স্বামী-স্ত্রীর রোমান্টিক কষ্টের গল্প : বিচিত্র জীবন

স্বামী-স্ত্রীর রোমান্টিক কষ্টের গল্প : বিচিত্র জীবন

লেখক: রাজু আহাম্মেদ
জুলাই মাসের তের তারিখ। মিনু’র জীবনে বিশেষ দিন আজ। সেজেগুজে অপেক্ষা করছে প্রিয়তম স্বামীর জন্য। রাত ন’টা নাগাদ ঘরে ফিরলো জামাল রহমান। স্ত্রীর সাজসজ্জ্বায় বিন্দুমাত্রও বিস্মিত হলো না সে। ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বের করেই বেরিয়ে যাচ্ছিলো। মিনু পথ আগলে বললো, কই যাচ্ছো? আজ না গেলে হয় না?
স্বাভাবিক বিনয়ের অনুরোধ তবু জামাল রাগের স্বরে বললো, না। হয় না। আর এই রাত্রিবেলা এত সেজেছো কেন?
-কেন, সেজেছি? তুমি জানোনা?
-না। পথ ছাড়ো। অফিসে যেতে হবে, অনেক কাজ আছে।
মিনু সরে দাঁড়ালো। কর্মব্যস্ত মানুষটাকে বলাই হলো না, আজ তাদের বিবাহ-বার্ষিকী। আর বলেই বা লাভ কি! মানুষটা কাজ ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। বিয়ের পরপর’ই একটু একটু করে কতটা বদলে গেছে সে। মিনু সাজ নষ্ট করে দরজা আটকিয়ে শুয়ে পড়লো। শখের রান্না রান্নাঘরেই রয়ে গেলো।
রাত সাড়ে দশ’টায় অফিসে গেল জামাল। জামালকে দেখেই বসা থেকে উঠে সালাম জানালো মিনাজ।
মিনাজের পরনের শার্ট ঘামে ভেজা। ঘামে ভেজা শরীরেই বস জামালের রুমে ঢুকল সে। সারাদিনের কাজ-কর্মের ফিডব্যাক জানিয়ে বলল, স্যার! একটা ঝামেলা ছিলো। অনুমতি দিলে বলতাম।
-হ্যাঁ, বলো।
-স্যার, আমার মা খুব অসুস্থ। হাসপাতালে নেওয়া দরকার। আমার ক’টা দিন…
-ছুটি প্রয়োজন, তাই তো?
-জ্বি, স্যার।
-তুমি না গত সপ্তাহেই ছুটি কাটালে! আবার! তখন মা’য়ের চিকিৎসা করালে না কেন?
-মা তখন সুস্থ ছিলেন। হঠাৎ করেই অবস্থা খারাপ।
-তোমার বাসা কোথায় জানি?
-পঞ্চগড়।
-বহুদূর! ভাড়াও তো যায় অনেক।
-জ্বি, স্যার।
-তুমি এক কাজ করো, ছুটি না গিয়ে বরং টাকাটা বাসায় পাঠিয়ে দাও। চিকিৎসা করুক।
-স্যার, মা’কে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, দেখাশুনা করবে এরকম কেউ নেই বাড়িতে। আমার স্ত্রী গর্ভবতী। সে সব জায়গায় যেতে পারে না।
বস এবার কিছুটা রেগে গিয়ে বলল, ক’দিন আগেই ৫ দিন ছুটি কাটিয়েছো, সপ্তাহ না ঘুরতেই আবার ছুটি! ব্যবসায় লালবাতি জ্বালায় দিবা নাকি তুমি? গতমাসেও তুমি ঠিকঠাক প্রফিট দিতে পারোনি। যেতে হয় তো একবারে চলে যাও, কাজের জন্য লোকের অভাব হবে না।
মিনাজ চাপা হাসি হেসে সালাম দিয়ে বেরিয়ে আসলো। মা’য়ের অসুখ অথচ বাড়ি যাবে, সে সুযোগ নেই। চাকুরিটারও খুব দরকার। এই আকালের সময় চাকুরি গেলে আরেকটা চাকুরি পাওয়া কষ্টের।
মিনাজের স্ত্রী অসুস্থ শরীরেই মা’কে নিয়ে হাসপাতালে যান। মা’য়ের একবারে অনেক গুলো অসুখ চেপে ধরেছে। জন্ডিস, কিডনিতে পাথর, টিউমার। অসুস্থতা এড়িয়ে চলে, “আমার কিচ্ছু হয়নি” এইভেবে নিত্যনতুন খেঁটে খাওয়া স্বভাব গ্রামের মানুষের। মিনাজের মা পারুল বেগমও তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু এবারে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি, শরীরের নাজেহাল অবস্থা।
হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। অনেক গুলো টেস্ট করানো হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই হাজার ত্রিশেক টাকা চলে গেছে। দ্রুত অপারেশন করানো উচিত।
মিনাজ মোবাইলে খোঁজ নেই রোজ। ফোনে কথা বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসে মা’য়ই বরং তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, “পাগল ছেলে! কিচ্ছু হবে না আমার। তোর বৌ যেভাবে আমার সেবাযত্ন করে, আমার কিচ্ছুটি হবে না। তুই কবে আসবি বাপ? তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।”
মিনাজ কিছু বলে না। চোখ দিয়ে পানি ঝরে। ইচ্ছে করে, এখনি মা’য়ের কাছে ছুটে চলে যেতে। কিন্তু এখন গেলে এ মাসের বেতন পাবে না। টাকারও দরকার। মনে মনে ভেবে রেখেছে মিনাজ, ছুটি দিক বা না দিক, বেতন পেলেই চলে যাবে সে।
কিছুদিন বাদে হঠাৎ খবর এলো, পারুল বেগমের টিউমার ফেটে গেছে। অবস্থা খুবই ভয়াবহ। মিনাজ চাকুরির পরোয়া না করে ছুটলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। চোখ দিয়ে গলগল করে পানি ঝরছে। না জানি শেষ দেখাটা হবে কি-না!
জামালের ব্যস্ততা দেখতে দেখতে নিজেকে অনেকটা মানিয়ে নিয়েছে মিনু। কোথায় যাচ্ছে, কখন যাচ্ছে-আসছে, খাচ্ছে কিনা! কোনো কিছুতেই মিনুর কিছু আসে যায় না। চঞ্চল মেয়েটা কেমন নিরব হয়ে গেছে। বেলকুনিতে বসে দারোয়ান লুদির মিয়া আর তার বৌ’য়ের খুনসুঁটি যখন দেখে সে, বুকটা তার খাঁখাঁ করে ওঠে। মিথ্যে হাসি হেসে মনে মনে বলে, “টাকা! টাকা! হায়রে টাকা! কেড়ে নিলে সব।”
স্বল্প টাকা বেতনের চাকুরি তবু কত খুশি তারা। এই অল্প বেতনেই তারা মাঝেমাঝে ঘুরতে যায়, বউকে সাইকেলের রডে বসিয়ে সারা শহর ঘুরে-বেড়ায় দারোয়ান ব্যাটা। মিনুরও ইচ্ছে হয়, কিন্তু তার জামাই-এর তো সাইকেল নেই। মাইক্রো গাড়ি, অনেক বড় জায়গাজুড়ে বসার জায়গা। হয়তো সেজন্য ওদের মতো তাদের ঘনিষ্ঠতা নেই। দূরত্বতেই বসবাস।
জুলাই মাসের ৩০ তারিখ। রাত বার’টা নাগাদ হঠাৎ আকাশ ডাকতে শুরু করলে বিদ্যুৎ চলে গেল। জামাল তখনো বাড়ি ফিরেনি। মাসের শেষ। লাভ-লসের হিসেব তখনো মিলেনি তার। আকাশে বিজলী চমক দিচ্ছে, সেই চমকে কেঁপে উঠছে মিনু। দেয়ালে টানানো ছবি গুলো যেন হেসে উঠছে তাকে দেখে! ভয়ভয় লাগছিলো। লুদির মিয়ার বৌ’রে ডাকতে চেয়েও ডাকলো না। নিজের অসুখে অন্যের সুখে কাঠি করার মতো মনে হলো ব্যপার’টা। দারোয়ান ব্যাটা আর তার বৌ নিশ্চয় ঘুমাচ্ছে কিংবা একজন আরেকজনের বুকের উপর শুয়ে গল্প করছে, এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে। মিনুর তো গল্প করার কেউ নেই! তাই বলে সে আরেকজনের গল্প ভেঙ্গে দিতে পারে না।
কোলবালিশ চেপে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলো মিনু। হঠাৎ মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠল তার। ব্যাথা ক্রমশ বাড়তে শুরু করলো। দারোয়ান ব্যাটার বৌ’রে ডাকবে, সে শক্তি গলায় নেই। জামাল কে ফোন দিয়ে বললো, “জামাল! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি কই? প্লিজ আসো। আমি মরে যাচ্ছি।”
জামাল বিরক্তির স্বরে বলল, তো আমি কি করবো? মাঝরাতে পাগলামি শুরু করেছো? ফোন রাখ্। আমার কাজ শেষ হলেই আমি ঘরে ফিরবো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন কেটে দিলো মিনু।
রাত তিনটে নাগাদ বাড়ি ফিরলো জামাল। কয়েকবার কলিংবেল বাজানোর পরে চোখ ডলতে ডলতে লুদির মিয়া গেট খুলে দিলো।
দোতালায় দরজা ভিতর থেকে লক করা। তার কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুললো সে। বিদ্যুৎ তখনো আসেনি। ফ্রেশ হয়ে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট জ্বালালো। তারপর এসে ঘুমিয়ে পড়লো। মিনুর গা’য়ে একবার হাত দিয়ে দেখলোও না, মেয়েটা ঘুমিয়েছে কিনা!
সকালে ঘুম ভাঙার পরে টেবিলে একটা কাগজ চোখে পড়লো তার, কাগজে লেখা, ” আমার মরণের দিনও তোমার কাজের শেষ হলো না। তোমার কাজই হোক তোমার সংসার। এগিয়ে নিয়ে যাক তোমাকে বহুদূর।
জানো, জামাল! খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তোমার কোলে মাথা রেখে শেষবারের মতো তোমাকে দেখতে। তুমি আমার কপালে চুমু এঁকে দিতে! আমি শান্তিতে চোখ বুঝতাম। সে আর হলো কই! পোড়াকপালি আমি, ভালো থেকো তুমি।
ইতি, তোমার মিনু।”
জামালের বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। দৌড়ে গিয়ে মিনুর শরীর নাড়াল। নিথর শরীর কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। মিনুকে টেনে নিয়ে জামাল চিৎকার করে কান্না শুরু করলো, মিনু! মিনু! এটা কি হল! তুমি আমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারো না। মিনু! মিনু!
জামালের কান্নার শব্দে লুদির মিয়া আর তার বৌ ছুটে আসলো।
-লুদির? মিনু! আমার মিনু!
-কি হইছে, ভাইজান? হাসপাতালে নিতে হইবো?
-আমার মিনু! আমাকে একা করে চলে গেছে সারাজীবনের জন্য।
লুদির মিয়া জামালের কাঁধে হাত দিয়ে বললো, ভাইজান! নিজেকে শক্ত করেন। ধৈর্য ধরেন। মানুষ সারাজীবন বাঁচে না। সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে।
কয়েকদিন বাড়িতেই রইল জামাল। ফোন বন্ধ। অফিসে চলছে অফিসের মতো। আত্ম-অপরাধবোধে ধুঁকে ধুঁকে মরছে সে। কাজ নিয়ে এত পাগল না হয়ে, এই সময়টাই যদি মিনুকে দিতো সে, তাহলে হয়তো এভাবে তাকে হারাতে হতো না। হঠাৎ তার মিনাজের কথা মনে পড়লো। ফোন ওন করে তাকে ফোন দিলো সে। মিনাজের অসুস্থ মা’য়ের খোঁজ নিয়ে বললো, মিনাজ! তুমি চিন্তা করো না। তোমার চাকুরি যাবে না। মা’য়ের পাশে থাকো। উনি সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ছুটি কাটাও, কোনো সমস্যা নেই।
-অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।
-আর টাকা পয়সা লাগলে, জানিয়ো। সঙ্কোচ করার কোনো দরকার নেই।
-ধন্যবাদ স্যার। তবে আপাতত টাকা লাগবে না। বসত-ভিটা বিক্রি করে দিয়েছি। মা’র অপারেশন হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, উনি এখন ভালো আছেন।
-আচ্ছা। ভালো থাকো।
-আচ্ছা, স্যার।
জামাল ফোন কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ভাবছে, তার অঢেল টাকা থেকেও মিনুকে বাচাঁনোর জন্য কিচ্ছু করতে পারলো না। অথচ কেউ কেউ নিজের সমস্ত শেষ করে ফেলছে, তার পরিবারের জন্য। আজ তার উপলব্ধি হচ্ছে, পরিবারের মানুষকে ভালো রাখার জন্য টাকার চেয়ে বেশি দরকার সময়, একটুখানি গুরুত্ব-যত্ন আর একটুখানি ভালোবাসা।
গল্পঃ কর্মব্যস্ততায় বিচিত্র জীবন
লেখকঃ রাজু আহাম্মেদ
storiesগল্পরোমান্টিক গল্পস্বামী-স্ত্রী