মোবাইল ফোনে ভয়েস কলের ব্যয়ে অননেট-অফনেট পার্থক্য তুলে দেওয়ার দেড় মাসের মাথায় গত ১ অক্টোবর চালু হয়েছে এমএনপি বা নম্বর অপরিবর্তিত রেখে অপারেটর বদলের সুবিধা। তবে গ্রাহকদের অভিযোগ, সরকার মোবাইল ফোন সেবা নিয়ে একের পর এক যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তাতে অপারেটরদের স্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে।
প্রায় ছয় বছর ধরে প্রতি মিনিটে অননেটে (একই অপারেটরের নম্বর) কলের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা এবং অফনেটের (অন্যান্য অপারেটরের নম্বর) ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন মিনিট ৬০ পয়সা নির্ধারণ করা ছিল। গত ১৪ আগস্ট থেকে যেকোনো নেটওয়ার্কে সর্বনিম্ন ট্যারিফ হচ্ছে প্রতি মিনিট সর্বনিম্ন ৪৫ পয়সা। এর বিরুদ্ধে মোবাইল ফোন গ্রাহকদের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলনও করা হয়েছে।
এমনকি এমএনপি সেবা সম্পর্কে শুরুতে ফি ধরা হয় ৩০ টাকা। চালুর সময় জানানো হলো ফি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকা। একই সঙ্গে রয়েছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও সিম রিপ্লেসমেন্ট ফি ১০০ টাকা। সব মিলে একটি নম্বর অন্য অপারেটরে নিতে হলে ফি গুনতে হবে ১৫৭ টাকা ৫০ পয়সা। বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. জহরুল হক গত ১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যাবসায়িক স্বার্থেই এর ফি বাড়ানো হয়েছে। ভারতে এমএনপি সেবার চার্জ এত দিন ১৯ রুপি ছিল। তা আরো কমিয়ে গত জানুয়ারিতে মাত্র চার রুপি নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিদেশি কলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের অপারেটর শনাক্তের জন্যও কলপ্রতি পাঁচ পয়সা চার্জ নেওয়া হবে। মোবাইলে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও বাড়তি একই চার্জ নেওয়া হবে।
অভিযোগ রয়েছে, শুধু এ দুটি বিষয়েই নয়, মোবাইল ফোন সেবার ক্ষেত্রে গ্রাহক স্বার্থের পক্ষে সংশ্লিষ্ট আরো অনেক বিষয়েই বিটিআরসি যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি বা অহেতুক সময়ক্ষেপণ করেছে। মোবাইল ইন্টারনেটের চার্জ এখনো গতির ভিত্তিতে না করে ডাটা হিসেবে নেওয়া হচ্ছে। এসব বিষয়ে গ্রাহক স্বার্থের বদলে অপারেটরদের স্বার্থ সংরক্ষণ বা তাত্ক্ষণিকভাবে বেশি রাজস্ব আদায়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অফনেট ও অননেটের মধ্যে বিভাজন তুলে দিয়ে একক কলরেট নির্ধারণ করায় ব্যয় বেড়েছে গ্রাহকদের। বিশেষ করে যারা আগে অননেটে কথা বলত সেই বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের ব্যয় আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। নতুন ব্যবস্থায় আয় বাড়ল কি না, জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মাহমুদ হাসান গতকাল বলেন, এ বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা যাচ্ছে না। গ্রাহকদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি মূল্যায়ন করতে আরো সময় লাগবে। তবে গ্রাহকদের কলের পরিমাণ আগের চেয়ে কমে গেছে।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গতকাল বলেন, ‘আমাদের গ্রাহকদের বুঝতে হবে ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়েছে। আর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ১৯৭১ সালে। এ জন্য ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করা ঠিক হবে না। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদের এগোতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আগে অননেটে যারা কথা বলত, সেসব গ্রাহকের কলচার্জ কিছুটা বাড়লেও এখন অফনেটের গ্রাহকরা আগের তুলনায় কম ব্যয়ে কথা বলতে পারছে। বিভাজন চালু থাকার কারণে অননেটের যে মনোপলি চলছিল, তা ছিল অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতে মোবাইল ফোন অপারেটরদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র ছিল না। আমরা সুস্থ প্রতিযোগিতা চাই। এ ছাড়া অননেট ও অফনেট বজায় রেখে এমএনপি সেবা চালু করা যেত না। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মোবাইল ফোন গ্রাহকরা এখনো কম কলচার্জেই কথা বলতে পারছে বলে জানি।’
কল কমে যাওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘গত ঈদে দেশে আন্তর্জাতিক কল আগের তুলনায় অনেক কম এসেছে। তবে এর কারণ ভিন্ন। এখন অনেকে সরাসরি ভয়েস কল না করে ভাইবার, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার—এসবে কথা বলছে। স্থানীয় কলের ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে। আসলে ভয়েস কলের সময়ই এখন শেষ হয়ে যাওয়ার পথে।’
এদিকে গ্রাহক স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার, পিএসটিএন, বিডাব্লিউএসহ বিভিন্ন অপারেটরের মানসম্মত সেবা বা ‘কোয়ালিটি অব সার্ভিস’ রেগুলেশন এখনো চূড়ান্ত হয়নি। মানসম্মত সেবা না দিতে পারলে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের কী শাস্তি হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। কলড্রপ নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ এখন আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন অপারেটরদের ‘পে পার ইউজ’ ব্যবস্থা নিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে পরোক্ষ প্রতারণার ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে চলেছে। ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর বিটিআরসির তত্ত্বাবধানে মোবাইল ফোন সেবা বিষয়ে যে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে গ্রাহকদের অভিযোগ ছিল, অপারেটররা এত বেশি প্যাকেজ ও প্রমোশনাল অফার দিচ্ছে, যা বাছাই করা কঠিন। এর মাধ্যমে গ্রাহকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে এবং তাদের প্রতারিত হতে হচ্ছে। এসব অভিযোগ তোলার প্রায় দেড় বছর পর গত ৮ ও ৯ এপ্রিল বিটিআরসির ২১২তম সভায় ‘পে পার ইউজ’-এর লিমিট পাঁচ টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে নানা ধরনের প্যাকেজ ও অফারের বিষয়টি এখনো ঝুলে রয়েছে। মোবাইল ফোন অপারেটররা বলছে, অননেট, অফনেট ব্যবধান দূর হওয়ায় প্যাকেজ ও প্রমোশনাল অফার ক্রমেই কমে আসবে।
‘কোয়ালিটি অব সার্ভিস’ রেগুলেশন সম্পর্কে জানা যায়, গত এপ্রিলে বিটিআরসির ২১২তম সভায় এ বিষয়ে একটি কার্যপত্র উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, রেগুলেশনের খসড়া প্রস্তুতের জন্য ৯ সদস্যের একটি কমিটি একটি খসড়া রেগুলেশন প্রস্তুত করে। কমিটি সুপারিশ করে, টেলিযোগাযোগ আইনের ৬৫ ধারা সংশোধন করে রেগুলেশনের শর্ত ভঙ্গের ক্ষেত্রে প্রথমবার ৫০ হাজার টাকা এবং পুনরায় অপরাধ করলে প্রতিবারে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হোক। তবে বিটিআরসির লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং বিভাগ সুপারিশটিতে পরিবর্তন আনে। তারা এখন বিদ্যমান ৬৫ ধারার আলোকেই জরিমানার পরামর্শ দেয়। এ ধারায় জরিমানা কত করতে হবে বলা নেই। বরং অপরাধের ধরন ও ক্ষতির পরিমাণের ভিত্তিতে জরিমানা আরোপের কথা বলা হয়েছে। সভায় বিটিআরসির লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং বিভাগের সুপারিশই গ্রহণ করা হয়।
রেগুলেশনটি এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে—এ প্রশ্নে বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. জহরুল হক গত রবিবার রাতে বলেন, ‘এ মুহর্তে সেটা মনে পড়ছে না।’
তবে গতকাল টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘কোয়ালিটি অব সার্ভিস রেগুলেশনটি আমরা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।’ এ প্রসঙ্গে টেলিকমবিষয়ক গবেষণা সংস্থা লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো ও টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ খান বলেন, কোয়ালিটি অব সার্ভিসের প্যারামিটারটা কী হবে সে প্রশ্নের মীমাংসা আগে হওয়া দরকার।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আমরা আগে বলেছিলাম নেটওয়ার্ক উন্নত করার পর এমএনপি চালু করতে। কিন্তু বিটিআরসি এ বিষয়ে অপারেটরদের তাগিদ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অননেট-অফনেট বিভাজন তুলে দিতে গিয়ে গ্রাহক স্বার্থের বিরুদ্ধে কলরেট বাড়িয়ে দিয়েছে।