রোমান্টিক উপন্যাস – ফ্যান্টাসি থ্রিলার কৃ (পর্ব-৯)

রোমান্টিক উপন্যাস : ফ্যান্টাসি থ্রিলার উপন্যাস- কৃ (পর্ব-১)

রোমান্টিক ফ্যান্টাসি থ্রিলার উপন্যাস- কৃ (পর্ব-২)

রোমান্টিক উপন্যাস (ফ্যান্টাসি থ্রিলার) ”কৃ” (পর্ব-৩)

রোমান্টিক উপন্যাস – ফ্যান্টাসি থ্রিলার কৃ (পর্ব-৯)

ধ্রুব নীল

অচেনা পাখির শব্দে ঘুম ভাঙল। পাখি আমি কম চিনি। হয়তো সেটা বুলিবুলিই ছিল। পাখিরাও ইদানীং মানুষ হয়ে যাচ্ছে নাকি। পাশ ফিরে শুলাম। ঘুম ছুটে যাওয়া যাকে বলে সেটা ঘটল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। চোখ ডলে নিলাম ভালো করে। মগজটা হুট করে প্রসেস করতে পারছে না। কম্পিউটার হলে এতক্ষণে হ্যাং করে বসে থাকতাম। কিন্তু মানুষের মগজ হ্যাং করে না। অদ্ভুত সব যুক্তি এনে বের করে। আমার মাথাও তেমন একটা যুক্তি খুঁজতে শুরু করলো। কিছু খোঁড়া যুক্তি পেয়েও গেল। আমার পাশে যে শুয়ে আছে সে কৃ নয়, রেশমা!

‘আমার ধারণা আমার মাথা পুরোপুরি গেছে।’

‘মোটেও না। মাথা যায়নি। আপনি যে বুঝতে পেরেছেন আপনার একটা সমস্যা হয়েছে, মনে করেন এতেই অর্ধেক রোগ সারা।’

আমি জানতাম ডাক্তার শরফুদ্দিন এ টাইপ একটা কথাই বলবেন। আমি অপেক্ষায় আছি তার প্রেসক্রিপশনের। ওষুধের নামও বলে দিতে পারবো। তিনি আমাকে আপাতত ক্লোনাজেপাম গ্রুপের কোনো একটা ওষুধ লিখে দেবেন। যেটা আমাকে কয়েকদিন ঘোরের ভেতর রাখবে। রাতে ঘুম হবে চমৎকার। পরে দেখা যাবে ওটা ছাড়া আমার আর ভালোই লাগছে না। ওষুধ না খেলেই ফিরে আসতে শুরু করবে কৃ। শুধু কৃ না, সঙ্গে পরিবারশুদ্ধ নিয়ে আসতে পারে।

গল্পটা বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। গল্প বলার ক্ষেত্রে সতর্ক লেখকরা লিনিয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করেন। মানে সময় ধরে ধরে ঘটনাপ্রবাহ সাজানো। একটা ঘটনার পর আরেকটা। লাইন ধরে ঘটনারা এগিয়ে যাবে। গল্পের ডালপালা যতই ছড়াক, সময়ের মেরুদণ্ড বেয়ে এগিয়ে চলবে ঠিকই। আমার বেলায় সেটা হচ্ছে না। তারপরও যতটা সম্ভব ধারাবাহিকতা রক্ষা করার চেষ্টা চলুক।

সেন্ট মার্টিনে সকালবেলা রেশমাকে দেখে আমি চমকে গেলেও আমার মস্তিষ্ক ধাতস্ত করে নিল নিজেকে। যেন অদৃশ্য কেউ একজন আমার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলল। রেশমার ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। চাদর জড়িয়ে আমার দিকে চোখ কুঁচকে তাকাল। আগের মতো নির্লিপ্ততা নেই সেই চোখে। আছে চিন্তার ছাপ। তারমানে আমি নিশ্চয়ই গত কয়েকদিন ধরে তার সঙ্গে অদ্ভুত আচরণ করছিলাম। সত্যিই কি তাই? নাকি আমার সঙ্গেই অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘটেছিল?

‘এত সকালে উঠলে কেন। এদিকে আসো। কাছে আসো।’

এ কথার মানে আমি জানি। সে এতটা আমুদে গলায় ডাকছে যে কাছে যেতেও ইচ্ছে করছে। আমি কাছে গেলাম। উষ্ণতা নিলাম রেশমার শরীরের। সাত বছরের চেনা গন্ধটাও পেলাম।  নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে কৃ আমাকে শেষ পর্যন্ত দখল করতে পারেনি। কারণ আমি সত্যিই রেশমার সান্নিধ্যে কেমন যেন একটা নিরাপদ বোধ করতে লাগলাম।

এদিকে গতরাতের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি নিঃশ্বাসের স্মৃতি যে একদম তরতাজা! হায় কৃ! তোমাকে বোঝা গেল না।

আমি বর্তমান সময়ের রেশমাকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘আজ কত তারিখ?’
‘আজ ১৩ এপ্রিল। তোমার ছুটি। কালও ছুটি। এ জন্য বেড়াতে এসেছি। আর কিছু জানতে চাও?’
‘আমরা এখানে কবে এসেছি?’
‘তোমার কী হয়েছে? খিদে পেয়েছে? নাকি সুগার কমে গেছে?’
‘আমরা কবে এসেছি?’
‘দুদিনও তো হয়নি। কেন? চলে যাবে?’
‘তৈরি হও। ঢাকা যাব। আমার কিছু ভালো লাগছে না। এই সব সমুদ্র টমুদ্র ফালতু জায়গা। এত  লোনা পানি দেখার কী আছে। এর চেয়ে তোমাদের গ্রামের বাড়ির পাশে জঙ্গলের ভেতর যে পুকুরটা আছে সেটার পাড়ে গিয়ে বসে থাকি চলো।’

যথারীতি এসবে কাজ হলো না। সেদিন সারাটা দিন রেশমার সঙ্গে আমি সেন্ট মার্টিনে ঘুরে বেড়ালাম এবং একের পর এক ব্যাখ্যা হাতড়ে বেড়ালাম। হতে পারে কৃ আমার কাছ থেকে কৌশলে বিদায় নিয়েছে। রেশমাকে তুলে এনে এখানে হোটেল রুমে রেখে গেছে এবং সম্ভবত তার মগজ ধোলাই করার ক্ষমতাও আছে। অথবা গ্রাম থেকে ঢাকায় ও সিলেটে যাওয়ার সময় কৃর চোখে যে বিষণ্নতা ধরা পড়েছিল, সেটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানে ও আসলে তখনই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে এরপর থেকে আমি রেশমাকেই কৃ ভেবে এসেছি এবং গতরাতে রেশমার সঙ্গেই আমার অলৌকিক এক মিলন হয়েছিল। অন্তত রেশমার ভাবভঙ্গি দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। ও একটু বেশিই চুপচাপ হয়ে গেছে।

পরদিন দুপুরে আমরা টেকনাফ থেকে ঢাকার বাস ধরলাম। পথে বিশেষ কথা হলো না। বেশিরভাগ সময় রেশমা আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। সাধারণত ও যেটা করে না। আমার মন বলছে, ঢাকায় ফিরে ঘুম ভেঙে দেখবো আমার পাশে কৃ বসে আছে এবং তার মুখে ক্রূর একটা হাসি। হাসতে হাসতে বলছে, ‘তুমি জানো না আমি যেকোনো রূপ ধরতে পারি? রেশমার রূপ ধরে দেখলাম, আমার জন্য তোমার টান কতটা।’

আমি কি কৃর পরীক্ষায় পাস করবো?

উদ্ভট এক টেনশন নিয়ে শেষ হলো আমাদের যাত্রা। ঢাকায় ফিরেই দ্রুত পিজির মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের এপয়েন্টমেন্ট নিলাম। ঘটনা যতটা পারা যায় রাখঢাক রেখে তাকে বললাম। তিনি আমাকে কাগজে ছকটক এঁকে অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলেন।

‘…যাকে বলে অবসেসিভ কমপালসিভ সিজোফ্রেনিয়া। এক্ষেত্রে আপনার মগজটা হুট করে অনেকগুলো স্মৃতি তৈরি করে ফেলছে। আপনি ভাবছেন সময় অনেক চলে গেছে, আসলে এক সেকেন্ডও যায়নি। এখন থেকে ডায়রি লিখবেন। দেখবেন সব ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন। আপাতত মনে করে এ ওষুধগুলো খাবেন। আর অবশ্যই পরেরবার আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন।’

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামতেই লাল গাড়িটায় চোখ আটকে গেল। বেশ দামি গাড়ি। গাড়ির প্রতি আকর্ষণ আমার কখনই ছিল না। তবে এ গাড়িটায় চোখ আটকে গেল। রিয়ার ভিউ মিররে মিষ্টি একটা পরিচিত মেয়ের মুখ। হালকা হলেও বেশ দশাসই মেকআপ নেওয়া। চুলটাও বদলে গেছে। চুলের আগার দিকটা কেমন বাঁকানো। চোখে সানগ্লাস। সব মিলিয়ে বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ধনী ও বিদেশি ডিগ্রি পাওয়া একটা চেহারা।

আমার দিকে তাকাল না মুখটা। আমি কাছে এসে দাঁড়ালাম। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে মেয়েটা আবার ফিরিয়ে নিল মুখ। আমারও কি তাই করা উচিৎ? নাকি প্রথম যেদিন ছাদে হ্যাংলার মতো তাকিয়েছিলাম সেভাবে তাকানো উচিৎ।

‘উঠে পড়ো।’

তালপাকা এই গরমে মনে হলো কানের কাছে বৃষ্টি নেমেছে। দেরি না করে উঠে পড়লাম। আরামদায়ক সিট। ভেতরে এসির বাতাসে মনে হলো মাঘ মাসের শুরু। সিটে বসতেই মন চাইল চাদর মুড়ে ঘুম দেই। রাতে ইদানীং ঘুম একদমই হয় না।

রাস্তায় যানজট নেই। মনে হলো উড়ে উড়ে যাচ্ছি। পেছন থেকে কৃকে দেখাচ্ছে লেটেস্ট স্মার্টফোন ব্যবহার করা পরীর মতো। মাথায় এমন বিচিত্র সব উপমা যখন ভিড় জমাচ্ছিল তখন ব্রেক কষলো কৃ।

নেমে পড়লাম। জায়গাটা ঢাকার কাছেই। উত্তরার আশপাশের একটা জায়গা। কৃ নামল। আমার দিকে এখনো সরাসরি তাকায়নি। সেও কি কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়াচ্ছে?

‘তুমি তো বিজ্ঞান বোঝো। তোমার বিজ্ঞান আর আমার বিজ্ঞান মিলবে না। তবে তোমার ভাষায় বলতে গেলে, তোমার বাস্তবতা আমি কিছুটা বদলে দিয়েছি। তোমার ভালোর জন্যই।’

অবিকল লুনার মতো শোনাচ্ছে কৃর কথাগুলো। আমাকে কঠিন ছ্যাঁকা দেওয়ার পর লুনা একদিন ফোনে আমাকে এ টাইপের কথা বলেছিল। এরপর থেকে কেউ আমার ভালো চাইলেই কেমন যেন আতঙ্কে পড়ে যাই।

‘ওই রাতে আমিই ছিলাম তোমার সঙ্গে। আমাদের রাতটা মিথ্যে ছিল না।’

‘ও। আচ্ছা।’

‘দেখো, এটা মোটেও জটিল কিছু নয়। অন্তত আমার কাছে। তোমরা মানুষরা সময় বুঝতে পারো না দেখে সব জটিল করে ফেল। তুমি ভাবছো কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে সব ব্যাখ্যা করতে পারবে। মোটেও না। একটা বস্তু এক সময়ে একশটা জায়গায় থাকতে পারে, সময়টা আটকে থাকলেই হলো। সহজ ব্যাপার। তুমি এখন এখানে আছো, আবার একটু পর নিজেকে চাইলে… থাক এসব বক বক করে লাভ নেই। খিদে পেয়েছে?’

আমাদের প্রেমের গল্পটা ক্রমে সায়েন্স ফিকশনের দিকে ছুটছে কেন? নিজের ভেতর উত্তর পেলাম না।

‘তোমার সঙ্গে আমার গল্পটা হবে মহাকাব্যিক এক প্রেমের উপন্যাস। কিন্তু এটা ক্রমশ সাইকো-থ্রিলারের দিকে গড়াচ্ছে। ডাক্তার শরফুদ্দিন বলে দিয়েছেন তুমি হচ্ছো আমার অবসেসিভ কমপালসিভ..।’

‘গো টু হেল।’

‘তোমার গেটআপের সঙ্গে সঙ্গে দেখছি পারসোনালিটিও বদলাচ্ছে। ঘটনা কী! এটাও কি কৃদের বৈশিষ্ট্য?’

‘কৃ না ছাই, আমি এখন মানুষ। উড়তে পারি না বুঝলে!’

‘নাহ, তুমি মানুষও না। তুমি হলে ক্ষমতা হারানো সুপারম্যান। তোমার চোখেমুখে নিদারুণ কষ্ট।’

‘আরেকটা কথা বললে তোমার হৃৎপিণ্ড সেদ্ধ করে খাব।’

‘সেদ্ধ করাটা তো অশুদ্ধ আচার। হৃৎপিণ্ড খেতে হয় কাঁচা। চিবিয়ে চিবিয়ে। দুপাশের বড় বড় দুটো সাদা দাঁত বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়বে।’

‘থামবে!’

কৃর পোশাকটা ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম। হালফ্যাশনের একটা কাটাকুটি করা জামা, সঙ্গে জিন্স। জামাটা দেখলে মনে হবে জামা নয়, অন্য কিছু দেখি। চোখ বারবার ইতিউতি চলে যাচ্ছে। পরেই আবার মনে হলো, যাহ, কিছুই দেখা হলো না।

‘এভাবে তাকালে তোমাকে এই ভরদুপুরে রাস্তার মধ্যে ন্যাংটো করে আমি চলে যাব। উড়তে না পারলেও ক্ষমতা কিছু আছে।’

‘নাহ, সে সুযোগ আর পাচ্ছো কই। আমি ঠিক করেছি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব। তুমি আমার সঙ্গে যা শুরু করেছো, তাতে এ সংসার টিকবে না। আই মিন বিয়ে করার আগেই ডিভোর্স। ভালো কথা, একটু পর আবার রেশমা হয়ে যাবে না তো?’

‘কেন? ওকে দরকার? এখন আমাকে ভয় লাগছে? রেশমার বুকের মধ্যে মুখ লুকাবে?’

‘ও বাবা। এ তো দেখি দু মুখো সাপ। ওকে, রেশমার প্রসঙ্গ বাদ। শুধু শেষ একটা প্রশ্ন আছে।’

‘আমি জানি কী বলবে!’

চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটা বলল কৃ। আমিও বুঝে ফেললাম যে কৃ জানে এবং কেন এত বিরক্ত।

‘শোনো তোমাদের মানে এই মানুষদের মধ্যে কিছু উজবুক আছে। আগাগোড়া কিছু না বুঝেই নিজেকে বিরাট জ্ঞানী ভেবে ফেলে।’

‘ওঝাকে দেখে আমার জ্ঞানী মনে হয়নি। কিন্তু ঘটানাটা কী ছিল?’

আমার শেষ প্রশ্নটা ছিল ওঝাকে ঘিরে। যার আচরণ কিংবা মন্ত্রপাঠের প্রভাব পড়েছিল কৃর মধ্যে।

‘এখন যদি তুমি একটা উটপাখিকে রকেট কিভাবে কাজ করে সেটা বোঝাতে চাও, তা পারবে?’

‘শেষ পর্যন্ত আমাকে উটপাখির সঙ্গে তুলনা করলে? যাকে তুমি এত ভালবাসো?’

‘কারণ উটপাখি বিপদ দেখলে মাটিতে মুখ গুঁজে রাখে আর ভাবে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না।’

‘তারপরও চেষ্টা করতে দোষ কোথায়। তা ছাড়া এ জায়গাটা ভাল লাগছে না। কাশফুল উড়ে উড়ে নাকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। তোমার এই ফেরারি গাড়িটা নিয়ে মেরিন ড্রাইভে গেলে মন্দ হতো না। আহা সমুদ্র! এক কাজ করো গাড়িটা বিক্রি করে একটা স্পিডবোট কিনে ফেল।’

‘রিয়েলিটি সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই তুষার। যা দেখো সেটাই বাস্তব মেনে নাও। দুচার কলম বিজ্ঞান পড়ে নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবা বন্ধ করো।’

‘আমি লেখক, বিজ্ঞানী নই।’

‘তা তো জানি। প্রেম করা বাদ দিয়ে তোমাকে এখন অনেক কিছু শেখাতে হবে আমার!

আমি বিরাট সাহসের কাজ করে ফেললাম। কৃর রাগী রাগী মুখ উপেক্ষা করে এগিয়ে এসে তার কোমর জড়িয়ে ধরলাম। তারপর খুব কাছ থেকে চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘এবার আমায় কিছু শেখাও মায়বিনী।’

storiesকৃগল্পপ্রেমের গল্প