করোনা দিনের কড়চা : আহমেদ তাকদীর

পাখিরাও মানুষ!
ওরির পাখি দুটির শরীর খারপ। ঝিমুচ্ছে। কি বিশ্রী ব্যাপার। ইতোমধ্যে দুবার মেয়ে আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে। এবার পাখিদের কিছু হলে আমাকে ছাড়বে না। এর আগে ওর একটা কাকাতুয়া ছিলো। কি হলো, মাস খানেকও টেকেনি। দুদিনের ঝিমুনিতেই শেষ। খাঁচাটা অনেকদিন বারান্দায় পড়ে আছে। ভাবলাম দুটো পাখি কিনে আনবো। তবে সে কথা ভেবে আবার মনকে পাত্তা দেই না। মিতা (আমার বৌ) এসব পছন্দ করে না। ওর ধারণা দুনিয়ার রোগ-ব্যাধির অর্ধেক এই পশু পাখিরা এনেছে। এদের সঙ্গে সহাবস্থান নয়। ওকে তো বোঝাতে পারি না। যাকে তুমি ভালোবাসো তারও তো পাখির মতো উড়োউড়ো মন। যাক এক যুগ পড়ে ওসবের আর কোন ‘খানা’ নেই।
তবুও কি ভেবে একজোড়া কোয়েল আনলাম। মুরগি আর পাখির মাঝামাঝি। বোঝালাম ডান বাম কিছু দেখলে সোজা বুটের ডাল দিয়ে ভুনা ভুনা। তবে ওরি খুব খুশি। দুদিন ওর লেগেছে ওদের সঙ্গে মানাতে। একই ভয়, যদি মরে যায়। আমি যতই বলি বাবা দুনিয়ায় কিছুরই গ্যারান্টি নাই। তবুও তার এককথা বাবা এবার আর পাখিরা মরে যাবে নাতো?
এটা কেমন একটা সময় বলুনতো। ট্রাম্পের মাথা ওলোট-পালোট। তাবোত দিগগজ রাষ্ট্রপ্রধানরা কোরাইন্টাইনে। এ রকম একটা সময়ে বেটা কোয়েল তুই ঝিমুবি। জ্বরটাও একটু থাকতে পারে। থার্মোমিটারেতো আরা মাপা যাচ্ছে না। এ সময়ে দুনিয়ার সবচে ‘ভয়ালু’ ‘ডরালু’ ব্যাধিযে জ্বর। কি যানি গলা ব্যাথা আছে কি না, হাল্কা শাদাটে হাগু অবশ্য দেখা যাচ্ছে। কি বলি বলুনতো ব্যাটার আবার করোনা হলো নাতো? আইডিসিআর কি কোয়েলের কথা শুনে রেগে যাবে?

কালিবাউশের হাসি
আজ কালিবাউশ দিবস। মাছেরা প্রতিবাদ করতে পারে না বলে এখনো বাজার থেকে হেসেঁলে আসছে। মানুষেরা গৃহবন্দি হওয়ার আনন্দতো ক’দিন ধরে দেখছি। কক্সবাজারে ডলফিন লাফাচ্ছে, ইন্ডিয়ায় হরিণ আর ভাম নেমেছে রাস্তায় আর ইসরায়েলে ভালুক ঘুরছে সাগরপাড়ে। আবার কবিতাও শুনছি ‘পৃথিবীটা ডলফিনেরও’ কথা সত্য কালিবাউশতো ডলফিন বা তিমি নয়। তাই আজ ওর আর রক্ষে নেই। ওর জাত ভাইরা যতই নদী সাগড়ে লাফাক, দিন আসুক আমরাও দেখিয়ে দেবো মানুষের বাচ্চা আমরা। তোদের হাতে মারবো, কারেন্ট জালে মারবো…।
যাই হোক কথা খুব প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠছে। আসলে গত ১৫ বছর যে কিভাবে গেলো বুঝতে পারিনি। দৌড়, ঝাপ, ক্যারিয়ার, বিয়ে, বাচ্চা, অর্থ। আমি কোথায় ছিলাম। আমিওতো বেচে ছিলাম, কিন্তু আমি কোথায় ছিলাম? ওরিয়ানাটা এখনো সুন্দর রং করে প্রজাপতি আঁকে, ওমা কি সুন্দর গান গাইলো আজ বিকেলে বারান্দায়। মিতা পিঠা বানাতে জানে? আমার মনে পড়ছে না। বারান্দায় তরমুজের বিচি পুতেছি। তিনটি চারা উঠেছে। প্রতিদিন একটু একটু বড় হচ্ছে কি অদ্ভুদ! রাতের সৌন্দর্য কি নিবিড় ভাবে নিস্তব্ধতায় পিচ ঢালা রাস্তায় নেমে আসে। কবিতার মতো বাতাসটাও বেশ মোলায়েম। কান পাতলে দক্ষিণা বাতাসের শুশু (শো শো নয়) শুনতে পাই। আগে তো এগুলো দেখিনি। নাকি দেখার আমি মরে গিয়েছিলো?
কালিবাউশটা আমিই রান্না করবো। কালিয়া। প্রিপারেশন ডান। টমেটো পেস্ট আর টক দইও ফেটে নিয়েছি। পিয়াজগুলো হাল্কা আচে আছে, সোনালি হলেই মূল রান্না শুরু হবে। গন্ধ বের হবে। ম ম গন্ধ। আমরা মেয়েটা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে। বাবাকে সাহায্যের জন্য ব্যতিব্যস্ত। মাছ ভাজা শেষ। শরিষার তেলে কালিবাউশ ভাজলে কি সুন্দর গন্ধ বের হয়। নাকটা কেমন জানি শিরশির করে ওঠে। কালিবাউশ ভোজন হবে। আসলে এমন একটা কালিবাউশ গত ১৫ বছর তো আমি খাইনি। আসলে খেয়েছি কিন্তু এরকম অনন্ত দিন তারিখহীন বিশ্রামের সুখে তো খাইনি! করোনা এ কারণে একটি ধন্যবাদতো পেতে পারে।

কোয়ারেন্টাইন
খটোমটো ইংরেজি শব্দগুলোর বাংলাও খটমটো বা দুষ্প্রাপ্য। লেলিনের (আমার বন্ধু) এক দুখের গল্পে কোয়ারেন্টাইন শব্দটি প্রথম শুনি। দেশ থেকে শুটকি নেয়ায় সিডনি এয়ারপোর্টে নাকি ওকে কোরারেন্টাইনে যেতে হয়েছিলো। তখন মাথা ঘামাইনি। এখনো তো মাথায় ঘামানোরই কিছু পাচ্ছি না। আচ্ছা বলুন তো এর বাংলা কি হবে? বনবাস? অবশ্য বনে তো থাকা যাবে না। পশু পাখি আছে। তাদেরও সংগঠন আছে। বায়ো হ্যাজার্ড নাউ বিগ ইস্যু। ঘরবাস? মানুষতো আজন্ম ঘড়েই আছে। হ্যাঁ দু চার জন ঘর ছারলেও আসলেতে ঘরেই ছিলো। বলা যায় আপন জন ছেড়েছে। আপন জনের মায়াই তো মোহ। ছাড়া যায় না। আর ধরে থাকলে ঋষি হওয়া যায না। যাগ্গে এখন ঋষি হওয়ার পর্ব নয়। কোয়ারেন্টাইন পর্ব।

লাংঙস অব দ্য ওয়ার্ল্ড
এই ক’দিন আগে আমাজন পুড়ে শেষ। দুনিয়া জুড়ে হাপিত্যেশ। অক্সিজেন এবার বোতলভরে কিনতে হবে। বাজারের লম্বা লিস্টে বউ লিখে দেবে এক বোতল ফ্যামিলি সাইজ অক্সিজেন। কি জানি স্বপ্ন হয়তো বিশেষ শুক্রবারের ডিসকাউন্ট দেবে। অপেক্ষায় থাকবো ওই দিন কেনার, ২০% ডিসকাউন্টতো বেশ কম কি বলেন? পৃথিবীর ফুসফুস আমাজন ডেঞ্জারে। কোন কথা হবে না।
বিড়ি ফোকা অবশ্যই একটি প্রথম সাড়ির বদ অভ্যাস। কিন্তু কি জানেন এ অভ্যাসটা না গত ২০ বছর ধরে গভীরভাবে আমার কান্ধের ওপর বসে আছে। ব্যস্ততা, টেনশন, সফলতা সবকিছুতে চাই, বলতে পারেন চাই ই চাই। বেচার আমার ফুসফুস দুবছরে একবার কফ পয়দা করা ছাড়া কোন প্রতিবাদই করতে পারে নাই। কারণ ওর মালিকের এসবে থোরাই কেয়ার। এবার অবশ্য করোনার ডাকে পরিস্থিতি বদলেছে। বেচারা ফুসফুস আমার দীর্ঘদিন পর ধোয়ার বাইরে শ্বাস নিচ্ছে। সিগারেটযে দিনে খাবারের ওয়াক্তেরও নীচে নামিয়ে ফেলেছি। আমাজন পোড়ার পর একটি ভরা মৌসুম বর্ষা গেলো অবশ্য শুনেছি আমাজনে সারা বছরই বৃষ্টি হয়। আর পাখিদের প্লান্টেশনেতো কোন ছুটির দিন নেই। আশা করা যায় আশানুরুপ বীচ তারা অসীম পোড়া ভূমিতে ফেলেছে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে গাছের চারা। যদিও নবীন তবুও আগামীর সবুজ তারা। অক্সিজেনের ফ্যাক্টরি। আর সত্যি বলতে আমর ফুসফুস বা আমারও বা সামর্থ্য কোথায় বছর ধরে অক্সিজেনের বোতল কেনার। অন্যদিক ফুসফুস আবার সবল হয়ে উঠছে সে নিশ্চই এখন বেশি বেশি অক্সিজেন চাইবে।

ahmed.takdir@gmail.com