রোমান্টিক গল্প: হা কপাল

রোমান্টিক গল্প: হা কপাল। লেখক: বকুল রায়

রাস্তায় কোন সুন্দরী মেয়েকে হাঁটিয়া যাইতে দেখিলে সবাই তাহার দিকে তাকাইয়া থাকে। আর আমার কাজ হইলো তাহাদের দিকে তাকাইয়া থাকা, যাহারা কাজ বিহীন এই কাজটা করিয়া থাকেন। বখাটেরা অতি আগ্রহের সহিত তাকাইলেও তাহাদের আগ্রহ ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত মেয়েটা তাহাদের দৃষ্টি সীমার মধ্যে থাকে, আর ভদ্রঘরের যুবকদের দেখা যায় খানিক্ষণ হা হুতাশ করিতে, পাইতে গিয়াও কি যেন পাইলনা; এমনি একটা ভাব। আর মধ্যবয়স্কদের আচরন ইহার মোটামুটি বিপরীত বলা চলে। কেহ বা পানের পিক ফেলিবার ছলে, কেহ বা জুতা ঠিক করিবার জন্য খানিকটা বাঁকা হইয়া আড়চোখে কিঞ্চিত পরিমান মুখদর্শন সারিয়া লয়, যেন ইহা তাহাদের একখানি অতি জরুরী কাজ। আবার অনেক প্রবীনদের বলিতে শুনি,“নাহ্, এইবার দেশটা গেল, আর কিছুদিন যাক্, তখন বাবারা বুঝবে, মেয়েছেলেদের আর তখন বেঁধেও রাখা যাবেনা”

“নাহ্ ভাই মেয়েছেলে বের হয়েছে বলেই তো আজ এ পর্যন্ত–”

“আরে ভাই রাখেন নীতির কথা, খবর রাখেন দেশের?”

তাহাদের ঝগড়া স্পষ্ট করিয়া এই পর্যন্তই বুঝা যায়, পরবর্তীতে কথার জোর বাড়িয়া যায় বিধায় কেহই কাহারও কথা বুঝিতে পারেনা। আসলে ইহারা এইরুপ ঝগড়া করেন তাহাদের সান্ধ্যকালীন অবসর কাটাইবার জন্যে। তবে আজিকার ঝগড়াটা একটু অন্যরকম ছিল, ঝগড়া হইতেছিল এক সুন্দরী অষ্টাদশী আর এক বছর পঁচিশেক যুবকের সহিত। ঝগড়া শুরু হইয়াছিল এইভাবে,

যুবকের সহিত কেমন করিয়া জানি তরুনীর ধাক্কা লাগিয়া যায়, ফলে যাহা হইবার তাহা হইল, পরিস্থিতি স¤পুর্নরুপেই তরুনীর পক্ষে গেল, কেননা পক্ষ লইবার জন্যে সে যথেষ্ঠ সুন্দরীও ছিল, লোকদের আর দোষ কি? যুবক যতই বলিতে চায়, সে নির্দোষ; ততই তরুনীটি ফোঁস করিয়া বলিয়া উঠে,“তা হলে কি আমিই ইচ্ছা করে আপনার মত কেলে ভুতের সাথে ঢলাঢলি করতে এসেছি?” তাহার সাথে সাথে অন্যরাও সজোরে বলিয়া উঠে, “ কিহে কেলে ভুত, নিজেকে মিষ্টার ওয়ার্ল্ড ভাবো নাকি?”

যুবকের কথা কেহ আর শুনিতে চাহেনা। এক পর্যায়ে যুবক ক্ষিপ্ত হইয়া পকেট হাতড়াইয়া কি যেন বাহির করিতে চায়, কিন্তু কেহ কিছু বুঝিলনা, আড়াল হইতে কে যনে বলিল,“শালা চাকু বের করছে দেখ!”

“কই দেখি!!!”

“কত্ত সাহস!!”

“ধর শালারে!!”

যাহারা গড়ের মাঠে কিছুদিন ধরিয়া কারাতের প্র্যাকটিস করিয়া আসিয়াছিল, তাহাদেরই সবার আগে ডাক পড়িল। দেশ ও সমাজের অশেষ কল্যানের উদ্দেশ্যে তাহারা যুবকের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল। তরুনীটিও চুপচাপ কাটিয়া পড়িল। আর আমি তরুনীর পিছু লইতে শুরু করিলাম।

হন্তদন্ত হইয়া একটা প্রকান্ড বাড়িতে তরুনী প্রবেশ করিল।

 

–     মা! পানি দাওতো একগ্লাস

কিন্তু কাউকে দেখা গেলো না। তরুণী নিজেই আগাইয়া গিয়া টেবিল হইতে পানির জগ হাতে নিল, কিন্তু তাহাতে বোধহয় যুবকের অভিশাপ লাগিয়াছে, জগ জলশূন্য। অতঃপর তরুণী তাহার হাতের কাছে রাখা গ্লাসটা লইল এবং কী যেন ভাবিয়া তাহা আছাড় দিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিল। তাহাকে দেখিয়া বোঝা গেল এই কাজে সে ততটা অভ্যস্ত নয়। হয়তো তাহার মা তাহাকে সবসময় মান্য করিয়াই চলে, যাহার ফলে সে গ্লাস ভাঙ্গার বিদ্যেটা সহজে শিখিতে পারে নাই।

 

যুকের নাম সুরেশ মজুমদার। যখনকার কথা বলিতেছি তখন আগ্রায় চলিতেছে উনিশশত চুরাশি সাল।

যুবকের পিতা ব্যবসায়িক কর্মে এই খানটাতে আসিয়াছিল। তবে তিনি বর্তমানে এইখানে স্থায়ী ভাবেই থাকার ব্যবস্থা করিতেছেন, কেননা আগ্রায় তাহার ব্যবসার দৈর্ঘ্য প্রস্থ উভয়েই বাড়িয়া গিয়াছে। এমনকি তাহার একমাত্র সন্তান সুরেশের বিশেষ ইচ্ছা আগ্রায় থাকিয়াই সে তাহার পড়ালেখা চালাইয়া যাইবে। তাহার মতে এইখানকার পরিবেশ সিদ্ধেশ্বরী থেকে অত্যাধিক ভালো। তাই এই লইয়া তাহাদের কাহারই আর দ্বিমত রহিলনা।

সুরেশের মাতৃবিয়োগ হয় যখন তাহার বয়স পাঁচ-ছয় হইবে। পিতার কাছেই বড় হইয়াছে সে। মেয়েদের ব্যপারে তাই তাহার জ্ঞান এখনও পূর্ন হয়নাই। এখনও সে ধাক্কা দিবার নিয়ম কানুন রপ্ত করিতে পারেনাই।

বিশ্বনাথ বাবুর আজ আবার চোখের সমস্যা শুরু হইয়াছিল। তাই সুরেশের সামান্য পরিবর্তন তাহার চোখ এড়াইয়া যায়। সুরেশও কাউকে কিচ্ছু না বলিয়া চুপচাপ রহিল।         

 

সুরেশের সহিত অষ্টাদশীর সাক্ষাৎ ঘটিবার এক সপ্তাহ পরের ঘটনা বলিতেছি–

বাসে চড়িলে সুরেশ সহসা মহিলা আসন চিনিতে পারে না। সে ধপাস করিয়া একখানটাতে বসিয়া পড়িল। অন্যরা ব্যাপারটাতে তেমন গা করিল না। কিছুক্ষণ পরেই অঘটনটা ঘটিল। সেই অষ্টাদশী আসিয়া উপস্থিত। যেন বাসের মহিলা আসনখানার মান রক্ষা করিতে আসিয়াছে। সুরেশ প্রথমে তাহাকে চিনিতে পারিলনা। কিন্তু আগেকার সেই ঝাঁজমাখা কন্ঠ শুনিয়া সে একটু ঘাবড়াইয়া গেল।

 

-ভালোয় ভালোয় উঠুন বলছি, নইলে!

সুরেশ বুঝিতে পারিলনা তাহার অপরাধটা কোন ধরনের। আজতো তাহার সহিত কাহারো ধাক্কা লাগেনাই। সে ভীত হইয়া চিন্তা করিতে লাগিল। আর অষ্টাদশী রুমাল লইয়া ঘাম মুছিতে লাগিল। সুরেশ উঠিয়া বসিতেই সে তাহাতে ধপাস্ করিয়া বসিয়া পড়িল।

 

অষ্টাদশীর নাম নন্দিতা রায়। তবে আজ শাড়ি পড়ায় তাহার বয়স বোধকরি আরো বছর দুই বাড়িয়া গেল। কিন্তু শশীলাল মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করিবার ন্যূনতম বয়স হইল তেইশ বৎসর, নন্দিতা অত্র কলেজের পার্টটাইম শিক্ষিকা।

তাহার মা অনুরাধা রায়ের পিতা বিশাল বড়লোক। তাই স্বামী বিয়োগেও তাহাকে বিশেষ সমস্যায় পড়িতে হয় নাই। নন্দিতাকে লইয়া তাহার সমস্যায় পড়িবার কথা থাকিলেও তিনি পড়িলেননা। তাহার এই মেয়েটা তাহার পুত্র সন্তানের অভাব মিটাইয়া দিয়াছে। অনুরাধা তাহার মেয়েকে অনেকটা মান্য করিয়া চলে বলা যায়। ইহার কারণ হিসেবে একদিনকার ঘটনার কথা বলা যায়। সেদিন নন্দিতা আর অনুরাধা সার্কাস দেখিতে গিয়াছিল। ভীড়ের মধ্যেও নন্দিতা আর অনুরাধা নিজেদের জন্যে উপযুক্ত স্থান বাছিয়া লইল। তথাপিও এক প্রকারের বখাটে যুবক নন্দিতার পিছু ছাড়িতেছিলনা। সে পরিপূর্ণ উদাসীনতার সহিত নন্দিতার গা ঘেঁসিয়া দাঁড়াইবার পরিকল্পনা করিতেছিল। অনেকক্ষণ পর্যন্তও যখন ইহার হাত হইতে নিস্তার পাওয়া যাইতেছিল না তখনই নন্দিতা ছেলেটিকে বলিল, ‘এই ছেলে! এদিকে এসো!’

বখাটে একটু ঘাবড়াইয়া গেলেও তাহার চাইতে বেশি ঘাবড়াইল নন্দিতার মা। তিনি হা করিয়া নন্দিতার পানে তাকাইয়া রইলেন।

যুবক উদ্বিগ্ন হইয়া বলিল, ‘আমাকে বললেন?”

নন্দিতা কোনও কথা না বলিয়া যুবকের দিকে আগাইয়া তাহার গালে সশব্দে একখানা চড় বসাইয়া দিল। এইবারও যুবকের চাইতে বেশি অবাক হইল অনুরাধা।

 

সুরেশ যাইতেছিল প্রতাপ চৌধুরীর কাছে। প্রতাপ চৌধুরী আর বিশ্বনাথ রায় বহুকাল আগেকার বন্ধু। তিনি এখানকার প্রসিদ্ধ ডাক্তারদের মধ্যে একজন। তাই সুরেশ তাহার কাছে মাঝে মাঝে তাহার পাঠ বুঝিয়া লইবার জন্য যায়। তিনিই সুরেশের একমাত্র বন্ধু। সুরেশও তাহার মাঝে এমনি কিছু একটা পাইয়াছিল।

কলেজের সম্মুখে বাস আসিয়া থামিতেই নন্দিতা নামিয়া পড়িল। আর সুরেশ তাহার পরের স্টপেজেই নামিল। দুইজনের মধ্যে বার কয়েক চোখাচোখি ব্যতিত আর কোন কলহ বাধিল না।

 

প্রতাপ চৌধুরীর পরিবার বলিতে শুধু তিনি আর তাহার ষোড়শী কন্যা কমল। তবে বাপ মেয়ের মাঝে আরেকজন সদস্য শুরু হইতে অদ্যাবধি বিদ্যমান। সে হইল বাড়ির ভৃত্য রঘু। তাহার বয়স দেখিতে মনে হয় পঞ্চাশ হইবে। কিন্তু সে সবাইকে বলিয়া বেড়ায় তাহার বয়স এখনও পঁয়তাল্লিশ হয়নাই। যদিও এই কথা সে কমলের জন্মের পর হইতেই বলিয়া আসিতেছে।

 

কমলের কিছু কথা না বলিলেই নয়। কেননা অনেকেই এতক্ষণে অনেক কিছু আন্দাজ করিয়া ফেলিয়াছেন। তাই তাহার পরিচয়ের প্রথমটা হইল স্থানীয় একটা কলেজের দ্বারা সে তাহার শিক্ষা জীবনের দ্বিতীয়ার্ধ্বে প্রবেশ করিয়াছে।

ইহা ব্যতিত সে এখানকার সাপ্তাহিকে নিয়মিত লেখালেখিও করিয়া আসিতেছে। শুনা যাইতেছে গুটি কয়েক প্রকাশকের সহিত তাহার আলাপও হইয়াছে। অতএব প্রতাপ চৌধুরীকে পুরোপুরি না হইলেও মোটামুটি সুখী বলা চলে। কেননা ইতিপূর্বে তাহার স্ত্রী তাহাকে ত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়। আমি সেই কাহিনী আপাতত বলিবনা। এখন প্রতাপ চৌধুরীর একমাত্র ভাবনা তাহার কন্যাকে লইয়া। সুরেশ পাত্র হিসেবে মন্দ না। তথাপি ডাক্তারিত তাহার অপরিসীম আগ্রহ, সন্দেহ নাই ইহাতে সে যশ কুড়াইবে। অতএব উভয় পক্ষ হইতেই একধরনের নীরব স¤মতির লক্ষণ টের পাওয়া যায়। তবে কমলের আচরন কেমন যেন উক্ত লক্ষনের মাঝে অস্বস্তির আবরণ দিয়া দেয়। প্রতাপ চৌধুরী একবার অপরাহ্নে তাহার কন্যাকে লইয়া বিশ্বনাথ বাবুর বাসায় গিয়াছিল। তিনি তাহার গৌণ উদ্দেশ্যখানাকে মুখ্য উদ্দেশ্য বানাইয়া কন্যাকে বলিলেন যে, বিশ্বনাথ বাবুর অম্বলের ব্যাথা উঠিয়াছে, তাহাকে একটু দেখিতে যাইতে হবে, এবং বিশ্বনাথ বাবু নাকি তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া কমলকেও লইয়া যাইতে বলিয়াছেন। কমল বিষয়টা লইয়া প্রথমে তেমন মাথা ঘামাইলনা। কিন্তু যখন সে দেখিল বিম্বনাথ বাবু স্বয়ং তাহাদেরকে অভ্যর্থনা জানাইতে আগাইয়া আসিল, তখনি সে তাহার অতি ক্ষুদ্র অনুমানকে বৃহৎ করিয়া তুলিল। কথাচ্ছলে জানিতে পারিল যে আজ সুরেশবাবু অসুস্থ, তাই সে অভ্যর্থনা করিতে আসিলনা। প্রতাপ চৌধুরী অবশ্য একবার মুখ ফসকাইয়া বলিয়া ফেলিয়াছিলেন এই বলিয়া,“যা তো মা, সুরেশ কেমন আছে একটু দেখে আয়”

বলিয়াই বুঝিলেন, তাহার এই কন্যা অসম্ভব বুদ্ধিমতী। তাহার স¤মুখে এতটা আগাইয়া যাওয়া ঠিক হয়নাই। যদিও কমল কথাটি শুনিতে পায় নাই তবুও প্রতাপ চৌধুরী একটু মৌন হইয়া গেলেন। কথা আর বাড়িলনা।

 

প্রতাপ চৌধুরী ডাক্তারীর কাজে বাহিরে গিয়াছিলেন। ঘরে একা কমল আর রঘুই ছিল। বেলা পড়িয়া আসিয়াছে। কমল তাহার পাঠ প্রস্তুত করিতেছিল। আর রঘু একটুখানি বিশ্রাম লইতেছিল। এমনি সময় সুরেশ আসিয়া প্রবেশ করিল। তাহার এই ঘরে যাতায়াতে কোনরুপ সংশয় ছিলনা। কেননা সে প্রতাপ চৌধুরীকে একান্ত নিকটের মানুষ বলিয়াই জানে। এমনকি ঘরে প্রতাপ চৌধুরী নাই জানিয়াও তাহার বিন্দু মাত্র উদ্বেগ জন্মিল না। ঘরে নাই তো কি হয়েছে! একটুবাদেই আসিয়া পড়িবে। দরজা খুলিয়া, বসিতে বলিয়া কমল সোজা ভিতরে চলিয়া গেলো। কিছুক্ষণ পরে যখন সুরেশ গলা চড়াইয়া ডাকিল,“কমল! কমল!”

 

কমলের ভারী মেজাজ বিগড়াইল। তাহার ইচ্ছা করিতে লগিল সুরেশবাবুকে কিছু কড়া কথা শুনাইয়া দেয়।

সুরেশ বলিল, “জল! একটু জল!!”

হঠাৎ করিয়া কমল ভীষন রকমের আত্মগ্লানিতে ভুগিতে লাগিল। এই মানুষটাকে সে এতক্ষণ বিনা আপ্যায়নে বসাইয়া রাখিয়াছে।

তাড়া করিয়া সে সেই কক্ষ হইতে চলিয়া গেলো, পরে রঘুকে দিয়া ফলাহার আর মিষ্টান্ন পাঠাইয়া দিল। বলিয়া রাখা ভালো, ইহাদের মধ্যে কমলের নিজের তৈরী একধরনের পিঠাও অন্তর্ভূক্ত ছিল। যাহা দেখিতে আকর্ষনীয় না হইলেও সবার উপরে স্থান পাইল।

 

কমলকে দেখা গেলো পর্দার আড়াল হইতে সুরেশের প্রতি নজর রাখিতেছে। তাহার অভিসন্ধি সেই বুঝিল। তবে সুরেশকে একটার অধিক পিঠা না খাইতে দেখিয়া সে আহত ভঙ্গিতে চলিয়া গেলো। ঠিক করিল এই মানুষটার সম্মুখে আর যাইবে না। ডাকিলেও না।

 

প্রতাপ চৌধুরী আসিবার পূর্বেই সুরেশ চলিয়া গেলো। যাওয়ার পূর্বে শুধূ একটিবারের মত বলিল “যাচ্ছি”। কেউ আগাইয়া দিতে আসিলনা। সুরেশ তাহা খেয়াল করিল না।

প্রতাপ চৌধুরী ফিরিয়া আসিলেও কমল তাঁহাকে সুরেশের আগমনের কথা বলিলনা। কেন বলিল না, তাহা কেবল সে নিজেই জানে।       

 

ইহার পরের কিছুদিনের কথা না বলিলেও চলে। তবে চতুর্থ দিবসের কথা না বলিলেই নয়। নন্দিতার সেইদিন কলেজে একটু তাড়া ছিল। তাই সে সুরেশকে প্রথমে খেয়াল করিল না। সুরেশ তাহাকে মৃদু স্বরে ডাকিতেছিল। তাহার আওয়াজ নন্দিতা পর্যন্ত যাইতে কি যেন সংকোচ করিতেছিল। বোধহয় সেইদিনের ঘটনার রেশ এখনও কাটিয়া যায়নাই।

-“এই যে শুনুন!”

নন্দিতা ঘাড় ফিরাইয়া তাকাইয়া সুরেশকে দেখিয়া একটু খানি বিরক্ত হইয়া গেলো। এমনিতে আজ তাহার তাড়া, তাহার উপর সেইদিনকার সেই কেলে ভুত। তাহার মেজাজ যুক্তিগত ভাবেই বাড়িয়া গেলো।

-“কী চাই!”

যেন রাস্তার কোন ভিকিরর আবেদনে সাড়া দিচ্ছে সে। সুরেশ তাহার কন্ঠের শ্লেষ টুকু ধরিতে পারিল না। তানা হইলে অন্যান্যের মত সেও দুচারটে বিদ্রুপাত্মক শ্লোক তাহাকে শুনাইয়া দিতে পারিতো। কিন্তু তাহার এক ধরনের আনন্দ লাগিতেছে। কেননা আজ তাহার একধরনের জয় সুনিশ্চিত হইয়া আছে।

-“এই যে নিন, বাসে ফেলে এসেছিলেন”

 

নন্দিতা হাত বাড়াইয়া ব্যাগখানা লইল। তাহার লওয়ার ভঙ্গি দেখিয়া মনে হইল বুঝি ব্যাগের ভিতরে অমুল্য রত্ন রহিয়াছে। তাহার মানে এই নয় যে সে অমূল্য রত্নের লোভেই ইহা লইয়াছে। ইহার মধ্যে তাহার বিদ্যার্থীদের এক্সাম শিট রহিয়াছে। যাহা আজ না লইলেই নয়। এই বস্তুর জন্যই বোধকরি তাহার আজ এত তাড়া ছিল। সে কিছুক্ষণ কিছু না বলিয়া চুপ করিয়া রহিল।

অতঃপর কেলেভুতের পরিবর্তে আজ সুরেশের প্রতি মৃদু একটা ধন্যবাদ জুটিল।

সুরেশ অপেক্ষা না করিয়া চলিয়া গেলো। আজ তাহার প্রতাপ চৌধুরীর বাড়িতে যাইবার কথা থাকিলেও সে গেলো না। আজ সে ভীষণ মজা পাইয়াছে। একটা মোক্ষম প্রতিশোধ আজ সে নিতে পারিয়াছে। এই আনন্দে আজ সে হাঁটিয়া পার্কস্ট্রিট পার হইয়া রাম এ্যভিনুতে চলিয়া আসিল। 

 

ষষ্ঠ দিবসের কথা বলিতেছি। আজ নন্দিতার তাড়া ছিল না। তথাপি তাহার আচরণে একধরনের তাড়ার ছাপ প্রতিদিনই থাকে। ইহাকে সে একপ্রকার সঙ্গী করিয়া লইয়াছে। বাস ¯ট্যান্ডে আসিয়া সে একটু খানি অপেক্ষা করে। বোধহয় কোন সিদ্ধান্ত নিতেছে। তাহার পর ঘড়ি দেখিয়া কি যেন মনে করিয়া সে মনহোরী দোকানে ঢুকিয়া পড়িল। প্রথমে মনে হইবে যেন আজ তাহার ক্লাশ শুরু হইতে ঢের সময় বাকী। তাই সে সামান্য কেনাকাটা করিতে চায়। কিন্তু নন্দিতা ভাবিতেছে অন্য কথা, আজ তাহার প্রথম ঘন্টার পাঠ প্রস্তুত হয়নাই। তাই সে দেরী করিয়া যাইতেছে। কেননা বিদ্যার্থীদের সে নিজ দায়িত্বে পাঠ প্রস্তুত করিয়া দেয়। তবে আজ কেন তাহার এই রকম অনিয়ম হইল তাহা বলিতে পারিনা। বোধহয় সন্ধ্যের পর হইতে তাহার মাথা ধরিয়াছিল। ইহা হইলেও হইতে পারে। কেননা যাহাকে সে কেলে ভুত বলিয়া মারাত্মক রকমের অপমান করিয়াছিল, আজ তাহার ফলেই তাহার পদোন্নতী হইলেও। ইহা যে একপ্রকার মানসিক যন্ত্রণা তৈরি করে নাই, তাহা কে বলিতে পারে!

 

মাঝে মধ্যে তাহাকে ঘাড় ঘুরাইয়া কাহাকে যেন খুঁজিতে দেখা গেলো। বোধহয় ঐ দিনের ধন্যবাদটা পুরা দেয়া হয়নাই। আজ তাহার পুরাটাই দিতে হইবে। এবং সেই ধন্যবাদটা লইতেই বোধহয় অত্র স্থানে সুরেশের আগমন ঘটে। তাহাকে দেখিয়া নয় বরং তাহার পানে চাহিয়া নন্দিতা একপ্রকার মিষ্টি হাসি দিল। সুরেশও কিছু একটা আন্দাজ করিয়া হাসিয়া দিল। নন্দিতা বোধহয় পূর্বঘটনা ভুলিয়া গেলো, তা না হইলে সে এমন কথা বলিতে পারে কি করিয়া!

-“ কেমন আছেন!”

সুরেশের জবাব হইল একপ্রকারের সরল হাসি, যাহা ভাষায় লেখা যায়না। তাই উহার বর্ননা দিতে পারিতেছিনা। তাহাদের মাঝে হইয়া যাওয়া কথা গুলো নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। তাই তাহার বিবরন দিয়া আর দীর্ঘ করিবনা।

 

ইহার পরদিনও সুরেশের সহিত নন্দিতার দেখা হইল। এইবার তাহাদের দেখা হইল পূর্বপরিকল্পনা মত। তাই সময়ের এতটুকু হেরফের হয় নাই। যথা সময়ে দুজনেই উপস্থিত।

-“একি! তুমি এটা কি পরে এসেছ!”

সুরেশের পরনে একখানা ছাই রংয়ের শার্ট দেখিলাম। তাহাতে অনেক গবেষনা করিয়াও যখন কোন খুঁত আবিস্কার করিতে পারিলামনা। তখন বুঝিতে পারিলাম এই রংখানা নন্দিতার নিতান্তই অপছন্দের। সুরেশও তাই বোকার মত হাসিল।

-“এই রকম গাধার মত হাস কেন?”

সুরেশ এইবার অন্যরকম করিয়া হাসিল। তাহার এই হাসি কোন্ চতু®পদীর সাথে মিলিল তাহা বলিতে পারিনা,তবে নন্দিতা আরেকটু রাগিয়া গেলো। যেন সুরেশকে চিবিয়া খাইবে। এই রাগ দেখিতে সেই দিনকার রাগের মত হইলেও তাহাদের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান ®পষ্টই চোখে পড়ে। এবং ইহা অনেকখানি চোখে পড়িবার মতই ঘটনা।

 

এক সপ্তাহ পরের কথা বলিতেছি। সুরেশকে আজ কেমন যেন বিষন্ন দেখাইতেছে। সে হয়তো কিছু একটা ভাবিয়া পাইতেছিলনা। তাই অনেকটা সরল আগ্রহ লইয়া সে নন্দিতাকে জিজ্ঞেস করিল,

“আচ্ছা, তুমি আমার প্রেমে পড়লে কেন?”

 নন্দিতার হঠাৎ ভীষণ রাগ হইল। সে সুরেশের পানে কিছুক্ষণ তাকাইয়া পরে উঠিয়া দাঁড়াইল।

-“ দেখ তুমি যদি তাই ভেবে থাক তবে ভুল করেছ, এখনও সময় আছে সুরেশ, তুমি ভেবে দেখতে পারো”

সুরেশ ভাবিয়া পাইলনা, ইহাতে তাহার ভাবিবার কি আছে। সে মৃদু কন্ঠে নন্দিতাকে অনেকটা অভিযোগের সুরে বলিল,

“ কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না”

নন্দিতার ইচ্ছা হইল সুরেশকে একখানা চড় কষাইয়া দেয়। সে আর কোন কথা না বলিয়া দ্রুত হাঁটিয়া প্রস্থান করিল।

 

ছয় মাস গত হইয়াছে। সুরেশের সহিত কমলের বিবাহের আর মাত্র দিন দুয়েক বাকি। বলিয়া রাখা ভালো, ইহার মাঝে তাহার সহিত আর নন্দিতার দেখা হয়নাই। আজ সুরেশ কমলের সহিত বাজারে আসিয়াছে তাহাদের বিবাহের কেনাকাটা করিবার জন্যে।

-“আচ্ছা আপনি ‘দ্যা সুইটেস্ট পেইন’ বইটা পড়েছেন?”

-“ না”

কমল বিরক্ত হইয়া সুরেশের দিকে তাকায়, এই পর্যন্ত সুরেশ তাহার সহিত হ্যাঁ,না ব্যাতীত অপর কোন আলাপ করেনাই। দেখিয়া সে ভাবিল, হয়তো লজ্জা পাইতেছে। “থাক্ বেচারাকে আর লজ্জায় ফেলতে হবে না” এই ভাবিয়া সেও আর কোনও কথা বলিল না।

 

কমলের হঠাৎ আইসক্রিম খাইতে ইচ্ছা হইল। সে দোকানে বসিয়া আইসক্রীম খাইতেছে, আর সুরেশ গেলো তাহার জন্যে শাড়ি পছন্দ করিতে। বিধাতার কি ইচ্ছা বলিতে পারিনা! নন্দিতাও আজ একই স্থানে শাড়ি কিনিতে আসিয়াছিল। সুরেশকে প্রথমে সে দেখিতে পায়নাই। পরে যখন সুরেশকে বলিতে শুনিল,

“এই টা নয় ঐ নীল রংয়েরটা দিন”

তখনই সে তাহাকে দেখিল। এবং দর্শন পরবর্তী তাহার আচরন ইতিপূর্বের আচরণ অপেক্ষা সম্পূর্ণ বিপরীত হইল।

প্রথমেই সে সুরেশের হাত ধরিয়া ফেলিল। কেননা মাস ছয়েক আগে সে প্রায়ই উহা ধরিত, ইহাতে সে তেমন সংকোচ বোধ করে না। সুরেশ ভীষন চমকাইয়া প্রথমে এদিক ওদিক তাকাইল। নাহ্, কমলের আইসক্রিম এখনও শেষ হয় নাই।

 

নন্দিতার মুখ চকচক করিতে দেখিলাম। প্রথমে নির্বাক থাকিলেও এইবার সে কথা বলিল,

-“কোথায় ছিলে বলতো!, অভিমান হয়েছিল বুঝি! বারে! আমি তোমার অভিমান ভাঙাবো না এমনটি বলেছি নাকি! কতবার বললাম না ছাই রংয়ের শার্ট একদম পরবে না! দাঁড়াও বিয়েটা হোক, তারপর তোমার যত্ত ছাই রংয়ের শার্ট আছে সব আমি পুড়ে ছাই করবো। গাধা কোথাকার!”

   

 

storiesগল্পপ্রেমের গল্প