আমাদের ঐতিহ্য আমাদের গর্ব

স্কুল থেকে ফেরার পথে কিংবা বিকেলে গ্রামের অলিগলিতে ঘুরতে গিয়ে পুরনো ভাঙাচোরা কোনো মন্দির কিংবা শতবর্ষীয় কোনো বটগাছ দেখে মনে মনে ভেবেছো, আমাদের গ্রামে কত্ত পুরনো জিনিস আছে! লন্ডনে কি আছে এমন! মনে হয় না! ঐ যে রাজবাড়ির দিঘী, ঐখানে নিশ্চয়ই এক কালে দাঁতাল হাতি পানি খেত। এমন আরো কত ঐতিহ্য যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে সেখানে। খোদ রাজধানী ঢাকাতেই তো ঐতিহ্যবাহী স্থানের শেষ নেই। সেই মোঘল আমলের কতগুলো ভবন এখনও কী সুন্দর চকচক করছে। বাইরের ক’জন জানে এসবের কথা! অথচ তোমরা কিন্তু তাজমহল, চীনের গ্রেট ওয়াল, আমাজন জঙ্গল আর গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের নাম ঠিকই শুনেছ। আর তাই এবার আমাদের হাজার হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্যের কথা জানবার পালা বিদেশিদেরও। তা না হলে পরে ওরা আবার অভিমান করে বলে বসতে পারে, তোমাদের দেশে এতসব পড়ে আছে, তোমরা আমাদের আগে জানাওনি কেন! আর এই জানিয়ে দেওয়ার কাজটা সহজ করতেই অনেক অনেক আগে একটা উদ্যোগ নিয়েছিল ইউনেস্কো। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি ভাবলো কোন দেশে পুরনো কী আছে তা একটা তালিকা করলেই তে ল্যাঠা চুকে যায়। আর তালিকা মানেই প্রতিযোগিতা। খুশির খবরটা হলো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ নামের সেই তালিকায় নতুন করে স্থান পেতে যাচ্ছে আমাদের দেশের আরো কয়েকটি ঐতিহ্য ।

মহাস্থানগড়

মহাস্থানগড়ের নাম কে না শুনেছে। অবশ্য অনেকেই হয়তো এটা জানে না যে এর বয়স প্রায় দুই হাজার তিনশ বছর। এমনকি তখন থেকে পনেরশ সাল পর্যন্ত করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠা এই মহাস্থানগড়ই ছিল তখনকার মানুষের রাজধানী। যখন ইউরোপ আমেরিকা সভ্য হতে শেখেনি, তখন থেকেই এ অঞ্চলে লোকে আসতো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে! মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন এবং আরো অনেক হিন্দু রাজারা এ অঞ্চলকে বানিয়েছিলেন তাদের প্রাদেশিক রাজধানী। আর ওই রাজধানীর ধ্বংসাবশেষই কিন্তু আজকের বগুড়া। আর নিদর্শনগুলো যেখানে অক্ষত রয়ে গেছে সেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে আজকের মহাস্থানগড়। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের কয়েকশ মানুষের যাতায়াত এখানে। আর জায়গাটা যে বিশেষ কিছু তা বুঝতে পেরে ১৯৬৭ সালে করতোয়া নদী ঘেঁষে সরকার গড়ে তোলে এক প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় খুলনার ষাটগম্বুজ মসজিদ, নওগাঁর পাহাড়পুর ও সুন্দরবন থাকলেও বগুড়ার মহাস্থানগড় কিন্তু এখনো জায়গা পায়নি। কী আশ্চর্য তাই না! আসলে এতদিন বোধহয় আমরা বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকা টালিকা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। তা না হলে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের সভ্যতা কী করে ঐতিহ্য হয় না! তবে এবার বোধহয় হয়েই যাবে।

লালবাগ কেল্লা

গুনে গুনে চারশ বছরের পুরনো এই কেল্লা। মোগল আমলের দুর্গ ছিল এটা। আর তাই শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা উপমহাদেশের একটা ঐতিহ্য এই কেল্লা। অথচ দেখ, এটারও নাম নেই। এমনকি আমাদের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের যে তালিকাটা আছে, সেখানে একেবারে ফার্স্টবয় হলো এই লালবাগ কেল্লা। অবশ্য আমরা নিজেরাই যেখানে উদারহস্তে এই ঐতিহাসিক স্থাপনার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছি তাতে আর ইউনেস্কোর কী দোষ! লালবাগ কেল্লায় গেলে এর মোগল আমলের দেয়ালটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ো। দেখবে দেদারসে তাতে পেরেক ঠুকে আর আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে হরেক বিজ্ঞাপন! আমরা নিজেরা মূল্য বুঝলে তবেই না বিশ্বকে বোঝাতে পারবো।

ময়নামতি

মহাস্থানগড়ের মতোই একটি প্রাচীন নগরী ছিল কুমিল্লা জেলায়। আজকের ময়নামতি তারই ধ্বংসস্তূপ। লালমাই সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপনা ছিল এই নগরীতে। মূলত বৌদ্ধ বিহারের অবশিষ্টাংশই এখন চোখে পড়বে বেশি। তার আগে সেখানে ছিল জয়কর্মান্তবসাক নামের আরেক প্রাচীন নগরী। অর্থাৎ প্রাচীন ময়নামতির আগেও সেখানে সুপ্রাচীন আরেকটি সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। আবার ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালে বার্মার যুদ্ধে বৃটিশ শাসনাধীন কমনওয়েলথের ৪৫ হাজার সেনা মারা গিয়েছিল। তাদের সমাধিও আছে ময়নামতিতে। বিখ্যাত হওয়ার জন্য এটাও একটা বড় কারণ।

হলুদ বিহার

নামের শেষে বিহার মানেই এককালে বৌদ্ধ মন্দির আর শান্তশিষ্ট একটা সভ্যতা ছিল সেখানে। নওগাঁর আরেকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন এই হলুদ বিহার। জেলার বদলগাছী উপজেলার বিলাসবাড়ি ইউনিয়নের দ্বীপগঞ্জ গ্রামে গেলেই দেখা মিলবে এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের। এশিয়ার বৃহত্তম সোমপুর বিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এই হলুদ বিহার। দ্বীপগঞ্জ গ্রামের হাটের পাশেই আছে এর অন্যতম চিহ্ন একটা উঁচু ঢিবি। যার উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। এখানে আগে অনেক খনন হয়েছে। এখনও চলে খোঁজাখুঁজি। পাথর, ধাতব মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, অলংকার আঁকা ইট পাওয়া গেছে অনেক। দেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৭৬ সালে হলুদ বিহারকে সংরক্ষিত মনুমেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেয়।

জগদল বিহার

নামটা অনেকেই শোনোনি তাই না? এই বিহারটিই ছিল ১২শ সালের দিককার ইউনিভার্সিটির মতো। শিক্ষা ও জ্ঞানের আদানপ্রদানের অন্যতম কেন্দ্র ছিল নওগাঁর এই পুরাকীর্তি। কাশ্মিরের সাধু-পন্ডিতরা এখানে এসেছিলেন জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতে। বলতে পারো প্রাচীন বাংলার সভা-সেমিনার হতো এখানটায়। আর তাই তালিকায় উঠতে পারে জেলার ধামরাইহাট থানার জগদল বিহারের নাম।

সংসদ ভবন

মনে হতে পারে, আরে এতো প্রতিদিন দেখি, কতই বা আর বয়স হলো এ ভবনের। কিন্তু ঐতিহ্যেরও তো একটা শুরু থাকে। আর শুরুতেই যদি নজর কেড়ে নেয় সবার, তবে তালিকায় নাম উঠতে আর অপেক্ষা করতে হয় না। মার্কিন স্থপতি লুই আই কানের সেরা কাজ বলা যেতে পারে আমাদের সংসদ ভবনটাকে। এমন সুদৃশ্য লেক আর এত বড় মাঠ বিশ্বের খুব কম সরকারি ভবনেরই আছে। ২১৫ একর জমির ওপর স্থাপনাটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটিকে জাতীয় সংসদ ভবন হিসেবে ঘোষণা করেন। এমনকি নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করতে লুই আই কানকে তাগাদাও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৮২ সালে সংসদ ভবনে প্রথম অধিবেশন বসে। তবে এর দক্ষিণ অংশসহ আরো কিছু কাজ শেষ হয় ১৯৮৩ সালে। এই ফাঁকে টুকে নাও, ১৯৯৮ সালে আগা খান পুরস্কার পায় আমাদের সংসদ ভবন। আর এই স্থাপনার ওপর পড়াশোনা করে অনেকেই স্থাপত্যকলায় পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন। ইউনেস্কোর এবারের তালিকায় না থাকলেও পরে যাতে সংসদ ভবনটা স্থান পায়, এ জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে আমাদের সরকার।

স্টাডিগাইড ক্লাবের ফেসবুক গ্রুপ

গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন ও উত্তর

চাকরির পরীক্ষার জন্য সাধারণ জ্ঞান