বাজারে নকল ইলিশ বলে এখন সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে ‘সার্ডিন’। ঠিক ইলিশের মতই দেখতে মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম সার্ডিন (sardine, সামুদ্রিক পোনা মাছ বিশেষ)। এক সময় মেডিটারেনিয়ান দ্বীপ সার্ডিনিয়া’র চতুর্দিকে এ মাছের আধিক্য ছিল বলে এরা সার্ডিন নামে পরিচিতি পেয়েছেন। স্থানীয় ও জেলেদের কাছে পরিচিতি চন্দনা, যাত্রিক, টাকিয়া, পানসা, খায়রা ও সাগর চাপিলা নামে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা সার্ডিন বা চন্দনা মাছকে ইলিশ বলেই বিক্রি করছে। এ মাছ বেশিরভাগ সাগরপথে আমদানি করা হয়। তাই ফরমালিনযুক্ত এ মাছ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তরা।
এখন দেখে নেওয়া যাক সার্ডিন ও প্রকৃত ইলিশ ইলিশের মধ্যে ব্যবধান এবং চেনার উপায়। সার্ডিনের দেহ পার্শ্বীয়ভাবে পুরু এবং পীঠের দিকের চেয়ে পেটের দিক অপেক্ষাকৃত উত্তল ও চ্যাপ্টা। ইলিশের দেহ পার্শ্বীয়ভাবে পুরু, পিঠের ও পেটের দিক প্রায় সমভাবে উত্তল। সার্ডিনের দৈর্ঘ্য সাত সেন্টিমিটার থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ইলিশ বেশ বড় (৭৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত) হয়ে থাকে। সার্ডিনের মাথার আকৃতি ছোট ও অগ্রভাগ ভোঁতা। ইলিশের মাথার আকৃতি লম্বাটে ও অগ্রভাগ সূচালো। সার্ডিনের পৃষ্ঠীয় পাখনার অগ্রভাগে এবং পুচ্ছ পাখনার কিনারা ঘোলাটে। ইলিশের পৃষ্ঠীয় পাখনার অগ্রভাগে এবং পুচ্ছ পাখনার কিনারা অনেকটা ফ্যাকাশে। সার্ডিনের চোখের আকৃতি তুলনামূলকভাবে বড়। আসল ইলিশের চোখের আকৃতি তুলনামূলকভাবে ছোট।
মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, সার্ডিন মাছটি দেখতে ইলিশের মতো। তাই পয়লা বৈশাখকে সামনে রেখে অনেকে মাছটিকে ইলিশ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। অনেক ব্যবসায়ী টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, উখিয়া ও কক্সবাজার উপকূল থেকে এই মাছ কিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছেন। রাজধানীর অন্যতম প্রধান বাজার কারওয়ান বাজারেও দেদারছে বিক্রি হচ্ছে এই সার্ডিন মাছ।
এ বাজারের মাছ ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান বলেন, বাজারে এখন জাটকা ছাড়া বড় আকারের ইলিশ খুবই কম। জাটকা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকায়। আর সার্ডিন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। প্রতিটি সার্ডিনের ওজন ৪৫০ থেকে ৭০০ গ্রাম। তবে এই সার্ডিনই ইলিশের দামে বিক্রি করা হচ্ছে ক্রেতার কাছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ইলিশের মতো দেখতে আরেক মাছ হচ্ছে চৌক্কা। জেলেদের ভাষায় সার্ডিনকে টাকিয়া এবং চৌক্কাকে চৌক্কা ফ্যাইসা বা চটপটিও বলা হয়। দেশে এখন এসব মাছের ছড়াছড়ি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায়ও এসব নকল ইলিশের হদিস মিলেছে। গবেষণা বলছে, চাপিলা, সার্ডিন ও চৌক্কা মাছ বিক্রি হয় ইলিশ নামে। সার্ডিন আকারে অনেকটা জাটকার মতো। আর চৌক্কা বেশ বড় হয়; লম্বায় অনেকটা ইলিশের কাছাকাছি। তবে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই চৌক্কা এবং ইলিশের মধ্যে পার্থক্য বোঝা যাবে।
জানা গেছে, সাগরে সারা বছরই কম-বেশি সার্ডিন ও চৌক্কা ধরা পড়ে। এখন বিদেশ থেকেও আমদানি হয় এসব মাছ। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের কাঁচাবাজার থেকে রাতের আঁধারে চলে যায় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে, যারা বড় বড় পাতিলে করে এসব মাছ অলিগলি ঘুরে বিক্রি করে। এ ছাড়া মাওয়া ও দৌলতদিয়া ঘাটের পাশাপাশি ইলিশের জন্য বিখ্যাত চাঁদপুরের মেঘনার মোহনায়ও এসব মাছ যাত্রীদের কাছে কম দামে বিক্রি করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের আরেক মাছ বিক্রেতা জয়নাল মিয়া বলেন, দেশি ইলিশের তুলনায় এসব মাছের দাম অনেক কম। কিন্তু বিক্রি করি ইলিশের দামে। এখন এসব মাছ আমদানিও হচ্ছে। বাজারেও এসব মাছ ভরপুর। তিনি জানান, সামনে পয়লা বৈশাখ থাকায় এখন ইলিশের চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই এখন মাছ কিনতে আসা নতুন ক্রেতাদের আমরা টার্গেট করি। তাড়াহুড়া করে ইলিশের নামে এসব মাছ গছিয়ে দেওয়া হয়। ক্রেতারা কিছুটা কম দাম পেলেই বেশি করে কেনেন।
বিদেশি মাছের অন্যতম আমদানিকারক আবদুর রউফ জানান, `সার্ডিন`, ‘চৌক্কা’ `চাকোরি` এবং `ডটেড গিজার্ড শাড` দেখতে ইলিশের মতো, কিন্তু ইলিশ নয়। এগুলো এক ধরনের সামুদ্রিক মাছ। প্রতি কেজিতে ছয়টি থেকে শুরু করে ১৬টি পর্যন্ত ধরে। ভিয়েতনাম এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসব মাছ আমদানি করা হচ্ছে। পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে কিছু ইলিশ আমদানি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, উৎপাদনকারী ওইসব দেশের মানুষ ইলিশের মতো দেখতে এসব মাছ খায় না। তাই খুব কম দামে অর্থাৎ মাত্র এক ডলার পাঁচ সেন্ট মূল্যে মাছগুলো আমদানি করা যায়।
আসল ইলিশ চেনার উপায় জানতে চাইলে মৎস্য গবেষকা আনিসুর রহমান বলেন, এসব মাছ ইলিশের মতোই দেখতে। তবে কিছু পার্থক্য রয়েছে। এসব মাছ ইলিশের চেয়ে চওড়ায় কম এবং চোখের আকার বড়। চৌক্কার মাথা লম্বাটে ও সুঁচালো। সার্ডিনের মাথা বড় ও সামনের অংশ ভোঁতা। এসব মাছে ইলিশের গন্ধ নেই। একটু ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যায়।
এদিকে আমদানি করা নকল ইলিশে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান থাকে বলে সম্প্রতি ধরা পড়েছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণে। সংস্থাটি বলছে, এসব মাছে উচ্চমাত্রায় ক্ষতিকর ক্যাডমিয়াম ও সিসা পাওয়া গেছে। সম্প্রতি এক চিঠিতে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা সব মাছ বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।