লেখক : ধ্রুব নীল
সময়পুর। এ নামে বাংলাদেশে কোনো গ্রাম নেই। মানে এখন আমাদের যে মানচিত্র তাতে এর অস্তিত্ব নেই। গ্রামের নামটা আমারই দেওয়া। কারণ, আমার মতে নামটা সময়পুরই হওয়া উচিত। যদিও ওই গ্রামের লোকজন নাম-ধাম নিয়ে ভাবে না। তাদের কাছে গ্রাম মানে গ্রাম।
সময়পুর গ্রামে সময় যেতে চায় না। সবার হাতেই অফুরন্ত সময়। কাজ করতে করতে কোনো কৃষকের মনে হলো আজ নিড়ানি বাদ দিয়ে বসে থেকে শরতের ঘ্রাণওয়ালা বাতাস খাবে। তো সে সেটাই করে যাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক সময় রাত হবে। শেয়াল ডাকবে। শেয়ালের ডাক শুনে শুনে কোনো শিশুকে তার মা গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াবে। সেটাও অনেক সময় নিয়ে। তারপর নিশাচর পাখির গাছের গর্তে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে নেমে আসবে গভীর রাত। যে রাতটাও কাটতে চাইবে না অনেকক্ষণ।
এখানে আসার পরই আমি গ্রাম কাকে বলে শিখেছি। গ্রাম হওয়ার মতো সবই আছে সময়পুরে। চিকন লতার মতো সজনে, খালের পাড়ে বেড়ে ওঠা কলমি গাছ, তাতে কলমি ফুল, বেতফলের ঝোপ, ভাটফুলের ঝাঁঝাল ঘ্রাণ, ঝিরি নালা দিয়ে বয়ে চলা কাগজের নৌকা, শতবর্ষী একটা বটগাছ ও সেটাকে ঘিরে বসা গানের আসর।
তবে এসবের মাঝে আমার পছন্দ হলো একটা নৌযান। ন্যানোব্লাস্ট ইঞ্জিন ছাড়াই নৌকা নামের যে যানে বসলে আমার আর নিজের সময়ের বিধ্বস্ত পৃথিবীটায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। ও হ্যাঁ, নৌকায় বসলেও কিন্তু সময়টা আটকে যায়!
সময়পুরে শীতকালটা কাটিয়েছি কদিন আগে। ভাপা পিঠা আর দুধপুলির স্বাদ এখনও আমার নিউরাল নেটওয়ার্কে গেঁথে আছে। সঙ্গে করে নিজের সময়ের কোনো প্রযুক্তি আমি আনিনি। তাই আপাতত মনে রাখার চেষ্টা করছি সব।
হারু মাঝি নৌকা ছাড়তেই আমি স্মৃতিতে হারিয়ে গেলাম। তার মুখ দিয়ে বিচিত্র একটা সুর বের হচ্ছে। এমন গানও এখানে আসার আগে শুনিনি। ভাওয়াইয়া নামের ওই গানের ফাঁকে এবার নিজের ফেলে আসা বর্তমানটার কথা বলা যায়।
আমি যে বাংলাদেশ থেকে এসেছি, সেখানে চলছে তিন হাজার চুয়ান্ন সালে। সময়পুরে কত সাল? এখানে কোনো ক্যালেন্ডার দেখিনি অবশ্য। আমার পৃথিবীর একমাত্র আমিই সেই বিজ্ঞানী যে গ্রামটা খুঁজে পেয়েছি। সেটা বছরখানেক আগের কথা।
সময়পুরের নামটা প্রথমে আমার কাছে ছিল পঁয়ত্রিশ ডিজিটের একটা সংখ্যা। আমার সময়ের বাংলাদেশে যা কিনা এক দুর্গম ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছু নয়। ওই ধ্বংসস্তূপের মাঝে ছোট কালো দরজাটার অস্তিত্ব ধরা পড়েছিল আমার কোয়ান্টাম বাবল স্পেকট্রোমিটারে। সাধাসিধে একটা স্পেস পোর্টাল ভেবেই ঢুকে পড়ি ওই দরজার ভেতর। এরপর নিজেকে আবিষ্কার করি ঝুম বৃষ্টিতে একটা সুবিশাল গাছের তলায়। পেছনে তাকিয়ে দেখি পোর্টাল গায়েব। আর সামনে সবুজ রঙের সারি সারি গাছ।
সেদিন থেকেই আমি এ গ্রামের বাসিন্দা। প্রথমদিকে এখানে সেখানে কয়েকদিন কেটেছে। পরে গ্রামের লোকজন আমাকে আশ্রয় দেয়। মানুষগুলোর অমায়িক ও আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করে। আটকে রাখে সময়পুরে।
সবচেয়ে অদ্ভুত লেগেছিল যে, তাদের খাবার তৈরিতে কোনো প্রিন্টার ব্যবহার করতে হয় না। মাটি থেকে গাছ বেড়ে উঠলেই তবে ওরা খায়। আর সেটা বেশ মজা করেই। আমিও সেটাই খাচ্ছি নিয়মিত। এ খাবারের স্বাদ আমার তিন হাজার চুয়ান্ন সালের বাংলাদেশের কোনো খাবারে পাইনি।
আমি যে সময় থেকে এসেছি সেখানে গ্রাম নেই। গ্রাম কী জিনিস কেউ জানেই না। আছে শুধু সেক্টরের পর সেক্টর। দশ-পাঁচ-তের নম্বর সেক্টরে আমার ঘর। সেখানে আমার স্ত্রী মারিনি ও একমাত্র মেয়ে ইরিনা আমার অপেক্ষায় আছে। মাঝে মাঝে ওদের কাছে ফিরে যাবার তাগাদা বোধ করলেও আপাতত পোর্টালটা মানে সেই কালো দরজাটা খুঁজে পাচ্ছি না। অবশ্য ফেরার তাগাদা এখনও প্রবলভাবে তৈরি হয়নি।
ইরিনা অনেক বড় হয়েছে। গ্রহ-গ্রহান্তরে গবেষণায় দিন কাটে তার। মারিনিও কাজ করে যাচ্ছে আন্ত-গ্যালাক্টিক কমিটির শান্তিরক্ষা মিশনে। তার দেখাও পাওয়া যায় কদাচিৎ।
সময়পুরে এতদিন অনেক কিছু শিখেছি ও মানুষগুলোকেও বুঝতে পেরেছি। কদিন আগে রসুল মিয়া নামের এক খাদ্য উৎপাদানকারী আমাকে তালের শাঁস নামের একটি রসাল বস্তু খাওয়ালেন। গাছ থেকে একগাদা পেড়ে বললেন যত খুশি খান। খেতে গিয়ে মনে হলো আমার জগতে এমন স্বাদের খাবার কিনতে কমপক্ষে পাঁচ হাজার ইউনিট ব্যয় করতে হবে।
ওই দিন শরিফের মা খাইয়েছেন লাউ-চিংড়ি নামের একটি যৌগিক তরকারি। এখানকার বিনোদনগুলোও অদ্ভুত। ভার্চুয়াল কিছুই নেই। সবই বাস্তব। রতনের সঙ্গে বড়শি ফেলে দুটো পুঁটি মাছ ধরার পর আমার মনে হলো শরীরে কেউ প্রচণ্ড খুশির হরমোন নিও-ডোপামিন পুশ করেছে। রতনের সঙ্গে আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘মাছরে মাছ! এইবার তুই নাচ!’
এখানকার শব্দ, ছন্দ ও আনন্দ প্রকাশের বিচিত্র সব ভাষা ইতিমধ্যে আমার শেখা হয়েছে। ধানগাছের গোড়া শুকিয়ে আসার পর খড়ের গাদাটাকে আমি নাম দিয়েছিলাম হেমন্তের প্রহরী। যদিও লোকজন আমার এসব প্রশংসা শুনে হাসে আর বলে, ‘ভাইজান যে কোন দুনিয়াত থাকেন।’ আমি তাদের বোঝাতে পারি না যে আমি কোন সময়ের দুনিয়া থেকে এসেছি।
সময়পুরেও সময় যায়। তবে কোন গতিতে, সেটা বোঝার জো নেই। তবে আমার হিসাব বলছে, এখানে অনন্তকাল পার হলেও সেটা আমার সময়ে কয়েক মুহূর্তের সমান হতে পারে।
কিশোর রতনের সঙ্গে খাতির হয়েছে বেশ। দূরন্ত ছেলেটার ফকফকা হাসির উৎস আমার জানা নেই। তবে সব কিছুতেই তার আনন্দ। তার সঙ্গে ফড়িং ধরার মিশনে নেমে আমি হয়রান হয়েছি। একটাও ধরতে পারিনি।
‘এ গ্রামের বাইরে কী আছে রতন?’
‘জানি না। কিছু নাই।’
‘বলো কী! গ্রামটা আস্ত মহাকাশ নাকি? স্পেস একদম বেঁকে গেছে?’
‘হইতে পারে। জানি না।’
‘চলতো হাঁটা দেই। দেখি গ্রামের শেষ প্রান্তে কী আছে।’
‘যামু না। আম্মা পিডাইবো।’
‘মারবে না। আমি আছি তো।’
‘চলেন তাইলে। সাঁঝের আগে ফিরতে হইব।’
হাঁটতে হাঁটতে ভেবেছিলাম একটা ধোঁয়াটে দেওয়ালের সামনে এসে পড়ব। তেমনটা হলো না। পরিচিত একটা ধানক্ষেতের আইল দেখে বুঝতে পারলাম আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরে এসেছি। ঠিক যেন মিনি একটা ব্ল্যাকহোল। পুরো স্পেসটাই বেঁকে আছে এখানে। আর সম্ভবত এ কারণেই এখানে সময়টা এমন অদ্ভুত কায়দায় চলে।
‘চলেন। দিয়া ভূতে ধরসে আমাদের। যতবার যাইবেন এইখানেই আবার আসতে হইব। কাশিনাথ মন্দিরে একটা পুরান ঘর আছে। সেখানে ভূত আছে। মানুষ গেলে আর আসে না। এইটা সেই ভূতের কারবার।’
সেদিন মনে প্রাণে ভূতের প্রতি অগাধ বিশ্বাস নিয়ে চলে গেলাম ডেরায়। কুপিবাতি নামের একটি বস্তুতে জ্বলছে ফসিল তেল। তার আলোয় নাচানাচি করছে কত ছায়া। আমি সেই ছায়ার নৃত্য দেখছি আর ভাবছি কত কী। এমন সময় দরজায় কার যেন ছায়া।
‘চাচামিয়া ঘুমান? আমি রতন।’
‘রতন এত রাতে!’
‘মাঝে মইদ্যে রাইতে বাইর হই। ভূত দেখনের লাইগা।’
‘ভূত কোথায় দেখবে!’
‘চলেন, কাশিনাথ মন্দিরে যাই।’
আমি আবারও এক অমোঘ আকর্ষণের ফাঁদে পড়ে গেলাম। কী মনে করে সঙ্গের ব্রিফকেসটাও নিলাম। তাতে আমার পথের দিশারি কোয়ান্টাম বাবল।
জ্বলজ্বলে শেয়ালের চোখ দেখে দুজন পা চালালাম দ্রুত। ঘোষদের পুকুর পাড় ঘেঁষে যাওয়ার সময় একটা পেঁচা ভীষণরকম ঘাড় বাঁকিয়ে আমাদের দেখল। রাজনদের পাঁচমিশালি সবজি ক্ষেত পাড়ি দেওয়ার সময় কুড়িয়ে পেলাম ঝরে পড়া পাকা গাব। ওটার সঙ্গে দুটো পেয়ারাও পেড়ে দিল রতন। খেতে খেতে পেয়ে গেলাম কয়েকটা কাউফল। বেশ মজাই লাগে ফলটা।
প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর রতন আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল সেই মন্দিরে। জংলায় ভরা বড় উঠোন। এরপর একটা মূল দরজা। ভেতরে ঢুকবো? আমি কি ভয় পাচ্ছি? অসংখ্যবার ইন্টার-গ্যালাক্টিক মিশন সম্পন্ন করা বিজ্ঞানী আমি। আর এখন কিনা একটি পোড়ো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ভূতের ভয় পাচ্ছি! মারিনি ও ইরিনা শুনলে নিশ্চিত আমার ব্রেইন রিবুট করতে চাইবে। নাহ। সেটা হতে দেব না। তাতে আবার এখনকার স্মৃতিগুলো সব হারিয়ে যাবে। অন্যরকম এই ভয়ের স্মৃতিটাকে যে আমি বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে প্রতিবাদ জানাল দরজা। ঢুকে পড়লাম ভেতরে। আমার পেছনে রতন। সেও সিঁটিয়ে আছে বেশ। আচমকা বিপ বিপ করে উঠল আমার কোয়ান্টাম বাবল স্পেকট্রোমিটার। এখানে কোথাও অস্বাভাবিকতা খুঁজে পেয়েছে! কোথায়? লণ্ঠন উঁচিয়ে দেখলাম সামনে আরেকটা একটা ভারী দরজা। অনেক দিন খোলা হয়নি যা।
দরজা খুলতেই দেখি যা ভেবেছি তাই। এক কোণে সেই গোলগাল কালো ধোঁয়ামাখা চাদরের মতো দরজা।
‘ভূতের দরজা। ঢুইকেন না স্যার।’
রতনের সতর্কবার্তা আমার কানে এলেও মাথায় ঢুকল না। বুঝে গেছি ব্যাপারটা। এই সেই হারিয়ে যাওয়া পোর্টাল। সময়পুরে আর কখনও আসা হবে আমার? দরজার কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই কানে এলো অস্পষ্ট একটা রেডিওর সম্প্রচারের মতো শব্দ। ইরিনা কাকে যেন বলছে ‘বাবাকে খুঁজে পেতে দরকার হলে আমি ড্রাকুনা গ্যালাক্সিতেও যাব।’
আমি জানি, ওই গ্যালাক্সিতে ভয়ানক সব অপরাধপ্রবণ প্রাণীরা থাকে। মেয়ের এমন কান্না কান্না গলা শুনে আর থাকতে পারলাম না।
রতনের দিকে ফিরে তাকালাম হাসিমুখে। তাকে বোঝালাম, সব ঠিক আছে। এ ভূত ভালো ভূত। ব্রিফকেস থেকে বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম একটা ডায়রি। গত এক বছরে বসে বসে লিখেছি ওটা। আমার পৃথিবীর গল্প। রতন বড় হয়ে পড়বে আর সব বুঝবে এমনটাই আশা আমার। বড় না হলে ক্ষতি নেই। সব বুঝতে হবে এমনও কথা নেই।
পা বাড়ালাম কালো ধোঁয়াটার দিকে। আমি যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, সময়পুরে গোধুলির ঠিক আগে আগে পুকুরের ঘাটে বসা আসরে বকপাখির উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে লোকেরা আলাপ করবে আমার হারিয়ে যাওয়ার গল্প। রতনের কথা কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে। আবার হয়তো রতন কাউকে বলবেই না গভীর রাতের এই রোমাঞ্চকর অভিযানের কথা।