সংসদ চলাকালীন সংসদে এবং এরপর সংসদের বাইরে বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সর্বত্র তিনি এত বেশি সমালোচিত হয়েছেন যে একপর্যায়ে জনগণের করের টাকা খরচ করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে মন্ত্রণালয়ের অবস্থান জানান দিতে হয়েছে তাকে। সেই বিজ্ঞাপনও এতটাই মিথ্যা আর ভুল তথ্যে ভরা যে সেটিও তাকে আরেক দফা সমালোচনার মুখে ফেলেছে।
ঈদের আগে এক দফা লকডাউন শেষে ঈদোত্তর পর পর ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকার প্রাথমিকভাবে ঘোষণা দিয়েছিল ‘সবচেয়ে কঠোরতম বিধিনিষেধ’-এর। পৃথিবীর সব দেশের জন্য যেখানে ‘লকডাউন’ শব্দটি যথেষ্ট সেখানে আমাদের দেশে কঠোর, কঠোরতম, সর্বাত্মক, পুরোপুরি ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করেও লকডাউন/বিধিনিষেধ কার্যকর করা যায়নি। অবশ্য কার্যকর করার বিষয়ে সরকার কতটুকু আন্তরিক ছিল সে প্রশ্ন নিশ্চিতভাবেই উঠতে পারে। এমনকি যখন আক্রান্ত এবং মৃত্যু দু’টিই ঊর্ধ্বমুখী, তখনও মাত্র ১৫ দিনের একটি লকডাউন কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। শেষমেশ মুখ খুলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
এক জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যতবারই আমরা চাই সংক্রমণের লাগাম টানতে, বৈজ্ঞানিক পরামর্শ মতো সংক্রমণের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে, কোনোবারই তা শেষ পর্যন্ত নিতে পারলাম না। ক্ষতি তো সবার হচ্ছেই। পূর্বনির্ধারিত মেয়াদ অনুসারে আর পাঁচটা দিন কেন ধৈর্য ধরা গেলো না! সামনে পরিস্থিতি কী হবে তা নিয়ে খুবই শঙ্কিত। শুধু একটি সেক্টরের কারণে আমরা বারবার পিছিয়ে পড়ছি, অন্য সব সেক্টর ধৈর্য ধরে সহ্য করলেও একটি সেক্টর যেভাবে লাখ লাখ শ্রমিককে অমানবিকভাবে টানাহেঁচড়া করে নানাভাবে ঝুঁকি-দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দেয়, তাদের চলাচল প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়া লাখো মানুষের মধ্যে সংক্রমণের গতি ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে, তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! আমরা একদিকে রোগ কমাই, অন্যরা আবার রোগ ছড়িয়ে দিয়ে হাসপাতাল ভরে ফেলে, আর দোষ হয় আমাদের। রোগের উৎস যারা বন্ধ করতে পারে না তাদের যেন কোনও দোষই কেউ দেখে না!
শেষে একপর্যায়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেই ফেলেছেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় দায়ী নয়’।
প্রথমে যখন ‘সবচেয়ে কঠোরতম বিধিনিষেধ’ জারি করা হয়, তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, কোনোভাবেই এই বিধিনিষেধে কাউকে ন্যূনতম ছাড় দেওয়া হবে না। এমনকি গার্মেন্ট কারখানা মালিকদের উপর্যুপরি অনুরোধের পরও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সাফ জানিয়ে দিয়েছিল ৫ আগস্টের আগে কোনোভাবেই কিছুই খোলা রাখা যাবে না। ঈদের সময় মানুষ বাড়ি গিয়েছিল এ তথ্য মাথায় রেখে। অথচ ৭ দিন পার হতে না হতেই ৩০ জুলাই ঘোষণা এলো ১ আগস্ট থেকে রফতানিমুখী শিল্প (পড়ুন গার্মেন্ট কারখানা) খোলা হবে। আশ্চর্য এই যে,
১) বারবার বলার পরেও সরকার তার নিজের দুই সপ্তাহের লকডাউনের সিদ্ধান্ত ধরে রাখতে পারেনি।
২) সরকার খুব ভালো জানে সব রফতানিমুখী শিল্পকারখানার, মূলত গার্মেন্টকর্মীরা সবাই গ্রামে গেছে। গণপরিবহন না খুলে এ ধরনের ঘোষণা যে মানুষের জন্য কতটা বিপর্যয়কর হতে পারে, সেটুকু না বোঝার কোনও কারণ নেই। ৩১ জুলাই আমরা দেখতে পেলাম লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টকর্মী বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রিকশা, অটো, ট্রাক, পিকআপ, হাঁটা মিলিয়ে ভেঙে ভেঙে অবর্ণনীয় কষ্টের শিকার হয়ে ঢাকায় ফিরছে। এই বীভৎস কষ্টের ‘বোঝার’ ওপরে যুক্ত হয়েছে স্বাভাবিক ভাড়ার ৪/৫ গুণ বেশি খরচের ‘শাকের আঁটি’।
৩) এ পরিস্থিতিতে সরকার ৩১ জুলাই সন্ধ্যায় প্রথমে লঞ্চ চালুর ঘোষণা দেয়। খবর শুনে নানা লঞ্চঘাটে যখন হাজার হাজার মানুষ হাজির হন, তখন তারা জানতে পারেন এভাবে হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে লঞ্চ চালানো সম্ভব নয়। এর যুক্তি দিতে গিয়ে মালিকরা জানান, ৫ তারিখ পর্যন্ত লকডাউন থাকার সিদ্ধান্তের কারণে লঞ্চের চালক এবং অন্য কর্মচারীরা ছুটিতে চলে গেছে।
৪) তারপর আসে গণপরিবহন খোলার সিদ্ধান্ত। কিন্তু এরমধ্যে মানুষ যে যেভাবে পেরেছে ঢাকায় আসতে গিয়ে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য এবং আরও বহু মানুষের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।
৫) তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক ১ আগস্ট গার্মেন্ট কারখানা না খুললে এই সেক্টরে প্রলয় ঘটে যেত, তাই সরকার আর ৪টি দিনও অপেক্ষা করতে পারেনি। সে পরিস্থিতিতেও কারখানা খোলার ঘোষণা অন্তত ৩/৪ দিন হাতে রেখে, সব ধরনের গণপরিবহন চালু করে দেওয়া দরকার ছিল, যাতে গার্মেন্টকর্মীরা তাদের সুবিধা মতো সময়ে এসে কাজে যোগ দিতে পারে। এতে তাদের যাত্রার দুর্ভোগ যেমন এড়ানো যেত, তেমনি অনেকটা কমিয়ে আনা যেত করোনা ঝুঁকিও।
৬) এই সরকারকে সব সময়ই দেখা গেছে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে গার্মেন্ট শিল্প। তাদের আধিপত্য যেমন সংসদের বাইরে, তেমন সংসদের ভেতরেও। এই সংসদের দিকে তাকালে বোঝা যায় তারাই মূলত সরকার। সুতরাং প্রণোদনার অর্থের সবচেয়ে বড় ভাগ তাদের, ব্যাংক ঋণের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী তারা। বিদেশে টাকা পাচার, ঋণখেলাপি হওয়ার ক্ষেত্রেও সামনের সারিতেই আছেন তারা।
এই যাচ্ছেতাই পরিস্থিতির জন্য নিশ্চিতভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দায়ী নয়। এবং এ ধরনের পরিকল্পনাহীন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবেই করোনার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে এবং দিনের শেষে চাপটা যাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর। এখন প্রশ্ন হলো, গত দেড় বছর করোনার সঙ্গে বসবাসের পর করোনা চিকিৎসা এবং করোনার টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্জন কতটুকু। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, মানুষ চিকিৎসার জন্য গেলে তারা চিকিৎসা দেন, টিকার ব্যবস্থা করেন। এই বক্তব্য কতটুকু সত্য? প্রতি জেলায় সরকারি পর্যায়ে আইসিইউ তৈরি করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপর্যুপরি নির্দেশনার পর এখনও দেশের অর্ধেকের বেশি জেলায় সরকারি পর্যায়ে একটি আইসিইউ বেড নেই। এখনও ১৭টি জেলায় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা নেই, অর্থাৎ সেই জেলাগুলোতে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দিয়ে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব না। ১৭ কোটি মানুষের দেশে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আছে মাত্র দেড় হাজারের কিছু বেশি। কোভিড চিকিৎসা দেওয়ার হাসপাতালে বেড নেই পর্যাপ্ত সংখ্যার আশপাশেও। নেই পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য চিকিৎসাকর্মী। এখন এর মাশুল দিচ্ছে জনগণ।
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই যে দেশের আর সব মন্ত্রণালয়ের মতো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও অদক্ষতা, অযোগ্যতা, সর্বোপরি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ব্যর্থ, যেমন ব্যর্থ দেশের আর সব মন্ত্রী। এই কলামের আলোচনায় এটা নিশ্চয়ই স্পষ্ট যে সরকারের আরও অনেক মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা, সমন্বয়হীনতার অনিবার্য ফলই হচ্ছে করোনার সাম্প্রতিক বিপর্যয়। দিনের শেষে আক্রান্ত সবাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আসে বলেই, এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে মারা যায় বলেই আমাদের ফোকাসে থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যৌক্তিক কারণেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর এর মন্ত্রী সমালোচনার শিকার হয়। কিন্তু একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি, এটা করতে গিয়ে আমাদের যেন অন্য সব মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী আর সরকারের সার্বিক, সামষ্টিক ব্যর্থতা ভুলে না যাই।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ