তসলিমা নাসরিন : নারীর সঙ্গে পরাধীনতার সম্পর্ক প্রাকৃতিক নয়

তসলিমা নাসরিন

সুদর্শন সৌদি যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের পরাধীন মেয়েদের জন্য এক আশীর্বাদ, এরকমই ভেবেছিলাম। নারী-বিরোধী সমাজের পরিবর্তন তিনিই করবেন। আর কারও দ্বারা তো সম্ভব হলো না ধর্মের এবং পুরুষতন্ত্রের জাঁতাকলে না পিষে মেয়েদের মানুষের মর্যাদা দেওয়া। যখন গাড়ি চালানোর অধিকার দিলেন মেয়েদের, ভেবেছিলাম একটু একটু করে নারী-বিরোধী আইনগুলো তিনি বাতিল করবেন। শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছিলাম। সৌদি আরবের মতো একটি কট্টর মৌলবাদী দেশে জম্মে  তিনি যে মনে প্রাণে আধুনিক হলেন, সমতা আর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে বলে কয়েও হাত দিলেন, মুগ্ধ বিস্ময়ে তাই তাকে শুধু দেখে গেছি। ফেসবুকে, টুইটারে, কলামে তার প্রশংসা করেছি। তিনিই হয়তো রাজতন্ত্র বিদেয় করে গণতন্ত্র আনবেন, হয়তো তিনিই আনছেন নতুন সূর্যোদয়! তিনিই তো বলেছিলেন ‘ইসলাম বলেনি বোরখা পরা বাধ্যতামূলক, কেউ ইচ্ছা করলে পরবে, না করলে পরবে না’। বাহ, এমন বাক্য তো আগে কখনও রাজপ্রাসাদ থেকে উচ্চারিত হয়নি! বাধ্যতামূলক বোরখার শৃঙ্খল থেকে বুঝি সৌদি নারীরা শেষ অবধি মুক্তি পেতে যাচ্ছে! কিন্তু একটুখানি তলিয়ে দেখলে কি বুঝি না, আসলে ওইসব কথা চমক দেওয়ার জন্য বলা? অথবা বিশ্বকে বোকা বানানোর জন্য বলা? বোরখা আজও মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক। বোরখা না পরে বাড়ির বাইরে বেরোবার অধিকার কোনও মেয়ের নেই। সেদিন কিছু সৌদি মেয়ে বোরখা উল্টো করে পরে বোরখা না পরার অধিকার না থাকার প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদ করে যে কিছু অধিকার আদায় করা যায় না, যাবে না, সৌদি রাজপরিবার দয়া করলেই শুধু তারা দয়া পেতে পারে, নারীবাদীদের এ কথা বেশ জোরেশোরেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি চালানোর অধিকারও সৌদি মেয়েরা আন্দোলন করে পায়নি, সৌদি রাজা এবং যুবরাজ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেই পেয়েছে। আন্দোলন করে বা লড়াই করে গাড়ি চালানোর অধিকার মেয়েরা পেয়েছে, এমন অলক্ষুণে কথা যেন কোনও নারীবাদী না বলে, তা রাজপ্রাসাদ থেকে সরকারিভাবে নারীবাদীদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি চালানোর অধিকারটি পাওয়ার কিছুদিন আগেই তো ১১ জন আন্দোলনকারী নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ১১ জনের মধ্যে ৪ জন মুক্তি পেয়েছে, বাকি ৭ জন মেয়ে, পুরুষ-অভিভাবক ছাড়া বা পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মেয়েদের যে দেশের বাইরে পা ফেলা নিষিদ্ধ এই আইনটি বাতিল করার দাবি করে। ৭ জন এখনও মুক্তি পায়নি। ২৫ বছর জেলও শুনেছি তাদের হতে পারে।

গত বছর মুহম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক আদর্শের সমালোচনা করেছিলেন কয়েকজন লেখক বুদ্ধিজীবী। সে কারণে ৩০ জন লেখক বুদ্ধিজীবীকে তিনি জেলে ভরেছেন। গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন সাংবাদিক জামাল খাশোগি। আমেরিকার ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা তার কলামে খাশোগি মুহম্মদ বিন সালমানের সমালোচনা নির্ভয়ে করেছিলেন। কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে ক্ষমতাচ্যুত করার, দেশে ভিন্নমত যাদেরই আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সমালোচনা। তখনও তো খাশোগি জানেন না যে তাকে হত্যা করার ফাঁদ পাতা হচ্ছে। ফাঁদ পাতছেন মুহম্মদ বিন সালমান। ফাঁদে পা দিয়েছেন খাশোগি। তুরস্কে গিয়েছেন, সৌদি দূতাবাসে গিয়েছেন, এবং নিশ্চিহ্ন হয়েছেন। তাকে কে মেরেছে, কারা মেরেছে, এসব প্রশ্ন নিয়ে দুনিয়া ব্যস্ত। ওদিকে আমাদের আধুনিক, প্রগতিশীল, সমাজ সংস্কারক সৌদি যুবরাজ, কেউ যেন তাকে সন্দেহ না করে, একের পর এক মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন। খাশোগি নাকি তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে মল্লযুদ্ধ করতে গিয়ে মরেছেন। তুরস্কের সরকার এই হত্যাকান্ডের পেছনে কে বা কারা আছে তা জানার জন্য দুনিয়াকে ব্যস্ত না রাখলে হয়তো অনেক হত্যাকান্ডের মতো এটিও মানুষ দুদিন পর ভুলে যেত। সিআইএর লোকেরা তদন্ত করে জেনেছেন, খাশোগিকে হত্যা করার হুকুম দিয়েছিলেন স্বয়ং মুহম্মদ বিন সালমান।

মুখোশটা খসে গেছে বিন সালমানের। তিনি প্রমাণ করেছেন তিনি কারও মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করেন না। তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। তিনি বর্বরতায় বিশ্বাস করেন। বর্বরতায় বিশ্বাস করেন বলে খাশোগিকে খুন করার জন্য তিনি রিয়াদ থেকে ১৫ জন সরকারি খুনি পাঠিয়েছেন তুরস্কে। তিনি খুনিদের দিয়ে খাশোগির শরীর টুকরো টুকরো করে কাটিয়ে অ্যাসিডের ভিতর ডুবিয়ে গলিয়ে তরল করে নর্দমায় ঢেলে দিয়েছেন। খাশোগিকে আক্ষরিক অর্থেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছেন বিন সালমান। কত বড় বর্বর হলে এভাবে দূতাবাসে ঢুকিয়ে মানুষ খুন করতে পারে কেউ। যে লোক মানবাধিকারে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেন না, সে লোক নারীকে কী অধিকার দেবেন? উত্তর : কিছুই না। সৌদি আরব এমনিতেই বর্বর। এখনও জনগণকে দেখিয়ে এক কোপে মানুষের মুন্ডু কেটে নেয়। অপরাধীকে ভুল শোধরাবার কোনও সুযোগ দেয় না। সভ্য দেশে মৃত্যুদ- নেই। নৃশংসতায় এখনও সবার ওপরে সৌদি আরব। নারীকে গাড়ি চালানোর অধিকার দিলেন সৌদি যুবরাজ। সম্ভবত গোটা বিশ্বের চাপ ছিল বলেই দিয়েছেন। কিন্তু নারীকে তার পছন্দমতো পোশাক পরার অনুমতি দিলেন না, নারীকে তার নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অধিকার দিলেন না, অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে কথা বলার, মেশার অধিকার দিলেন না, পুরুষ অভিভাবক ছাড়া ভ্রমণ করার অধিকার দিলেন না। নারী তার প্রাপ্য অধিকার পায়নি, পাবেও না। অন্তত বিন সালমানের আমলে নয়।

সৌদি মেয়েদের অনেকেই আজ বোরখা না পরার অধিকার পাচ্ছে না বলে বোরখা উলটো করে পরেছে। উলটো করে বোরখা পরে কি সত্যিই প্রতিবাদ করা যায়? কার কী এলো গেল নিজের বোরখা নিজে উলটো পরলে! কারও চোখেও পরবে না। আর চোখে পরলেই বা কী! বোরখা তো পরেছে, সে যেভাবেই পরুক। প্রতিবাদটা ভালো হতো, যদি বোরখাটাই না পরে রাস্তায় বেরোতো। একজন দু’জন নয়, হাজার হাজার মেয়ে যদি বোরখা না পরতো! গ্রেফতার করবে তো? কজনকে করবে? হাজার হাজার? করুক না। দুনিয়াতে সৌদি আরব তো একা নয়, আরও দেশ আছে। দেখছে। তেল আর অস্ত্রের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে আমেরিকা আর কতদিন বর্বরতাকে দেখেও দেখবে না? দুটো দেশ মিলে তো ইয়েমেনের অসহায় মানুষদের সর্বনাশ করে ছেড়েছে। অসভ্য দেশ তো অসভ্য দেশই। সভ্য দেশগুলোও যদি অসভ্যের অসভ্যতায় হাত মেলায়, তখন বড় আশাহত হই।

মুহম্মদ বিন সালমান রাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, গণতন্ত্রে নয়। তিনি বর্বরতায় বিশ্বাস করেন, সহনশীলতায় নয়। তার কাছ থেকে নারীর জন্য পাওয়ার কিছু নেই।

নারীদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম নারীদেরই চালিয়ে যেতে হবে। দু’একজনের প্রতিবাদে কাজ হয় না। দু’একজনকে জেলে ভরে নির্যাতন করা হয়। শত শত হাজার হাজার নারী-পুরুষকে একযোগে সমাজ বদলানোর আন্দোলন করতে হবে। রাউফ বাদাবিকে চাবুক মারা হয়েছে, জেলে বন্দী করা হয়েছে। আরও ১০ বছর তাকে জেল খাটতে হবে। কারণ তিনি তার ফেসবুকে লিখেছিলেন তিনি ধর্ম মানেন না। সারা পৃথিবীর প্রগতিশীল মানুষ রাউফের মুক্তির জন্য আন্দোলন করছেন। অথচ বিন সালমানের গায়েই লাগছে না কিছু। তিনি যদি ভালো মানুষ হতেন, রাউফকে মুক্তি দিতেন। রাউফের মতো আরও অনেক মুক্তচিন্তক যুক্তিবাদী মানুষকে মুক্তি দিতেন। মানবাধিকারে আর মত প্রকাশের স্বাধীনতায় যে লোক বিশ্বাস করে না, তাকে আমাদের বিশ্বাস করার কোনও প্রয়োজন নেই।