আজ রইল ধ্রুব নীলের লেখা রহস্যজট বাগেশ্রীর শেষ আলাপ । এটি মূলত একটি গল্প ধাঁধা। প্রথম সমাধান করার চেষ্টা করুন। উত্তর দেখার জন্য একদম শেষে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন।
আকাশের চাঁদ আর জলের চাঁদকে যখন এক বলে ভ্রম হয়, তখন অনেক আপাত সত্য নিরেট অর্থহীন ঠেকে কারও কারও কাছে। সবার কাছে সে অনুভূতি এক মনে না হলেও একেবারেই যে আলাদা আলাদা তা কিন্তু নয়।
এমন কূলহারা পূর্ণিমায় সত্য গোসাইয়ের বড় মেয়েটা যখন আশপাশের শত অচেনা শঙ্কাকে চুলোয় তুলে এবং রাতের নিরবতাকে আরও এক ধাপ গভীরে পৌঁছে দিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ধীরলয়ে গাইতে শুরু করে বাগেশ্রীর আলাপ, তখন পাইনসাদের পুকুর পাড়ের আধমরা নারকেল গাছের কাণ্ডের ফোকরে বাসা বাঁধা রহস্য পাখিটা সে গানে কান দেয়।
তার সঙ্গে আরও একজন কান পেতে শোনে রাতের কিশোরীর আকুলতা। সে পান চাবায় আর আলাপের তালে মাথা নাড়ায় কিছুটা। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তার মাথা আসলে স্থিরই থাকে। রহস্য ভেদ করা তার পছন্দের কাজ হলেও এই একটা মুহূর্তে সে চায় রহস্য আরও গাঢ় থেকে গাঢ়তর হোক।
কিশোরীর রাগ চর্চায় তবলা বাদকের অভাবটা বুঝি দূর করে দেয় যমুনার শাখানদীর ঢেউ। অন্তত ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারু মাঝির এমনই একটা কিছু মনে হয়।
বাগেশ্রীর আলাপ শেষ হতেই হারু মাঝি আর দাঁড়াতে পারে না। ঢেউ তখন ছন্দ টন্দ ভুলে তার নাম ধরেই সজোরে চেঁচাতে থাকে। হারু মাঝি ত্রস্ত পায়ে হেঁটে যায় তার ঘাটে বাঁধা নৌকার দিকে। এমন পূর্ণিমার রাতে সে নৌকাতেই রাত কাটায়। কখনও জেগে, কখনও আধো ঘুমে।
রহস্যজট : অন্তর্ঘাত
একদিন ভরা পূর্ণিমা থাকা সত্ত্বেও নদীর পথ ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় হারু মাঝির কানে আসে না কিশোরীর বাগেশ্রী কিংবা আশাবরী। বাড়িটার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনও সাড়াশব্দ পায় না। ‘মাইয়েটার শইল খারাপ মনে লয়’। মনে মনে এই একটি বাক্য গজরাতে গজরাতে হারু মাঝি নৌকায় ওঠে। রান্না করে। কিন্তু পুরোপুরি খায় না। গান না শোনায় ঘুমও হয় না ঠিক মতো। আর তাই পরদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ার কারণে খবরটাও তার কানে আসে দেরিতে। সত্য গোসাইয়ের কিশোরী মেয়েটার লাশ পাওয়া গেছে সুরুজ মোল্লাদের বাড়ির পাটক্ষেতের পাশে বাঁশঝাড়ের গোড়ায়। বিবস্ত্র লাশটাকে দেখে কারও বোঝার বাকি থাকে না তার সঙ্গে কী ঘটেছে। পাটক্ষেতের মাঝে অনেকগুলো গাছ থেবড়ে গেছে। নরম ভেজা মাটিতে দেবে গেছে কয়েকটা গাছ। লাশটা আলগোছে পড়ে ছিল বাঁশঝাড়ের ভেতর। খুনি যেন আশা করেছিল রাতের মধ্যেই শেয়াল কুকুরে খাবে।
কেউ একজন এসে লাশটাকে ঢেকে দেওয়ার পরও যেন বিভৎসতা কমে না এতটুকু। গ্রামবাসী লাশ দেখে বার বার, হারু মাঝিকে কেউ দেখে, কেউ দেখে না। ভাল করে দেখলে বুঝতে পারতো, হারু মাঝির অমন ভেঙে পড়া চেহারা আগে কেউ কোনওদিন দেখেনি। নজর বুলিয়ে অনেক খুনখারাবির কূল করে ফেলা হারু মাঝিকে দেখে এও মনে হবে যেন সে এখন যাবতীয় রহস্য খোঁজার ঊর্ধ্বে চলে গেছে।
থানার ওসি কাঁধে হাত রাখার পরই সম্বিত ফিরে পায় হারু মাঝি।
‘মাইয়েটার গলা ছিল কোকিলের মতো। পইত্যেক দিন রাত্তিরে ডাক পাড়িতো..।’
থানার ওসি কাঁধে রেখে বিব্রত বোধ করলেন। তিনি ভেবেছিলেন হারু মাঝি বুঝি এখন কোনও ক্লু বের করবে এই খুনের। কিন্তু তার কথা শুনে ওসি আবার হাত সরিয়ে ফেললেন। বুঝতে পারলেন হারু মাঝির সময় লাগবে। ওসি বিড় বিড় করে বললেন, ‘যে হারামজাদাই কামডা করুক। ছাড়াছাড়ি নাই। তুমি খালি একখান নাম কও মাঝি। বাকি কাম আমার।’
লাশ ময়নাতদন্তে যাওয়ার আগে হারু মাঝি এক ঝলক দেখতে চাইল। মেয়েটার হাতে চুড়ি ভেঙে কেটে যাওয়া দাগে চোখ পড়তেই হারু মাঝির চোখ ছল ছল করে উঠলো। চোখ মুছতেই গলার কাছে চোখে পড়লো লাল হয়ে যাওয়া দাগ। গলার বাম পাশে জ্বলজ্বল করছে একটা বুড়ো আঙুলের ছাপ। এ ছাড়া শরীরের আর কোথাও কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই।
সুরুজ মোল্লার বাড়িতে সে ছাড়া আর কেউ ছিল না। বউ বাচ্চারা মাসখানেক হলো নানার বাড়ি বেড়াতে গেছে। পুলিশ তাকে নিয়ে গেছে জেরা করতে। সকালে ফজরের ওয়াক্তে সেই নাকি সবার আগে লাশটা দেখে। পুলিশেও খবর দেয় সে।
ওসি বলল, ‘ছাড়াছাড়ি নাইক্কা। সুরুজ আলি কালু বেপারি সবকটারে কোমর বাইন্দা নিয়া যামু।’
‘আপনের কারে সন্দ হয়?’
‘আমি তো মনে করি আকামডা করসে সুরুজ। ওর বাঁশঝাড়েই তো লাশ। ওই নাকি আগে দেখসে। সে নিজের পিঠ বাঁচাইতে নাটক করতাসে।’
‘ও আপনেরে ফোন দিয়া কী কইসে?’
‘রাইতের বেলায় ও নাকি শব্দ শুনসে। বাইর হইয়া ঘুটঘুটা আন্ধারে নাকি কিছু দেখে নাই। পরে নাকি আর সাহস পায় নাই।’
‘হুমম। ভয়ের চোটে উল্টাপাল্টা কইতে পারে।’
সত্য গোসাই নির্বাক। পরিবারের অন্যরাও সহজে মুখ খুলছেন না। তবে গুঞ্জন আটকে থাকে না। বলাবলিতে যতদূর বোঝা গেল স্থানীয় প্রভাবশালীর হাত আছে এ ঘটনায়। সত্য গোসাইয়ের ভিটে আর জমি কেনার চাপ দিয়ে আসছিল যে দীর্ঘদিন ধরে, সেই কালু বেপারিই নাকি গোসাইকে শিক্ষা দিতে এ কাণ্ড ঘটিয়েছে। কালু বেপারি নিজে হয়তো মেয়েটাকে ধর্ষণ করে খুন করেনি, এমনটাই ভাবছে সবাই। কাউকে না কাউকে ভাড়া করেছিল। সত্য গোসাইয়ের পাশের কয়েক বাড়ির লোকজনেরও একই কথা। এর মাঝে নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে মাঝে সাঝে গোসাইদের বিবাদ লাগলেও সেটা যে এমন ঘটনা অব্দি গড়াবে না সে ব্যাপারে সবাই প্রায় নিশ্চিত। তবে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যাচ্ছে না নাসিরুদ্দিনের ছেলে তবারককে। গ্রামবাসী জানে তবারকের নজর খারাপ। সারাদিন বিড়ি ফোঁকে আর গোসাইয়ের মেয়েটার দিকে তার অনেক দিন ধরেই নজর ছিল তার। আবার দুদিন আগে স্কুলে যাওয়ার পথে নাকি মেয়েটাকে সিকদার বাড়ির ছোট ছেলে হোসেন সিকদার তুলে নেবে বলে হুমকি দিয়েছিল। কিশোরী খুন হওয়ার আগের দিন অবশ্য তাকে কেউ গ্রামেই দেখেনি। তবে ডান হাত না থাকায় লোকজন হোসেন সিকদারকে খুব একটা গোনায় ধরছে না কেউ। তার সঙ্গে আবার সুরুজ মোল্লার খাতির আছে। সুরুজও তার পক্ষে সাফাই গাইল। এদিকে তবারক আর কালু বেপারি বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। গ্রামবাসী নিশ্চিত এদের কেউ না কেউ মেয়েটাকে খুন করেছে। আবার কেউ এটাও বলছে মেয়েটার শরীরে আঘাতের চিহ্ন নাই, তার মানে মেয়েটা হয়তো ইচ্ছা করেই কারও সঙ্গে বের হয়েছে। তবে একজন কোনও কিছুতেই এখনও নিশ্চিত হতে পারছে না- হারু মাঝি।
লাশ নিয়ে যাবার অনেকক্ষণ পরও হারু মাঝি বাঁশঝাড়ের তলা ছেড়ে নড়ে না। থানার একজন কনস্টেবল আছে তার সঙ্গে। টুকটাক আলাপ করছে সে। তবে হারু মাঝি কথা কমই বলছে। তবে যে কটা কথা বলছে তা অনেকটা নিজের সঙ্গে নিজের কথা। লোকজনের মুখে শোনা নানান কথার সুতো জড়িয়ে সে করে একটা কিছু দাঁড় করাতে চাইছে।
‘তো হারু মাঝি তুমি বিয়াশাদি করবা না। নাকি আজীবন চোর ডাহাইত খুঁজবা।’
হারু মাঝি খানিক পর উত্তর দেওয়ার ছলে বলে, ‘মাইয়েটার নাম ছিল মাধবী। বড়ই সোন্দর গলা। আর গীত হুনা অইব না।’
‘বড়ই দুর্দিন। এখন আর মানুষ মানুষ নাই গো হারু মাঝি। তুমি নৌকা বাইয়া নদী পার অইয়া সমুদ্দুর যাওগিন। তোমার আর এইহানে কাম নাই।’
‘ধর্ম অধর্ম কুনু বিষয় না। বিষয় হইল মোহ। খারাপ মোহ ভালা মোহ। খারাপ মোহ মানুষের চৌখে চাদর পরাই রাখে। চোখের চাদর সইরে গেলে বহু কিছু দেখন যায়।’
হারু মাঝি উবু হয়ে আতিপাতি করে এতক্ষণ ধরে যা যা খুঁজে পেল, ওগুলোকে ঠিক প্রমাণ বলা যায় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ হতে পারে লোকের। আধপোড়া সিগারেট, একটা নতুন কেনা রুমাল।
হারু মাঝির হাতে মোট তিনটি ক্লু। অপরাধী কে তা শুধু আঁচই করেনি, রীতিমতো নিশ্চিত এখন। রাগে শরীর তার কাঁপছেও। অন্যদের মতো মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না বলে হেঁটেই রওনা দিল থানার দিকে। মেয়েটা যে ইচ্ছা করে কারও সঙ্গে যায়নি সেটাও প্রমাণ করতে হবে তাকে। তারচেয়েও বড় কথা মূল খুনিকে ধরলে এটাও বোঝা যাবে ঘটনাটার আড়ালে প্রভাবশালী কারওর হাত আছে কিনা।