হরর গল্প : নিস্তার

লেখক: ধ্রুব নীল ।। ধরন : হরর গল্প । বাংলা আধিভৌতিক হরর গল্পটি চাইলে অডিও বই আকারে শুনতে পারবেন নিচের ভিডিওতে ক্লিক করে।

অডিও গল্প: হরর : নিস্তার

ঝড়ের ঝাপটায় তোশক চুপসে গেছে। রাজ্জাক জানালা বন্ধ করছে না। তার মনেও ঝড়। বাইরের ঝড়ের সঙ্গে মনের ঝড়ের কাটাকুটি খেলা হচ্ছে।
দুই বছর নীলিমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে রাজ্জাক। এখনো চিঠিটা দেওয়া হয়নি। দিলেই তুলকালাম বেঁধে যাবে। কলেজের বণিক স্যারের মেয়ের সঙ্গে প্রেম বাড়িতে মেনে নেবে না। রাজ্জাকের বাবা রাধানগর মসজিদ কমিটিতে আছেন। ঘটনা ঘটলে ইজ্জতের বেড়াছেড়া লেগে যাবে।

[হরর গল্প : নিস্তার]


নীলিমা বললে রাজ্জাক এক শার্টে ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে। সমস্যা হলো নীলিমা সেটা বলবে না। সে রাজ্জাককে বিশেষ পাত্তা দেয় না। রাজ্জাক প্রতিদিনই হ্যাংলার মতো গার্লস কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে কাল থেকে দাঁড়াদাড়ি বন্ধ। কাল নীলিমার বিয়ে।
বাইরে যে ঝড় হচ্ছে তাতে বিয়ের গেট লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার কথা। এমনটা ভেবেও রাজ্জাকের খুশি লাগছে না। একটু পর পর সিগারেট হাতে জানালার কাছে খাটে পা দুলিয়ে বসছে। ভারী বৃষ্টির সঙ্গে শিলও পড়ছে। সেই শিলে টুপটাপ খসে পড়ছে বাবার সবজি বাগানের টমেটোগুলো। বাগানের পাশে কাঁচা রাস্তা। রাস্তার ওপারে ঝোপের বেড়া। বেড়ার ওপাশে ভাঁটফুল আর রিফিউজি লতার জঙ্গল। দুয়েকটা কড়ই আর আম-জাম গাছ আছে। সেগুলো ফাঁক গলে দেখা যায় ধানক্ষেত। সেদিকেই তাকিয়ে আছে রাজ্জাক। বজ্রপাতের অপেক্ষায় আছে। সরাসরি এখনো বজ্রপাত দেখেনি সে।
বিদ্যুৎ চমকাতেই মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল রাজ্জাক। বজ্রপাতের শব্দ আসবে এই জন্য নয়। বিদ্যুৎ চমকাতেই একটা কিছু দেখেছে। অস্বাভাবিক কিছু। রাস্তার লাগোয়া আমগাছটার ঠিক গোড়ায় একজন বসে আছে। হাতের সিগারেট আঁকড়ে দ্বিতীয় বিদ্যুৎ চমকের অপেক্ষায় আছে রাজ্জাক।
‘নীলিমা!’
কেউ যখন উল্টোপাল্টা দেখে, তখন সে বুঝতে পারে না যে সে ভুল দেখছে। তার কাছে তখন জগতের সত্য-মিথ্যা এক হয়ে যায়। রাজ্জাকের মন বলছে, চোখের ভুল। কারণ সকাল থেকেই তার মনে নীলিমারা চিন্তা। কাল তার বিয়ে, সে এই তুমুল ঝড়ে মধ্যরাতে গাছতলায় আসবে কেন!

[ হরর গল্প : নিস্তার ]


বিদ্যুৎ আরেকবার চমকাতেই দেখলো গোলাপি শাড়ি পরা মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে আছে। শীতে মেয়েটাকে কাঁপতেও দেখল। পলকহীন রাজ্জাক আবছা বুঝতে পারছে, কাঁপতে কাঁপতে নীলিমা গাছের ডাল লক্ষ্য করে কিছু ছুড়ছে।
একটা দড়ি। আবার বিদ্যুৎ চমকালো। একটা টুলও দেখল পাশে।
সত্যিই নীলিমা? রাত একটা বাজে কালবৈশাখী ঝড়ে কোনো তরুণী গাছের ডালে দড়ি ছুড়বে কেন?
ডাক দেবে? নীলিমা না হয়ে যদি অন্য কিছু হয়! আবার ভাবল, এই ঝড়ের শব্দে নীলিমার কানে পৌঁছাবে তার ডাক?
ভয়ানক শব্দে কাছেপিঠে কোথায় বজ্রপাত হলো। রাজ্জাকের শীত শীত লাগছে। বরফগলা পানির ছিটায় ভিজে গেছে। জানালা বন্ধ করে দেবে? মোটেই না। দৃশ্যটা সে দেখবে। তার মস্তিষ্ক এরইমধ্যে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে ব্যাপারটা। অপছন্দের বিয়ের হাত থেকে বাঁচতে নীলিমা ফাঁস নিচ্ছে এবং রাজ্জাকের সেটা দেখা উচিত। কারণ নীলিমা তার ভালোবাসার দাম দেয়নি।
রাজ্জাকের মনের ঘাপটি মেরে থাকা একটা অংশ চাচ্ছে নীলিমা মরে যাক। রাজ্জাককে তখন আর কল্পনা করতে হবে না যে তার তুমুল পছন্দের মেয়েটা অন্য কারও সঙ্গে বাসর রাত কাটাচ্ছে। আবার দ্বিতীয় কারণও আছে। কাউকে চোখের সামনে মরতেও দেখেনি সে।

অনেকক্ষণ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে না। রাজ্জাক নিষ্পলক। এবার বিদ্যুৎ চমকাতেই কুঁকড়ে গেল। গলায় আচমকা টান লাগল যেন। পরক্ষণেই দম নিল জোরে। দড়িতে বেকায়দায় ঝুলছে নীলিমা। রাজ্জাকের চোখে চোখ পড়েছে তার। রাজ্জাককে দেখে ফেলেছে! প্রচণ্ড বিস্ময় মেয়েটার চোখে।
রাজ্জাকের মনে হলো খুন করতে গিয়ে ভিকটিমের হাতে ধরা পড়ে গেছে। এক দৌড়ে নীলিমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে? ওই তো মেয়েটা। এক হাত শূন্যে বাড়ানোর সে কি চেষ্টা! বড় বড় চোখে রাজ্জাকের কাছে আকুলি বিকুলি করে চাইছে এক চিলতে অক্সিজেন। আত্মহত্যার যাবতীয় পরিকল্পনা যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে ছন্নছাড়া এক যুবকের দরবারে।
দম কি পুরোপুরি আটকে গেছে নীলিমার? ফাঁস নিলে কতক্ষণ লাগে মরতে? রাজ্জাক ছুটছে। বাগানে পড়ে থাকা টমেটো মাড়িয়ে ছুটতে গিয়ে আছাড় খেলো। নাকে লাগল কাদামাটির ঝাঁঝাল সোঁদা গন্ধ। নীলিমাকে বাঁচাতেই হবে। ফের বিদ্যুৎ চমকাতেই সম্বিৎ ফিরল রাজ্জাকের। নিজেকে আবিষ্কার করলো জানালার পাশে। এতক্ষণ একচুলও নড়েনি সে।
ঝাড়া কয়েক সেকেন্ড নিকষ কালো। পরবর্তী বিদ্যুৎ চমকে স্পষ্ট দেখলো নীলিমার দুহাত ঝুলে পড়েছে দুপাশে। কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসা চোখ জোড়া তাকিয়ে আছে রাজ্জাকের দিকেই। এবার আর আকুতি নেই চোখে। আছে রাজ্যের ক্ষোভ। রাজ্জাকের ইচ্ছা করলো ছুটে গিয়ে নীলিমার মাথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়। মরে যাওয়ার পর কেন সে এভাবে তাকাবে! রাজ্জাক তো তাকে মারেনি।
বড় করে দম নিল রাজ্জাক। বুঝতে পারল ক্ষণে ক্ষণে সে নিজেও দম আটকে রেখেছিল। তারপর আলগোছে জানালাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল ভেজা চাদরেই।

‘তুই আমাকে বাঁচালি না কেন রাজ্জাক?’
‘আমার ইচ্ছা।’
‘এত করেব ডাকলাম। ফাঁসটা খুলে দিলি না। তুই না আমাকে ভালোবাসিস?’
‘তুমি তো বিয়েশাদি নিয়ে ব্যস্ত। আমার প্রেমের খবর রাখার টাইম ছিল?’
‘আমি তো বুঝতাম। কলেজের সামনে তো এমনি এমনি দাঁড়িয়ে থাকতি না।’
‘বুঝলে আরেকজনকে বিয়ে করতে গেছো কেন? ভালো কথা, তুমি তো মরেই গেছো। কথা বলছ কী করে?’
‘মরে গেলে কথা বলা যায় না? বেঁচে থাকলে বলা যায় কী করে? বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া সমান কথা। তুই যেমন বেঁচে আছিস, আমি তেমন মরে আছি। সমান সমান। হিহিহি।’
‘হাসবি না! মরা মানুষ হাসে না! মরা মানুষ হাসে না!
‘তুইও মরবি। তোর গলায় ফাঁস পড়বে! বুঝলি! এই দেখ দড়ি।’
‘কীসের ফাঁস! কে ফাঁস নিব! আমি না! আম্মা! ও আম্মা! আমার দম আটকা লাগে কেন! ফাঁস আটকা পড়সে। ও আম্মা!’

ধড়ফড় করে ওঠেনি রাজ্জাক। স্বাভাবিকভাবেই চোখ মেলল। গত দশ বছর ধরে একই দুঃস্বপ্ন দেখে চলেছে সে। ধড়ফড়ানিটা তাই বন্ধ আছে।
স্বপ্নটা প্রতিরাতেই দেখে। মাঝে তিন দিন স্বপ্নের হাত থেকে বাঁচতে না ঘুমিয়ে ছিল। কাজ হয়নি। চতুর্থ দিন আরও দীর্ঘায়িত হলো স্বপ্ন। শেষের পাঁচ মিনিট নীলিমা দড়ি হাতে ধাওয়া করেছে তাকে। রাজ্জাক দৌড়াতে গিয়ে একপর্যায়ে দেখলো তার পা মাটিতেই পড়ছে না। ধরেই ফেলছে নীলিমা!

[ হরর গল্প : নিস্তার ]


জানালা দিয়ে বিমানের ডানার দিকে তাকিয়ে শ্বাসটা কিছুক্ষণ আটকে রাখল রাজ্জাক। তারপর মুখ গোল করে ছাড়ল। কোথায় যেন শিখেছে এভাবে দমের ব্যায়াম করতে হয়। করলে কী হয়? ফাঁসিতে ঝুললে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকা যায়? সে কেন ঝুলতে যাবে! তার দমের ব্যায়ামের দরকারটা কী! রাজ্জাক ফের চার সেকেন্ড দম আটকে আট সেকেন্ডে ছাড়ে। দম ছাড়তে ছাড়তেই ল্যান্ড করে বিমানবন্দরে।
নীলিমা মারা যাওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে ইতালি চলে যায় রাজ্জাক। দশ বছরে স্মৃতিতে ধুলো জমে যাওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিদিন একই দুঃস্বপ্ন দেখে বলে সেই রাতের স্মৃতি এখনও ঝকঝকে তকতকে।
বিদেশে ডাক্তার দেখিয়েছে। ওষুধপত্র খেয়েছে। ঘুমের ওষুধের কড়া ডোজেও কাজ হয়নি। নীলিমা পিছু ছাড়েনি একটা রাতও। স্বপ্ন যেভাবেই শুরু হোক না কেন, শেষ হয় রাজ্জাকের গলায় ফাঁস পরানোর মধ্য দিয়ে।

গত দশ বছর রাজ্জাক একবারও বাড়ি আসেনি। এবার মনে হলো, ডা. আন্তোনিও ঠিক কথাই বলেছেন, গ্রামে ফেরা ছাড়া দুঃস্বপ্নের হাত থেকে নিস্তার নেই তার। দুঃস্বপ্ন থেকে বাঁচতে রাজ্জাককে ফিরে যেতে হবে গ্রামে। মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে সেই মুহূর্তের। ক্ষমা চাইতে হবে। কার কাছে চাইবে?
গ্রামের চালচিত্র বিশেষ বদলায়নি। খড়ের গাদাগুলো আগের জায়গাতেই আছে। প্রাইভেটকারের কাচ নামিয়ে শুকনো ঘটির গন্ধ নিল নাক টেনে।
ভাঁটফুল আর লতাপাতার বেষ্টনী দেওয়া রাস্তাটা দেখে নিরবে শ^াস ছাড়ে রাজ্জাক। মনে পড়ে নীলিমার লাশ নামানোর পর দিনও আকাশে মেঘ ছিল। সেই রাতে ঝড় ছিল। একের পর এক বজ্রাঘাত। সেদিনও রাজ্জাক বাড়ি ছেড়ে বের হয়নি। মনে হচ্ছিল বজ্রাঘাতের রূপ ধরে নীলিমা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ফাঁস দেওয়া আমগাছটা বজ্রাঘাতে মরে গেছে। দাঁড়িয়ে আছে গাছের কঙ্কাল। পোড়া আমগাছে তাকালেই গ্রামবাসীর মনে পড়ে ঝুলন্ত সেই বিভীষিকা। তারা এসব স্মৃতি জিইয়ে রাখতে বড় ভালোবাসে। রাজ্জাকের দুঃস্বপ্ন নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। রাজ্জাক ভাবল, গাছটা টিকে থাকার একটা কারণ অবশ্যই আছে।
বাড়িতে এসেছে দুদিন হলো। গতরাতেও একই স্বপ্ন। নীলিমা একটা সাদা শাড়ি আর লাল টিপ পরে এসেছে। বাড়িতে এসেই হইচই। ‘রাজ্জাককে বিয়ে করবো! রাজ্জাককে বিয়ে করবো।’
রাজ্জাক তার বাবার ভয়ে অস্থির। মা একটা লাল শাড়ি পরে বিয়ের বন্দোবস্ত করতে ব্যস্ত। কোন এক চাচাতো ভাইকে দেখল টাকা গুনতে গুনতে বলছে, ‘কয় গজ কাফন লাগবে যেন? চার গজেই হয়ে যাবে চাচি। আগরবাতি লাগবে গোটাদশেক।’
স্বপ্নে ঘটনা অতিদ্রুত ঘটে। বিয়ে পড়ানো শেষ। এবার ভিড় থেকে কেউ একজন বলল, ‘মা দড়িটা পরাও এবার।’
রাজ্জাক দেখল সাদা শাড়ি পরে বউ সেজে থাকা নীলিমার হাতে মালা নেই, ফাঁস নেওয়ার দড়ি! সে হাসিমুখে রাজ্জাকের দিকে এগিয়ে আসছে গলায় দড়ি পরাতে।
‘নাও রাজ্জাক, মালা পরো। ফাঁসের মালা। কাছে আসো, পরিয়ে দিচ্ছি। এরপর আরাম করে ফাঁস নেবে। আসো। আসো! আসো!’

বাজারে আড্ডা দিতে গিয়ে রাত হয়েছে অনেক। সময় দেখতে ইচ্ছে হলো না। মনে আকুলি-বিকুলি বিষণ্নতা। গত রাতের স্বপ্নটায় দড়ির আগ পর্যন্ত তার মন ভালো ছিল। ভীষণরকম ভালো। মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যি নীলিমার সঙ্গে তার বিয়ে। শেষ দৃশ্যটার আগেই ঘুম ভেঙে গেলে ভালো হতো।
আষাঢ়ের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ছাতা না এনে বিরাট ভুল হয়েছে। বাড়ির দিকে হেঁটেই রওনা দিল রাজ্জাক। হাতে চটের ব্যাগটা ভারী ঠেকছে।
ফেরার পথে নীলিমাদের বাড়ি দেখা যায়। অনুষ্ঠান হচ্ছে। সম্ভবত তার ছোট বোনটার গায়ে হলুদ। সবাই হিন্দি গান বাজিয়ে হই চই করে বড় বোনের স্মৃতি ভুলতে ব্যস্ত। তবে কারও না কারও কথায় গল্পটা উঠে আসবেই, যে গল্পে রাজ্জাকের অস্তিÍব নেই। তবু নীলিমার জীবনের একটা অন্ধকার চরিত্র হয়ে ঘাপটি মেরে আছে সে।
আমগাছের গোড়ায় দাঁড়াল। গাছটার দিকে তাকালে মনে হয় সে কিছু চায়। না দিলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রাজ্জাকের ঘটনা ফাঁস করে দেবে ওটা।
‘দুর ছাতার মাথা! যে নিজে মরতে চায়, তাকে কেউ বাঁচাতে পারে?’
নিয়ম করে অ্যান্টিবায়োটিকের মতো প্রতিদিন এ কথা আওড়েছে রাজ্জাক। তবু ভেতরে কে যেন কথাটা মানতে চায়নি একবারও।
আমগাছের নিচে কে যেন বসে আছে। সিগারেট ধরাতে গিয়েও রেখে দিল রাজ্জাক। বাড়িতে বৃদ্ধা মা আর বড় বোন এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাজ্জাকের ওপর পরিবারের অনেক দায়িত্ব। তবু রাজ্জাকের আজ নিজেকে পালকের মতো হালকা মনে হয়।
আমগাছের নিচে ঝোপঝাড়ের কারণে তরুণীর চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। এমন সাপখোপের মধ্যে কেউ বসে থাকে?
গাছটার কাছে দাঁড়াতেই রাজ্জাকের মনের ঝুল পড়া দরজাটা খুলে গেল। কলেজে পড়ার সময়কার দরজা। ওই দরজা সামান্য ফাঁক করতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল একঝাঁক স্মৃতি। সবার আগে দেবীর মতো হাসিমুখে স্বাগত জানাল নীলিমা। রাজ্জাকের কল্পনাটা সুবিধার হয় না। রূপবতী নীলিমাকে মনে হলো রূপের মুখোশ পরে আছে। মুখোশ খুললেই বেরিয়ে আসবে ফাঁস নেওয়া থ্যাবড়ানো চেহারাটা।
‘রাজ্জাক। ও রাজ্জাক।’
‘কে! কে!’
‘কখন থেকে বসে আছি। তোমার এত দেরি হলো।’
‘নীলিমা তুমি! তুমি না…!’
‘আমি কী? মরে গেছি? মরে গেলেই সব শেষ? তোমাকে কত করে ডাকলাম। এই তোমার আসার সময় হলো। এতক্ষণ ঝুলে থাকলে মানুষ বাঁচে বলো?’
‘আমাকে মাফ করো নীলিমা। আমাকে মাফ করো।’
‘তুমি আমাকে কেন বাঁচাওনি আমি জানি।’
‘কী জানো!’
‘ফাঁস নেওয়ার দৃশ্য দেখার খুব শখ ছিল তোমার তাই না? ছোটবেলায় আমারও এমন আজব শখ ছিল। সাপে কাটলে কেমন লাগে সেটা বোঝার জন্য ঢোড়া সাপ খুঁজলাম সারাটা দিন। শেষে পুকুরের কিনারে মোটা গাছের শেকড়ের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিতে শুরু করলাম। দুটো সাপ আমাকে দেখে উল্টো পালিয়ে গেল। কেউ কামড়ই দিল না।’
তীক্ষ্ম একটা কাঁটা বিঁধল রাজ্জাকের মগজে। সাপের বিষয়টা তার ছোটবেলার। শেষে একবার সাপুড়ের ব্যাগের ভেতরও হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল সে। এটা নীলিমার জানার কথা না।
‘এসব কেন শোনাচ্ছো নীলিমা?’
‘হিহি। কারেন্টের শক কেমন লাগে সেটা মনে আছে? ওই যে একবার সকেটের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে দিলে?’
‘তুমি জানো! তুমি সব জানো!’
‘কারণ আমি জানি তুমি কী চাও রাজ্জাক। তুমি চাও ফাঁস নিতে কেমন লাগে সেটা অনুভব করা। মনের ইচ্ছেটাকে তুমি অনেকদিন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছো রাজ্জাক। এ কারণেই প্রতিদিন স্বপ্নটা দেখো। ডা. আন্তোনিও তোমাকে এটাই বলেছিল তাই না?’
‘তুমি কী করে জানো এত কিছু?’
জবাব দিল না নীলিমা। স্বপ্নে দেখা সেই সাদা শাড়িটাই পরে আছে। কপালে টিপ নেই।
রাজ্জাক দেখলো বাড়ির উঠোনে সেই কবেকার টমেটো ক্ষেত। দশ বছর আগের গাছগুলো আবার মাটি ফুঁড়ে গজিয়েছে। টকটকে লাল টমেটোয় ভর্তি প্রতিটি গাছ। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিটাও কোন ফাঁকে মুষলধারে হয়ে গেছে। দূরে বজ্রপাত হচ্ছে ঢিমে তালে। বাড়িতে বাবার তাফসিরের আসর ভাঙার মৃদু কোলাহল। ধর্মপ্রাণ বুড়োগুলো যার যার বাড়ি যাবে একটু পর। অতীতের ফাঁদে আটকে পড়া রাজ্জাককে বাঁচাতে কেউ আসবে না সহসা।
‘আসো রাজ্জাক। সব ব্যবস্থা করা আছে। ফাঁস নিতে কেমন লাগে আজ টের পাবে।’
‘না! না! আমি বুঝতে চাই না! নীলিমা তুমি চলে যাও।’
নীলিমার ভুবন ভোলানো হাসি। শাড়িটা বদলে নীল পাড় হয়ে গেল। অপ্সরীর মতো দেখালেও রাজ্জাকের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। ওই অসম্ভব মায়াময় মুখখানায় কোনো চোখ নেই। চোখ ছাড়াই নীলিমা এমন করে তাকাল রাজ্জাকের দিকে, যেন সব দেখছে। রাজ্জাকের মনের গলিতে গলিতে থাকা যাবতীয় শখ-ইচ্ছা সব জেনে যাচ্ছে নীলিমা। সে হয়ে উঠেছে ইচ্ছেপূরণ দেবী।
‘ফাঁস নেওয়ার সময় চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আমার লাশটা মর্গে নেওয়ার আগেই টুপ করে পড়ে গিয়েছিল ও দুটো।’
‘কী চাস! কী চাস তুই!’
‘আসো তোমার গলায় দড়ি পরাই। ভয়ের কিচ্ছু নেই। ঘড়ি ধরা কয়েকটা মুহূর্ত। এরপর সব শেষ। ফাঁস না নিলে কী করে বুঝবে যন্ত্রণাটা কেমন?’
নীলিমা ভুল বলেনি। রাজ্জাক তার নিজের দম আটকে রেখে বহুবার বোঝার চেষ্টা করেছে শ^াস না নেওয়ার চূড়ান্ত মুহূর্তের অনুভূতি কেমন। শরীরের কোষে কোষে জন্ম নেওয়া অনির্বচনীয় সেই বিদ্রোহের মুখে প্রতিবার পরাজিত হয়েছে সে। ইচ্ছাশক্তিকে ছাপিয়ে শরীরটা হয়ে ওঠে আরেক অস্তিত্ব। যে শুধু বাঁচতে শিখেছে। আজ নীলিমা তার মনটাকেই জেতাতে চায়। এত দিনে রাজ্জাকের জানা হয়ে গেছে, অমোঘ এ কৌতুহল না মেটানো পর্যন্ত বারবার সেই দুঃস্বপ্নটা হাজির করবেই নীলিমার ছায়াপ্রেত। নীলিমার হাতে কী সুন্দর ধবধবে সাদা সড়ি। পোড়া আমগাছের ডালে সুন্দর করে বাঁধা হয়েছে ইতালিয়ান দড়িটা।
রাজ্জাক কাঁদছে। ভয়ানক বীভৎস এ কৌতুহলের হাত থেকে বাঁচার আর পথ রইল না। আর দেখতে হবে না সেই দুঃস্বপ্ন।
মেঘের আকাশে নক্ষত্র নেই। কেউ দেখছে না রাজ্জাকের অন্তিম মুহূর্তটা। পরম মমতায় তার গলায় পরানো হলো মসৃণ দড়িটা। ঝুলে পড়তেই রাজ্জাকের দেহ ঘুরে গেল তার ঘরের দিকে। চোখ গেল সেই কপাট খোলা জানালায়। বিস্ফারিত চোখে দেখলো জানালার ওপাশে অবাক চোখে তাকিয়ে তার ফাঁস নেওয়া দেখছে সে নিজেই।

হরর গল্প: ডার্ক ম্যাটার

গল্পধ্রুব নীলহরর