকুরকে যে তার আর সাধ্য থাকে না কোনোরকম নড়াচড়ার। কুকুরটার আর্তচিৎকারে সকালের সমস্ত সৌন্দর্য নিমেশে ম্লান হয়ে গেলো।
দ্বিতীয় ঘাতক হাতে একটা মোটাসোটা লাঠি নিয়ে এগিয়ে এসে আর্তনাদরত কুকুরটার ঘাড় বরাবর লাঠিটাকে স্থাপন করে পা দিয়ে সমস্ত শক্তিতে চেপে ধরলো নিপুণ দক্ষতায়।
এবার তৃতীয় ঘাতক একটা বড়সড় ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ এনে ঠেঁসে ধরলো কুকুরটির পেটে। ইঞ্জেকশনটা পুশ করা মাত্র একটা শেষ চিৎকারে মানুষের নৃশংসতার প্রতিবাদ জানিয়ে চোখ বিস্ফারিত করতে করতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো কুকুরটা। পিক আপের ড্রাইভার এসে মৃত কুকুরটির দুই পা আর দুই হাত দুই হাতের কব্জিতে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো খোলা ট্রাংকের ভেতরে।
ঘাতকের দল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রবেশ করলো মুচিপাড়ার ব্যাকইয়ার্ডে। ওখান থেকে একে একে ধরে আনলো আরো কয়েকটি কুকুরকে। এবং একই কায়দায় একই নৃশংসতায় ওদের হত্যা করলো বিষাক্ত ইঞ্জেকশন পুশ করে।
‘ভাগ মিঠুয়া ভাগ–জলদি ভাগ যা’–বলে চিৎকার করতে করতে ছুটতে থাকা কুকুরপ্রেমী অসহায় মুচি কিশোর ছেলেটার করুণ মুখটা আজও ভুলতে পারিনি আমি।
ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচতে কুকুরগুলোর কেউ কেউ আশ্রয় খুঁজছিলো এতোদিনের পরিচিত মানুষদের ঘরে। কিন্তু সেই ঘরের বাসিন্দারাই দেখিয়ে দিয়েছে ঘাতকদের–এই যে এইখানে লুকিয়ে আছে একটা…!
কোনো কোনো কিশোর এবং যুবক পলায়নরত কুকুরদের পথ আটকে ওদের ধরিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো কিশোর দেখিয়ে দিয়েছে–এই যে এই ড্রামের আড়ালে গর্তের ভেতরে লুকিয়ে আছে একটা…!
এক পর্যায়ে পিক আপ ভ্যানের ট্রাংকটা উপচে পড়ছিলো। কুকুরের লাশের স্তুপের ভেতর থেকে বিস্ফারিত চোখে মৃত কুকুরগুলো অশ্রুসজল তাকিয়ে ছিলো আমাদের দিকে। মানুষের নিষ্ঠুরতা আর বিশ্বাস ঘাতকায় হতবাক বিস্মিত কুকুরগুলো কি তখন অভিশাপ দিচ্ছিলো?
আজ এতোকাল পরেও নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের শিকার মুচি পাড়ার সেই নিরিহ কুকুর ‘মিঠুয়া’দের জন্যে বুকের ভেতরে কেমন হাহাকার অনুভব করি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে মানুষের এই নিষ্ঠুরতার উপাখ্যান কেউ না কেউ লিখে রাখবেই।
মানুষ তোমার ক্ষমা নেই!
অটোয়া ১২ ডিসেম্বর ২০১৮
[ক্যাপশন/ লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিটা ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত। ভারতের কেরালায় ঢাকার আদলেই কুকুর নিধনযজ্ঞ পরিচালিত হয়েছে ২০১৬ সালেও। ছবিটা সেই ঘটনার।]