যে পাঁচজনের লড়াইয়ে ভারতে সমকামিতা বৈধ হল

১৯৯৮ সালে ম্যাসাচুসেটসের ক্লার্কস ইউনিভার্সিটি থেকে ডাবল মেজর করে ভারতে ফিরে আসার পর আয়েষা কাপুর যোগ দিয়েছিলেন ই-কমার্স খাতে, যা তখন এ দেশে সবে মাথা তুলছে। খুব শিগগিরি বিজনেস হেডের পদে পৌঁছতেও কোনও অসুবিধে হয়নি তার।

কিন্তু দশ বছরের মধ্যেই ছবিটা পাল্টে গেল – যখন তার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের কথা জানাজানি হওয়ার পরই তাকে চাকরি ছাড়তে হয়। আয়েষার সঙ্গী ছিলেন একজন মহিলা।

পরে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করে তিনি ভারতের কর্পোরেট জগতে দারুণ সফল ঠিকই – কিন্তু নিজের সঙ্গীকে নিয়ে সামাজিক ও পারিবারিক কোনও অনুষ্ঠানে যেতে তাকে এখনও সমস্যায় পড়তে হয়।

কিংবা, হত। বৃহস্পতিবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে সমকামিতা যেহেতু আর অপরাধ বলে গণ্য নয়, তাই এখন থেকে আর ওরকম ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধায় পড়তে হবে না বলেই আশা করছেন আয়েষার মতো আরও অনেকে।

ভারতীয় সমাজে সমকামিতা সামাজিকভাবে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হতে আরও কত সময় লাগবে বলা মুশকিল, তবে এ ক্ষেত্রে আইনগত বাধা যে আর থাকল না সেটাকেই বিরাট এক অর্জন বলে মনে করছেন এলজিবিটি (লেসবিয়ান-গে-বাইসেক্সুয়াল-ট্রান্সজেন্ডার) সমাজের সবাই।

অথচ ২০১৩ সালে ভারতের এই সুপ্রিম কোর্টই দিল্লি হাইকোর্টের একটি আদেশ খারিজ করে দিয়ে বলেছিল ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের ৩৭৭ ধারা (যাতে সমকামিতা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ) বাতিল করার কোনও অধিকার আদালতের নেই, কারণ সে দায়িত্ব পার্লামেন্টের।

২০১৬-তে সেই রায়ের বিরুদ্ধেই সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হন বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আসা দেশের পাঁচজন সেলিব্রিটি – যার অন্যতম ছিলেন আয়েষা কাপুর। তাদের পিটিশনে তারা সুপ্রিম কোর্টেরই নিজেদের রুলিং পুনর্বিবেচনার আর্জি জানান।

এই পাঁচজন তারকার আইনি লড়াইয়ের সুবাদেই যে আজ ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের নিজেদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুযায়ী জীবন যাপনের অধিকার পেলেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু কারা এই পাঁচজন?

১) ৫৯ বছর বয়সী নভতেজ সিং জোহর ভারতের একজন বিখ্যাত ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী, ভারতনাট্যম নৃত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির পুরস্কারেও ভূষিত তিনি।

গত দুদশকেরও বেশি সময় ধরে যে সঙ্গীর সাথে রয়েছেন তিনি, তার সাথে মিলেই সুপ্রিম কোর্টে পিটিশনটি দাখিল করেছিলেন তিনি।

তার যুক্তি ছিল, ভারতের সংবিধান যে জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অঙ্গীকার করে – ৩৭৭ ধারা তার পরিপন্থী।

২) সাংবাদিক সুনীল মেহরা (৬৩), যিনি এক সময় ম্যাক্সিম ম্যাগাজিনের ভারতীয় সংস্করণের সম্পাদক ছিলেন, তার সঙ্গে নভতেজ সিং জোহরের দেখা হয়েছিল সেই ১৯৯৪ সালে।

প্রথম দেখা হওয়ার ছমাস পর থেকেই তারা এক সঙ্গে থাকতে শুরু করেন, সেই জুটি আজ প্রায় পঁচিশ বছর পরেও ভাঙেনি।

সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা পিটিশনে অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিলেন সাংবাদিক সুনীল মেহরাও।

৩) রিতু ডালমিয়া (৪৫) ভারতের নামী সেলিব্রিটি শেফ-দের একজন। তার ‘ডিভা’ রেস্তোরাঁ চেইন ভারতে সেরা ইটালিয়ান খাবারের অন্যতম ঠিকানা বলে ধরা হয়।

রিতুর জন্ম কলকাতায়, শহরের বেশ রক্ষণশীল একটি বনেদী মারোয়াড়ি পরিবারে। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন লেসবিয়ান হিসেবে।

এক সাক্ষাৎকারে রিতু নিজেই জানিয়েছিলেন, তিনি যে লেসবিয়ান সে কথা নিজের পরিবারের কাছে ঘোষণা করেছিলেন একদিন ডিনারের টেবিলে খেতে বসে। তার বাবা-মাও সেটা সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি।

৪) এই পিটিশনে যুক্ত ছিলেন ৬১ বছর বয়সী আমন নাথও – যিনি ভারতের নিমরানা হোটেল চেইনসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার।

তবে শুধু হোটেলিয়ার হিসেবেই নয়, শিল্পরসিক ও ইতিহাসবিদ হিসেবেও তার খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। শিল্পকলা, ইতিহাস, স্থাপত্য ও ফোটোগ্রাফির মতো বহু বিষয়ে তিনি অজস্র বই লিখেছেন।

৫) আমেরিকায় পড়াশুনো করে ফিরে আসা আয়েষা কাপুরের কথা তো আগেই বলেছি। তিনি ছিলেন সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা পিটিশনের পঞ্চম মুখ।

ই-কমার্সের জগৎ ছেড়ে দেওয়ার পর আয়েষা এখন যুক্ত ফুড অ্যান্ড বিভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে – আর সেখানেও তিনি ভীষণ সফল।

৩৭৭ ধারাকে বিলুপ্ত করে ভারতের এলজিবিটি-রা যে নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপনের অধিকার পেলেন, তার জন্য তারা অবশ্যই এই পাঁচজনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন।

সূত্র : বিবিসি বাংলা