Monday, March 17

রঙ-তুলির গল্পে স্বপ্ন দেখে অরণী

এস আলী দুর্জয়: কাজী আফিয়া আনজুম অরণী ছোটবেলা থেকেই শিল্পের প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করতেন। কাগজ-কলম পেলেই তিনি লাইন টানতে শুরু করতেন, নতুন কিছু আঁকার চেষ্টা করতেন। তাঁর এই শিল্পপ্রীতির মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর বাবা, যিনি একসময় নিজেও আঁকা-আঁকি করতেন। বাবার আঁকা পুরোনো চিত্রকর্মগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন তিনি, আর সেগুলো দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার পথে। তবে ছোটবেলায় আঁকার ক্ষেত্রে তাঁকে সরাসরি শিক্ষা দিয়েছেন তাঁর মা, যিনি নিজেও কিছুটা আঁকতে জানতেন।

কাজী আফিয়া আনজুম অরণী
কাজী আফিয়া আনজুম অরণীর ছবি

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শিল্পচর্চা আরও গভীর হতে থাকে। বিশেষ করে, অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের রনি নামে এক শিক্ষার্থীর কাছে কিছুদিন আঁকা শেখার সুযোগ পান। সেখান থেকেই তাঁর চারুকলার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। সেই সময় থেকে তাঁর স্বপ্ন ছিল চারুকলায় পড়ার, তবে বাস্তবতার কারণে শেষ পর্যন্ত রাজশাহী কলেজের সমাজকর্ম বিভাগে ভর্তি হন। তবু শিল্পের প্রতি ভালোবাসা এতটুকু কমেনি।

২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর থেকে তাঁর আঁকার প্রতি আগ্রহ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে “অরণি-Orony” নামের ফেসবুক পেজে নিজের আঁকা ছবি আপলোড করতে থাকেন, আর ধীরে ধীরে পরিচিতদের মধ্যে তাঁর কাজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শখের বসে শুরু করা এই শিল্পকর্ম একসময় বাণিজ্যিক রূপ নেয়, যখন অনেকে তাঁর আঁকা ছবি কেনার আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করেন। এরপর থেকে তিনি কেবল শখের বশে নয়, বরং পেশাগতভাবেও চিত্রশিল্পকে গ্রহণ করেন।

কাজী আফিয়া আনজুম অরণী
কাজী আফিয়া আনজুম অরণী

পেন্সিল স্কেচ, পেন স্কেচ, ওয়াটার কালার, প্যাস্টেল কালার, জলরঙ এবং এক্রেলিক রঙ—সব মাধ্যমেই কাজ করতে ভালো লাগে তাঁর। তবে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এক্রেলিক রঙে কাজ করতে। রঙের গাঢ়ত্ব, টেক্সচার এবং দ্রুত শুকানোর সুবিধার কারণে এটি তাঁর প্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এক্রেলিকের মাধ্যমে তিনি তাঁর ভাবনা ও সৃষ্টিশীলতাকে আরও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন।

কাজী আফিয়া আনজুম অরণী
কাজী আফিয়া আনজুম অরণী

শুধু অনলাইনে নয়, অফলাইনে এবং কাস্টম অর্ডারের মাধ্যমেও তিনি তাঁর শিল্পকর্ম বিক্রি করেছেন। তবে পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আঁকা ও স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের কাজে যুক্ত থাকায় সময় ম্যানেজ করা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর মতে, ছবি আঁকার জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো একটি উপযুক্ত পরিবেশ, যেখানে তিনি একান্তে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারেন। আর মন ভালো থাকলে তবেই তিনি ভালো একটি শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তুলতে পারেন।

একটি চিত্রকর্ম শেষ করতে অনেক সময় ও পরিশ্রম লাগে, যা পড়াশোনার পাশাপাশি সামলানো তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কাজের অনুরোধ পেয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত। বিশেষ করে টিনএজ দর্শকদের কাছ থেকে তিনি সবচেয়ে বেশি সাড়া পান, যা তাঁকে অনুপ্রাণিত করে আরও ভালো কিছু করতে।

কাজী আফিয়া আনজুম অরণী
কাজী আফিয়া আনজুম অরণীর আঁকা কিছু ছবি

তাঁর মতে, রাজশাহীতে চিত্রশিল্পীদের জন্য যথেষ্ট সুযোগ নেই। এখানে চিত্রশিল্পের প্রদর্শনী হয় না বললেই চলে, যার ফলে শিল্পীরা তাঁদের কাজ তুলে ধরার যথাযথ সুযোগ পান না। ফলে প্রতিভাবান অনেক শিল্পী আড়ালেই থেকে যান।

তবে এসব প্রতিকূলতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ভবিষ্যতে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যেতে চান। যদি কোনো কারণে শিক্ষকতার সুযোগ না পান, তাহলে পুরোপুরি চিত্রকর্মকেই পেশা হিসেবে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।

তরুণদের উদ্দেশ্যে তাঁর পরামর্শ—কেউ যেন সমাজ বা পরিবারের চাপে নিজের প্রতিভাকে হারিয়ে না ফেলে। অনেকেই চিত্রকলা, সংগীত, নাট্যকলা বা নৃত্যকলার প্রতি ভালোবাসা পোষণ করেন, কিন্তু পরিবারের ইচ্ছার কারণে ভিন্ন কোনো পেশায় যেতে বাধ্য হন। তিনি মনে করেন, যার যা ভালো লাগে, সেটিই করা উচিত। পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার গড়লেই মানুষ তার কাজের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করতে পারে।

কাজী আফিয়া আনজুম অরণী

শিল্পচর্চার পথে নানা বাধা থাকলেও তিনি মনে করেন, নিষ্ঠা ও পরিশ্রম থাকলে সেই পথেই সফলতা পাওয়া সম্ভব। রাজশাহীতে চিত্রশিল্পীদের জন্য সুযোগ কম হলেও তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন এখানকার শিল্পীরা তাঁদের কাজের জন্য যথাযথ স্বীকৃতি পাবেন। তাঁর এই পথচলা তরুণদের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকুক—সেটিই তাঁর আশা।#

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *