Monday, December 23
Shadow

কিডনি রোগ ও খাবার : ডা. শহিদুল ইসলাম সেলিম

কিডনি রোগ

কিডনি রোগ ও খাবার

কিডনি রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে খাবারে তেমন বিধিনিষেধ থাকে না। তবে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (সিকেডি) বা দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগীদের কতটুকু খাবার খেতে হবে এবং পানীয় পান করতে হবে—এটা জানা খুব জরুরি। বিকল হওয়া কিডনি বা বৃক্ক তখন শরীরের বর্জ্য পদার্থগুলো অপসারণ করতে পারে না বিধায় চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শে কিডনিবান্ধব খাবারের দরকার হয়। পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি রোগ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শহিদুল ইসলাম সেলিম

 

কিডনির প্রধান কাজ রক্ত পাম্প করে দেহের বিপাকের প্রান্তদ্রব্য বা বর্জ্য পদার্থ মূত্র আকারে নির্গত করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইউরিয়া, যা প্রতিদিন ৩০ গ্রামের মতো নির্গত হয়। এর অর্ধেকটা আসে খাবার থেকে, বাকিটা আসে শরীরের বিভিন্ন টিস্যুর ধ্বংসপ্রাপ্তি থেকে। ৩০ গ্রাম ইউরিয়া নির্গমনের জন্য কমপক্ষে ৭৫০ মিলিলিটার প্রস্রাব তৈরি এবং নির্গত হতে হয়; কিন্তু একুইট নেফ্রাইটিস হলে নির্গতের পরিমাণ আস্তে আস্তে কমে যায় এবং ইউরিয়া ও অন্যান্য বর্জ্য শরীরে জমা হতে থাকে।

একুইট নেফ্রাইটিস, নেফ্রোটিক সিনড্রোম, একুইট রেনাল ফেইলিওর, ক্রনিক রেনাল ফেইলিওর—সাধারণত এই চার ধরনের কিডনির রোগ হয়। কিডনি রোগের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন খাবার যেমন—শর্করা, চর্বি, প্রোটিন বা আমিষজাতীয় খাদ্য, লবণ ও পটাসিয়াম, ক্যালরি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিডনিকে পুরোপুরি বিকল না করতে বা আরো ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে কিছু খাবার সহায়তা করতে পারে, যাকে বলে কিডনিবান্ধব খাবার। এই সময়ে প্রোটিন, ক্যালরি, ভিটামিন এবং মিনারেলের সঠিক ভারসাম্য নিশ্চিত করতে সঠিক খাদ্যতালিকা তৈরি করতে হয়।

কিডনি রোগ ও খাবার

আমিষ

কিডনি বিকল রোগীদের প্রোটিন বা আমিষজাতীয় খাবার কম খেতে হয়। বিশেষ করে প্রাণিজ প্রোটিন, সামুদ্রিক মাছ, দুগ্ধজাত খাবার যত কম গ্রহণ করা যায় ততই শ্রেয়। এনুরিয়া হলে প্রোটিন সীমাবদ্ধ করে প্রতিদিন ২০ গ্রাম করে ১০-২০ শতাংশ গ্লুকোজ বা ফ্রুকটোজ মুখে বা ইন্ট্রাগ্যাস্ট্রিক ড্রিপ বা আইডি দিতে হবে। ৫০০-৭০০ মিলিলিটার প্রস্রাব হলে শরীরের প্রতি কেজি হিসাবে প্রত্যহ ০.৫ গ্রাম আমিষ দেওয়া যেতে পারে।

২০ গ্রাম আমিষের খাদ্যতালিকা হতে পারে সকালের নাশতায় তিন-চার পিস রুটি-পাউরুটি, একটি ডিমের সাদা অংশ, পরিমাণমতো ভাজি বা ডালের পানি ইত্যাদি। এরপর সকাল ১১টার দিকে নাশতা হতে পারে দুই পিস বিস্কুট অথবা ১ কাপ মুড়ি। দুপুরের খাবার হতে পারে ১.৫-২ কাপ ভাত অথবা ২-৩টি রুটি, এক ছটাক মাছ বা মাংস, পরিমাণমতো পাতলা ডাল। মনে রাখতে হবে, আমিষের মাত্রা খুব বেশি কমানো বা সীমাবদ্ধ করা ঠিক হবে না। এতে এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। কিডনির কার্যকারিতা এবং প্রস্রাব নির্গমন স্বাভাবিক হলে তখন পর্যাপ্ত আমিষ শুরু করা যেতে পারে।

 

পানীয়

প্রাথমিক পর্যায়ের কিডনি রোগীদের তরল বা পানীয়জাতীয় খাবারে তেমন বিধিনিষেধ না থাকলেও শেষ ধাপের কিডনি বিকল রোগীদের পানীয় গ্রহণ করতে হয় হিসাব করে। বিশেষ করে যাদের শরীরে পানি আসে বা ফুলে যায়, তাদের ক্ষেত্রে দৈনিক পানির পরিমাণ মেপে দিতে হয়। তবে রোগীকে কতটুকু পানি দেওয়া যাবে, তা নির্ভর করে রোগীর শরীরে বিদ্যমান পানির অবস্থানের ওপর। যেহেতু প্রস্রাবের সঙ্গে পানি নির্গত হওয়া ছাড়াও প্রায় ১০০০ মিলিলিটার পানি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে, ঘাম ও পায়খানার সঙ্গে নির্গত হয়, সে জন্য প্রত্যহ একটা ফ্লুইড চার্ট তৈরি করতে হবে। যতটুকুু প্রস্রাব নির্গত হয়, তার সঙ্গে আরো ১০০০ মিলিলিটার রোগীকে দিতে হবে। রোগীকে দেওয়া চা, স্যুপ, দুধ, ফলের রস খাওয়ার পরিমাণ বের করে মোট ফ্লুইড থেকে বাদ দিতে হবে। আবার শরীরে বিদ্যমান পানি বেশি থাকলে প্রস্রাবের পরিমাণমতো বা সর্বমোট ১০০০ মিলিলিটার পানি রোগীকে দিতে হবে।

 

সোডিয়াম

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, স্নায়ুর রক্তনালির কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ ও শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে সোডিয়াম বা লবণ। এ জন্য খাবারে আমরা লবণ খাই। অনেক খাবারে আবার প্রাকৃতিকভাবেই খনিজ বা লবণ থাকে; কিন্তু কিডনি বিকল রোগীদের দেহে অতিরিক্ত লবণ ও পানীয় তৈরি হয় না বলে শরীর ফুলে যায়। দেখা দেয় উচ্চ রক্তচাপ, হার্টে সমস্যা, ফুসফুসে পানি আসা ইত্যাদি সমস্যা। তাই পরামর্শ হলো, খাবারে আলাদা লবণ, উচ্চ সোডিয়াম উপকরণগুলো (সলটেড বিস্কুট, সলটেড বাটার, সয়াসস, সামুদ্রিক লবণ) এড়িয়ে চলুন। বাড়িতে তৈরি খাবার খান, ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন। লবণের পরিবর্তে মসলা এবং ভেষজজাতীয় খাবার বেছে নিন। টিনজাত বা কৌটার খাবার থেকে দূরে থাকুন। কেনাকাটার সময় লেবেলটি পড়ুন এবং লো-সোডিয়ামযুক্ত খাবার নির্বাচন করুন।

 

পটাসিয়াম

মাংসপেশি গঠন ও স্নায়ুকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে পটাসিয়াম; কিন্তু কিডনি বিকল রোগীদের শরীরে পটাসিয়াম বেশি থাকলে তখন রক্ত পরিশোধন করতে পারে না। রক্তে পটাসিয়ামের আধিক্য গুরুতর হৃদরোগ সৃষ্টি করতে পারে। যাদের রক্তে পটাসিয়ামের মাত্রা একটু বেশি, যারা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সেবন করেন, তাঁদের উচ্চ পটাসিয়ামযুক্ত ফলমূল ও সবজি যেমন—কলা, কমলা, টমেটো, কিশমিশ, তরমুজ, ডাব, আলু, পালংশাক ইত্যাদি খেতে নিষেধ করা হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে কম পটাসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার যেমন—আপেল, আঙুর, স্ট্রবেরি, শসা ইত্যাদি খেতে বলা হয়।

 

ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম

হাড়কে সুস্থ ও সবল রাখতে ফসফরাস ও ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন। তবে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগীদের শরীরে ফসফরাসের মাত্রা খুব বেশি হলে তখন তারা হৃদরোগের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ক্যালসিয়ামেরও মাত্রা কমে গেলেও হার ভঙ্গুর বা পেশির অবস্থান দুর্বল হতে পারে। এ জন্য প্রতিদিন ১,০০০ মিলিগ্রামের বেশি ফসফরাস গ্রহণ করা ঠিক নয়। তাই স্বল্পমাত্রার ফসফরাসসমৃদ্ধ খাবার বা তাজা ফল, শাকসবজি এবং নিরামিষজাতীয় খাবার খেতে অভ্যাস করুন। মাংস, মুরগি, দুগ্ধজাত ইত্যাদি ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবারগুলোতে উচ্চমাত্রার ফসফরাস থাকে বলে কম খাওয়া ভালো। বর্জন করা দরকার ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্টও।

 

কিডনি রোগ ও খাবার

গ্রহণ করা যেতে পারে

চর্বি : যেহেতু ফ্যাটের বিপাকের প্রান্তদ্রব্য বা বর্জ্য কিডনির ওপর নির্ভরশীল নয়, সেহেতু এনুরিয়া থাকলেও ফ্যাট বা চর্বিজাতীয় খাবার দেওয়া যাবে।

শর্করা : একুইট নেফ্রাইটিসের সময় রোগীর দেহে শক্তি জোগানোর প্রধান উৎস কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় খাবার। তাই কিডনি রোগীদের এজাতীয় খাবার বর্জন করা উচিত নয়।

ভিটামিন : ভিটামিন ‘সি’, ‘ডি’ বা ‘বি’ কমপ্লেক্স ডেফিসিয়েন্সি বা ঘাটতি থাকলে সাপ্লিমেন্ট হিসেবে যোগ করা যেতে পারে।

 

ডায়ালিসিসের সময়

কিডনি অকেজো রোগীর যখন ডায়ালিসিস শুরু হয়, তখন খাবারে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশি পরিমাণ আমিষের প্রয়োজন হয়। তখন শুধু পানির পরিমাণ কম হবে।

 

কিডনি সংযোজনের পর

কিডনি সংযোজনের পর স্বাভাবিক পানি ও টাটকা খাবার খেতে বাধা নেই। তবে খাবার যেন বাসি, ভেজাল না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কিডনি রোগ ও খাবার

 

https://www.youtube.com/watch?v=Geg0SPadJxM

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!