বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির শীর্ষ পাঁচে দেশ

মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি এ বছর শেষে কত হতে পারে, তা নিয়ে ভিন্ন তথ্য মিলছে সরকার ও বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে। বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, এ বছর বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭.৩ শতাংশ। গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুজাতিক সংস্থাটি এ-ও বলেছে, বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠা শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা অন্য চারটি দেশ হলো ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, ভুটান ও ভারত। মাত্র এক দিন আগে আরেক বহুজাতিক সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জানিয়েছিল, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৮ শতাংশ। এরও দুই সপ্তাহ আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রবৃদ্ধি হবে ৮.১৩ শতাংশ।

‘বাংলাদেশ উন্নয়ন আপডেট’ প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁও কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বিশ্বব্যাংক। তাতে স্বাগত বক্তব্য দেন ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট জে শোম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি কত শতাংশ হবে, তা নিয়ে প্রতিবছরই বিতর্ক হয় সরকার ও বহুজাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অবশ্য এবার প্রবৃদ্ধি নিয়ে এক সংস্থার সঙ্গে আরেক সংস্থার তথ্যের বিস্তর ফারাক দেখা গেছে। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়, জিডিপির প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির হার, খেলাপি ঋণসহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে কথা বলেছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বিশ্বে ক্রমবর্ধমান পাঁচটি অর্থনৈতিক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে ইথিওপিয়া ৮.৮ শতাংশ, রুয়ান্ডা ৭.৮ শতাংশ, ভুটান ৭.৬ শতাংশ এবং ভারত ৭.৫ শতাংশ। যদিও ৭.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে পঞ্চম স্থানে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে জিবুতি, আইভরি কোস্ট ও ঘানা রয়েছে।

মূল প্রবন্ধে ড. জাহিদ হোসেন দেখিয়েছেন, বিশ্ব পরিস্থিতি বর্তমানে যেভাবে এগোচ্ছে তাতে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.৩ শতাংশ অনেক বেশি। প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে রপ্তানিতে সুবাতাস, শিল্প খাতের অবদান, প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের অংশ দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা থাকা নিয়ামক হয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া বিদ্যুতের অভাবনীয় সাফল্য এবং কৃষিতে বাম্পার ফলনও কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতের অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, দুর্বল রাজস্ব আদায়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে আকাশে জমা হওয়া মেঘের সঙ্গে তুলনা করে জাহিদ হোসেন বলেন, এসব দুর্বলতার কারণে ঘূর্ণিঝড় হবে না ঠিকই, তবে এসব ঝড়ের পূর্বাভাস।

বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি খাতে সংস্কারের তাগিদ দিয়েছে। আর্থিক এবং রাজস্ব খাত, অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং ব্যাবাসায়িক বিধিনিয়মে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্থারের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে যতটা বিনিয়োগ হওয়া দরকার, ততটা হচ্ছে না। সরকারি বিনিয়োগ বেশি হচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ততটা আশানুরূপ হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ একটি ছোঁয়াচে রোগ। একে প্রশ্রয় দিলে অন্যরা সেই সুযোগ চাইবে। ঋণখেলাপিদের বারবার ঋণ পুনঃ তফসিলের সুযোগ দিলে অন্যরাও সেটি দাবি করবে। পুনঃ তফসিলীকরণ ছোঁয়াচে রোগকে বাড়িয়ে দেয় বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। সরকার ঋণখেলাপিদের ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পরিশোধের কথা বলছে। সরকার যুক্তি হিসেবে দেখাচ্ছে, দুর্যোগ এবং কম্পানির লোকসানের কারণে এমন সিদ্ধান্ত। কিন্তু ২০১৭ সালে হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যা ছাড়া দেশে আর কখন বড় দুর্যোগ হয়েছে? তা ছাড়া যারা ঋণখেলাপি, তারা সবাই কি অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি? এখানে বিভিন্ন শ্রেণির ঋণখেলাপি আছে। অনেকে আছে, যাঁরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি।

টেকসই প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে খেলাপি ঋণসহ পুরো ব্যাংকিং খাত, ব্যক্তি খাতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়া এবং সক্ষমতার তুলনায় রাজস্ব আদায় না হওয়াকে চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক।

স্বাগত বক্তব্যে রবার্ট জে শোম বলেন, চলতি অর্থবছর বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭.৩ শতাংশ। এটি বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করলে অনেক বেশি।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম দুর্বল খাত। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। অর্থাৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সরকারি ব্যাংকগুলোর মালিক হিসেবে কাজ করবে। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। ড. জাহিদ হোসেন ব্যাংক খাতে শঙ্কার কথা উল্লেখ করে বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়ে। এতে মেঘ ঘনীভূত হবে। খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশ বাড়লে ছয়টি ব্যাংক, ৯ শতাংশ বাড়লে ২৯টি ব্যাংক এবং ১৫ শতাংশ বাড়লে ৩৫টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়বে। এ ছাড়া বড় তিন ব্যাংক ঋণগ্রহীতা যদি তাদের ব্যবসায় বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, তাহলে ২১টি ব্যাংক, সাতজন ঋণগ্রহীতা যদি বিপর্যয়ে পড়ে, তাহলে ৩১টি ব্যাংক এবং ১০ জন সর্বোচ্চ ঋণগ্রহীতার বিপর্যয় হলে ৩৫টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়বে। তবে এসব যদি একবারেই ঘটে তাহলে ব্যাংকিং খাতে ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। তবে সাধারণত একবারেই এ রকম ঘটনা ঘটে না।

জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে রাজস্ব আদায় সক্ষমতার তুলনায় অনেক কম। গত ৭ মাসে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। গত ১৬ বছরেও এত কম রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়নি। সমমানের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে রাজস্ব আদায় কম। সক্ষমতার তুলনায় রাজস্ব আদায় কম দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া। অন্যদিকে সক্ষমতার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ভালো করছে ভারত ও ভিয়েতনাম।

অর্থনীতিশীর্ষশীর্ষ পাঁচে