আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) দেশের প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম, যা ১৯৯৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরায় ৬০ একরজুড়ে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি “কম্বাইন কোয়ালিটি উইথ মোরালিটি” স্লোগানে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবিকতা নির্ভর দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কাজ করছে। এখানে ১৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ভৌগোলিক অবস্থান, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ও সড়কপথের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে আইআইইউসিয়ানরা বিভিন্ন আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। যেমন, ২০১৮ সালের কোটা বিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা যখন সড়ক অবরোধের চেষ্টা করেছিল কিন্তু পুলিশের বাধার কারণে তখন সফল না হলেও ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একটি মাইলফলক সৃষ্টি করে। শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা এবং সড়কপথ ও রেলপথ অবরোধের কৌশলগত গুরুত্ব আন্দোলনটিকে সফল করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে ১৬ জুলাই আইআইইউসির ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। এই আন্দোলনের পিছনে কোনো পূর্ব প্রস্তুতি না থাকলেও এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা না; বরং এটি ছিল সাহসী কিছু শিক্ষার্থীর প্রচেষ্টার ফলাফল। যারা নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। ভয় ছিল, এই বুঝি কেউ এসে তুলে নিয়ে যায়। ফ্যাসিবাদের ১৫ বছরে গুম-খুন তো দুধভাতে পরিনত হয়েছিল। যাদের জন্য আইআইইউসিতে ১৬ জুলাই তাদের জানাই বিপ্লবী সালাম।
জুলাই মাসের শুরু থেকেই আইআইইউসির শিক্ষার্থীরা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলনে অংশ নেয়া শুরু করে। ১২ জুলাই থেকে ষোলশহরে তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ১৫ জুলাইও ক্লাস শেষ করে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য ষোলশহর যায়। সেদিন শিক্ষার্থীরা নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের হামলার মুখোমুখি হয়। ধাওয়া পাল্টা চলতে থাকে রাত পর্যন্ত। এতো কিছুর পরেও আইআইইউসিয়ানরা নিজ ক্যাম্পাসের ভেতরে আন্দোলন করার সাহস তখনও দেখাতে পারেনি। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি, হুমকি এবং ভীতি প্রদর্শনের ফলে শিক্ষার্থীরা মনোবল পাচ্ছিলো না। ২০১৮ সাল থেকে কোটা বিরোধী আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সাথে যুক্ত কিছু সাবেক আইআইইউসিয়ান কর্তৃক পরিচালিত ‘ক্যাম্পাস টাইমলাইন’ পেজ থেকে নিয়মিত উৎসাহ দেওয়ায়, প্রাক্তন প্রক্টরিয়াল বডির পক্ষ থেকে ৮ জুলাই রাতে বিবিএ ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী খালেদ সাইফুল্লাহকে এনএসআই এর ভয়ভীতি প্রদর্শন সহ আরো কয়েকজনকে ভয়-ভীতি দেখানোর অভিযোগ আছে।
এর মাঝেই ১৫ জুলাই রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ এক সাহসী কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়। ইএলএল ডিপার্টমেন্টের শাহেদুল ইসলাম মাহিম, ‘আইআইইউসি মিমার’ গ্রুপে একটি ঘোষণায় জানিয়ে দেন যে, তিনি এবং তার বন্ধুরা ১৬ জুলাই আইআইইউসির মাটিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে অবস্থান নেবেন। ক্যাম্পাসে অবস্থান করার এই ঘোষণা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে অনলাইন জুড়ে। দীর্ঘদিনের চেপে থাকা ক্ষোভ যেন আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে। শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে, সেমিস্টারভিত্তিক গ্রুপগুলোতে প্রচারণা শুরু হয়, টেলিগ্রামে নতুন গ্রুপ তৈরি করা হয়। ফিমেল একাডেমিক জোনের শিক্ষার্থীরাও এ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এই আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক হলো ‘আইআইইউসি মিমার’ গ্রুপের ভূমিকা। এটি একটি বিনোদনভিত্তিক কমিউনিটি হলেও আন্দোলনের সময় এটি হয়ে ওঠে যোগাযোগের একটি প্রধান মাধ্যম। যেখানে অন্য কোনো গ্রুপ সাহস দেখাতে পারেনি, সেখানে আইআইইউসি মিমার গ্রুপ সাহস করে নিজেদের উন্মুক্ত করে দেয়। পরদিন ১৬ জুলাই চট্টগ্রামে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি দুপুর সাড়ে এগারোটায় অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও দেশের সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম আইআইইউসিয়ানরাই নিজ ক্যাম্পাসে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করে কর্মসূচি ঘোষণা করায় চট্টগ্রামে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনর সমন্বয়ক আইআইইউসিয়ান সিয়াম এলাহি সহ আরো অনেকের পরামর্শে সাড়ে এগারোটার প্রোগ্রাম সাড়ে তিনটায় ঘোষণা করা হয়।
১৬ জুলাই সকালে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত স্থানগুলোতে ক্যাম্পাসগামী বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে বাস আসলেও, সেদিন কোনোধরণের নোটিশ ছাড়াই কোনো পয়েন্টে বাস ছিল না। জানা যায়, কর্তৃপক্ষ সেদিন শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে যাওয়া ঠেকাতে ক্লাস বাতিল করার পরিকল্পনা করেছিল। পরবর্তীতে, পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পর বাস পাঠায়। এই ঘটনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। যারা আগে ক্যাম্পাসে পৌঁছেছিল, তারা লাইব্রেরির সামনে জড়ো হতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রক্টরিয়াল বডি শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তারা ক্যাম্পাসের গেট বন্ধ করে দেয়, যেন শিক্ষার্থীরা বাইরে যেতে না পারে। সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে পুলিশ অবস্থান করছিল। ফলে, শহর থেকে আগত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ না করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে তারা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী সড়কটি অবরোধ করে। আন্দোলন ক্রমশ তীব্র আকার ধারণ করে। ক্যাম্পাসের ভিতরে থাকা পুলিশ বাহিনী ও প্রক্টরিয়াল টিম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এসে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ তুলে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। এ সময় মহাসড়কে থাকা শিক্ষার্থীদের একটি দল ক্যাম্পাসের ভিতরে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের গেট খুলে নিয়ে আসার জন্য রেললাইন পর্যন্ত পৌঁছালে দেখতে পায় শিক্ষার্থীরা গেট খুলে রেললাইনে অবরোধ করেছে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি ট্রেন ক্যাম্পাসের কাছে পৌঁছালে পরিস্থিতি দেখে সেটি চট্টগ্রাম স্টেশনে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাস রেললাইনে দাঁড় করিয়ে সেখানে কয়েকজন অবস্থান নিয়ে বাকিরা মহাসড়কে ফিরে যায়। উল্লেখ্য, জুলাইয়ের এই আন্দোলনে আইআইইউসির শিক্ষার্থীরা প্রথমবারের মতো মহাসড়কের পাশাপাশি রেললাইনও অবরোধ করেছিল। সকাল থেকে মহাসড়কের এক পাশ অবরোধ থাকলেও ১১টা নাগাদ শিক্ষার্থীরা পুরো মহাসড়ক অবরোধ করে। এ সময় দুইজন ম্যাজিস্ট্রেট (শিক্ষার্থীদের ধারণা এদের মধ্যকার একজন সীতাকুণ্ড উপজেলার ইউএনও ছিলেন), পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পুলিশ বাহিনী আইআইইউসির মেইন গেটের সামনে ডালাস পাম্পে অবস্থান নেয়। তাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম, সিনিয়র-জুনিয়র কর্মকর্তা ও শিক্ষকবৃন্দ যোগ দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েদের আলাদা একাডেমিক জোন থাকায় মেয়েরা তাদের একাডেমিক এলাকায় কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকে। মেয়েদের এই উচ্ছ্বাস ছেলেদেরকে আরও উৎসাহিত করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে। শিক্ষার্থীদের মুহুর্মুহু স্লোগানে আইআইইউসি ক্যাম্পাস ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রকম্পিত হতে থাকে। ঐতিহাসিক স্লোগান যেমন, ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার,’ ‘কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার,’ ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না,’ এবং ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ সহ নানা ধরণের প্রতিবাদী ধ্বনিতে চারপাশ মুখর হয়ে ওঠে। দুপুর ১২টা নাগাদ ক্যাম্পাসে পরিচিত ছাত্রলীগের কিছু কর্মীও পুলিশের পাশে জড়ো হতে শুরু করে। সাড়ে ১২টার দিকে খবর আসে, সীতাকুণ্ড থেকে ট্রাক বোঝাই দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাতে আসছে। শিক্ষার্থীরা সতর্ক হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সীতাকুণ্ড থেকে আগত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা আইআইইউসির ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মীর সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের উপর পেট্রলবোমা ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে, দেশীয় অস্ত্র (ছুরি, চাপাতি, রামদা ও হকিস্টিক) দিয়ে হামলা করে। এসময়ে পুলিশের ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের মতো। হামলায় আব্দুর রহিম, মোনতাসির সালেহীন এবং শাহেদুল ইসলাম সাকিবসহ প্রায় ডজন দুয়েক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। আহতদের মধ্যে কারো রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো, কেউ টিয়ারশেলের ধোঁয়ার কারণে শ্বাসকষ্টে ভুগছিল। আব্দুর রহিমের মাথায় ৯টি সেলাই লাগে। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হয় এবং গুরুতর আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়। সন্ত্রাসীরা ফিমেল একাডেমিক এলাকায় গিয়ে আন্দোলনরত মেয়ে শিক্ষার্থীদের উপরও হামলা চালায়। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধে সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। সন্ত্রাসীদের থেকে ৫০টিরও বেশি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে প্রক্টর অফিসে জমা দেয় শিক্ষার্থীরা। ১৬ জুলাই সীতাকুন্ডতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সমর্থনে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি বিভিন্ন প্রকার হুমকির কারনে বাতিল করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধে আইআইইউসির শিক্ষার্থীদের সাথে সীতাকুণ্ড ডিগ্রি কলেজেসহ স্থানীয় কলেজের কিছু শিক্ষার্থীরাও অংশগ্রহণ করেছিল। সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে গেলেও সীতাকুণ্ড উপজেলার কাছে অবস্থান করতে থাকে। দুপুর ২টার দিকে শহরে আন্দোলনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ক্যাম্পাস ছাড়ে। সীতাকুণ্ড, মীরসরাই ও বাড়ইয়ারহাটের শিক্ষার্থীরাও বাড়ি ফেরার জন্য বাসে ওঠে। বাসগুলো সীতাকুণ্ডের উপজেলার কাছে পৌঁছালে আগে থেকেই অবস্থান করা সন্ত্রাসীরা পিস্তল ও দেশীয় অস্ত্র দেখিয়ে বাস থামিয়ে হামলা চালায়। বাসে ইট-পাথর মারতে থাকে। সন্ত্রাসীরা বাসে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের মারধর করতে গেলে, সীতাকুণ্ড ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী আসাদ বাধা দিতে গিয়ে আহত হন। এই হামলায় আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়।
অপরদিকে শহরে যাওয়া আইআইইউসির শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম নগরীর ২ নম্বর গেট এলাকায় অবস্থান নেয়। কাছাকাছি অবস্থিত ষোলশহর রেলস্টেশনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ১৫ জুলাই বিকেলে ধাওয়া খাওয়ায়, ১৬ জুলাই দুপুর থেকেই দেশীয় অস্ত্রসহ সেখানে অবস্থান করছিল। তারা ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে ২ নম্বর গেটে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি সাড়ে ৩টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাওয়া শিক্ষার্থীরা নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের একতরফা হামলার শিকার হয়। ক্যাম্পাসে পুলিশের নীরব ভূমিকা দেখা গেলেও ২ নম্বর গেটে পুলিশ সরাসরি ছাত্রলীগের সহযোগী বাহিনীর ভূমিকা পালন করে। সন্ত্রাসীদের হামলায় শিক্ষার্থীরা মেয়র গলিতে আশ্রয় নেয়। সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানিরা যেভাবে সম্ভব শিক্ষার্থীদের সাহায্য করলেও অনেক শিক্ষার্থী হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়। হামলা চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বাসগুলো মেয়র গলির সামনে এসে পৌঁছেছিল, সেগুলোও সন্ত্রাসীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়। বেশিরভাগ বাসই বিআরটিসির ছিল। বাসের ভেতরে থাকা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা বাস থেকে নামলে তাদের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। আব্দুল আল কায়েস নামে এক শিক্ষার্থী তার তিনজন বন্ধুসহ মেয়র গলির পাশের একটি গলিতে আশ্রয় নিলে সন্ত্রাসীদের হাতে ধরা পরলে তাদের মারধর করে মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে সেখান থেকে বের করে দিলে গলির বাইরে থাকা একজন গুলি চালালে তারা অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও তারা আবারও হামলার শিকার হন। হামলায় কায়েস অজ্ঞান হয়ে গেলে সন্ত্রাসীরা তাকে মৃত্যু ভেবে ফেলে রেখে গেলে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে যায়। মারধরের ফলে তার পেটে রক্ত জমাট বেঁধে প্রস্রাব ও বমির সঙ্গে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। আরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তার নামে মিথ্যা মামলা দায়ের হওয়ায় পুলিশ তার বাসায় যায়। তবে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে থাকায় তিনি সেদিন পুলিশের হাত থেকে বেচে যান। হামলা থেকে বাচতে দৌড়ে নিরাপদ কোথাও যাবার সময় আবিদ বিন গফুর নামে এক শিক্ষার্থী রাস্তায় পড়ে গেলে সন্ত্রাসীরা তার গলায় কোপ মারার চেষ্টা করে। তিনি হাত দিয়ে প্রতিরোধ করলে তার হাত ও পায়ে একাধিক কোপ দেয়। বন্ধুদের সহায়তায় একটি বাড়ীতে আশ্রয় নিলে সন্ত্রাসীরা সেখানে হামলা করতে চাইলে দারোয়ন গেট বন্ধ করে দিলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। এভাবে সেদিন আরো অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছিলো। সেদিনের হামলায় আবিদ বিন গফুর ও আব্দুল আল কায়েস ছাড়াও বহু শিক্ষার্থী আহত হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজ এবং অনান্য কলেজ-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২ নম্বর গেট এবং মুরাদপুরে জড়ো হয়ে অবস্থান নিতে শুরু করলে আগে থেকেই ষোলশহরে অবস্থানরত ছাত্রলীগ-যুবলীগ সন্ত্রাসী এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাধে। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি চালায় এবং ককটেল বোমা ছোড়ে। এতে গুরুতর আহত হন অনেক শিক্ষার্থী। আহত শিক্ষার্থীরা পাশ্ববর্তী মেডিকেল সেন্টারগুলোতে চিকিৎসা নিতে গেলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সেখানে গিয়েও হামলা চালায়। চিকিৎসক ও মেডিকেল স্টাফরা আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দেওয়ার কারণে অকথ্য গালিগালাজের শিকার হন। গুলি ও ককটেলের আঘাতে ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী মোঃ ওমর ফারুক, চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোঃ ওয়াসিমএবং ওমর গনি এমইএস কলেজের ছাত্র ফয়সাল আহমেদ শহীদ হন। এদিনই আমরা রংপুরে সর্বপ্রথম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদ আবু সাঈদ কে হারাই। ঢাকায় সাইন্স ল্যাব মোড়ে শহীদ হন বলাকা সিনেমা হলের সামনে হকারি করা শাহজাহান ও ঢাকা কলেজের ছাত্র সবুজ আলী। ১৬ জুলাই সারাদেশে দিনভর ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ ও আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থকদের হামলায় শহীদ হন ছয়জন। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রুমে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এদিন বিকালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর ও বগুড়ায় বিজিবি মোতায়েন করে। সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং রাতে মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
১৬ জুলাই নিজ ক্যাম্পাসে, সীতাকুণ্ডতে এবং মুরাদপুর এড়িয়ায় আহত হয়েছিলেন আব্দুর রহিম, মোনতাসির সালেহীন, শাহেদুল ইসলাম সাকিব, নাহিদ হোসাইন, নুসরাত, সাইমন, ফেরদাউস, আব্দুল আল কায়েস, তাফহীম, চৌধুরী ইলহাম, আহমাদ মিল্লাত, নাজমুল ইসলাম, রুবাইয়্যাত রিয়াদ, তানভীর আহমেদ, আবিদ গফুর, আশিক নাসির, ইয়াসিন এবং মাইনুল ইসলামসহ অর্ধশতাধিক আইআইইউসিয়ান। তাদের সাহসিকতার জন্য আমরা গর্ব অনুভব করি। এই ইতিহাসকে সংরক্ষণ করা এবং সঠিকভাবে উপস্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। যাদের অসীম সাহসে এই ইতিহাস, তাদের যথাযথ সম্মান ও মূল্যায়ন না করা আমাদের বড় একটি ব্যর্থতা হবে। আইআইইউসি প্রশাসনের উচিত লাইব্রেরি ভবনে একটি ‘জুলাই বিপ্লব কর্নার’ স্থাপন করা, যেখানে জুলাই বিপ্লবের ইতিহাসের পাশাপাশি আইআইইউসির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ত্যাগ ও সাহসিকতা নিরপেক্ষতার সাথে লিপিবদ্ধ থাকবে। ১৬ জুলাই আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম’র জন্য একটি স্মরণীয় এবং বেদনাদায়ক দিন। এই দিনটি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের একটি তারিখ নয়; এটি ন্যায়ের জন্য লড়াই, সাহসিকতা এবং ঐক্যের প্রতীক। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।
আব্দুল্লাহ আল হাসান।
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।