মনোযোগ ও ঘুম নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িত ‘লোকাস সেরুলিয়াস’ ক্রমশ গবেষকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে।
এটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ঘুম আমাদের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
যারা অনিদ্রায় ভুগেছেন, তারা জানেন ঘুম না আসা কীভাবে ধৈর্যচ্যুতি ও বিরক্তি তৈরি করতে পারে। মনে হয় যেন মাথার ভেতরে অদৃশ্য আলো জ্বলছে, আর ক্রমাগত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এক অবিরাম কণ্ঠস্বর। এই অনুভূতি থেকে মুক্তির জন্য যে নিঃশব্দ লড়াই, তা অনিদ্রায় ভোগা ব্যক্তিরা খুব ভালোভাবেই বোঝেন।
তারা প্রায়ই মস্তিষ্কের সেই ‘বোতাম’ বা ‘সুইচ’ খুঁজে বেড়ান, যা টিপলেই সমস্ত চিন্তাভাবনা এক মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও এমন কোনো বোতাম বাস্তবে নেই, তবে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা এখন নিশ্চিত যে মস্তিষ্কের সজাগ থাকার পদ্ধতিটি একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের জটিল নিউরোন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, যার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে এক ক্ষুদ্র নিউরোনগুচ্ছ—লোকাস সেরুলিয়াস। ল্যাটিন ভাষায় এর অর্থ ‘নীল বিন্দু’।
লোকাস সেরুলিয়াসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এর নীল রঙ, যা নোরপাইনফ্রিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের উপস্থিতির কারণে হয়। এটি আমাদের শারীরবৃত্তীয় ও মানসিক উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দীর্ঘদিন বিজ্ঞানীরা ধারণা করতেন যে ঘুমের সময় লোকাস সেরুলিয়াস নিষ্ক্রিয় বা সুপ্ত থাকে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এটি কখনোই সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয় না। বরং এর ক্রিয়াকলাপ অব্যাহত থাকে এবং কখনো কখনো কম মাত্রার কার্যকলাপের মাধ্যমে আমাদের ঘুমের গভীরতা নিয়ন্ত্রণ করে।
মস্তিষ্কের গিয়ার সিস্টেম
লোকাস সেরুলিয়াস অবস্থিত মস্তিষ্কের স্টেমে, ঘাড়ের ঠিক ওপরে। এতে রয়েছে প্রায় ৫০,০০০ কোষ, যা পুরো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ৮৬০০ কোটি নিউরোনের তুলনায় একেবারেই ক্ষুদ্র অংশ।
এই নিউরোনগুচ্ছ প্রথম শনাক্ত করেন মারি অ্যান্টোয়ানেটের চিকিৎসক ফিলিক্স ভিক দিয়াজ, ১৮ শতকের শেষের দিকে। তবে বেশ কয়েক দশক ধরে এটি বিজ্ঞানীদের নজর কাড়েনি। পরে, ২০ শতকে বোঝা যায়, লোকাস সেরুলিয়াস মস্তিষ্কে সংকেত পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে।
নোরপাইনফ্রিন নিউরোনের সক্রিয়তা বাড়ায় এবং মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে সংকেত পাঠায়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মনোনিবেশ করার ক্ষমতা, একাগ্রতা এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
লোকাস সেরুলিয়াসের গিয়ার মোড
মস্তিষ্কের এই নীল বিন্দুটি বিভিন্ন স্তরে কাজ করে, যা ‘গিয়ার সিস্টেম’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।
গিয়ার ১: খুবই নিম্ন স্তরের কার্যকলাপ। মনোযোগ ছড়িয়ে পড়ে, চিন্তাগুলো এলোমেলোভাবে ঘোরাফেরা করে।
গিয়ার ২: মাঝারি স্তরের কার্যকলাপ। মাঝে মাঝে নিউরোন সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা মনোযোগ ধরে রাখার জন্য আদর্শ।
গিয়ার ৩: উচ্চমাত্রার উত্তেজনা। এই পর্যায়ে ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ প্রতিক্রিয়া সক্রিয় হয়, এবং মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
লোকাস সেরুলিয়াসের কার্যকলাপ দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়। সকালে এটি নিম্ন স্তরে থাকে, দুপুরের দিকে সক্রিয়তা বাড়ে এবং সন্ধ্যার পর আবার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে।
রাতে নজরদারি
অনেকেই মনে করেন, রাতে ঘুমের সময় লোকাস সেরুলিয়াস সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, এটি মাঝে মাঝেই সক্রিয় হয় এবং আমাদের ঘুমের গুণমান নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
সুইজারল্যান্ডের লুসান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অনিতা লুথির গবেষণায় দেখা যায়, ঘুমের নির্দিষ্ট পর্যায়ে লোকাস সেরুলিয়াস সাময়িকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা আমাদের ঘুম ও জাগরণের মধ্যবর্তী একটি সংবেদনশীল পরিস্থিতি তৈরি করে।
র্যাপিড আই মুভমেন্ট (REM) ঘুমের পর্যায়ে লোকাস সেরুলিয়াসের নিম্ন স্তরের কার্যকলাপ দেখা যায়, যা স্বপ্ন দেখার সঙ্গে সম্পর্কিত। REM ঘুম চলাকালীন আমাদের পেশিগুলি অস্থায়ীভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যাতে আমরা স্বপ্নের ক্রিয়াগুলো বাস্তবে প্রতিফলিত না করি।
ভালো ঘুমের জন্য করণীয়
লোকাস সেরুলিয়াসের অতিরিক্ত সক্রিয়তা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই গবেষকরা খুঁজে দেখছেন, কীভাবে এই নীল বিন্দুকে ‘শান্ত’ রাখা যায়। দক্ষিণ কোরিয়ার একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করছেন, কপালের নির্দিষ্ট স্নায়ুর ওপর মৃদু বৈদ্যুতিক প্রবাহ চালিয়ে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না।
এছাড়া, ভালো ঘুমের জন্য আমাদের সন্ধ্যার সময় অতিরিক্ত উত্তেজক কার্যকলাপ এড়ানো উচিত। টিভি, মোবাইল ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকা দরকার। মস্তিষ্ককে শান্ত করতে ধ্যান ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম কার্যকরী হতে পারে।
লোকাস সেরুলিয়াস স্বায়ত্তশাসিত স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত, যা শ্বাস, হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা যদি নিয়ন্ত্রিত ব্যায়াম ও শিথিল করার কৌশল অবলম্বন করি, তাহলে এই অংশকে সঠিকভাবে পরিচালিত করা সম্ভব।
সকালে হালকা ব্যায়াম করা লোকাস সেরুলিয়াসের কার্যকলাপ বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। তবে রাতের দিকে অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করলে এটি অত্যধিক সক্রিয় হয়ে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
শারীরিক প্রসারণ (stretching) এবং ধীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম লোকাস সেরুলিয়াসের উত্তেজনা কমাতে পারে এবং গভীর ঘুমের সহায়তা করতে পারে।
গবেষকরা আরও জানার চেষ্টা করছেন, কীভাবে এই ক্ষুদ্র ‘নীল বিন্দু’ আমাদের ঘুম ও মানসিক সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলে। ভবিষ্যতে এই গবেষণা ঘুমের সমস্যার কার্যকর সমাধান নিয়ে আসতে পারে।