যে ভাবে ফুটতে ফুটতে কেটলির সব জল উবে যায়, পড়ে থাকে শুধুই তেতে থাকা শূন্য কেটলি, ঠিক সেই ভাবেই উবে যাচ্ছে আমাদের নেপচুনের মতো চেহারার ওই ভারী গ্রহের বায়ুমণ্ডলের সবটুকু। হয়ে পড়ছে সর্বস্বান্ত! ‘সর্বহারা’ই!
নাসার হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপের নজরে ওই ভিনগ্রহটি ধরা পড়ে বছরছ’য়েক আগে। কিন্তু তখনও জানা যায়নি, তা উবে যাচ্ছে। আর সেটা হচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত হারে।
উবে যাচ্ছে ‘গ্লিয়েসি-৩৪৭০-বি’। তার বায়ুমণ্ডল ছড়িয়ে পড়ছে মহাকাশে
গত ৬ বছর ধরে গ্রহটির উপর নজর রেখে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গায়েগতরে তার হালকা, পলকা হয়ে পড়ার খবর পেয়েছেন। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’-এর ১৩ ডিসেম্বর সংখ্যায়।
৫৭টা পৃথিবী ঢুকে যাবে গ্লিয়েসি-৩৪৭০-বি’র পেটে!
পৃথিবীর চেয়ে প্রায় সাড়ে ৪ গুণ বড় আর ১৪ গুণ ভারী সেই গ্রহটি জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে তার জন্মদাতা নক্ষত্রের ভয়ঙ্কর ‘রোষে’! সুবিশাল ওই গ্রহের খুব পুরু বায়ুমণ্ডলকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাচ্ছে একটি নক্ষত্র। যার নাম- ‘গ্লিয়েসি-৩৪৭০’। গ্রহটির গা পুড়িয়ে দিচ্ছে ১ হাজার ৭০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটেরও বেশি তাপমাত্রায়।
কোন মুলুকে আছে সেই ‘সর্বস্বান্ত’ গ্রহ?
আমাদের চেয়ে ৯৭ আলোকবর্ষ (আলোর গতিতে ছুটলে এক বছরে যতটা দূরে যাওয়া যায়) দূরে ‘ক্যানসার’ নক্ষত্রপুঞ্জে থাকা সেই ভিনগ্রহটির নাম ‘গ্লিয়েসি-৩৪৭০-বি’ বা, ‘জিজে-৩৪৭০-বি’। যা চেহারায় প্রায় আমাদের সৌরমণ্ডলের অষ্টম গ্রহ নেপচুনের মতোই। ভারীও প্রায় ততটাই। ওই ভিনগ্রহের ভিতরে এতটা জায়গা রয়েছে যে, ৫৭টা পৃথিবীকে পুরে দেওয়া যায়। আর তার পরেও কিছুটা জায়গা খালি পড়ে থাকবে ওই ভিনগ্রহে।
কী ভাবে উবে যায় গ্রহদের বায়ুমণ্ডল? কেন উড়ে যায়? দেখুন ভিডিয়ো
কিন্তু যে অসম্ভব দ্রুত হারে ওই ভিনগ্রহটির ‘মাংস’ (বায়ুমণ্ডল) ছিঁড়ে খাচ্ছে তার জন্মদাতা নক্ষত্র- গ্লিয়েসি-৩৪৭০, তাতে আমাদের পৃথিবীর মতো চেহারা ও ওজনে হালকা-পল্কা হয়ে পড়তে তার খুব একটা দেরি হবে না বলেই মনে করছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
কেন উবে যাচ্ছে গ্রহটির বায়ুমণ্ডল অত দ্রুত হারে?
মূল কারণ, ওই ভিনগ্রহটি রয়েছে তার জন্মদাতা নক্ষত্র বা তারা গ্লিয়েসি-৩৪৭০-র খুব কাছে। কতটা কাছে জানেন? দূরত্বটা মাত্র ৩৭ লক্ষ মাইল। যা আমাদের সৌরমণ্ডলে বুধ যতটা কাছাকাছি রয়েছে সূর্যের, তার ১০ ভাগের এক ভাগেরও কম দূরত্ব! যেন তার নক্ষত্রের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে ভিনগ্রহটি!
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক অনাবাসী ভারতীয় অর্জুন রাঘবন বলছেন, ‘‘আমাদের নেপচুনের মতো অত বড় আর অত ভারী গ্রহকে এর আগে আমরা তার নক্ষত্রের এতটা কাছাকাছি থাকতে দেখিনি।’’
গ্লিয়েসি-৩৪৭০-বি’কে ছেড়ে বেরিয়ে আসছে তার বায়ুমণ্ডল
এটা ঠিক, ওই ভিনগ্রহ গ্লিয়েসি-৩৪৭০-বি যে নক্ষত্রটিকে (গ্লিয়েসি-৩৪৭০) প্রদক্ষিণ করেছে, তা আমাদের সূর্যের চেয়ে অনেকটাই ছোট। আর তার তেজও নেই ততটা, কারণ, সেটা আমাদের সূর্যের মতো অতটা গনগনে তাপে জ্বলছে না। বরং গ্লিয়েসি-৩৪৭০ আদতে একটি ‘লাল বামন নক্ষত্র’ (রেড ডোয়ার্ফ স্টার)। কোনও নক্ষত্রের জ্বালানি ফুরিয়ে এলে, তা ধীরে ধীরে ‘লাল বামন নক্ষত্র’ হয়ে যায়। তখন তার ‘উনুনের আগুন নিভে আসে’ অনেকটাই।
কিন্তু লাল বামন নক্ষত্র হলেও, গ্লিয়েসি-৩৪৭০-র বয়স আমাদের সূর্যের মতো অতটা বেশি নয়, জানাচ্ছেন রাঘবন।
তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের সূর্যের বয়স যেখানে ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ কোটি বছর, সেখানে গ্লিয়েসি-৩৪৭০ নক্ষত্রের বয়স বড়জোর ২০০ কোটি বছর।তাই আমাদের সূর্যের তুলনায় গ্লিয়েসি-৩৪৭০ নক্ষত্রটিকে বলা চলে, ‘তরুণ, তরতাজা’। তাই, উনুন নিভে এলেও এখনও তার যে তাত রয়েছে, তাও খুব কম নয়। তা ছাড়াও, ওই নক্ষত্রটির অনেক কাছে আছে গ্লিয়েসি-৩৪৭০-বি ভিনগ্রহটি। যা ভিনগ্রহটির গা পুড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্টই।’’
আমাদের সৌরমণ্ডল বড়ই ব্যাতিক্রমী!
এই ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের ছায়াপথ ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’র অন্যান্য নক্ষত্রমণ্ডলের চেয়ে আমাদের সৌরমণ্ডল একেবারেই ব্যাতিক্রমী। অন্যান্য নক্ষত্রমণ্ডলে জন্মদাতা তারা বা নক্ষত্রদের অনেক বেশি কাছে আছে বিশাল আর গ্যাসে ভরা ভারী গ্রহগুলি। তাদের চেয়ে অনেক দূরে রয়েছে ছোট ছোট পাথুরে গ্রহগুলি। যেগুলি আকার, আকৃতিতে আমাদের পাথুরে বুধ, মঙ্গল, শুক্র, পৃথিবীর মতো। বা পৃথিবীর চেয়ে একটু বড় (সুপার আর্থ, মোটামুটি দেড় গুণ বড় হলে)। কিন্তু আমাদের সৌরমণ্ডলে ঘটেছে ঠিক উল্টো ঘটনাটা। এখানে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুনের মতো সুবিশাল, খুব ভারী আর গ্যাসে ভরা গ্রহগুলি রয়েছে সূর্য থেকে অনেক বেশি দূরে। বরং তুলনায় সূর্যের অনেক কাছাকাছি রয়েছে পৃথিবী, মঙ্গল, শুক্র, বুধের মতো ছোট ছোট পাথুরে গ্রহগুলি।
চেহারায় আমাদের নেপচুনের মতো হলেও গ্লিয়েসি-৩৪৭০-বি ভিনগ্রহটি কিন্তু তার জন্মদাতা নক্ষত্রের অনেক বেশি কাছে রয়েছে। তার ফলে, নক্ষত্রের ভয়ঙ্কর তাপে তা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। তার দুর্বল অভিকর্ষ বল আর আটকে রাখতে পারছে না ভিনগ্রহ গ্লিয়েসি-৩৪৭০-বি’র বায়ুমণ্ডলকে। তা মহাকাশে উড়ে যাচ্ছে।
মূল গবেষক জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিনসেন্ট বাউরিয়ার তাঁর গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘‘আমাদের নেপচুনের মতো চেহারার অত বড় আর ভারী কোনও ভিনগ্রহকে এর আগে এত দ্রুত হারে উবে যেতে দেখা যায়নি।’’
ঠিকই। এর আগে নেপচুনের মতো চেহারার আরও একটি ভিনগ্রহকে উবে যেতে দেখা গিয়েছিল কয়েক বছর আগে। তার নাম- ‘গ্লিয়েসি-৪৩৬-বি’ বা, ‘জিজে-৪৩৬-বি’। সেটাও আমাদের চেয়ে রয়েছে মোটামুটি একই দূরত্বে। কিন্তু যে হারে জিজে-৪৩৬-বি ভিনগ্রহটি উবে যাচ্ছে বলে দেখা গিয়েছিল, তার অন্তত ১০০ গুণ দ্রুত হারে উবে যাচ্ছে গ্লিয়েসি-৩৪৭০-বি’র বায়ুমণ্ডল।
রাঘবন বলছেন, ‘‘তার কারণ সম্ভবত একটাই। তা হল, ঘনত্বের নিরিখে জিজে-৪৩৬-বি’র চেয়ে অনেকটাই হাল্কা গ্লিয়েসি-৩৪৭০-বি।’’
মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এর জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক দেবেন্দ্র ওঝা বলছেন, ‘‘বায়ুমণ্ডল এই ভাবে প্রায় পুরোটাই উড়ে গেলে, এক দিন গ্লিয়েসি-৩৪৭০-বি হয়ে পড়বে পৃথিবীর মতোই একটি পাথুরে গ্রহ। বা তার চেয়ে একটু বড় চেহারার কোনও গ্রহ। যাদের বলা হয়, ‘সুপার আর্থ’।’’