লাতিন আমেরিকার দেশগুলো এখন চীনা কোম্পানিগুলোর কাছে আকর্ষণীয় বাজার ও বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। এই দেশগুলোর আছে প্রাণবন্ত একটি ভোক্তা বাজার। আধুনিক অবকাঠামোর চাহিদাও বেড়েছে এখানকার অঞ্চলে। সেইসঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদেও ভরপুর লাতিন আমেরিকা। সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা জানালেন এসব তথ্য।
বেইজিংয়ের চায়না এন্টারপ্রাইজ কনফেডারেশনের সিনিয়র গবেষক লিউ সিনকুও বলেছেন, ব্রাজিল, কলম্বিয়া এবং পেরুসহ অনেক দেশে অর্থনৈতিক সংস্কার এবং অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনা চলমান রয়েছে। লাতিন আমেরিকায় চলমান নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে এই অঞ্চলের প্রতি চীনের আকর্ষণ সামনে আরও বাড়বে।
লিউর মতে, লাতিন আমেরিকার অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নয়ন এবং আধুনিকীকরণে অবদান রাখতে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বের একটি উর্বর ভূমি খুঁজে পেতে পারে চীনা কোম্পানিগুলো।
এই বছরের শুরুর দিকে, চীনের তৈরি ছয়টি বৈদ্যুতিক ও প্রচলিত জ্বালানির সমন্বয়ে তৈরি ট্রেন চিলির সান্তিয়াগো এবং কুরিকোর মধ্যে চলাচল শুরু করে। এগুলোই ছিল চীনের রপ্তানি করা প্রথম দ্বৈত-শক্তির ট্রেন।
চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সিআরআরসি কর্পোরেশন লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছিংতাও সিআরআরসি সিফাং রোলিং স্টক কোম্পানি লিমিটেডের তৈরি ট্রেনগুলোর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার। চিলিসহ লাতিন আমেরিকায় চলাচলকারী এ ধরনের ট্রেনের মধ্যে চীনের ট্রেনগুলোই দ্রুততম।
সিআরআরসি ছিংতাও সিফাং-এর সিনিয়র ডিজাইনার ওয়াং চিংচুন বলেন, ট্রেনগুলো ইন্টারনাল কমবাশন এবং গ্রিড-ভিত্তিক পাওয়ার সাপ্লাই সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত। ট্রেন বন্ধ না করেই এগুলোর পাওয়ার সিস্টেম বদলানো সম্ভব।
এ ধরনের প্রতিটি ট্রেন ৬৩০ জন যাত্রী বহনে সক্ষম, যা চিলির রেলওয়ের যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে।
অন্যদিকে ব্রাজিলের পানাতি ফটোভোলটাইক পাওয়ার স্টেশন চালু হয়েছে গত জুনে। বেইজিংয়ের স্টেট পাওয়ার ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনের বিনিয়োগে নির্মিত পাওয়ার স্টেশনটির সক্ষমতা বছরে ২৯২ মেগাওয়াট। সাড়ে তিন লাখ পরিবারকে পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ দিতে পারবে এটি।
পাওয়ার স্টেশনটির ব্রাজিল শাখার চেয়ারম্যান লিন কুইসিয়াং বলেছেন, স্টেশনটি জলবায়ুর পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। বছরে প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমাবে এটি।
গত মাসে বেইজিংয়ে এক সেমিনারে চীনের জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি-জেনারেল চাং শিসিন বলেন, চীন ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক যোগসূত্র রয়েছে, যা কিনা পারস্পরিক সহযোগিতার একটি দৃঢ় ভিত্তি ও অফুরন্ত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক জানিয়েছে, অক্টোবরের শেষ নাগাদ লাতিন আমেরিকার ২১টি দেশে ২৫০টিরও বেশি প্রকল্পের জন্য ১৬০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন সহায়তা প্রদান করেছে, যা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
ব্যাংকটি জানিয়েছে, প্রকল্পগুলো মূলত লাতিন আমেরিকার অবকাঠামো, জ্বালানি, খনিজ, উৎপাদন, বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগের মতো ক্ষেত্রগুলোয় চীন ও এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ব্যবহারিক সহযোগিতার সম্পর্ক ব্যাপকভাবে উন্নত করেছে।
চীনের অন্যতম তেল উৎপাদক চায়না ন্যাশনাল অফশোর অয়েল কর্পোরেশন গত আগস্টে ঘোষণা করেছিল, এটি ব্রাজিলের মেরো তেলক্ষেত্র থেকে ১ কোটি ২০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের বাণিজ্যের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছে। এর মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো কোনো চীনা কোম্পানি ব্রাজিলীয় সরকারের তেলের নিলামে জয়লাভ করে।
এই তেলক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ব্রাজিলীয় প্রতিষ্ঠান প্রি-সাল পেত্রোলিও এসএ বা পিপিএসএ ব্রাজিল সরকারের পক্ষ থেকে উৎপাদন ভাগাভাগি চুক্তির পরিচালনা এবং উৎপাদিত তেল ও গ্যাসের বাণিজ্যিকীকরণ করবে।
চীনের শুল্ক প্রশাসনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে চীনের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার বৈদেশিক বাণিজ্য মূল্য আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ৭৯ ট্রিলিয়ন ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে।
নির্মাণ যন্ত্রপাতি, যাত্রীবাহী যানবাহন, সোলার সেল, ট্রেন, নির্মাণ সামগ্রী, উৎপাদন সরঞ্জাম, ইলেকট্রনিক্স, টেক্সটাইল, গার্মেন্টস ও গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি ছিল লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে চীনের প্রধান রপ্তানি পণ্য।
অন্যদিকে, লাতিন আমেরিকা থেকে চীনে এসেছে নানা ধরনের ধাতু, অপরিশোধিত তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, শস্য, যাত্রীবাহী বিমান, ইস্পাত, রাসায়নিক, কাঠ, কফি, ফল, মাংস এবং জলজ পণ্য।
সূত্র: সিএমজি